You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.07 | বিশ্ব  বিবেক বাংলাদেশ কোথায় থারমাপােলির পূণ্য কাহিনী কোথায় হলদিঘাটের ধন্য বাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

বিশ্ব  বিবেক বাংলাদেশ কোথায় থারমাপােলির পূণ্য কাহিনী

কোথায় হলদিঘাটের ধন্য বাহিনী

-আজ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে সব যেন নিষ্প্রভ হইয়া যায়। এ এক বড়াে বিস্ময়কর, অলৌকিক, অসম, যে অসম্ভব সংগ্রাম। অসম্ভবকে যাহারা সম্ভব করিতেছেন তাঁহাদের অভিনন্দন।  “জয় বাংলার” বিজয় বৈজয়ন্তী যেখানে যেখানে উড়িয়াছে তাহারা একাই উড়াইয়াছেন। ওই দেশের বহু দূত ও প্রতিনিধি-যাহারা শােনা যায়, ছড়াইয়া পড়িয়াছেন দেশে দেশে তাঁহাদের উদ্দেশে বলি ঃ ফিরিয়া যান। বিশ্বের বিবেক জাগ্রত করা? জাগিবে না। নিজের মেরুদণ্ডের চারপাশে ঘুরপাক খাইতে খাইতে এই বৃদ্ধা পৃথিবী ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার নাসিকা গর্জনকে জাগরণের চিহ্ন বলিয়া ভুল করিবেন না। | জাগিলে চেহারাটা অন্যরকম হইত । দিকে দিকে ধিক্কার উঠিত। সহায়তার হাত নানাদিক হইতে আপনা-আপনি প্রসারিত হইয়া আসিত-মানবতাবােধে উদ্বুদ্ধ মিশন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাহারা এমন কি আপন আপন দেশের সরকারের মর্জির তােয়াক্কাও রাখিত না। | আর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া? সে আরও চমৎকার। গােটা বিশ্বকে সংসদীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়াছে যে ব্রিটেন, এবে বুড়াে হইয়া সে বুঝি পক্ষকাল প্রায় পােবা ও বধির-হইয়াছিল। কিংবা হয়তাে বা অপেক্ষা করিতেছিল “বাংলাদেশের মুক্তিকামী প্রাণ ট্যাংকের তলায় বা বােমার ঘায় চূর্ণ হইয়া যায় কিনা যায়। তাই বুড়াে ব্রিটেন চোখের সামনে তাহার সাধের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর পাশবিক অত্যাচারের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াও রা-টি কাড়ে নাই । ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক এতদিনে মুখ খােলার ফুরসুৎ পাইয়াছেন। কিন্তু  শুধুই তােলামি করিয়াছেন। “পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশা লাঘব করিতে ব্রিটেন তার যা করণীয় তা নাকি পালন করিতে চায় । ঈশ্বর জানেন ইংরাজের অভিধানে করণীয়” কথাটার মানে কী। ব্রহ্মচর্য পালন? ধন্যবাদ স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম, ব্রিটেনের করণীয় বিশেষ কিছু নাই, আজিকার দিনে তাহার উপর “নাই ভুবনের ভার”।

ভারত ছাড়া বাহির বিশ্বে সবচেয়ে আগে মুখ খুলিয়াছে সােভিয়েট রাশিয়া। এখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুটিগুটি তাহার পিছনে আসিয়াছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিসারেরা এতদিনে শুধু পরিস্থিতিটা দর্জির মত মাপ জোককরিতে পারিয়াছেন, জামা বানানাের সময় তাহাদের এখনও হয় নাই। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল মুক্তিফৌজের হাতে”- এই বিলম্বিত সাটিফিকেট মুক্তিফৌজের বিশেষ কাজে লাগিবে না; মুক্তিফৌজ যাহা করিয়াছে নিজের হিম্মতেই করিয়াছে। সেইদিক হইতে রুশ বয়ান বরং বেশকিছু কড়া। একটা হেতু বােধ হয় চীন- কারণ কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। ক্রেমলিনের পুরাদস্তুর আছে। এক চোখ পূর্ব বাংলার উপর রাখিয়া, আর একটাতে আড় চোখে চীনের দিকে চাহিয়াই রাশিয়া কথাগুলি উচ্চারণ করিয়াছে। চীন নিজে অবশ্য এখনও তেমন উচ্চবাচ্য করে নাই, তবে পিণ্ডির সঙ্গে পিকিং এখনও গাঁটছড়ায় বাধা। সম্ভবত চীনের চোখে পিণ্ডির জঙ্গীচক্র প্রগতিপন্থী, নহিলে এমন। অসবর্ণ আঁতাত ঘটিবে কেন? তবু সে যে এই ব্যাপারে চুপ করিয়া আছে তাহার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ- পূর্ব বাংলার জনমত একেবারে হাত ছাড়া হইয়া যাক, সে তা চায় না। ভারতকে এতখানি সদিচ্ছার জমি ছাড়িয়া দিতে পিকিং স্বভাবতই রাজি নহে। অনিবার্যভাবে আবার সেই ভারতেরই প্রশ্নটাই উঠিয়া পড়িতেছে। যে তিনটির বৃহৎ শক্তির হাতিয়ার লইয়া পিণ্ডি লড়িতেছে, তাহারা যাহাই করুক, এ দেশ কী করিবে? প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, “নীরব দর্শক হইয়া থাকিবনা”-যদি শ্রীমতী গান্ধী বলেন, যাহা করার তাহা করিতেছি- করিতেছি কিন্তু বলিব না তাহা হইলেও বলিব প্রমাণ চাই- অন্তত স্বীকৃতি। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী এম সী সি চাগলা স্বয়ং বলিয়াছেন, সাহসী ও দৃঢ়পদক্ষেপ চাই ।

স্বীকৃতির দাবি অন্যান্য স্তরে ও নানা দায়িত্বশীল মহলেও ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। রাজ্য মন্ত্রীসভাগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নূতন মন্ত্রীসভা এই দাবি কেন্দ্রকে জানাইয়া দিয়াছে সর্বপ্রথম। শ্রীচাগলার মতাে আইনগত পাণ্ডিত্য সকলের না থাকুক, কয়েকটি ঐতিহাসিক নজির অনেকের মনে পড়িতে পারে। মনে পড়িবে আলজেরিয়ার এফ-এল-এন তাহাদের সশস্ত্র সংগ্রামে টিউনেসিয়া ও মরক্কোর নিকট নিয়মিত সাহায্য পাইয়াছে। স্বাধীন আলজেরিয়া সরকার গঠিত হইয়াছিল দেশের বাহিরে কায়রােয়, আর তাহার একটি কর্মকেন্দ্র ছিল টিউনিস। এই অস্থায়ী সরকারকে সেদিন স্বীকৃতি দিয়াছিল অনেক দেশঘানা, গিনি, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডান, রাশিয়া, চীন, ইউ এ আর ইত্যাদি। টিউনিসিয়ার বর্গিরা এবং তাহার নিও-দস্তুর পার্টির আস্তানা ছিল কায়রাে। আর পূর্ববাংলার মুক্তিফৌজ তাে তাহার নিজের দেশের। জমিতে দাড়াইয়া লড়িতেছে। ফ্রান্সের দ্যগল আশ্রয় লইয়াছিলেন ইংল্যান্ডে, আর অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। লন্ডনে, ১৯৪৪ সনে। পােলান্ড, বেলজিয়াম ইত্যাদি বহু আক্রান্ত দেশই বিপন্ন মুহূর্তে “প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে তাহাদের স্বাধীনতার পতাকাটি উডীন রাখে। “বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কিন্তু প্রবাসী নন, নিজ ভূমে পরবাসী, বড়জোর এইমাত্র। প্রতিবেশী কি তাহাকে, স্বগৃহে সর্বতােভাবে সুস্থিত ও সুসিদ্ধ হওয়ার পথ সুগম করিয়া দিবে না? নৈতিক দায় তাহার । দিকে দিকে উচ্চারিত দাবি হইতে মনে হয় এদেশের জনমত প্রস্তুত হইয়াই আছে, মনঃস্থির করিতে বাকী শুধু এ দেশের সরকারের।

৭ এপ্রিল ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা