You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.31 | দিল্লির দ্বিধা কেন - সংগ্রামের নোটবুক

দিল্লির দ্বিধা কেন

আমাদেরই ঘরের দুয়ারে ঝঞ্চাবেগে যে-ঘটনা ছুটিয়া চলিয়াছে, উদ্দাম, দুর্বার, বল্গাহীন কোনও বেগবান তুরঙ্গই তাহার একমাত্র তুলনা। তাহার ক্ষুরে ক্ষুরে উৎক্ষিপ্ত ধূলি, তাহার বিস্ফারিত নাসারন্ধ্রে ফেনা। মনে হয় দিল্লি যেন এই দৃশ্যের ঠিক মানে বুঝিতে পারিতেছে না। পারিলে তাহার প্রতিক্রিয়া এত শীতল, এত নিপ, এত সাবধানী আর হিসাবী হইত না। ওই বাংলার কোটি কোটি মানুষ মিলিয়া একটি রাষ্ট্র গড়িয়াছে। একটি সরকারও। রক্তাক্ত প্রভাত সেই নবজাতকের জন্ম। কিংবা বাংলাদেশের হৃদয় হইতে স্বয়ং বাংলাদেশই যেন বাহির হইয়া আসিয়াছে। ওদিকে তুমুল অস্থিরতা, এদিকে তূরীয় স্থিরতা। দিল্লি এখনও শুধু কূটনীতির নিক্তি আর কেতাদুরস্ত কেতাব লইয়া বসিয়া আছে। কীসের অপেক্ষায়, সে জানে। গতকাল আমরা আর্ত মানবতার ত্রাণের কথা বলিয়াছি। আজ তার চেয়েও একটু অগ্রসর হইয়া বলিতে চাই, শুধু ইহাতেই কুলাইবে না। শুধু হরতাল-পারন, সংসদে শুভেচ্ছা, সদিচ্ছা ইত্যাদি রকমারি নানা ইচ্ছাকে কলাপের মতাে প্রকাশ করিলেই চলিবে না। আরও কিছু চাই। প্রতিবেশী দেশে পাইকারী হারে যদি হত্যালীলা চলে, তবে রাষ্ট্রপুঞ্জে আক্রান্ত মানুষদের হইয়া কথা বলিতে কোনও লজ্জা নাই, বরং লজ্জায় লজ্জায় কয়েকটা দিন যে কাটিয়া গেল, এইটাই লজ্জার । ইহার চেয়ে সামান্যতর ছুতায় এ দেশ দুনিয়ার হাটে ছুটিয়া গিয়েছে। এদেশের সামান্যতম হাঙ্গামা লইয়া পিন্ডি-করাচি দুনিয়ার হাটে হাঁড়ি ফাটাইয়াছে।  সময় ও স্রোত কিছুর জন্যই অপেক্ষা করে না, ভারতের জন্যও করিবে না । জগতের আর দশটা মুরুব্বী দেশ যাহাই করুক, তাহাদের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকা ভারতের সাজে না। কারণ এদেশ পাকিস্তানের কাছে নিছক এটি বিদেশ নয়, পাকিস্তানের প্রতিবেশী। তাহার চেয়েও বেশী ? ভারতের পঞ্জরাস্থি ভাঙিয়াই পাকিস্তানের সৃষ্টি। যে যাই বলুক, ঘটনা যে দিকেই মােড় লউক, পাকিস্তান বস্তুত নিজেও ভাঙিয়া অন্তত দুই টুকরা হইয়াছে। তিন, চার বা পাঁচ টুকরা হইবে কিনা, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু ইহা ঠিক যে পূর্ব পাকিস্তান বলিয়া ওই দেশের কোন অংশ আর নাই, থাকিবেও না।

“জয় বাংলা” সেনানী জয়ী হইতেছে, এই জীবনমরণের লড়াইয়ের ফল যদি অন্যরকম হইত, তবু “বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ বলা চলিত না। আজ যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটা নিছক জবরদস্তি, গায়ের জোর- যে জোরে ইংরাজেরা ভারতকে দুই-শতক পদানত করিয়া রাখিয়াছিল। জঙ্গী বুট রাখিতে পারিবে কয়দিন? দুইবৎসর, দুই মাস, না দুই দিন? জবর দখলদার ইহার চেয়ে বড় কোনও নৈতিক পরিচয় পিড়ি-করাচির জঙ্গীচক্রের নাই । যা ছিল সব তােপের মুখে বােমার ঘায়ে পুড়াইয়া পুড়াইয়া সে নিজেই ছাই করিয়া দিয়াছে। এই সন্ধিক্ষণে দ্বিধা ভারতকে মানায় না। কেননা ওখানকার ঘটনার স্পন্দন এখানকার প্রতিটি প্রাণে প্রতিস্পন্দন সৃষ্টি করিয়াছে। সে প্রত্যাশাকে বিমুখ করা দিল্লির উচিৎ হইবে না। ওপার বাংলায় নতুন অস্থায়ী সরকারের দাবি এপারের কাছে একটা এপার-উসপারের চ্যালেঞ্জ বটে। যদি কুটনীতিই বিচাৰ্য হয় তবু বলিতে হইবে, এমন সুযােগ দিল্লির কাছে আগে আসে নাই, সময় বহিয়া গেলে আর আসিবে না। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক পাল্লাও ঢাকার দিকে ভারী। কারণ “বাংলাদেশ” মেজরিটি। এক লঘিষ্ট ভাগ তাহাকে ধর্ষণ করিতে উদ্যত হইয়াছে। যাহা সত্য তাহাকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা ভবিষ্যতের  ইতিহাসে পরিহাসের বিষয় হইয়া দাড়াইবে। আজ যাহা ডি ক্যাক্টো” কাল তাহা” ডি জ্বরে” হইয়া যায়আন্তর্জাতিক ইতিহাস ইহাই বলে । পিকিংকে প্রায় সকলের আগে ভারতই স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। কই, সেদিন তাে কোনও দ্বিধা দেখা যায় নাই। আজ বাংলাদেশের নবজন্মও সমান ভাবে সত্য। ওখানকার নবজন্ম এখানকার জনমানসেও পুনর্জন্ম ঘটাইয়াছে, দিল্লি আজও বুঝি তাহার হদিশ পায় নাই? আবার যেন সেই স্বদেশী যুগের জোয়ার আসিয়াছে। এই উদ্দীপনা, এই উন্মাদনা উপপ্লব এতকাল কোথায় ছিল? আজ এ দেশে প্রাণে প্রাণে “জয় বাংলার” জয়ের কামনা। দিল্লি কি স্বদেশের সকল মানুষের সেই প্রত্যাশাকেও স্বীকারে অঙ্গীকারে সম্মানিত করিবে না? না করিলে ভুয়া বামপন্থী সিংহল আর ভুয়া সমাজতন্ত্রী বর্মার সঙ্গে তাহার তফাত রহিল কি?

৩১ মার্চ ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা