রাজ্য ও রাজনীতি আর দেরী নয়, যা করবার এখনই স্থির করতে হবে
–বরুণ সেনগুপ্ত
বাংলা সম্পর্কে পাকিস্তানের নীতি এখন পরিষ্কার। প্রথমত, তারা বাংলাদেশের ক্যানটনমেনট ও গ্যারিসন শহরগুলিকে যতদিন সম্ভব নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশের ভিতরে রাষ্ট্রসংঘের পরিদর্শক, বসিয়ে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযােগ বিশ্বের দরবারে প্রচারের চেষ্টা করবে। এবং তৃতীয়ত, যদি বাংলাদেশ সরকার পাক সেনা বিতারণের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য চায় ও যদি বাংলদেশ সরকারের সেই আবেদন অনুসারে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদশের ক্যান্টনমেনট ও গ্যারিসনগুলি থেকে। পাক সেনাদের উচ্ছেদ করতে অগ্রসর হয়, তাহলে পশ্চিম ভারতের উপর ঝটিতি আক্রমণ হানবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমী বৃহক্সাগুলি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন প্রভৃতির নীতি কি তাও এতদিনে। পরিষ্কার। প্রথমত, তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি চান না। তারা চান, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের মধ্যেই থাকুক। দ্বিতীয়ত, ভারত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্য করুক এটাও তাঁরা চাননা। তৃতীয়ত। মুক্তিসংগ্রামীদের যাতে কিছুতেই ভারত সাহায্য না করতে পারে সেই জন্য তারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের পরিদর্শক বসাতে চান। এবং চতুর্থত, তাদের এই নীতিগুলি মানাতে বাধ্য করার জন্য তারা ভারত সরকারের উপর নানা ভাবে চাপ দিতে চান। এই অবস্থায় ভারত সরকার কী করবেন সেইটাই এখন প্রধানমন্ত্রীকে স্থির করতে হবে। পাকিস্তানী এবং পশ্চিমা বৃহত্রাষ্ট্রগুলির নীতি যখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, ভারত সরকারের নীতিও তখন পরিস্কার হওয়া। উচিত। ভারত সরকার চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান এবং তারপর এক কোটি শরণার্থীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থাৎ আপােষ সমাধান যে হবে না, পাকিস্তান যে শেখ। মুজিবরকে যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনও রফা করতে যাবে না, ইয়াহিয়া চক্র।
যে স্বাধীন বাংলাদেশ কিছুতেই মানবে না— এ সব বিষয়ে এখন আর কারােও মনে কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়। এসব ব্যাপার এতদিনে নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরেছেন। এখন যতদিন যাবে ততই পাকিস্তান ও তার। বন্ধুরা বাংলাদেশের সমস্যার আন্তর্জাতিক জটিলতা বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামীদের সামনে অবশ্য একটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ খােলা নেই। বাংলাদেশকে পুরােপরি মুক্ত করার লড়াই। তাদের চালিয়ে যেতেই হবে। ইয়াহিয়া খাঁ যখন কোনও রক্ষায় রাজী নন, তিনি। যখন সৈন্যবলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পদাবনত রাখার অটল প্রতিজ্ঞা থেকে এক চুলও নড়বেন না-তখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদেরও স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করেই যেতে হবে। যদি কেউ পাক শাসকদের কাছে আত্মসমর্পন করতে চান, তবে তিনি তা করতে পারেন, কিন্তু যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন। করতে চাইবেন, যিনি পাক সৈন্যবাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চাইবেন তাঁকে জীবনের। শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তি-সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হবে। বাংলাদেশের সত্যিকারের মুক্তি-সংগ্রামীদের জন্য দুটো। পথ খােলা নেই। | বাংলাদেশ সম্পর্কিত আলােচনায় আজ আরও কয়েকটা সত্যি কথা বােধহয় খুব খােলাখুলি ভাবে। আলােচনা করা ভাল। প্রথমত, মুক্তিবাহিনী এখনও এত শক্তি সঞ্চার করেনি যে তারা লড়াইয়ের কৌশলে শিক্ষিত ও আধুনিকতম অস্ত্রে সজ্জিত একটা নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে উঠবেন। পৃথিবীর কোথাও কোনও দিন কোনও মুক্তিবাহিনী জন্মের ছ-সাত মাসের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চার করতে পারেনি, পারে না। তারজন্য কম করে ছ-সাত বছর লাগে।
দ্বিতীয়ত একটা নির্দয় দখলকারী সেনাবাহিনীর সঙ্গে গেরিলা কায়দায় লড়াই চালাতে গেলেও নিয়মিত। প্রচুর বিদেশী অস্ত্র সাহায্য চাই। বাংলাদেশের যা ভৌগােলিক অবস্থিতি তাতে একমাত্র ভারত বা ভারত। মারফৎ ছাড়া মুক্তিবাহিনী এই নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ পেতে পারে না। তৃতীয়ত, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর চাপে ব্যস্ত বলে পাক সেনারা এখন বাংলাদেশের ভিতরের বিভিন্ন । অঞ্চল থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সেইসব অঞ্চল এখন মুক্ত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পাক। সেনাবাহিনী যদি যথেষ্ট শক্তি নিয়ে আবার ওইসব অঞ্চলগুলি দখল করতে এগিয়ে যায় তাহলে আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরােধ করতে পারে। এবং চতুর্থত, পাক সেনাবাহিনী যদি ঢাকা, যশাের, কুমিল্লা। চট্টগ্রাম প্রভৃতি শহরে শক্ত ঘাঁটি করে বসে থাকতে চায় তাহলে মুক্তিবাহিনী একা তার সর্বশক্তি নিয়ােগ করেও। এক-আধ বছরের মধ্যে ওইসব ঘাঁটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে পারবে না।
এই মানে এই নয় যে, মুক্তিসেনাদের সাহসের কোনও অভাব আছে। মুক্তিসেনাদের কোনও অভাব। আছে। মুক্তিসেনাদের বীরত্বের তুলনা নেই। স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিতে যে তারা এতটুকুন কুণ্ঠিত নন। গত সাত মাসে হাজারে হাজারে বীরের মত প্রাণ দিয়ে তারা তা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আধুনিক যুদ্ধ শুধু বীরত্বের লড়াই নয়, আধুনিক যুদ্ধ প্রধানত অস্ত্র ও কৌশলের যুদ্ধ। মুক্তিসেনাদের হাতে সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ছয় ইনচি মরটার । শুধু মরটার, মেসিনগান, বা গ্রেনেড নিয়ে ট্যাংকে কামানে, বিমানে শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে পরাজিত করা যায় না। বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর হাতে রয়েছে রকেটসজ্জিত মারকিন স্যার জেট এবং স্যাফে ট্যাংক। রয়েছে পঁয়ত্রিশ মাইল পাল্লার ভারী রুশী কামান । আর রয়েছে অজস্র ছােট কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী চীনা কামান। এই বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে নেমে তাদের ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা অর্জন করতে মুক্তিবাহিনীর এখনও অনেক দেরি আছে। এই অবস্থায় ভারত সরকার কী করবেন তা প্রধানমন্ত্রীকে স্থির করতে হবে। এটা খুবই পরিষ্কার যে, এখনই বাংলাদেশ থেকে পাক সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করতে হলে মুক্তিবাহিনীর ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রত্যক্ষ ব্যাপক সাহায্য চাই। এবং সেজন্য ভারতীয় সেনা, বিমান। এবং নৌবাহিনীকে বাংলাদেশের অনেকটা ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। যশাের, কুমিল্লা, নাটোর, চট্টগ্রাম, ঢাকা। প্রভৃতি পাক ঘাঁটিতে গিয়ে আক্রমণ করতে হবে। তাছাড়া এখনই পাক সেনাবাহিনীক বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধটা যে ভাবে চলেছে সেভাবে অবশ্য ব্যাপক ভারতীয় অংশগ্রহণ ছাড়াও চলতে পারে । তাও বহুদিন ধরেই চলতে পারে তাতে আরও বাংলাদেশে ঘাটির সৃষ্টি হবে, আরও বহু বিমান ঘটির আগরতলার মত অবস্থা হবে। পাক গােলাগুলিতে প্রতিদিন বহু ভারতীয় প্রাণ হারাবেন। ইতিমধ্যে অবশ্য গােটা পশ্চিমী দুনিয়ার সংবাদ পত্রগুলি বলতে শুরু করেছেন যে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী পূর্ব বাংলায় ঢুকেছে। এটা তারা বলেই চলবেন। চোখের সামনে মুক্তিসেনা দেখলেও এখন বহু পশ্চিমী সাংবাদিক বিশ্বাস করতে চাইছেন না তারা সত্যিই বাঙালী মুক্তি সেনা।
পাক বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা চীন গায়েও কোনও কোনও পশ্চিমী সাংবাদিক ভারতীয় ছাপ খোঁজেন । এই প্রচার চলবেই। কারণ এই প্রচারের উপর ভিত্তি করেই পশ্চিমী শক্তিগুলি এখন পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চাইবেন। এবং ইতিমধ্যে পাক বাহিনী বাংলাদেশে আরও শক্তি গেড়ে বসেছে। ঘাঁটি শক্ত করার যত সময় তারা। পাবে ততই ঘাটি দখলের লড়াই কঠিন হয়ে উঠছে। ছয়মাস আগে যত সহজে যশাের ক্যানটনমেনট দখল করা গেছে, আজ যশাের দখল করতে তার অন্তত বিশগুণ শক্তি প্রয়ােগ করতে হবে এবং বহু লােককে প্রাণ দিতে হবে। এই অবস্থান প্রধানমন্ত্রী কি করবেন তা তাকেই স্থির করতে হবে। ভারতের যারা মিত্র ও পরিচিত তাঁরা। এই সময়ে ভারতের পক্ষে কতটা দাঁড়াতে রাজি, তা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বােধহয় আর কেউ জানেন না। আজকের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গের লীলা খেলার যুগে প্রত্যেকটি দেশ বিদেশের ব্যাপারে কোন বড় কিছু করতে হলে নানাদিক ভেবে এগােতে হয়। ইন্দিরা গান্ধীকেও তাই ভেবে এগােতে হবে বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে। কোন বড় পদক্ষেপ ঝুঁকি যখন বিরাট, বাংলাদেশ ব্যাপারে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন যখন পাকিস্তানের মিত্র।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা