You dont have javascript enabled! Please enable it! কঠিন সময়ের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় পদার্পণ তাৎপর্যপূর্ণ -শঙ্কর ঘােষ - সংগ্রামের নোটবুক

কঠিন সময়ের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় পদার্পণ তাৎপর্যপূর্ণ

–শঙ্কর ঘােষ

সংসদের অধিবেশনের সময় প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লিতে থাকাই রেওয়াজ। কিন্তু এবারের অধিবেশনে শ্রীমতী গান্ধীর সে রেওয়াজ মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই তিনি অর্ধেক ভারত সফর করে ফেলেছেন। আজ  যখন তিনি কলকাতায় আসছেন তখন নয়াদিল্লিতে সংসদের অধিবেশন চলবে। দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে নিত্যনূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে এবং সামগ্রিক অবস্থা যে ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে সে সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা। তার আজকের কলকাতা সফরের উদ্দেশ্যও তাই। তবে আজ ময়দানের জনসভায় তিনি কী বলবেন সে বিষয়ে কৌতূহল তুলনায় বেশী হওয়াই স্বাভাবিক। তার একটি কারণ, পশ্চিম বাংলা-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও পাকিস্তানী ফৌজের দৈনিক সংঘর্ষ। অন্য কোন রাজ্যের সাধারণ নাগরিক সীমান্ত সংঘর্ষের সঙ্গে এত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন। সীমান্তে পাকিস্তানী হানায় পশ্চিম বাংলার সাধারণ জীবন ব্যাহত হয়নি। যেমন হয়নি প্রায় আশি-লক্ষ শরণার্থীর সমাবেশে । অভ্যন্তরিক শত সমস্যা সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলা যেভাবে এই সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে তারজন্য। ইতিপূর্বেই শ্রীমতী গান্ধী এ রাজ্যের অধিবাসীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন, হয়ত এবারও জানাবেন।

এবারের সফরের গুরুত্বের তার চেয়ে বড় কারণ, বাংলাদেশ সমস্যা দ্রুত তার চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, এই ডিসেম্বর মাস ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের পক্ষেই খুব কঠিন সময় এবং তিনি বিশ্বাস করেন, এই কালমাসের পর উভয়েই সঙ্কটমুক্ত হবে। এই সঙ্কটের চরিত্র। কী ও কীভাবে তার সম্মুখীন হতে হবে- এসবের আভাস প্রধানমন্ত্রী আজ দিতে পারেন। তবে সংসদে অঘােষিত কোন নীতি তিনি কলকাতার জনসভায় ঘােষণা করবেন না ধরে নেওয়া যায়, কারণ সংসদে অধিবেশনের সময় অন্যত্র কোন নীতি ঘােষণী সংসদীয় রীতি বিরুদ্ধ। এই বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে শরণার্থী সমসার সমাধান হতে পারে, এরকম আশা। প্রধানমন্ত্রী ও ভারত সরকারের অন্য দু’একজন মুখপাত্র ইতিপূর্বে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এক বিশেষ কঠিন সময়ের অন্তে সঙ্কটমুক্তি হবে তা আগে কখনও বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংসদের বক্তৃতায় আরও বিষয় স্পষ্ট বলেছেন। ভারতের শরণার্থী ও সীমান্ত-সংঘর্ষের সমস্যা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরিক সমস্যার দুটি স্বতন্ত্র। সমাধান সম্ভব নয়। দুইয়েরই এক সমাধান। সেই সমাধান কী তাও তিনি প্রকারান্তরে জানিয়েছেন বলেছেন; বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বদেশের মুক্তি ছাড়া আর কোন সমাধানে সম্মত নন। মাত্র পক্ষকাল আগে যখন সংসদের অধিবেশন শুরু হয় তখনও শ্রীমতী গান্ধী এত স্পষ্ট ভাষায়। সঙ্কটমুক্তির দিক নির্ণয় করেননি। রাজনৈতিক সমাধানের উপরই তিনি জোর দিয়েছেন, বলেছেন শেখ। মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান সরকার যদি তার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস আলােচনা শুরু করেন তাহলে মীমাংসার সূত্রপাত হবে। 

সেই মীমাংসা যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিতেই হতে পারে তা প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেননি, যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, শ্রীজগজীবন রাম ও বহিবিষয়কমন্ত্রী, শ্রী স্বর্ণসিং মাঝে মাঝে সেরকম মন্তব্য করেছেন । শ্রীমতী গান্ধী তার সহকর্মীদের চেয়ে এবার অনেক এগিয়ে গেছেন । ইংরাজীতে তিনি লিবারেশন কথাটি ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক পরিভাষায় ইনডেপেনডেন্স’ ও ‘লিবারেশন’ সমার্থক নয়। যদি বা ফলশ্রুতির দিক থেকে দুটিকে এক বলা সম্ভব হয়, তাদের পন্থা ভিন্ন। আলােচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা’ আসতে পারে, মুক্তি নয়। মুক্তির পথ রক্তাক্ত। এই রক্তক্ষয় নিবারণের জন্য শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার দাবি। করেছেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানের শেষ চিহ্ন এই সেনাবাহিনী। তাদের প্রত্যাহার করার অর্থ বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর মতে বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তান ও তার মুরুব্বী দেশগুলির সামনে দুটি পথ আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেওয়া, অন্যথায় আরও রক্তপাতের পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করা। | বাংলাদেশ ও ভারতের সমস্যার সমাধান এক, এই উক্তির মধ্য দিয়ে শ্রীমতীগান্ধী জানিয়েছেন মুক্তি যােদ্ধারা ভারতের সহযােগীতা পাবে। সেই সহযােগীতার প্রকৃতি ও পরিমাণ কী হতে পারে তারও একটি  ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। একক লড়াইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা যদি আর এক মাসের মধ্যে বিজয়ী হন তাহলে ইতিহাসে তার তুলনা মিলবে না। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রীর মনােভাবের পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের চৈতন্য উদয় হবে এ আশা না করলেও, মুরুব্বী দেশগুলির চাপে ইয়াহিয়া খান তার নীতি পরিবর্তন করবেন এ-বিশ্বাস তার ছিল। এই চাপ সৃষ্টির জন্যই সঙ্কটকালের তাঁর সাম্প্রতিক দীর্ঘ বিদেশ সফর।

ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি ফিরেছিলেন। এই বিশ্বাস আর বজায় রাখা সম্ভব নয় বলেই তার মনােভাবের পরিবর্তন। ভারত ও পাকিস্তানের বিরােধে আমেরিকার নেতৃত্বে প্রায় সব পশ্চিমী রাষ্ট্র, এমন কি রাষ্ট্রপুঞ্জও বরাবর। ভারতের বিরােধিতা করে এসেছে। পশ্চিমের দরবারে ভারত কোনদিন ন্যায় বিচার আশা করতে পারে না । কিন্তু এই উপমহাদেশের বর্তমান অশান্তির প্রত্যক্ষ কারণ ভারত-পাকিস্তান বিরােধ নয়, কারণ পাকিস্তানের অন্তর্ধন্দু। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী আশা করেছিলেন, এবার আমেরিকা ও তার দোসর দেশগুলির ন্যায়বিচার করবেন, বাংলাদেশের নিরপরাধ জনসাধারণের দুর্দশা নিরসনের জন্য তাঁদের হাতের পুতুল ইয়াহিয়া খানকে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেবেন। তাঁরা তা করেন নি। তাঁরা আটমাস মৌব্রত পালন করেছেন। কারণ ভারতকে দোষী সাব্যস্ত করার কোন অছিলা তারা খুঁজে পান নি। ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে, ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশের দ্বারা এদেশের সার্বভৌম লঙ্ঘন করে ইয়াহিয়া খান এখন সেই সুযােগ করে দিয়েছেন।

দেশরক্ষার জন্য ভারত সীমান্তে সামরিক প্রতিসমাবেশকে উপলক্ষ করে তারা ভারতের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছেন; যেন উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশে। ভারত তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করাতেও তাদের আপত্তি।  এই অসমদর্শিতা প্রকট হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদে ইঙ্গ-মার্কিন প্ররােচনায় বেলজিয়াম যে প্রস্তাব পেশ করেছে তার মাধ্যমে। তার পরেও শ্রীমতী গান্ধী হয়ত আশা করেছিলেন পশ্চিমী মত পরিবর্তিত হতে পারে। সে-আশা প্রেসিডেন্ট নিকসনের চিঠিতে দূর হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা সরকার ভারতে সবরকম সামরিক রপ্তানী বন্ধ করেছেন। অস্ত্র সরবরাহ ১৯৬৫ সাল থেকেই বন্ধ আছে, এখন মেরামতির জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি পাঠানােও বন্ধ হল । ফলে অতীতে আমেরিকা অস্ত্র সাহায্য করেছিল তাও ভারতের কোন কাজে লাগবে না। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দিতে শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডকে বৃহৎশক্তি হিসাবে ভারত গণ্য করে না। সম্ভবত সেই কারণে তার সুর আরও চড়া। ইংল্যান্ড ভারতকে আক্রমণকারী ঘােষণার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। পাকিস্তানের পুরনাে দোস্ত চীন বরাবরই তাই করে আসছে; এবার রাষ্ট্রপুঞ্জের একজন সদস্য হিসাবের নিশ্চয়ই চীন তার পুনরাবৃত্তি করবে। একমাত্র সােভিয়েত ইউনিয়নই সমস্ত সমস্যাটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এখনও বিচার। করে সােভিয়েট ‘ভিটো’তে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব গ্রহণ বন্ধ হতে পারে, কিন্তু বিষােপার বন্ধ হবেনা। তাই নিরপত্তা পরিষদে অচল অবস্থায় বাংলাদশে ইয়াহিয়া খানকে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার সাহায্য দেওয়া। ইয়াহিয়া খান সে তার মুরুব্বীরা তার ইচ্ছা পালনে উদ্যোগী হয়েছেন, তিনি। তার হাতের পুতুল সূতাের পালটা টানে তাঁদেরই তিনি নাচাচ্ছেন। | প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জাতীয় স্বার্থে যা কিছু প্রয়ােজন সবই ভারত করবে। বর্তমান অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে। কী করা দরকার তার আভাস তিনি দিয়েছেন। তার জন্য ভারতকে আক্রমণকারী ঘোষণা করা হয় তাও যেমন তিনি অগ্রাহ্য করবেন তেমনি ইয়াহিয়া খানের অঙ্গুলী নির্দেশে নিরাপত্তা পরিষদ যদি কোন প্রস্তাব পাশ করে তাও তিনি মানবেন না। তারপরেও যদি পশ্চিমী গােষ্ঠীর মত পরিবর্তন না হয় তাহলে বাংলাদেশের মুক্তির লড়াইএ, ভারতের শরনার্থী সমস্যার চেষ্টা হয়ত একই পথ নেবে। সে পথের প্রথম পদক্ষেপ হবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেওয়া।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা