রাজ্য ও রাজনীতি পুর্ব খণ্ডে পাকিস্তানের মতলব কী
–বরুণ সেনগুপ্ত
এবার চুড়ান্ত লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সব দিক থেকে আক্রমণ করছেন। স্থল ও জলপথে পাক সেনাবাহিনীকে ঘিরে ধরার জন্য মুক্তি সেনারা এগিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানী বিমানবাহিনী যদি পূর্ব বাংলায় বেশি সক্রিয় হয় তাহলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্বাধীন বাংলার বিমান বাহিনীও প্রতি আক্রমণ। চালাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এটা চূড়ান্ত পর্যায় । ২৫ মারচ রাত্রে অতর্কিতে গােটা বাংলাদেশের উপর ঝাপিয়ে পড়ে পাক সামরিক নায়করা যে লড়াই শুরু করেছিলেন এবার তার চুড়ান্ত পর্যায় এসে গিয়েছে। এবার প্রায় গােটা বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে মুক্তি সেনারা। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই চুড়ান্ত লড়াইটা আচমকা কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তারা হয়ত মনে মনে আশা করেছিল যে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা তেমন শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে না, তারা নানা বন্ধু মারফৎ, ভারতের উপর চাপ এনেছিল যাতে ভারত তেমন ভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য না করে, তারা হয়ত ভেবেছিল প্রতিপক্ষ তাদের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামবে না।
কিন্তু এইসব ভাবনা চিন্তা এবং চেষ্টা তদবির সত্ত্বেও পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বড় আক্রমণে আত্মরক্ষার পরিকল্পনা করতে ভােলেনি। চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য তারা একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল। সেই পরিকল্পনার মত সব ব্যবস্থাও হচ্ছিল। ৩০ মাইল পাল্লার কামানও এনেছে। এখন তারা পূর্ব পরিকল্পনা মতই লড়াইটা পরিচালনা করছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে পাক সেনবাহিনীর লড়াই দেখে সবাই বুঝতে পারছেন এটা পূর্ব পরিকল্পিত আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। এই পূর্বপরিকল্পিত আত্মরক্ষার ব্যবস্থাটা কী? আপাতত দেখা যাচ্ছে পূর্ববাংলায় পাকিস্তনীরা চার পাঁচটি শক্ত ঘাটি তৈরি করে সেখানে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে চাইছে। এই ঘাঁটিগুলি তৈরি হচ্ছে ক্যানটনমেন্ট শহরকে কেন্দ্র করে। পুর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রায় সাড়ে চার ডিভিশন বা প্রায় আশি হাজার নিয়মিত সেনা এই সেনাবহিনীকে পাক সামরিক নেতারা আস্তে আস্তে ওই ঘাঁটিগুলিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় ও শক্ত ঘাটি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে ঢাকা শহর ও ক্রমিটোলা ক্যানটনমেন্টকে কেন্দ্র করে। সেখান প্রায় দু ডিভিশন সৈন্য নিয়ে পাক সেনাবাহিনী তার শেষ দুর্গ তৈরি করছে। পাক কর্তৃপক্ষ পূর্ববাংলা থেকে সম্পূর্ণ পলায়নের আগে পর্যন্ত ঢাকাকে দখলে রাখতে চায়। | দুটো উদ্দেশ্যে পাকিস্তান এই কাজ করে থাকতে পারে। (এক) তারা পূর্ববাংলার যথাসম্ভব ভিতরে মুক্তি বাহিনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে তারপর নিজ ঘাঁটির সামনে সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করার জন্য এই ব্যবস্থা করে থাকতে পারে। এবং (দুই) তার অন্য কোন বৃহৎ পরিকল্পনামত কাজ শুরু করার আগে সময় পাওয়ার জন্য এই আত্মরক্ষার শক্ত ব্যুহ রচনা করে থাকতে পারে।
মারচের পাক সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় পুরােপুরি না হলেও অনেকটা এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। যখন দেখল নানাদিক থেকে আক্রান্ত তখন ২৭ মারচই গােটা পুর্ববাংলার নব রণক্ষেত্র ছেড়ে পাক সেনাবাহিনী-ক্যানটনমেনট এবং গ্যারিসনগুলিতে ঢুকে গেল। তারপর প্রায় দুদিন ধরে তারা অপেক্ষা করল। সেখানে। গােটা পূর্ববাংলা তখন কার্যত স্বাধীন। কিন্তু তখন মুক্তিবাহিনী কোনও সুসংগঠিত সেনাদল নয়, লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও তাদের নেই সর্বোপরি হাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। মুক্তিবাহিনী বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে কিছু করতে পারলেন না। খুব দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্য এল। চট্টগ্রাম ঢাকা এবং চালনা দিয়ে সেই নবাগত পাক-সেনাবাহিনী এগিয়ে গিয়ে ক্যানটনমেনট ও গ্যারিসনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিল। এবং আস্তে আস্তে আবার প্রায় গােটা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল। এবার অবশ্য তেমন সুযােগ পাক সামরিক বাহিনীর নেই। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা এখন একটা বিরাট ও সুসংহত সেনাবাহিনী। তাদের হাতে এখন যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। আর, পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষেও এখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ববাংলায় সৈন্য সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সুতরাং এবার পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে আগের বারের কৌশল অবলম্বন করা সম্ভব নয়। আপাত দৃষ্টিতে এও মনে হতে পারে যে পাকিস্তানী সমরনায়করা পূর্ববাংলা থেকে “সাফল্যজনক পলায়নের জন্যই এই কৌশল অবলম্বন করছে। চার পাঁচটা ঘাঁটিতে তারা সমবেত হচ্ছে। সেইখান যতদিন সম্ভব আত্মরক্ষা করবে। এবং সেইসব ঘাঁটি থেকে নিজেদের যত বেশি সম্ভব লােকজন ও জিনিসপত্র বিমানপথে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। পূর্ববাংলা ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রধানত বিমানপথে অন্তত দু তিন লক্ষ লােককে তাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। | কিন্তু পাকিস্তানী সমরনায়করা কি এত সহজে পূর্ববাংলা ছেড়ে চলে যাবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না । তা যদি তারা চাইত তা হলে তাে লড়াই ছাড়াই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রফা করতে পারত। শুধু পূর্ববাংলায় বাংলাদেশের লড়াই যে তারা কিছুতেই জিততে পারবে না এটা না বােঝার মত বােকা পাকিস্তানী সমর নায়করা নয় ।
পুর্ববাংলাকে নিজেদের তাঁকে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত তারা চেষ্টা করবেই । এবং এই জন্য পাকিস্তানের নিশ্চয়ই কোনও বড় পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনার ভিত্তি খুব সম্ভব ভারত আক্রমণ। পাকিস্তানের সমরনায়ক জানে, এখনও যা পরিস্থিতি তাতে শুধু ভারতীয় হস্তক্ষেপের বা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ববঙ্গ অভিযানের অভিযােগ তুলে আন্তর্জাতিক “মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করা যাবে না। তাই পাকিস্তান এখনও পর্যন্ত পূর্ববাংলার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেনি । সম্ভবত, ভারতের সঙ্গে পুরােদমে লড়াই লাগিয়ে দিয়ে তারপর তারা সেই পথে যাবে। এবং ওইভাবে পূর্ববাংলায় ও যথাসম্ভব কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করবে। | হতে পারে সেই জন্য পাকিস্তানের এখনও দুচারদিন সময় চাই। ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে হবে পাকিস্তানকে তা করতে হবে পশ্চিমে । পূর্বে ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে অর্থহীন। অবশ্য, যদি দ্রুত বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা না করা যায়, তাহলে ভারতের সঙ্গে কোথাও যুদ্ধে যাওয়াই পাকিস্তানের মুর্খামি। কারণ, ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই পাকিস্তান চাইবে ঝটিতি আক্রমণ এবং দ্রুত ফললাভ। আর তার পরই বিদেশি হস্তক্ষেপ। পাকিস্তানের পক্ষে এবার স্থলপথে পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করেও দ্রুত ফললাভ সম্ভব নয়। কারণ, এবার পশ্চিম সীমান্তে ও ভারতীয় বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পাকিস্তান তাই একমাত্র আকস্মিক ব্যাপক বিমান আক্রমণের মাধ্যমে এই দ্রুত ফললাভের চেষ্টা করতে পারে। এই আক্রমণ যদি তারা করে তাহলে দুদিকেই করবে- পূর্বেও, পশ্চিমেও। সেই সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকিয়ে দেওয়া কয়েক হাজার পাক চরও নাশকতার কাজে সক্রিয় হয়ে উঠবে। | যেভাবেই করুক, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলাকে দখল রাখার চেষ্টা করবেই এবং সেই জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া ছাড়া তার পথ নেই। পাকিস্তানের কর্তারা কিন্তু এখনও এই বিরাট আত্মঘাতী সংঘর্ষকে এড়াবার ব্যবস্থা করতে পারেন। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও অন্যান্যদের পরদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। এখনও অসম্ভব নয়। কিন্তু পাকিস্তানীরা তাতে রাজি নয়। তাই তারা গােটা জিনিসটাকে টেনে ভারত-পাক সংঘর্ষে নিয়ে যাবেই। এবং সেজন্য তারা চাইবে প্রধানত আকস্মিক বিমান আক্রমণের পথ ধরতে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যেমন আমাদের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি পাকিস্তানের এই ভারত আক্রমণের ব্যাপারেও আমাদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। নানা বিচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও আমাদের আত্মরক্ষার সংগ্রাম। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে সেটা তাে সােজাসুজি আমাদের লড়াই হয়ে দাড়াবে। এই লড়াই যেমন সামরিক বাহিনীর, এই লড়াই তেমনি জনসাধারণেরও। এই লড়াই যে সামরিক এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা দুই-ই অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। দুইয়ের বিরাট ভূমিকা। একে অপরকে পরিপূৰক হিসাবে কাজ না করলে সাফল্য আসতে পারে না। এই অসামরিক প্রতিরক্ষাটা গড়ে তােলার প্রধান দায়িত্ব অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার। অসামরিক প্রতিরক্ষা মানে শুধু সাইরেন বাজানাে বা ট্রেঞ্চ খনন নয়। অসামরিক প্রতিরক্ষা মানে আসলে গােটা প্রশাসনকে জরুরী অবস্থার জন্য তৈরী রাখা। এই কাজ গােটা ভারতে কেমন হয়েছে আমি জানি না। এই কাজ পশ্চিমবঙ্গেও বা কতটা এগিয়েছে সে সম্পর্কে এই সন্ধিক্ষণে কোনও ব্যাপক প্রকাশ আলােচনা অনুচিত। আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, এই রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর তলার কর্তারা জাতির এই সঙ্কটজনক মুহূর্তেও যে চরম অপদার্থতা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং স্বার্থপরতার পরিচয় দিচ্ছেন তার তুলনা নেই। ভবিষ্যতে কখনও এই জঘন্যতম অধ্যায় তুলে ধরার সুযােগ পাব বলে আশা করি।
২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা