বিশ্লেষণ, বিচার, সমীক্ষা ইয়াহিয়া আর এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন
— শংকর ঘােষ
জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে নাস্তানাবুদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াখন শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করলেন। বনিয়াদী গণতন্ত্র, বেসামরিক সরকারের তকমাধারী জঙ্গী শাসন ইত্যাদি অনেক রকম ভাঁওতার আড়ালে যে-দেশে প্রায় পনেরাে বছর একের পর এক সমরনায়কের পদানত, সে দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা অর্থহীন। সামরিক শাসনই জরুরী অবস্থার নির্দেশক, পাকিস্তানের জরুরী অবস্থা চিরন্তন। বাংলাদেশে আট মাস ধরে যে তাণ্ডব চলেছে তাও এই, জরুরী অবস্থাকালীন সামরিক আইনসিদ্ধ। এমন কোন ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই যা জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেছেন কেবল এই অপপ্রচারের জন্য যে ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে উদ্যত। ইতিপূর্বেই তিনি গেয়ে রেখেছেন সীমান্তে অঘােষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এর পরের পর্ব ঘােষিত-যুদ্ধ। ভারতকে আক্রমণােদ্যত ঘােষণা করে ইয়াহিয়া খান ভারত আক্রমণের অছিলা সৃষ্টি করেছেন। প্রায় এক কোটি নিঃস্ব লােককে এদেশে পাঠিয়ে ও হাজার খানেক সীমান্ত সংঘর্ষের সৃষ্টি করে আট মাস তিনি ভারতের উপর যে প্রচ্ছন্ন আক্রমণ চালিয়েছেন এবার তা প্রত্যক্ষ আক্রমণে উত্তীর্ণ হবে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে যে-বিবৃতি দিয়েছেন তাতেই স্পষ্ট, ভারতের পাকিস্তানকে আক্রমণের কোন অভিপ্রায় নেই। শ্রীমতী গান্ধী এদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করতে সম্মত নন এবং পাকিস্তান যদি আক্রমণাত্মক কাজকর্ম চালিয়ে না যায় তাহলে জরুরী অবস্থা ঘােষিত হবে না। এমন কি, বয়রা সীমান্তে আকাশ যুদ্ধকেও প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সংঘর্ষ বলে অভিহিত করেছেন।
এসব সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান মিথ্যার বেসাত ফিরি করছেন এই আশায় যে, দু একজন আন্তর্জাতিক ক্রেতা জুটে যেতে পারে। তারা কেউ যদি নিরাপত্তা পরিষদে বা রাষ্ট্রপুঞ্জে বিষয়টি তােলেন তাহলে তথাকথিত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি এই উপমহাদেশে শান্তিরক্ষায় তৎপর হতে পারেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের আটমাসের নিরেট ঔদাসীন্য কুম্ভকর্ণের দ্রিাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কাজেই পাকিস্তানের আশা, এখন যদি তাদের নিদ্রাভঙ্গ হয় তাহলে সমস্যার সমাধানের জন্য তারা মার্চ মাসের পুরনাে ইতিহাস ঘাটিতে যাবেন না, তাদের তদন্ত শুরু হবে ইয়াহিয়া খান যেদিন অভিযােগ দায়ের কররেন সেদিন থেকে। তাতে বাংলাদেশ সমস্যার থাকলেও যুদ্ধ রােধের উপায় সম্পর্কে আমেরিকা সােভিয়েত ইউনিয়নের ঐকমত্য অসম্ভব নয়। এমনকি ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদগার সত্ত্বেও চীন সে উপায়ের প্রত্যক্ষ বিরােধিতা না করতে পারে। তবে ইয়াহিয়া যদি যুদ্ধ ছাড়া ক্ষান্ত না হন তাহলে রাষ্ট্রপুঞ্জ যুদ্ধবিরতির জন্য উদ্যোগী হতেই হবে। এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ তখন যে ব্যবস্থা নেবেন তাতে ভারত পাকিস্তানের সমীকরণ অনিবার্য। সে অবস্থায় মূল সমস্যাটি উপেক্ষিত না হয় তার জন্য ভারত সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপুঞ্জের সুপরিশ অগ্রাহ্য করার নজির পঁচিশ বছরে জমা হয়েছে।
২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা