ইয়াহু —
ইন্দ্রজিৎ
দিল্লিস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের উচ্চপদস্থ যে কর্মচারিটি দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছেন সংবাদপত্রে প্রচারিত একটি বিবৃতিতে তিনি পাকিস্তানের শাসনকর্তা ইয়াহিয়াখানের একটি নতুন নামকরণ করেছেন। ইয়াহিয়া খানকে তিনি বেহায়া খান আখ্যা দিয়াছেন। বেহায়া কথাটি পূর্ববঙ্গে বহুল প্রচলিত। অতিশয় স্কুল প্রকৃতির নির্লজ্জ মানুষকে চলতি ভাষায় বেহায়া বলা হয়- চামড়া অত্যন্ত পুরু, মান অপমান বােধ নাই। লজ্জার ব্যাপারে লজ্জা পায়না, ঘৃণার ব্যাপারে ঘৃণা বােধ করে না। পূর্ববঙ্গের বন্ধুটি খাটি দিশী মতে নামটা ঠিকই দিয়েছেন। তবে বিদেশী মতেও একটি খুব মানানসই নাম বহুকাল যাবৎ প্রচলিত আছে। আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজ সাহিত্যিক জোনাথন সুইফট ইয়াহিয়া সদৃশ জীবদের একটি নাম দিয়ে গিয়েছেন। সে নামটি হল ইয়াহু- পশুসদৃশ এক জীব-আকৃতিতে মানব সদৃশ, প্রকৃতিতে পশুবৎ। সুইফট রচিত গালিভারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত মারফৎ ঐ নামটি এখন সারা পৃথিবীতে পরিচিত। গালিভার তার ভ্রমণকালে নানা দেশে গিয়েছেন, নানা জাতের মানুষ এবং জীবজন্তু দেখেছেন। এর মধ্যে আকারে মনুষ্যসদৃশ হলেও ইয়াহু হল নিকৃষ্টতম জীব। সুইফট-এর দেওয়া নামটি এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে ইংরেজি ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে এটি এখন স্থায়ী আসন লাভ করেছে। অক্সফোর্ড ডিক্সনারি মতে এখন ইয়াহু অর্থ a bestial person, কৌতুকের বিষয় যে উচ্চারণে এবং আচরণে ইয়াহু এবং ইয়াহিয়া এই দুই এর মধ্যে আশ্চর্য মিল। সুইফট জগপ্রসিদ্ধ স্যাটারিয়ারিস্ট। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে তিনি যে সব দুর্নীতি দেখেছেন মানুষের নষ্টামি, ভণ্ডামি, নীচতা, ক্ষুদ্রতা, হিংস্রতা তার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত মনুষ্য সমাজের উপরেই তিনি আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি তাদের মনুষ্যপদবাচ্য বলেই মনে করেন নি, দ্বিপদ জন্তু হিসাবে দেখেছেন এবং তাহাদের নাম দিয়েছিলেন ইয়াহু।
সেদিন তিনি কল্পনার চোখে মানুষের যে বিকৃত রূপ দেখেছিলেন এবং বহুকাল যাবৎ পাঠকেরা যাকে অহেতুক মানব-বিদ্বেষপ্রসূত অতিশয়ােক্তি বলেই মনে করে আসছিলেন, এতদিনে সেই জন্তু-মানব নানা দেশে নানা সমাজে বাস্তব রূপ ধারণ করেছে। বলা বাহুল্য জাগ্রত সমাজে এসব জীব বেশি দিন টিকতে পারে না, সমাজের শুভবুদ্ধি তাদের নির্মূল করে দেয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় পাকিস্তানের সমাজ জন্মাবধি অচৈতন্য নতুবা ইয়াহিয়া বা ইয়াহু খানের ন্যায় কোন ব্যক্তি দেশের সর্বময় কর্তা। হয়ে বসতে পারতেন না। পাকিস্তান নামে মাত্র স্বাধীনতা লাভ করেছে আজ চব্বিশ বছর, তারমধ্যে বলতে গেলে চৌদ্দ বছর কেটেছে জঙ্গীশাসনের অধীনে। জনগণের পক্ষে চৌদ্দ বছরের অজ্ঞাতবাস বলতে হবে। কেন না দেশের শাসন ব্যবস্থায় দেশবাসীর কোন হাত নাই, কথা বলবার অধিকার নাই। মুষ্টিমেয় একটি জঙ্গী গােষ্ঠী দেশের কোটি কোটি মানুষের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। তাদের মানুষ বলে গণ্য করেনি, তারাও নিজেদের মানুষ বলে ভারতে শেখেনি। ফলে পাকিস্তান একটি ইয়াহুস্তানে পরিণত হয়েছে। সুখের বিষয় পূর্ববঙ্গের জনগণ চব্বিশ বছরও পাকিস্তানী বনে যায়নি। বাঙালী বলেই স্বাধীনতা স্পৃহা তাদের মজ্জাগত । ইসলামাবাদের দোহাই দিয়ে সাময়িক ভাবে তাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছিল ঃ আজ তাদের ভ্ৰমান্ত হয়েছে। তারা আজ ইয়াহুতন্ত্রের বিলােপ সাধনে বদ্ধপরিকর। বীরদর্পে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে ইয়াহু নন, তাঁরা মানুষ অর্থাৎ পাকিস্তানী নন, বাঙালী।
১ নভেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা