রাজধানী রাজনীতি পাকিস্তানে আবার রণহুঙ্কার
–খগেন দে সরকার
ভারতের আকাশে আবার যুদ্ধের কালাে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মুখ্যত আমেরিকার সাহায্যে পাকিস্তান যে সামরিক শক্তি গড়ে তুলেছে তারই গরমে সে আবার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে শুরু করেছে। কিন্তু যুদ্ধের দ্বারা নিজের বিপর্যয় ডেকে আনা ছাড়া পাকিস্তান যে তার কোন সমস্যার সুরাহা করতে পারবে নাসে কথাটা সে নিজেও বােধ হয় ভালাে করেই জানে। যুদ্ধ যদি বাধেই তা কবে কোথায় বাধবে তা সেটা পাকিস্তানের উপরেই নির্ভর করছে। যুদ্ধের উদ্যোগ সেই শুরু করেছে। ভারত অবশ্য আত্মরক্ষার্থ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানী হুঙ্কারের জবাব দিতে সে দুই খণ্ডেই প্রস্তুত। যুদ্ধের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন দেশই এটা করতে বাধ্য হত। ভারতের নীতির যারা নিয়ামক তারা এ ধরনের ব্যবস্থা না নিলে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহির পথ খুঁজে পেতেন পাকিস্তানের মতলব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, তবে যুক্তিসম্মত কিছু অনুমান নিশ্চয় করা চলে। পাকিস্তানের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশে পাকিস্তান যা করেছে তাতে কয়েকটি আরব দেশ ছাড়া অন্য কারাে কাছে তার মুখ বাঁচানাে সম্ভব হয়নি। যে উপনিবেশটি শােষণ করে সে এতকাল দিব্যি কাঁচা মাল এবং বিদেশী মুদ্রা ঘরে আনছিল, যার কাছে সে। নিজের জিনিস চড়া দরে বেচতে পারছিল, সেই উপনিবেশটি তার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহের কিছু নেই । ভারতের প্রতিরক্ষা মহলের বিশ্বাস ঃ পাকিস্তান যে মুহূর্তে বুঝতে পাবে বাংলাদেশ তার হাত থেকে চিরদিনের মত বেরিয়ে যাচ্ছে সেই মুহুর্তেই সে ভারত আক্রমণ করে বসতে পারে। তাতে তার কয়েকটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। এবং ভারতের কোন এলাকা সে দখল করতে পারলে তা নিয়ে দর কষাকষির। সুযােগ তৈরি করে নিতে পারে। এসব অনুমান একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। পাকিস্তান ১৯৬৬ সাল থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। জেনারেল আয়ুব এবং জেনারেল ইয়াহিয়া পাকিস্তানের দুই স্বৈর প্রভুই তাতে পুর্ণ মদৎ জুগিয়ে এসেছে। ১৯৬৫ সালে ভারত আক্রমণের আগে পাকিস্তান ১০ বছর ধরে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিল। সেবার ভারতের হাতে বেদম মার খেয়েও সে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান পশ্চিম রণাঙ্গনে সাতটি পদাতিক বাহিনী নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। বর্তমানে ওই রণাঙ্গনে পাকিস্তানের হাতে রয়েছে ১০টি পদাতিক বাহিনী, দুটি বর্মাচ্ছাদিত ডিভিশন এবং বর্মাচ্ছাদিত ব্রিগেড। সেবার পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান মাত্র এক ডিভিশন পদাতিক সৈন্য ও এক স্কোয়াড্রন বিমান বহর মােতায়েন করেছিল, এবার পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের হাতে রয়েছে চার ডিভিশন পদাতিক, একটি বর্মাচ্ছাদিত ডিভিশন এবং দুই স্কোয়াড্রন বিমান বহর। পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান এবার কাশ্মীর থেকে গুজরাট সীমান্ত বরাবর প্রায় দশ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করেছে। শিয়াল কোট সেক্টরে তিন কিংবা চার ডিভিশন পদাতিক এবং একটি বর্মাচ্ছাদিত বাহিনী, লাহাের সেক্টরে একটি কর্মাচ্ছাদিত বাহিনী, মুলতান থেকে ভাওয়ালপুর পর্যন্ত সীমান্ত বরাবর তিনটি পদাতিক ও একটি বর্মাচ্ছাদিত বাহিনী পাকিস্তান মােতায়েন করেছে বলে মনে হচ্ছে। | সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াবার জন্য পাকিস্তানে ১৮ বছর থেকে ২১ বছর বয়স্ক যুবকদের সেনাবাহিনীতে যােগদান আবশ্যিক করেছে, সেনাবাহিনীর লােকদের সব রকম ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর ৮ থেকে ১০ মাইল পর্যন্ত এলাকা থেকে পাকিস্তান নাগরিকদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে সেখানে তার দশটি পদাতিক বাহিনীর শতকরা প্রায় ৮০ভাগ সৈন্যকে মােতায়েন করেছে। সীমান্তে এই যুদ্ধ প্রস্তুতির পাশাপাশি সারাদেশ জুড়ে চলেছে,- “ভারতকে ঘৃণা কর,’; “ভারতকে গুঁড়িয়ে দাও’- ইত্যদি শ্লোগানের অভিযান। | এই প্রেক্ষাপটে ভারত সীমান্ত থেকে তার সৈন্য সরিয়ে আনবে না বলে প্রধানমন্ত্রী যে দৃপ্ত ঘােষণা করেছেন তা যে যােগ্য নেতৃত্বের পরিচয় বহন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। প্রথমত, পাকিস্তান নিশ্চয়ই এতদিনে টের পেয়ে গিয়েছে যে, যুদ্ধ বাধলে ভারতীয় বাহিনী তার যােগ্য প্রত্যুত্তর দেবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবনরাম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রযােজন হলে ভারত এবার পাকিস্তানের এলাকা দখল করে নেবে এবং সেখান থেকে সরে আসবে না। অর্থাৎ এ ব্যাপারে ভারত আমেরিকা, ব্রিটেন বা অন্য কারাে রাজনীতিক চাপের কাছে নতি স্বীকারে রাজি নয় ।
শ্ৰীমতী গান্ধীর ঘােষণার গভীরতর সামরিক তাৎপর্য রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের বাহিনী উপস্থিতকালে পাকিস্তান বাংলাদেশে নতুন করে সৈন্য পাঠাতে সাহস পাবে না। তাই ভারত সামরিক দিক থেকে ঢিলে দিলে পাকিস্তান খুবই খুশী হয়, কারণ তাহলে সে বাংলাদেশে অত্যাচার চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইচ্ছেমত সৈন্য পাঠাতে পারে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপের জন্য তলে তলে চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। | পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান ৫০০ মারকিনী প্যাটন ট্যাংক, ২০০ হালকা মারকিনী ট্যাঙ্ক, ২৫০ টি রাশিয়ান ট্যাংক এবং চীনের কাছ থেকে পাওয়া ২০০ টাংক এনে সমবেত করেছে বলে জানা গিয়েছে। এগুলির অধিকাংশই ১৯৬৫ সালের পর সংগৃহীত। এছাড়া ১৯৬৫ সালের পর থেকে পাকিস্তান নানা ধরনের বহু বােমারু বিমান ইত্যাদি সংগ্রহ করেছে। প্রতিরক্ষা মহলের ধারণায় পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর যেসব কাজে সফল হলেও হতে পারে সেগুলি হলঃ (১) কাশশ্মীর ও রাজস্থানে ভারতীয় এলাকা দখল, (২) ত্রিপুরা এবং উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, (৩) কলকাতা, বিশাখাপত্তনম এবং বােমবাই বন্দরে ভারতীয় জাহাজের উপর সাবমেরিন নিয়ে অক্রমণ এবং (৪) পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের শিল্পাঞ্চলে বােমাবর্ষণ।
ভারতের নীতি-রচয়িতারা সশস্ত্র বাহিনী কী ভাবে পরিচালনা করেন, ভারত কী ধরনের রাজনীতিক সিদ্ধান্ত নেয়। তার উপর অবশ্য অনেক কিছু নির্ভর করবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত কি মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করবে না। তাদের পাকিস্তানের রক্ত-লােলুপ জল্লাদদের দয়ার উপর ছেড়ে দেবে? ভারত মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণকারী বলে ঘােষণা করবে। তবু অনেকে মনে করেন-ভারতের উচিত। পাকিস্তানকে জোর আঘাত হানার মত করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আরও ট্রেনিং দেওয়া। তাতে মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তান ব্যতিব্যস্ত হতে বাধ্য হবে। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বাধলে চটকরে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে সৈন্য পাঠানাে সম্ভব হবে না। এই মতের সমর্থকরা আরাে মনে করেন ও আপাতত চীনের পক্ষ থেকে ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করল ভারত চীন সীমান্ত থেকে তার পার্বত্য ডিভিশনের অন্তত অর্ধাংশ সরিয়ে আনতে পারে। আজ ভারতের দরকার সাহসী এবং বাস্তববাদী নেতৃত্ব। পাকিস্তানকে উচিৎশিক্ষা দেবার জন্য সেটাই সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজন।
২২ অক্টোবর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা