রাষ্ট্রপুঞ্জ ও বাংলাদেশ
–ইন্দ্রনীল
অবশেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল উথানটের মােহভঙ্গ হয়েছে। বাংলাদেশ সমস্যা যে নিছক পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, তিনি সে কথা স্বীকার করেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্ষিক রিপােরটের মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, বিশ্বের সামনে বর্তমানে যেসব গুরুতর সমস্যা। রয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যা তাদের অন্যতম। পাকিস্তানে গৃহুদ্ধের ফলে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তা বিশ্বের পক্ষে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে উথানট বলেছেন, পারস্পরিক সমঝোতা এবং মানবিক আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দরকার। রাজনৈতিক সমাধানই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার আবেদন যে ব্যর্থ হয়েছে উথানট তাও স্বীকার করেছেন। | বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে হলে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। উথানটের এই উক্তিতে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তিনি আর বাংলাদশ সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে মনে করছেন না। রাষ্ট্রপুঞ্জে সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উত্থাপনের উদ্যোগ চলেছে। ঐ উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ। সরকারের এক প্রতিনিধিদল নিউইয়রক গিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যেতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের। মুখবন্ধে বলা হয়েছে, মৌল মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ দৃঢ় সংকল্প। সনদের ১ অনুচ্ছেদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সমান অধিকার ও বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে।
বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তােলা এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে মানবাধিকার ও মৌল স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশে মানবাধিকার, মৌল স্বাধীনতা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত হয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের লক্ষ্য ও মহান আদর্শ পর্যদস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতি ও আদর্শের দিক থেকে সাধারণ পরিষদে বা নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উত্থাপনের কোন বাধা থাকতে পারে না। বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এই অজুহাত অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবিক আদর্শের দিকে লক্ষ্য রেখে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা উচিত। দক্ষিণ আফরিকার বর্ণবৈষম্যের ফলে যে গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ১৯৭০ সালে সাধারণ পরিষদের। এক প্রস্তাবে সেজন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং দক্ষিণ আফরিকা সরকারের কাজের নিন্দা করা হয়। বর্ণ বৈষম্যের নীতি দক্ষিণ আফরিকা সরকারের ঘরােয়া ব্যাপার, সাধারণ পরিষদ এই অজুহাতে অগ্রাহ্য। করেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের ২(৭) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানবাধিকারের চুক্তি ওই অনুচ্ছেদে পড়ে না। বাংলাদেশে মানবাধিকার চুক্তির সব কটি অনুচ্ছেদই লঘন। করা হয়েছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপনে আন্তর্জাতিক আইনের বা মানবিক নীতির দিক থেকে কোন বাধা নেই। সনদের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উত্থাপন করা। যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংঘাত বা বিরােধ দেখা দিতে পারে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে যে কোন সদস্য রাষ্ট্র। সনদের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে তা উত্থাপন করতে পারেন।
বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপ্নকর । ঐ পরিস্থিতির ফলে আন্তর্জাতিক সংঘাত ঘটতে পারে। এই অবস্থায় যে কোন সদস্য রাষ্ট্র ৩৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদে বা নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উত্থাপন করতে পারেন। বিশ্বের কোথাও যদি শান্তি বিঘ্নিত হওয়ায় বা আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে সদদের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ সে বিষয়ে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন। ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাজ করতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের কোন সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ সমস্যা যে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিঘ্নকর, সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ৩৯, অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের বাংলাদেশ সমস্যার মীমাংসার জন্য অগ্রসর হওয়া উচিত। কোন সদস্য রাষ্ট্র বা নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশ সমস্যার রাষ্ট্রপুঞ্জে উথাপনে উদ্যোগী না হন, তাহলে সেক্রেটারি জেনারেল নিজেই তা করতে পারেন। সনদের ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিঘ্নকর কোন ঘটনা ঘটলে। নিরাপত্তা পরিষদে দৃষ্টি আকর্ষণ সেক্রেটারি জেনারেল ঐ ব্যাপারে করতে পারেন। আমরা অশা করছি সাধারণ পরিষদের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপিত হবে এবং এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ উদ্যোগী হবেন।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা