You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানে যে সত্য চাপা দেওয়া হয়েছে -আবদুল গাফফার চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানে যে সত্য চাপা দেওয়া হয়েছে

–আবদুল গাফফার চৌধুরী

উনিশশাে তেষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাস। বৈরুটের হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লাউঞ্জে বসেছিলেন পাকিস্তানের এককালের প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। রােগজৰ্জর চেহারা বিদেশে প্রায়-নির্বাসিত অবস্থা। বিদেশী কজন সাংবাদিক টের পেতেই তাঁকে হেঁকে ধরলেন, পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে কিছু বলুন।’ বিরক্ত হয়ে ৮ কোচকালে সােহরাওয়ার্দী, পাকিস্তানের রাজনীতি। তা-আমি কী বলবাে? পাকিস্তানে গণতন্ত্র নেই। কোনদিন ছিল না। সাংবাদিকেরাও কম ধুরন্ধর নন। একজন বললেন, সে কী বলছেন স্যার, আপনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনাে কী পাকিস্তানে গণতন্ত্র ছিল না?’ সােহরাওয়ার্দী দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘না ছিল না। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আশায় সেই অ-গণতান্ত্রিক পরিবেশেও আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে রাজি হয়েছিলাম। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, তাহলে পাকিস্তানে এখন যে রাজনীতি’ চলছে, তাকে আপনি কী বলবেন, বেসিক ডেমােক্রাসির রাজনীতি?’ সােহরাওয়ার্দী আগের মতােই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, না হত্যার রাজনীতি’।  এর তিন মাস পর ৫ ডিসেম্বর তারিখে বৈরুটের ওই হােটেল-কক্ষেই সােহরাওয়ার্দীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল। বৈরুটের পাকিস্তানী দূতাবাস বললেন, হৃদরােগে আকস্মিক মৃত্যু। আর ঢাকার শােকসভায় শেখ মুজিবর রহমান রােরুদ্যমান কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমার নেতার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ | সােহরাওয়ার্দী-কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান তখন মুখ খােলেননি। এখন মুখ খুলেছেন দীর্ঘ আট বছর পর । বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তার স্থির বিশ্বাস সােহরাওয়ার্দীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ একই অভিযােগ তুলেছেন করাচীর উর্দু দৈনিক ‘ন-ই নােসনি’ মিস ফাতেমা জিন্নার মৃত্যু সম্পর্কে। বলেছেন, তাকে শ্বাসরােধ ও পেটে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মের কল আপনি নড়ে। পাকিস্তানে হত্যার রাজনীতি সম্পর্কে এতদিনের চাপা দেওয়া সত্য আজ আপনি প্রকাশ হতে শুরু করেছে। বৈরুটের হােটেলে বসে সােহরাওয়ার্দী মিথ্যে বলেননি, পাকিস্তানের জন্মাবধি যে রাজনীতি চলেছে তা গুপ্ত হত্যার রাজনীতি। এই রাজনীতির প্রথম বলি স্বয়ং পাকিস্তানের স্রষ্টা মিঃ জিন্না। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতাে এই হত্যার খবরও চাপা দেয়া হয়েছে এবং যেটুকু বা সূত্র ছিল জিন্নার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বশের ডায়েরিতে, সে ডায়েরিও প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য প্রভাবশালী হাতের কারসাজিতে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। এই বইয়ের কয়েকটি সূত্র ধরেই পাকিস্তানের প্রাসাদ রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ঢাকার কোন কোন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ঘরােয়া বৈঠকে মত প্রকাশ করেছিলেন, জিন্নার মৃত্যু হয় ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে, ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে নয় এবং এই মৃত্যু হলাে পয়জনিং-এর ফল এই মৃত্যু রহস্য ঘনীভূত হয় কয়েকটি তথ্য থেকে মৃত্যুর আগে জিন্না করাচীতে নয়, জিয়ারতে ছিলেন।

হঠাৎ সেখানে থেকে করাচীকে জানানাে হয়, তার জন্য পােষাক তৈরির সাদা সূতী কাপড় প্রয়ােজন। পরবর্তীকালে অনুমান করা হয়েছে, এই সূতী কাপড় তার মৃতদেহ আচ্ছাদনের কাফন তৈরীর প্রয়ােজনে লেগেছে। দ্বিতীয়, জিন্নার যে ক্যান্সার হয়েছে এই তথ্য তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, এমন কি মিস জিন্নাও জানতেন না। মৃত্যুর পরে বলা হয়, তিনি ক্যান্সার রােগে মারা গেছেন। তৃতীয়, ১০ সেপ্টেম্বর রাত্রে অসুস্থ মিঃ জিন্নাকে জিয়ারত থেকে করাচীর গভর্ণর জেনারেল হাউসে স্থানান্তরিত করা হয়। গভীর রাতে মৌরীপুর বিমানঘাটী থেকে করাচী যাওয়ার পথে জিন্নাকে বহনকারী এম্বুলেন্সটি বিকল হয়ে যায়। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নতুন একটি গাড়ি এসে বিকল গাড়ি থেকে জিন্নাকে উদ্ধার করে এবং তাকে গভর্ণর জেনারেল হাউসে নিয়ে যায় । এই তথ্য থেকেও অনুমান করা হয়, জিয়ারত থেকে করাচীতে মিঃ জিন্নার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। জীবিত এবং মুমুর্মু জিন্নাকে নিশ্চয়ই বিকল এম্বুলেন্সে তিন ঘণ্টাকাল ফেলে রাখা হত না। চতুর্থ, গভর্ণর জেনারেল যে অসুস্থ শরীরে জিয়ারত থেকে করাচী আসছেন, এ খবর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কোন সদস্য দূরে থাক, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিও জানতেন না। তিনি যখন খবর পেলেন, তখন গভর্ণর জেনারেলের ভবনে পতাকা উড়ছে। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল বাক্শক্তি রহিত এবং অন্তিম শয্যায় শয়ান । মিস জিন্নার অবস্থাও তাই। দু’জনেই হয়ত অনুমান করেছিলেন মিঃ জিন্না গভীর ‘কমায় রয়েছেন। তারা মৃতদেহ দেখে বুঝতে পেরেও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তা গােপন করেছিলেন কিনা এই রহস্য এখনাে পরিষ্কার হয়নি। | মিঃ জিন্নার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী নিহত হন উনিশশাে একান্ন সালের মােলই অক্টোবর তারিখে। এটা প্রকাশ্য হত্যাকান্ড । রাওয়ালপিন্ডির জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাকে গুলি করা হয়। তার হত্যাকারীর নাম সৈয়দ আকবর। এই হত্যাকারীকে জীবিত গ্রেপ্তার করার সুযােগ পেয়েও জনৈক পুলিশ ইনস্পেকটার তাকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেন। পরে এই পুলিশ ইনস্পেক্টরের উচ্চপদে প্রমােশন হয়েছিল। লিয়াকত-হত্যা সম্পর্কে তদন্তকারী সামরিক অফিসার জেনারেল শেরখান এবং জেনারেল ইফতিখার উভয়েই রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এরপর লিয়াকত হত্যা তদন্ত পরিত্যক্ত হয় । পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরােধী দল এই হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য বৃটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিশেষজ্ঞ নিয়ােগের দাবি জানালে তকালীন নাজিম-মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্র সচিব নবাব মুশতাক আহমদ গুরমানী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশী হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। দীর্ঘকাল পর অবশ্য জনৈক বৃটিশ-বিশেষজ্ঞ এই হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য নিযুক্ত হন।

কিন্তু তিনি তদন্তের কাজে সফল হতে পারেননি। পাকিস্তানী রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন কেউ কেউ ব্যক্তিগত ও ঘরােয়া আলােচনায় মত প্রকাশ করেছেন, জিন্না এবং লিয়াকত আলী একই চক্রান্তের বলি হয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা ভারতের যুক্ত প্রদেশ ও বােমবাই থেকে আগত প্রভাবশালী লীগ-নেতাদের করায়ত্ত হয়। মিঃ জিন্নার। জন্ম করাচীতে এবং বাস বােম্বাইয়ে। লিয়াকত আলী যুক্ত প্রদেশের লােক। পাঞ্জাবের সামরিক ও আমলাচক্রের এটা সহ্য হয়নি। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বহুকথিত ‘প্যালেস ক্লিকের জন্ম তখনই। এই ‘প্যালেস ক্লিকের ফলই একটার পর একটা হত্যাকান্ডে, শাসন ক্ষমতায় বহিরাগতদের প্রভাব লােপ এবং পাঞ্জাবী আমলা ও সামরিক চক্রের একাধিপত্য। একটা সংশয় এখনাে অনেকের মনে রয়েছে। মিস জিন্না কী তার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের খবর জেনেও তা শেষ পর্যন্ত চেপে রেখেছিলেন? আইয়ুৰ তার আত্মজীবনী ‘প্রভু নয় বন্ধু’ পুস্তকে স্বীকার করেছেন, ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে ইস্কান্দার মীর্জা জেনারেল ইয়াহিয়া (বর্তমান প্রেসিডেন্ট), হামিদ (বর্তমান সেনাধ্যক্ষ) ও শের বাহাদুরকে গ্রেপ্তারের গােপন নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক জুন্টা জানতে পেরে মীর্জাকেই ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা করে। ক্ষমতাচ্যুতির পর ইস্কান্দার মীর্জা হয়ত পাকিস্তানে হত্যার রাজনীতির আরেকজন বলি হতেন। কিন্তু তিনি কপাল জোরে বেঁচে যান। আইয়ুব তার আত্মজীবনীতে ইঙ্গিত দিয়েছেন, পাকিস্তানে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন হাই কমিশনার মেজর জেনালের কর্থন পদচ্যুত প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হন এবং তিনি তার আরাে কজন বন্ধুসহ আইয়ুবের কাছে মীর্জার নিরাপত্তা সম্পর্কে আশ্বাস চেয়ে তা লাভ করেন। অতঃপর মীর্জা লন্ডনে নির্বাসিত হন। সবশেষে পাকিস্তানের রাজনীতিতে লৌহ মানব রূপে পরিচিত কালাবাগের আমিরের হত্যাকাণ্ড। কালাবাগের আমির জেনারেল আইয়ুবের সহযােগী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর ছিলেন। ৬৫ সালের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পর আইয়ুবের সঙ্গে তার মতবিরােধ এবং কিছুকালের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুতি। ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আততায়ীর হস্তে মৃত্যু। এই মৃত্যুকে পারিবারিক বিবাদের পরিণতি বলে চালানাের চেষ্টা হয়েছে আর আসল সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছে সযত্নে। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা পাত আইয়ুব-হত্যা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৮ সালে পেশােয়ারের এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলেন আইয়ুব। হঠাৎ হাশিম নামে এক তরুণ ছাত্র তাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি দুবার গুলি ছােড়ে। আইয়ুব টেবিলের নীচে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন। হয়ত সেই সঙ্গে উপলব্ধি করেন, তারও বিদায়ের ঘণ্টা বেজেছে।

মীর্জার মতাে সামরিক চক্রের কাছে তারও প্রয়ােজন ফুরিয়েছে। এবার নতুন জেনারেলকে গণী ছেড়ে দিতে হবে। পরের বছর মার্চ মাসেই গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইস্কান্দার মীর্জা যখন পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জুন্টার নেতা, তখন তার ডান হাত এবং সরকারী দল রিপাবলিকান পার্টির নেতা ডাঃ খান সাহেব আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। প্রথমে এই হত্যার দায়িত্ব আল্লামা মাশরেকির খাকসার পার্টির উপর চাপানাের চেষ্টা হচ্ছিল, তা সফল হয়নি। ডাঃ খান সাহেব ইস্কান্দার মীর্জার হয়ে পাকিস্তানে কন্ট্রোলড ডেমােক্র্যাসি প্রবর্তন এবং পার্লামেন্টের বদলে রিভলিউশনারী কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর করাচীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে এই সন্দেহ দানা বেধে ওঠে যে, সম্ভবত মীর্জার দিন ফুরিয়েছে। তিনি সামরিক জুন্টার আস্থা হারিয়েছেন। এবার ক্ষমতার শীর্ষে ব্যক্তি বদল আসন্ন। তারই পূর্বাভাস ইস্কান্দার মীর্জার রাজনৈতিক শক্তির উৎস ডাঃ খান সাহেবের অপঘাত-মৃত্যু। ১৯৪৯ সালে জিন্নার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে মিস ফতেমা জিন্না রেডিও পাকিস্তানের করাচী কেন্দ্র থেকে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তার ভাষণ প্রচারের মাঝখানে প্রায় পাঁচ মিনিট বিস্ময়কর যান্ত্রিক নীরবতা। শ্রোতারা ভাবলেন, ট্রান্সমিশন বিকল হয়েছে। মিস জিন্না জানলেন, তার ভাষণ যথারীতি প্রচারিত হয়েছে। তিনি বেতার কেন্দ্র থেকে-বাসায় ফিরে যখন শুনলেন তাঁর ভাষণের একটা বিশেষ অংশ’ প্রচারিত হয়নি, তখন বেতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। পাকিস্তান বেতারের বড় কর্তা তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর এককালের বহু নিন্দিত কর্তা বােখারী সাহেব। বােখারী সাহেব বললেন, এটা যান্ত্রিক ত্রুটি। মিস জিন্না বললেন, তাহলে তার ভাষণ পুনঃপ্রচারিত হােক। বােখারী বললেন, তা হয় না। এ নিয়ে খবরের কাগজে লেখালেখি হল। কিন্তু কী ছিল ভাষণের এই অশ্রুত অংশটুকুতে? মিঃ জিন্নার মৃত্যু-রহস্য সম্পর্কে কোন সূত্র অথবা প্রশ্ন? এই জিজ্ঞাসার জবাব মিস জিন্না পরবর্তিকালে আর দেননি।

১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা