যেভাবে বাংলাদেশের জন্ম
এম আসগর খান
১৯৭১ সালে এম আসগর খান পাকিস্তানি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ১৭ জানুয়ারি ১৯২১ সালে জম্মুতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। তিনি পাকিস্তানের গণতন্ত্র, সামরিক শাসন, ধর্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন। তাঁর বই উই হ্যাভ লার্ড নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি: পাকিস্তান—পলিটিকস অ্যান্ড মিলিটারি পাওয়ার (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫)-এর হাউ বাংলাদেশ ওয়াজ বর্ন’ অধ্যায় থেকে অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হলাে। রচনাটি ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলাে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাবতে পারেননি যে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তার এত বিপুল বিজয় হবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে দুটি বাদে সব কটি পেলেন। এতে তার ছয় দফা দাবিতে দর-কষাকষির সুযােগ বাড়ল। অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পেলেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জাতীয় সংসদে পাঞ্জাবের ৮২টি আসনের মধ্যে ৬২টি, সিন্ধুর ২৭টির মধ্যে ১৮টি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ২৫টির মধ্যে একটি আসন। পেলেন ভুট্টো। তবে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বেলুচিস্তানে। কোনাে আসন পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানেও কোনাে আসন পায়নি পিপিপি। সেখানে দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে ভুট্টো কোনাে পদক্ষেপ নেননি।
পৃষ্ঠা: ১৪৭
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে গিয়েও বিরােধীদলীয় নেতার আসনে বসতে আগ্রহী ছিলেন না ভুট্টো। নির্বাচনের ফলাফল বেরােনাের কয়েক দিন পরই বললেন, পাকিস্তানে তিনটি শক্তি আছে—সশস্ত্র বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি। তাই পাকিস্তানের জন্য দরকার দুজন প্রধানমন্ত্রী। একজন পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, আরেকজন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। ভুট্টোর এই অবস্থান ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার খুবই কাছাকাছি। তাদের এই অবস্থান অখণ্ড পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার প্রত্যাশাকে দূরে ঠেলে দিল।
নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকা সফরে যান। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল এস এম আহসানের মাধ্যমে ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। ১৯৭১-এর ১২ জানুয়ারি ঢাকায় এসেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভর্নর আহসানকে বললেন শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট হাউসে তলব করতে। সেখানে ইয়াহিয়া তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। শেখ মুজিবের আসার আগেই আহসান সেখানে হাজির হন। ইয়াহিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেন, ছয় দফার সব কটি তার জানা আছে কি না। আহসান বললেন, তাঁর সব জানা আছে। সবাই অপেক্ষা করছিলেন মুজিবের জন্য। মুজিব এলেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হলাে। ইয়াহিয়া মুজিবকে ছয় দফা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বললেন। মুজিব করলেন। মুজিব ইয়াহিয়াকে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনের ভাষণে তিনি নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়াকেই দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার আহ্বান জানাবেন। তার এ কথায় চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ইয়াহিয়া বললেন, মুজিব যদি এ প্রস্তাব আনেন, তবে তিনি তাঁর ‘গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়ােগ করবেন এবং এটি প্রত্যাখ্যান করবেন। ইয়াহিয়া জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে কেন প্রেসিডেন্ট হতে বলছেন? জবাবে মুজিব বললেন, তিনি এবং তাঁর দল মনে করে, এটাই হতে পারে সবচেয়ে সঠিক সমাধান। ইয়াহিয়া এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
পরদিন ইসলামাবাদের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগে বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সন্তোষজনক আলােচনা হয়েছে।’
যাহােক, এই আনন্দ-উন্মাদনা বেশি দিন টিকল না। ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ অনেকেই চাননি শেখ মুজিবের কাছে এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হােক।
পৃষ্ঠা: ১৪৮
বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো একদমই চাননি। ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে কোনাে ধরনের নিষ্পত্তির ঘাের বিরােধী ছিলেন তিনি।
কয়েক দিন পর ভুট্টো তাঁর পারিষদদের নিয়ে ঢাকায় এসে মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আন্তরিক পরিবেশে তাঁদের বৈঠক হলেও কার্যকর কোনাে অগ্রগতি কিন্তু হলাে না। যদিও সেটা বিস্ময়করও ছিল না। ঢাকা থেকে ফিরে ভুট্টো সব সময় ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে চলতেন। লারকানায় ইয়াহিয়া ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগী জেনারেল হামিদ [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান] ও জেনারেল পীরজাদাকে [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট মে. জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদা] অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিপুলভাবে আপ্যায়িত করেন ভুট্টো। এ সময় তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন, মুজিব তার আচরণ পরিবর্তন না করলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নামানাে হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক জান্তার প্রতিনিধিদের সভায় এই সিদ্ধান্ত পুনরায় অনুমােদন করা হয়।
সত্তরের মাঝামাঝি এক আলাপচারিতায় ইয়াহিয়া আমাকে বলেন, ‘ভুট্টো তাকে বলেছেন নির্বাচন ভুলে যেতে। কারণ, আমি সেনাবাহিনীর লােক, আর তিনি রাজনীতিবিদ। এই দুয়ে মিলে একটি ভালাে টিম হতে পারে। আর এই টিমই তাে পারে দেশের নেতৃত্ব দিতে। ইয়াহিয়া খান আমাকে আবার বললেন, তিনি এ বিষয়ে ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে তাঁর প্রস্তাব কী? জবাবে ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তান কোনাে সমস্যা নয়। সেখানকার হাজার বিশেক লােককে হত্যা করতে হবে। তাহলে সব ল্যাঠা চুকে যাবে। তখন আমি ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এ বিষয়ে তাঁর মতামত কী? তিনি বললেন, এ ধরনের প্রস্তাবের ব্যাপারে কী বলার থাকতে পারে!’
এদিকে শেখ মুজিবের কাছে খবর পৌছাল, ইয়াহিয়া খান লারকানায় আছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁকে ঘিরে কোনাে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যে মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে একটু নমনীয় ছিলেন, বিজয়ের পর তাঁর অবস্থান হলাে কঠোর।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকলেন। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক সভায় ভুট্টো ঘােষণা করলেন, তাঁর দলের কোনাে এমএলএ যদি ঢাকায় অধিবেশনে যােগ দিতে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন, তাহলে তিনি তাঁর ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। পরদিন। ইয়াহিয়া আকস্মিকভাবে অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করলেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া ঘােষণা দিলেন, পার্লামেন্টের অধিবেশন হবে ২৫ মার্চ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, এ
পৃষ্ঠা: ১৪৯
সময়ের মধ্যে তিনি প্রধান দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাঙালিদের কাছে ইয়াহিয়া ও তার প্রশাসনের যেটুকু গ্রহণযােগ্যতা ছিল, তা আর থাকল না।
এই অবস্থায় ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ভুট্টোর সঙ্গে যােগাযােগ করে তাকে বললাম, ঢাকা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ভুট্টো আমাকে সময় দিতে রাজি হলেন। সেই অনুযায়ী আমি করাচি গেলাম। কিন্তু তাঁর এক সহযােগী আমাকে হতাশ করে বললেন, ‘চেয়ারম্যান ব্যস্ত আছেন। তিনি দেখা করতে পারবেন না।’
আমি ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় সপ্তাহব্যাপী অবস্থানকালে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করি। একটা বাদে বাকি সব কটি বৈঠকে কেবল আমরা দুজনেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কথা বলি। মুজিব নিশ্চিত ছিলেন, ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমাতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন।
মুজিব আমাকে বলেন, তিনিও পাকিস্তানি ছিলেন। পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন। পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে বন কর রহেগা পাকিস্তান’ [পাকিস্তান অবশ্যই হবে] স্লোগান দিতে দিতে কলকাতা থেকে দিল্লি গেছেন। তখন কোথায় ছিলেন ইয়াহিয়া আর ভুট্টো? মুজিব ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে বলেন, বাঙালিকে কখনাে বিশ্বাস করা হয়নি। তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা মানুষের সঙ্গে কেউ করে না।
ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি কেন রাওয়ালপিন্ডি গেলেন না, আমি তাঁকে এ প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন, নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর তার সমর্থকেরা এই পরিস্থিতিতে তাকে সেখানে যেতে দিতে চাননি। যদিও মুজিব বলেননি, তারপরও আমার মনে হয়েছে, তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগীরা বিশ্বাস করেছিলেন, তিনি রাওয়ালপিন্ডি গেলে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।
পরবর্তী দিনগুলােতে কী ঘটবে, সে সম্পর্কে মুজিবের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি জানতেন, ঢাকায় প্রথমে ইয়াহিয়া আসবেন। তারপর আসবেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এম এম আহমেদ। তারপর আসবেন ভুট্টো। ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীকে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেবেন। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা ছিল, তাঁকে বন্দী করা হবে। তা না হলে তিনি নিহত হবেন হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা, না হলে নিজ লােকেদের দ্বারা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলাে, মুজিব যা ভেবেছিলেন, পরবর্তী দিনগুলােতে তা-ই ঘটতে লাগল।
তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর মুজিবের পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণ। তাঁর আহ্বানে ধর্মঘটে অচল হয়ে গেল ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তান। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে
পৃষ্ঠা: ১৫০
৭ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের মহাসমাবেশে ভাষণ দিলেন মুজিব। সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল, এই মহাসমাবেশ থেকে মুজিব ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দেবেন। ৭ মার্চের মহাসমাবেশে যােগ দেওয়ার জন্য ভাের থেকে মানুষ ঢাকার রাজপথে জড়াে হতে লাগল। এই সভা শুরু হলাে বিকেলে। বিকেলে রেসকোর্স পরিণত হলাে জনসমুদ্রে। তাদের অনেকেরই হাতে ছিল লাঠি। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানালেন। মুজিব বললেন, ২৫ মার্চ সংসদের অধিবেশন বসার আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তা কিন্তু এ দাবির ব্যাপারে ইয়াহিয়া কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। ভুট্টোও তাঁর অবস্থানে অনড় থাকলেন। ইয়াহিয়ার ঢাকায় আসার আগে ১৪ মার্চ ভুট্টো। এক বিবৃতিতে বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মেনে সাংবিধানিক কোনাে নিষ্পত্তির আগে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়, তাহলে এটা করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে। পরদিন আরেক বিবৃতিতে ভুট্টো বললেন, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে যেহেতু ভূখণ্ডগত দূরত্ব রয়েছে, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসনের বিষয়টি ধােপে টেকে না।
যেহেতু পরিস্থিতি ছিল গুরুতর, আমি আশা করেছিলাম ইয়াহিয়ার অবস্থান হবে ইতিবাচক। চেয়েছিলাম জনমতের চাপটা তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন। তবে এই মতটা যদি পাঞ্জাবের হতাে, তাহলে সঠিক হতাে। পাঞ্জাব-নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইয়াহিয়া। তিনি আবার ভুট্টোর কাছ থেকে চাপের মধ্যে পড়লেন। কারণ, ভুট্টো পাঞ্জাবের নির্বাচিত প্রধান। তবে যদি ইয়াহিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না-ও থাকে, তবু তিনি পাঞ্জাবের অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারেন না। আমি মুজিবকে পরামর্শ দিলাম পাঞ্জাব সফর করতে। আমি আশাবাদী ছিলাম, মুজিব পাঞ্জাব সফর করলে জনসমর্থন তাঁর পক্ষে নিতে পারবেন এবং সংঘর্ষ এড়ানাে সম্ভব হবে। আমি তাকে বললাম, তাঁর এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আছে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেওয়ার এবং তাঁর এই অধিকার পরিত্যাগ করা উচিত নয়। তাহলে পাকিস্তানও রক্ষা পাবে আর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তিনি (মুজিব) মনে করলেন যে এসব করার সময় পেরিয়ে গেছে।
১১ মার্চ করাচিতে সাংবাদিকদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় আমি বললাম, পাকিস্তান রক্ষার জন্য আর কয়েকটি দিন মাত্র সময় আছে। আমি বললাম, ঢাকায় যদি একটা বুলেট ছােড়া হয় এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করা
পৃষ্ঠা: ১৫১
হয়, তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হবে। ১৯ মার্চ মুলতানে ডিস্ট্রিক্ট বার অ্যাসােসিয়েশনে ভাষণদানের আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টির কর্মীরা আমাকে কথা বলতে বাধা দেয়। তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দরজা-জানালা ভাঙতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত আমি ও আমার কর্মীরা একটি ছােট কক্ষে আশ্রয় নিই। কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনাে ভূমিকা রাখেনি। মুলতানের ঘটনার পর আমি নিশ্চিত হলাম, ইয়াহিয়া নিষ্পত্তি চাচ্ছেন না। আমি জনগণকে সত্যটা জানাই, তা-ও তিনি চাচ্ছেন না। মুজিবই ছিলেন সঠিক অবস্থানে।
ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তাঁর সঙ্গে মাওলানা শাহ আহমাদ নুরানি রাজনৈতিক দল [জামাতে উলেমাই পাকিস্তানের নেতা], আবদুল ওয়ালি খানসহ [পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান] পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যও ছিলেন। বৈঠক হলাে পরদিন। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের ছয় দফার মূল দাবিগুলাে মেনে নিলেন বলে মনে হলাে। অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলাে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হবে এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি দুটি কমিটিতে বিভক্ত হবে, কমিটি দুটি গঠিত হবে প্রতিটি দল থেকে পৃথকভাবে সদস্যদের নিয়ে। তারা বিশেষ বিধানসহকারে সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করবেন এবং পার্লামেন্টের পূর্ণ অধিবেশনে তা বিবেচনা করা হবে।
ভুট্টো, প্রথমে যিনি ঢাকা যেতে আপত্তি করেছিলেন, সবকিছু নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে দেখে ২১ মার্চ ঢাকা গেলেন। মুজিবের সঙ্গে সমঝােতার খসড়া যখন ভুট্টোর কাছে গিয়ে পৌছাল, তিনি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বৈঠক ছাড়া সামরিক আইন প্রত্যাহার না করার পক্ষে অবস্থান নিলেন। তার একটা ধারণা ছিল, এটা সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে। পুরাে সমঝােতা আগে হতে হবে। এরপর থেকে ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগল। ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসতে শেখ। মুজিবকে রাজি করানাে হলাে। ২২ মার্চ মুজিব ও ভুট্টো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেন। এই বৈঠকের দুদিন আগেই যে সমঝােতা হয়েছিল, তা থেকে সরে এলেন মুজিব এবং দেশের দুটি দলের কাছে পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করলেন, এক মাস আগে ভুট্টো যে ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২ মার্চের বৈঠকেও কোনাে অগ্রগতি হলাে না। পরদিন ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান-সংক্রান্ত লাহাের প্রস্তাব পাসের বার্ষিকী। আর ওই দিনই বাস্তবিকভাবে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটল।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে লাগল। অদৃশ্য হয়ে গেল পাকিস্তানের পতাকা। যেসব বিদেশি দূতাবাসে পাকিস্তানি
পৃষ্ঠা: ১৫২
পতাকা উড়ছিল, সেসব স্থানে পাথর নিক্ষেপ করা হলাে। শেখ মুজিব তাঁর খসড়া সংবিধান পেশ করলেন। তাতে ছিল দুটি সার্বভৌম দেশের একটি কনফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা। প্রস্তাব করা হলাে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও বাণিজ্য অভিন্ন থাকবে। প্রস্তাবে বলা হলাে, এই অভিন্ন বিষয়গুলাে পরিচালনায় উভয় দেশকেই অর্থায়ন করতে হবে। মুজিবের এই প্রস্তাব তার। আইন উপদেষ্টা কামাল হােসেন ২৩ মার্চ পেশ করেন। প্রস্তাবটি ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের কাছে পাঠানাে হলাে এবং যথারীতি তা অগ্রহণযােগ্য হলাে। ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মুজিবের একটি বৈঠক ছিল। কিন্তু তা হলাে না। এ অবস্থায় শিগগিরই যে সামরিক অভিযান হতে যাচ্ছে, তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে যেন ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছিল। সবার মধ্যে বিরাজ করছিল শঙ্কা। কিছু নির্দেশনা দিয়ে সন্ধ্যার পর ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন। ভুট্টো তখনাে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর হােটেলের সাততলার কক্ষে বসেই ভট্টো ঢাকায় মেশিনগানের গর্জন শুনছিলেন। আর পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার পথে শ্রীলঙ্কার আকাশসীমায় চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে উড়ােজাহাজে বসে ইয়াহিয়া যখন স্কচের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন, তখন উড়ােজাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁকে জানিয়ে দেন, ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়ে গেছে।
সেনাবাহিনীর এক দল কমান্ডাে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এদিকে পাঞ্জাবি ও বাঙালিরা একে অপরের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা উভয়ই বলল, ইসলামের মহান মর্যাদা রক্ষার জন্যই তারা এটি করছে!
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে উপলব্ধি করল, তারা শুধু স্থানীয় জনগণের হামলার শিকার হচ্ছে না, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররাও তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। পাগল ছাড়া আর কে ভাবতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকবে, তখন প্রতিবেশী ভারত ধৈর্য ধরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ দেখবে। এপ্রিলের শেষ দিকেই ভারত থেকে সশস্ত্র গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে। এদিকে আমাদের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নজর কাড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা বাড়িয়ে দিতে থাকে ভারত।
এ অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে কোনাে দেশের এমন কোনাে চুক্তি ছিল না, যার মাধ্যমে কোনাে দেশকে সহায়তায় বাধ্য করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রও ওই সময় সাহায্যের কোনাে অঙ্গীকার করেনি। তা ছাড়া ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল
পৃষ্ঠা: ১৫৩
পাকিস্তানে প্রচণ্ড সমালােচিত। পাকিস্তান যদিও সিয়াটোর সদস্য ছিল, তবে এই চুক্তির শর্ত ছিল, যদি কোনাে কমিউনিস্ট দেশ দ্বারা কোনাে সদস্যদেশ। হামলার শিকার হয়, আর কংগ্রেস যদি অনুমােদন করে, তাহলেই কেবল দেশটি মার্কিন সহায়তা পেতে পারে। চীনের সঙ্গেও এমন কোনাে চুক্তি ছিল না যাতে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে তাদের বাধ্য করা যায়। আ করাচি থেকে চট্টগ্রামের নৌপথে দূরত্ব তিন হাজার মাইল এবং সেখানে। পৌছাতে হবে শত্রুদেশ ভারতীয় উপকূল অতিক্রম করে। পূর্ব পাকিস্তান ছিল তিন দিক দিয়ে ভারতের দ্বারা ঘেরা। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরেও ভারতের আধিপত্য। আর ফেব্রুয়ারিতেই ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের উড়ােজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিস্ময়কর হলাে, এরপরও পাকিস্তানে এ রকম অসংখ্য আশাবাদী মানুষ, সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ ছিলেন, যারা। বিশ্বাস করতেন যে ইয়াহিয়া খান তাঁর এই উন্মাদ অ্যাডভেঞ্চারে বিজয়ী হবেন।
জুলাই ও অক্টোবরে আমি দুবার ঢাকা সফর করি। সেখানে আমি যা। দেখি, তা আমাকে হতাশ করে। সত্তরের নির্বাচনে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত জামায়াতে ইসলামী একটা ভুল ধারণা নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন দিতে। থাকে। তাদের ধারণা ছিল, তারা ইসলামের সেবার জন্য এ সমর্থন দিচ্ছে। জুলাইয়ে পূর্ব পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে আমি ইয়াহিয়াকে বিস্তারিত জানিয়েছিলাম। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের ব্যাপারে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা কোনাে নিন্দা তাে জানায়ইনি, বরং তারা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
জুলাইয়ে ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার আলােচনা হয়। তাঁকে আমি পূর্ব পাকিস্তানের শােচনীয় পরিস্থিতির কথা জানাই। তাকে আমি পরামর্শ দিই, যদিও দেরি হয়ে গেছে, তারপরও একটা রাজনৈতিক সমাধান খোজার চেষ্টা ভুল হবে না। আমি বলি, আওয়ামী লীগের সব রাজনীতিবিদকে সাধারণ ক্ষমার আওতা আরও বাড়িয়ে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। আমি পরামর্শ দিই, পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকে আইন অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে। আমি বললাম, এ ধরনের সমাধান ছাড়া বিকল্প কিছু আর নেই। কিন্তু সে পরামর্শে কর্ণপাত করলেন না ইয়াহিয়া। তাঁর কাছে তখন তাঁর আত্মসম্মান এবং ক্ষমতার ক্ষুধাই ছিল বড়। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে বললাম অন্তত গভর্নরের পদ থেকে টিক্কা খানকে সরিয়ে দিতে। কারণ, বাঙালি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় টিক্কা খান নামটি পূর্ব পাকিস্তানে ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল। ইয়াহিয়া। বললেন, এরই মধ্যে তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। টিক্কা খানের বদলে
পৃষ্ঠা: ১৫৪
কাকে নিয়ােগ দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন। আইয়ুব খান। আমলের সবচেয়ে সফল গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আযম খানের নাম প্রস্তাব করলাম। কিন্তু এ প্রস্তাব ইয়াহিয়ার মনঃপূত হলাে না। কারণ, আগেই তিনি ড. আবদুল মালিককে ঠিক করে রেখেছিলেন। ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার সাবেক এই সদস্য ফিলিপাইনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আমি বললাম, এটা মন্দ হবে না। ড. মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব নিলেন।
এরই মধ্যে ঢাকায় মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানাে হলাে সেখানকার পরিস্থিতি দেখার জন্য। আমাকে বলা হলাে, সেনাপ্রধান মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আমাকে ব্রিফ করবেন। এই অস্বাভাবিক আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করি। মানচিত্রের সাহায্যে আমাকে পরিস্থিতি দেখানাের চেষ্টা করা হয়। আমাকে জানানাে হয়, বর্ষাকালে কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তিনি আমাকে জানান, আরও রাজাকার নিয়ােগের জন্য জেনারেল হেডকোয়ার্টার থেকে অর্থ এসেছে এবং শুকনাে মৌসুমে মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে। জেনারেল [পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ খান নিয়াজি] আমাকে জানালেন, ওই কাজটি করা সম্ভব হবে চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে। আমাকে মানচিত্রে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান দেখিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, পরিস্থিতি শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
আমি তাকে বললাম, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে দেখতে হবে ওই এলাকার সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে। ভারতের জড়িত থাকার প্রশ্নটি তুলে আমি বললাম, এটা নিশ্চিত, ভারত মুক্তিবাহিনীকে ব্যবহার করে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর ক্ষতি করতে চাইবে। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কথা শুনে জেনারেল সাহেব বললেন, ও আচ্ছা! তেমন কিছু ঘটলে সেটা হবে। ইসলামাবাদের সমস্যা।
বৈঠক শেষে যখন উঠতে যাব, তখন জেনারেল বললেন, দু-এক মাসের মধ্যে আবার এসে আমি যেন অগ্রগতি দেখে যাই। কিন্তু জেনারেলকে আমি বললাম, সম্ভবত ঢাকায় এটাই আমার শেষ সফর। তার এবং পূর্ব পাকিস্তানে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য শুভকামনা জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম।
রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এক অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে দেখা হয় পুরােনাে বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ গুল হাসান খানের সঙ্গে। পূর্ব। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে আমি তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি
পৃষ্ঠা: ১৫৫
নিজেও কদিন আগে ঢাকা থেকে ফেরেন। সেখানকার সেনাবাহিনীর অবস্থা শােচনীয়, সে বিষয়ে তিনি একমত হলেন। এখন কী করার আছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, যুদ্ধ।’ কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। যুদ্ধবিরতির জন্য, বললেন তিনি। আমি বুঝলাম, ইয়াহিয়া খানের কথার প্রতিধ্বনি করছেন তিনি।
ওই সময় সেনাশাসকদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছিল যে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ। শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসবে। ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই দুই শক্তিকে কাছাকাছি আনতে তিনি সহযােগিতা করেন। ইয়াহিয়ার মধ্যে এই ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতকে চাপের মধ্যে রাখবেন। একপর্যায়ে ভারত-পাকিস্তান আলােচনার টেবিলে ফিরে যাবে। এরই মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের পর জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর টেলিভিশন ভাষণে ইঙ্গিত দিলেন, তিনি আশা করছেন, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা বন্ধে সাহায্য করবে, সেখানে ভারত ইন্ধন জোগাচ্ছে।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আগে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর ও প্রদেশের সামরিক আইন প্রশাসকের কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পেয়েছিলাম। চিঠিতে তিনি আমার রাজনৈতিক তৎপরতা বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তিনি বললেন, আমার কাজকর্ম (আসন্ন বিপদ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য) নাকি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, আমার কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত করতে সামরিক আইনের অধীনে সরকার তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। ঢাকা থেকে ফিরে এ চিঠির জবাব আমি তাকে দিয়েছিলাম।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার প্রায় কাছাকাছি চলে এল। জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি আগেই ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যােগ দিয়েছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যােগ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হলেন। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ভারতপাকিস্তান বিবাদ নিয়ে আলােচনা হওয়ার কথা ছিল। ৬ ডিসেম্বর ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌছালেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাদে জাতিসংঘের সব দেশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে একমত ছিল। যেহেতু ঢাকার পতন হয়নি, তাই যুদ্ধবিরতিতে ভারতকে রাজি করানাের একটা সুযােগ অন্তত ছিল, যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে ঢাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়।
নিরাপত্তা পরিষদ যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে, তখন বিশ্বনেতাদের জানানাে হলাে, ভুট্টো ঠান্ডাজনিত রােগে আক্রান্ত হয়ে
পৃষ্ঠা: ১৫৬
নিউইয়র্কের একটি হােটেলে আছেন। এমন এক সময় ভুট্টো অসুস্থ হয়ে পড়লেন, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করছে এবং আত্মসমর্পণ তখন প্রায় আসন্ন। সুস্থ হয়ে ভুট্টো ১৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যােগ দিলেন। ততক্ষণে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। তারপরও মনে হয় আত্মসমর্পণ ঠেকানাে সম্ভব ছিল।
কিন্তু আমার কাছে মনে হলাে, নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণ দেওয়ার মতাে যােগ্য হয়ে ওঠেননি ভুট্টো। তার চেয়ে বরং মােচি গেটেই (লাহােরের প্রখ্যাত জনসমাবেশস্থল) তাকে ভালাে মানায়। প্রায় সব দেশ যখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের কথা ভাবছে, তখন তিনি এ ধারণা পুরােপুরি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘প্রয়ােজনে পাকিস্তান হাজার বছর যুদ্ধ করবে।’ এই বলে তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার এ মন্তব্য ছিল আমাদের দুর্বল রাজনৈতিক ভাবনার প্রকাশ। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে তাঁর ভাষণ প্রশংসিত হলাে।
পরদিনই পতন হলাে ঢাকার। রেসকোর্সে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। শত শত বিদেশি টিভি ক্যামেরায় এ দৃশ্য দেখানাে হলাে। বিশ্বের সব বড় বড় সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় শীর্ষ খবর হিসেবে এটি বেরােল। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সেনা কর্মকর্তারা ব্যাপক মানহানির শিকার হলেন। ৯৩ হাজার সৈন্য, বেসামরিক নারী-পুরুষকে পাঠানাে হলাে বন্দিশিবিরে। বিজয়ের পর অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হলাে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হলাে বিহারিরা। ওই বিহারিরা ভারতের নেফা ও বিহার থেকে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল। কিন্তু তারা কখনাে বাঙালি সমাজে নিজেদের এক করতে পারেনি। ভাষা ও জাতিগতভাবে সমস্যার শিকার এই বিহারিরা কখনাে বাঙালি সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টাও করেনি। বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের অন্ধ সমর্থন স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করে তােলে। এ জন্য বিজয়ের পর তাদের প্রতি কোনাে করুণা প্রদর্শন করা হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাই অসংখ্য বিহারিকে খুন করা হয়। এখনাে বিপুলসংখ্যক বিহারি ঢাকায় বিভিন্ন শিবিরে আছে। আমরা এখনাে তাদের স্বীকৃতি দিইনি। অথচ আমরা একসময় তাদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার প্রশংসা করেছিলাম, যখন তাদের সমর্থন আমাদের প্রয়ােজন ছিল।
তবে কেবল বিহারি আর পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও বিশ্বাস করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করবে। চীনও তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু যখন দেখা গেল তেমন কোনাে আশা নেই, তখন সত্যি সত্যিই সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে
পৃষ্ঠা: ১৫৭
হতাশা নেমে আসে। আর ঢাকায় সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রতিক্রিয়া ছিল চরম। সেনাবাহিনীর সব শাখায় ছিল অপমান-অপদস্থ হওয়ার হতাশা। সশস্ত্র বাহিনীর অফিসাররা প্রথমবারের মতাে পুরাে বিষয়টি পরিচালনার ক্ষেত্রে হতাশা প্রকাশ করেন। তবে এই হতাশাগুলাে নিয়ন্ত্রিত উপায়েই প্রকাশ পাচ্ছিল। আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান খান পুনরায় সেনাবাহিনীকে স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আনার প্রচেষ্টা নিলেন। কিন্তু এ সময় তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সেনা কর্মকর্তাদের চাপা ক্ষোভ উপলব্ধি করলেন। এ অবস্থায় তিনি এবং বিমানবাহিনীর প্রধান রহিম খান বিষয়টি নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনা করলেন। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হলেন।
অনুবাদ : কাজী আলিম-উজ-জামান
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান