You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.30 | ১৩ আশ্বিন ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১৩ আশ্বিন ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

-মুক্তিবাহিনী অসম সাহসী যোদ্ধারা দুর্বার গতিতে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী অঞ্চলে ভূরুঙ্গামারীতে গেরিলাযুদ্ধারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে খানসেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে। গত ক’দিনে গেরিলা যোদ্ধারা রৌমারী এলাকায় ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে দখলদার বাহিনীর ১০০ জন সেনা ও রাজাকার নিহত করে। এছাড়া ২০০ রাজাকার গুরুতরভাবে আহত হয়।

-দুটি ব্রিটিশ এওং একটি পোলিশ জাহাজ কোম্পানী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের জাহাজ পাঠাতে অসীকৃতি জানিয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দরে মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণের প্রেক্ষিতে তিনটি বিদেশী জাহাজ কোম্পানী তাদের এ সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়।

-খুলনা, যশোর খণ্ডের পাজিঘাট, কারামারা, পশ্চিমবাগ  ও শ্যামপুকুর গ্রামে পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং ২১ জন খানসেনাকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী মর্টারের ৩টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। সাপ্তাহিক জয় বাংলা (১৯-৯-৭১)

-সিলেট সীমান্ত এলাকায় মনতলা, কামালপুর, জয়পুর ধর্মনগর ও হরেশপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনীর গোলাবর্ষণ।

-ঢাকায় অবসরপ্রাপ্ত এ্যায়র মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাদানের ক্ষমা ঘোষণা করার আবেদন জানিয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম এন এ এবং এম পি এদের অবস্থা যাই হোক আর যেখানেই তারা থাকুন সাধারণ ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করে তাদে সবাই ক্ষময়া এবং স্পপদে পূর্ণহাল করা উচিৎ। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তাদের ক্ষমতায় থাকা উচিত।

-পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহম্মদের সঙ্গে ভারতের নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জে কে গলব্রেথের সঙ্গে সম্প্রতি মুজিব নগরে এক সাক্ষাৎকারে ছবি ছাপা হয়। উল্লেখ্য, ঐ দিন সাপ্তাহিকীটির মুখ্য প্রতিবেধনে জাতিসংঘে বাংলাদেশ দলনেতা হিসাবে খন্দকার মোস্তাকের নাম ছাপা হ্য এবং বক্তব্যে বলা হয় যে, জনাব আহাম্মেদ তাঁর এই সফরে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র  স্বাধীনতাকামী বিশ্বমানবের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা চালাবেন।

-ভারত সোভিয়েত যুক্ত ইশতেহারে রাজনৈতিক সমাধান প্রশ্ন থাকায় “দি ষ্টেটসম্যান” পত্রিকায় আওয়ামী লীগের কতিপয় জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। “কোসিগিনের ভূমিকা এতদিন যাবত পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা যা চেয়ে ছিল তাঁর সঙ্গে সার্থকভাবে মিলে গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।’

-মুজিবনগরস্থ যুবশিবিরের সদর দপ্তর থেকে পরিচালক এস আর মীর্জা পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা যুবশিবিরের জন্য চিকিৎসা ইউনিট প্রেরণ করে। এ ব্যবস্থায় এক হাজার যুব ইউনিটের একমাসের ঔষধ সহ চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল।

-160 Pakistani soldiers including two officers were killed in command raids during the last four days.(সংবাদপত্র)

-সোভিয়েত ইউনিয়ন সকারের এক বিবৃতি জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রশ্নে তীব্র সমালোচনা করা হয়। (কে সি এ পৃঃ ২৪৯৯১)

-সেপ্টম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ইসলামাবাদের পরিকল্পনা মোতাবেক লেঃ জেঃ নিয়াজি তাঁর গোটা সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলেন। সীমান্তের বড় বড় সড়কের উপর অসংখ্য ব্যাংকার তৈরি করল পাকসেনারা এবং প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটির মুখোমুখি ভারী কামান ও ট্যাংকসহ পাক সেনাবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশ পাকসেনাবাহিনীর প্রায় ৪২ টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন। ৩৫ টি ব্যাটালিয়ন পাকসেনা এবং ৭ ব্যাটিলিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানী রেঞ্জার। আধা সামরিকদের মধ্যে ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোরর্সের ১৭টা উইংগ এবং ৫ উইংগ মোজাহের অর্থাৎ মোট নিয়মিত সৈন্য প্রায় ৪০,০০০ এবং আধা সামরিক বাহিনীতে প্রায় ২৪,২০০ লোক। ২৪,০০০ ইণ্ডিষ্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স ছিল। সৈন্য ছিল মাত্র ৪২ ব্যাটালিয়ন। কিন্তু নামে ডিভিশন ছিল চারটা ১৪,৩৯,৯ ও ১৬। এছাড়াও ৩৯ নং ডিভিশন নামে আর একটা ডিভিশন ছিল মেজর জেনারেল জামসেদের অধীনে। আধা-সৈনিকরা এই ডিভিশানের আওতাধীন ছিল। এভাবে সৈন্য সাজিয়ে লেঃ জেঃ নিয়াজী বেশ একটু পরিতৃপ্ত হলেন।

-ডাঃ কিসিঞ্জারের গ্রন্থ প্রবাসী বাঙালী নেতাদের সাথে গোপন যোগাযোগ সম্পর্কিত অংশে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক। নিন্মে কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করা হ’লঃ- “৩০ জুলাই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ মিঃকাইয়ুম (সম্ভবতঃ মিঃ কাইয়ুম হলে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহিরুল কাইয়ুম) কলকাতাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটে আসেন এবং তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি আবার দু’সপ্তাহ পরে উত্তরের জন্য আসবেন এ কথা চলে আসেন। মার্কিন কনস্যুলেট এ খবর পররাষ্ট্র দফতরে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়। এ ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তাই বিবেচনা করেও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সম্মতি নিয়ে ডঃ কিসিঞ্জার মিঃ কাইয়ুমের সাথে মার্কিন  কনস্যুলেটের যোগাযোগের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন এবং পাকিস্তানী সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতায় আসার ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখার জন্য বলা হয়।

-নির্দিষ্ট দিন অর্থাৎ ১৪ই আগষ্ট মিঃ কাইয়ুম আবার মার্কিন কনস্যুলেটে আসেন। তিনি বলেন যে, মুজিবকে আলোচনায় অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হলে এবং ইসলামাবাদ যদি আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেয় তাহলে তাঁর গ্রুপ পূর্ণ স্বাধীনতার নীচে নেমে এসেও সমঝোতায় পৌঁছেতে পারে।

-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রচেষ্টাকে উৎশাহ দেয়া দরকার বলেও মিঃ কাইয়ুম অভিমত ব্যক্ত করে। এই বৈঠকের কয়েক দিন পর এসে মিঃ কাইয়ুম এ মত প্রকাশ করে যে ভারত একবার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলে এই ধরনের সমঝোতামূলক প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

-এই পর্যায়ে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে সামরিক শাসনকর্তা ইয়াহিয়া খানকেও গোপনে সংযোগের কথা জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পররাষ্ট্র বিভাগ ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূট জোসেফ ফারল্যাণ্ড ইয়াহিয়া খানকে এই যোগাযোগ এবং ছয় দফার ভিত্তিতে সমঝোতার সম্ভাবনার কথা জানানোর নির্দেশ প্রদান করে।

এ যোগাযোগের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার আশ্চ্যর্যজনক অনুকূল প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় বলে কিসিঞ্জারের গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াহিয়া এই ধরনের যোগাযোগকে অভিনন্দিত করে এবং তাকে এ ব্যাপারে অবগত রাখার অনুরোধ জানায়। উপরন্তু, তাঁর সকারের সাথে প্রবাসী বাঙালী নেতাদে গোপন যোগাযোগের ব্যাপারে মার্কিন উদ্যোগের প্রস্তাবে ইয়াহিয়া খান সম্মতি প্রদান করেন।

-২৭ আগষ্ট মিঃ কাইয়ুম যখন দ্রুত যোগাযোগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাস করে তখন মার্কিন কতৃপক্ষ আরও এক ধাপ অগ্রসর  হয়ে যায়। ৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রদূত ফারল্যাণ্ড ইয়াহিয়াকে তাদের (মার্কিন যক্তরাষ্ট্র) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (খন্দকার মোশতাক আহমেদের) সাথে যোগাযোগ এবং গোপন আলোচনার প্রশ্নে মতামত গ্রহণ করে। ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাবে রাজী হয়।

-এই সময়ে ইয়াহিয়া খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য প্রস্তাবও মেনে নেয়। ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গণধিকৃত সামরিক শাসনকর্তার (জেনারেল টিক্কা খান) স্থলে বেসামরিক গভর্ণর নিয়োগ করা হয়। ৫ই সেপ্টম্বর দেশত্যাগকারী সকলকে (শুধুমাত্র যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে) সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়।

-৯ সেপ্টেম্বর কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল কাইয়ুমের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাথে বৈঠকের ব্যবস্থার কথা বলে। ১৪ সেপ্টেম্বর মিঃ কাইয়ুম তাদের বলে যে, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রী’। এ ধরনের বৈঠকের বিশেষ প্রয়োজনীতা দেখতে পাচ্ছেন না। তবে ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অনাগ্রহের কারণ সম্পর্কে ভারতীয় সরকারের গোয়েন্দা তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়।

-২১ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রদূত ফারল্যাণ্ডের কাছ থেকে কলকাতার গোপন যোগাযোগ সম্পর্কে জানতে চান। এ অবস্তায় ফারল্যণ্ড উৎসাহী হয়ে বাংলাদেশের ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রী’র সাথে বৈঠক সম্ভব না হলে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে মার্কিন কনস্যুলের সাক্ষাৎতের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার কাছে থেকে অনুমতি প্রার্থনা করেন।

-২৩ সেপ্টেম্বর মিঃ কাইয়ুম একজন প্রতিনিধি মার্কিন কন্সাল নিকট প্রেরণ করে ও বার্তা পৌঁছে দেয় যে, ভারত সরকার তাদের সাথে (মার্কিন কন্সাল) তাঁর যোগাযগের কথা জেনে গেছে। মার্কিন কন্সাল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থার কথা প্রস্তাব করে। এর কিছু দিন পরে মিঃ কাইয়ুম আবার উপস্থিত হয়ে একই কথা বলে।

-এই গোপন যোগাযোগের বিষয়টি ভারতের নজরে আসায় সমস্ত ব্যাপারটি সামাল দেয়াড় জন্য ২৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাঁকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে শর্তহীনভাবে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এর জবাবে যে কোন আলোচনায় শেখ মুজিবের অংশগ্রহণ এবং তা স্বাধীনতার প্রদানের লক্ষ্যেই হতে হবে বলে প্রকাশ করেন।

-২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলকাতাস্থ মার্কিন কন্স্যুলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি বাঙালী জনগণের আকাঙ্খা পূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের কথা বলেন। মিঃ কাইয়ুম ৩রা অক্টোবর আরও বিস্তৃৎ আকাঙ্খা নিয়ে তাদের সাথে দেখা করেন। ১৬ অক্টোবর মিঃ কাইয়ুম ভারতের আপত্তির কথা তুলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে মার্কিন কন্স্যুলের বৈঠকে সম্ভাবনার কথা বাতিল করা দেন।

-ডঃ কিসিঞ্জারের মতে এভাবেই পাকিস্তান সরকার ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আলোচনায় উৎসাহ দানের প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যায়। (সচিত্র সন্ধানী/আশরাফ লতিফ ২৬.৭.৮৩)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী