রাজধানী/রাজনীতি চীনের সঙ্গে বােঝাপড়ার এখনই সময়
–খগেন দে সরকার
অবশেষে শ্ৰীমতী গান্ধী চীনের প্রধামন্ত্রী শ্রী চৌ এন-লাইয়ের কাছে তার সরকারের পক্ষ থেকে বার্তা পাঠিয়েছেন। ও পক্ষ এখনাে কোন জবাব দেয়নি। কিন্তু আকস্মিক হলেও, চীন ইতিমধ্যেই একটি আফরােএশীয় কমিটির পক্ষ থেকে ভারতীয় দলকে পিং পং খেলতে পিকিং যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। | এই শক্তিশালী এবং বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে ১৯৬২ সালের সংঘর্ষের পর থেকেই কূটনীতিক সম্পর্কে অচল অবস্থা দেখা দিয়েছিল। শ্রীমতী গান্ধীর পূর্ববর্তী দুই প্রধানমন্ত্রী-শ্রীনেহরু এবং শ্রীশাস্ত্রীর কেউই এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। কিন্তু শ্রীমতী গান্ধী যথেষ্ট সাহসিকতা সহ বরফ গলাতে পেরেছেন। যে যাই বলুক না কেন, এটা তার পক্ষে কম কৃতিত্বের কথা নয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তােলার প্রয়াসে শ্রীমতী গান্ধী দেশের অধিকাংশ মানুষকেই তার। অনুকুলে পাবেন বলেই মনে হয়। বামপন্থী দলগুলিরই অধিকাংশ এ ব্যাপারে তাকে সমর্থন করবে; করবে তার নিজ দলও। যারা করবে না তাদের সংখ্যা এবং শক্তি এতই নগণ্য যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাদের কথায়। কান না দিলেও কিছু আসবে যাবে না।
এ বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল জানার পর থেকেই শ্রীমতী গান্ধীর শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছে। সংসদের প্রায় ৫২০ জন সদস্যের মধ্যে ৩৫১ জনই এখন তাঁর দলের। তার চেয়েও বড় কথা ঃ শ্রীমতী গান্ধীর চেষ্টার ফলেই নব কংগ্রেস সত্যিকারের একটি রাজনীতিক দলের চরিত্র পেয়েছে–আগের মতাে সেটা এখন আর শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযােগশূন্য সুযােগ সন্ধানীদের দল মাত্র নয় । তার পিতার সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধীর মৌলিক আদর্শগত কিছু সাদৃশ্য থাকলেও দু-জনে আসলে পৃথক। শ্ৰীনেহরুর আমলেও সংসদে কংগ্রেস দলের স্বস্তিজনক গরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৫৭ সালে লােকসভায় কংগ্রেস সদস্যের সংখ্যা ছিল ৩৭৯; ১৯৬২ সালে ছিল ৩৫৮। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শ্রীনেহরুর উতুঙ্গ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও সেদিন কী ঘটেছিল? শ্রীমতী গান্ধী নিজেই একদা বলেছেন—শেষের দিকে। শ্রীনেহরুকে এক ধরনের বিষন্নতায় পেয়ে বসেছিল সেই বিষন্ন, মর্মাহত নেতা ক্রমেই নিজ দলের দক্ষিণপন্থীদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতের কথা শ্রীমতী গান্ধীর চেয়ে ভালাে করে কেউ জানেন না। সুতরাং চীনের সঙ্গে সত্যিই যদি তিনি সু-সম্পর্ক চান, তাহলে তাঁকে সূত্রটি নিয়ত ধরে থাকতে হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছিল এক যুগ আগে-১৯৫৮ সাল থেকে। ক্ষতটা। বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৫৯ সালে মার্চ মাসে তিব্বতের খামপা বিদ্রোহের সময় থেকে। ঐ বছর ৩১ মার্চ চীন অভিযােগ করে ভারতের কালিমপং শহরটি আসলে নাকি চীন-বিরােধী চক্রান্তেরই এক বিরাট খুঁটি। প্রসঙ্গত মনে পড়েঃ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সেদিন চীনের এই অভিযোেগ সত্য বলেই গ্রহণ করেছিল। তাই নিয়ে লােকসভায়ও বেশ এক চোট হৈ হট্টগােল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৯ সালের ৬ এপ্রিল শ্ৰীনেহরু নিজেই এক সাংবাদিক বৈঠকে স্বীকার করেন যে তিব্বতের ব্যাপারে সংসদে তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
দালাই লামা ভারতে পালিয়ে আসেন ৩১ মার্চ তারিখে। খবরটা প্রথম প্রচার করে চীনা সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান সিনহুয়া; পরের দিন শ্রীনেহরুও অনুরূপ ঘােষণা করেন। সেই থেকেই ভারত-চীন সম্পর্ক দ্রুত উত্রাইয়ের দিকে গড়াতে থাকে। একের পর এক ঘটনা সম্পর্কের মােড় ফেরাতে থাকে; কিন্তু ভারতীয় নেতারা সেদিন তা রােধ করতে সক্ষম হননি। ২৫ আগস্ট শ্রীনেহরু সংসদে ঘােষণা করেন-ভারতকে না জানিয়ে চীন বছর খানেক আগে আকসাইচীনে একটি রাস্তা বানিয়েছে। তিনদিন পর-২৮ আগস্ট-তিনি সংসদে জানালেন ঃ চীনারা নেফা এর লাদাকে হঠাৎ আক্রমণ শুরু করেছে। সংসদের দুই কক্ষই ক্রোধে ফেটে পড়ে। এর ফলে দল হিসাবে কংগ্রেস আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্রমশই সে দক্ষিণপন্থী বিরােধী দলগুলির দিকে ঝুঁকতে থাকে। ও দিকে বছর দুয়েক ধরে ১৯৬২-এর ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বােঝাপড়ার সর্বশেষ প্রস্তাব এসেছিল ১৯৬২ সালের ২৪ অক্টোবর শ্রীনেহরু সে দিনই সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। অনেক দিন কেটে যাওয়ার পর শ্রীমতী গান্ধী সেই ‘বােঝাপড়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি চীনের মতিগতি লক্ষ্য করে আসছিলেন। সংযােগ গড়ে তােলা হয়েছিল হ্যানয়, পিকিং মসকো কায়রাে এবং প্যারিসের সঙ্গে। তাছাড়া শ্রীমতী গান্ধীর পক্ষে অপেক্ষা না করে উপায় ছিল না। কারণ নিজ দলে তীর শক্তি সুদৃঢ় এবং সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের কোন প্রয়াসে তিনি উদ্যোগী হতে পারছিলেন না।
নিজ দলে তথা সরকারের নিজের অবস্থা সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়ে তবেই শ্রীমতী গান্ধী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। সুতরাং পিকিং বা অন্য কারাে মনে তার মনােভাব সম্পর্কে আর সংশয়। থাকার কারণ নেই। শ্রী চৌ এন-লাইয়ের কাছে লেখা চিঠিতে শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সমস্যা এবং তজ্জনিত উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়েই ও পক্ষের অনুকুল মনােভাব জাগাতে চেয়েছেন। তা ছাড়া যথাযােগ্য পর্যায়ে আলােচনায় বসার বাসনাও তিনি প্রকাশ করেছেন। ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারত এবং চীন-দুটি দেশই আর্থিক এবং সামরিক শক্তির দিক থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। ভারত আগের চেয়ে অনেক শক্তিমান হয়ে উঠেছে। অপর দিকে, চীনও পারমাণবিক শক্তি-গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাছাড়া চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডামাডােল সংযত করে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি, বাংলাদেশের ঘটনাবলী-ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে বােঝাপড়া করাটা ভারতের পক্ষেই বেশি দরকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শ্রীমতী গান্ধীই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ায় বিস্ময়ের কিছুই নেই। সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের ফলে ভারতেরও মনের জোর অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। তবে ভারত-রুশ চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রায় মাসখানেক আগেই শ্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে শ্রীমতী গান্ধীর চিঠি পাঠানাে হয়েছিল। সােভিয়েত ইউনিয়নকে অবশ্য প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাখা হয়েছে। সুতরাং চীনের সঙ্গে সমঝােতা প্রয়াসের সঙ্গে ভারত-রুশ চুক্তির প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের সংঘর্ষ ঘটার কারণ নেই। প্রশ্ন হল এ ব্যাপারে ভারত কতটা এগুবে; তার চেয়েও বড় কথা-চেয়ারম্যান মাও এ ব্যাপারে কতটা সাড়া দেবেন।
ভারতের দুই বিজ্ঞ কূটনীতিক শ্রীশেলভাঙ্কার এবং শ্রী ডি পি ধর কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছেন। বােধহয় পিকিং-এর কাছ থেকে কিছু অনুকূল সাড়া না পেয়ে শ্রীমতী গান্ধী শ্রী চৌ এন-লাইয়ের কাছে চিঠি লেখেননি। আজ শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্ব অবিসংবাদিত/নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এখন আর কাউকে তাঁর তুষ্ট করে চলার দরকার নেই। সুতরাং শ্রীমতী গান্ধী এখন স্বচ্ছন্দেই নয়দিল্লীর চৈনিক দূতাবাসের প্রতি কিছু বন্ধুত্বের নিদর্শন দেখাতে পারেন। ঐ দূতাবাসের সামনে থেকে পুলিশের শিবিরটি তুলে দেওয়ার পক্ষে নিশ্চয়ই কোন দুস্তর বাধা নেই। তাছাড়া তিনি পিকিং-এ আমাদের শারজে-দ্য-অ্যাফয়ারসের পরিবর্তে একজন অ্যামবাসাডর পাঠাতে পারেন। পিকিং আগে তা নাই বা করল। ভারত এ ব্যাপারে প্রথমে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ক্ষতি হওয়ার কিছু নেই। এ সবের দ্বারা সীমান্ত বিরােধ সংক্রান্ত আলােচনার পথ প্রস্তুত হতে পারবে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার শ্রীজেমস রেস্টন কিছু দিন আগে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের কথা তুললে চীনের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত বিরােধের বিষয়টিই উল্লেখ করেছিলেন। শ্রীমতী গান্ধী যদি এখন ভারতকে অচল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে না পারেন, তাহলে অন্তত আগামী এক দশকের মধ্যে সে কাজ সম্পন্ন করার মতাে কাউকে আমরা পাবাে বলে মনে হয় না।
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা