রাজ্য ও রাজনীতি বাংলাদেশ সমস্যা ক্রমেই জটিল হচ্ছে
–বরুণ সেনগুপ্ত
সাধারণ মানুষ যত বেশী আশা করছেন, এবার বােধহয় বাংলাদেশ সমস্যার একটা কোনও সমাধান হবে ততই যেন বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান দুরে সরে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ যত বেশি করে চাইছেন বাংলাদেশ সমস্যাটা সহজ হয়ে আসুক, তার একটা কোনও সুরাহা হােক ততই সে গােটা ব্যাপারটা জটিল। হয়ে উঠছে। অকারণ হােক, সাধারণ হােক একটা আশা জেগেছিল বেশ কিছু লােকের মনে যে ভারত সরকার বােধ হয় নয়ই আগস্ট বাংলাদেশে সম্পর্কে একটা বড় কিছু সিদ্ধান্ত ঘােষণা করবেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, ওইদিন রাজধানীতে বিরাট জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন। কিন্তু তা হল না। তার বদলে ওইদিন মানুষ জানতে পারলেন যে রুশ-ভারত চুক্তির নাটকীয় সংবাদ। সন্দেহ নেই, এই সংবাদ দেশের সাধারণ মানুষের একটা বিরাট অংশকে বিশেষ উৎসাহিত করেছে। তারা অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এর ফলে ভারতের শক্তি বাড়ল ছােট বড় বিভিন্ন রাষ্ট্রের শত্রুতার মুখে রুখে। দাড়াবার মত অবস্থা হল। তারা এই সঙ্গে সঙ্গেই ধরে নিলেন যে, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সরকারের দৃঢ়তর সিদ্ধান্ত নেবারও সুযােগ এল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছে না। গ্রামিকোর সফরান্তে যে ভারত-রুশ যৌথ ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশের ব্যাপারে যে কথাগুলি বলা হয়েছে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা মােটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বাংলাদেশ সমস্যাটাকে যেভাবে দেখেন, যেভাবে তার সমাধান চান, যে বাংলাদেশ তারা কল্পনা করেন তার সঙ্গে যৌথ ইস্তাহারে ঘােষিত বক্তব্যের মিল খুব সামান্যই। বরং যৌথ ইস্তাহারের ঘােষণা থেকে সামনে হওয়া স্বাভাবিক তাহল, বাংলাদেশ সমস্যার কোনও সন্তোষজনক সমাধান সুদূর পরাহত। এর উপর ঠিক একই সময় এসেছে শেখ মুজিবরের বিচারের প্রহসন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের আচার আচরণ দেখে মনে হয় তারা মুজিবরকে খুন করতে বদ্ধপরিকর। এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। কারণ, এ থেকে পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনও ভাবে কোনও রক্ষা করতে রাজি নয়। ভারত-রুশ যৌথ ইস্তাহারে কিন্তু ওই রফার প্রস্তাবের উপরেই গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে।
(১) সামরিক সমাধান নয়; (২) রাজনৈতিক সমাধান চাই; এবং (৩) ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদ অবস্থায় দেশে ফেরার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। যুক্ত ইস্তাহারে আরও বলা হয়েছে শুধু তাহলেই ‘পাকিস্তান সমগ্র জনসাধারণের স্বার্থ এবং এই এলাকার শান্তি সুরক্ষিত হবে।’ এই বক্তব্যের সামগ্রিক শুরুটাই হলাে রফা অর্থাৎ আপসে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান- যে সমাধান সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই মেনে নেবেন। | কিন্তু মূল প্রশ্নটাই হল, তা হতে পারে কিনা? অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ বুদ্ধি বলে, তা হতে পারে না। গত সাড়ে চার মাসে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বারবার পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, তা হতে পারে না। এখনও তারা সেই কথাই বলছে। এখনও তারা যেভাবে মুজিবর রহমানকে খুন করতে এগোচ্ছে, যেভাবে পূর্ববাংলার নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালাচ্ছে, তাতে এটা সকলের কাছেই পরিষ্কার হওয়া উচিৎ যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনও আপস করায় রাজি নয়। যুক্ত ইস্তহারে বলা হয়েছে, সামরিক সমাধান নয়, রাজনৈতিক সমাধান চাই। পাকিস্তান সরকারের কোন রাজনৈতিক সমাধানে রাজি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে কি ভারত এবং রুশ সরকার বিশ্বাস করেন? পাকিস্তান সরকার তাে গত সাড়ে চার মাস একমাত্র সামরিক সমাধানের চেষ্টাই করেছেন। সৈন্য দিয়ে পিটিয়ে অত্যাচার করে, খুন করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে কিভাবে পাকিস্তানের শাসকরা সচেষ্ট সেটা তাে বিশ্বের প্রায় সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। তাহলে রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা কোথায়? এর আরও একটা দিক আছে। পূর্ববাংলার গত চার মাসে পাকিস্তানের শাসকচক্র যা করেছেন তারপর বাংলাদেশের কোনও নেতার পক্ষেও তাঁদের দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতে সম্মত হওয়া অসম্ভব। কেউ যদি অন্য কিছুতে রাজি হন তাহলে বাংলাদেশের বহু মানুষ এবং মুক্তি ফৌজের একটা বড় অংশ। তাদের পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। আবার এত ঘটনার পর পশ্চিম পাকিস্তানের কোনও নেতার পক্ষেও আওয়ামী লীগের সে পুরনাে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যদি কেউ তা করতে যান তাহলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং উগ্রপন্থীরা সেই নেতাকে গদীচ্যুত করবেনই। পুর্ববাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা মেনে নেওয়া তাে দূরের কথা, পূর্ববাংলাকে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার কথাও কোনও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা এখন মুখে আনবেন না। তাই, বাংলাদেশের প্রশ্নে কোনও রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব।
যুক্ত বিবৃতির একটা অংশে বলা হয়েছে; রাজনৈতিক সমাধান হলেই, পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ, অন্তত জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ কি মনে করে যে পূর্ববাংলা পূর্ণ বা আংশিক স্বাধীনতা পেলে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে? তাছাড়া, পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণ’ কথাটার মধ্যে এইটাই মেনে নেওয়া হয়েছে যে পূর্ববাংলাও পাকিস্তানেরই অঙ্গ, পূর্ববাংলার মানুষও পাকিস্তানের জনসাধারণ। সেইটাই কি ভারত সরকারের বক্তব্য? তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকে কোথায়? বাংলাদেশের মানুষ কি মনে করেন যে তাঁরাও পাকিস্তানেরই জনসাধারণ। যে যাই মনে করুন, এ কথাটা বাস্তব সত্য যে পশ্চিম পাকিস্তানের বহু মানুষকে পাকিস্তানের সমর। নায়করা বােঝাতে পেরেছেন যে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যােদ্ধারা পাকিস্তানের শত্রু। আর এ ব্যাপারে তাদের সাফল্য শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ নয়। গােটা মুসলিম দুনিয়ার, এমন কি ভারতেরও অনেকের মধ্যে পাকিস্তানের নায়করা এই ধারণাটা বদ্ধমূল করিয়ে দিতে পেরেছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘােরতর ইসলাম বিরােধী কাজ।
যুক্ত বিবৃতির আর একটা উল্লেখযােগ্য বক্তব্য হল যে, শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে ফেরার পরিস্থিতি। সৃষ্টি করতে হবে। রুশ এবং ভারত সরকার কি মনে করেন যে যতদিন পূর্ববাংলায় পাক কর্তাদের খবরদারীর। সামান্য অধিকারও থাকছে ততদিন হিন্দু শরণার্থীরা আর ওদেশে ফিরে যাবেন? এটা সাম্প্রদায়িক জিগির নয়, বাস্তব সত্য, পূর্ববাংলা থেকে এই যাত্রায় ভারতে ৭০ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন তার প্রায় ৬০ লক্ষই হিন্দু। তারা যদি ফিরে না যেতে পারেন তাহলে কি ভারতে শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্ভব? আমি বলছি না, ভারত এখনই বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই শুরু করুক। আমি শুধু বলতে চাই, যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হচ্ছে সেটা অবাস্তব এবং অসম্ভব। তা হবে না, হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি মাত্র পথ খােলা হয় পাকিস্তানের সমরনায়কেরা জিতবে, না হয় বাংলাদেশের। মুক্তিযােদ্ধারা জিতবেন। পরিস্থিতি যা, তাতে মাঝামাঝি কোনও পথ নেই।
বড় বড় বেশ কয়েকটা রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে। আমেরিকা এবং চীন প্রকাশ্যেই পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র । দিয়ে সাহায্য করছে। গােপনে আরও কেউ কেউ এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চীন আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা বড় তফাৎ আছে। চীন এক্ষেত্রে খােলাখুলি ভাবে পাকিস্তানের শাসকদের সমর্থক। আমেরিকার শাসকরা এ ব্যাপারে খােলাখুলি ভাবে পাকিস্তানের সমর নায়কদের সমর্থক নয়, কিন্তু কার্যত পুরােপুরি তাদের পক্ষে। রাশিয়া প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, আবার বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে নয়, কিন্তু আমেরিকা এবং রাশিয়া দুজনেই মূলত মনে করে, বাপারটা পাকিস্তানের নিজস্ব। রাশিয়া এবং আমেরিকা যদি একযােগে ইয়াহিয়া খার উপর শক্তচাপ দেয় তাহলে সে তার বাংলাদেশনীতি পালটাতে বাধ্য, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা মুজিবকে হত্যা করতে সাহস। পাবেনা । কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা কি করবে? এখনও পর্যন্ত কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ দেখবেন এই রাশিয়া এবং আমেরিকা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানকে অলটিমেটাম দেবে যদি তারা দেখে যে ইয়াহিয়া খা করাচী এবং চট্টগ্রাম বন্দর চীনকে ইজারা দিয়ে দিচ্ছে। তখন কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের “লজ্জা” আর থাকবে না? “লজ্জাও” আর থাকবে না।
১৩ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা