মুজিবের ভাগ্যনির্ধারক ঘাতক ইয়াহিয়া নয়
— শংকর ঘােষ
পাকিস্তানের জঙ্গীনায়ক, বীর ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেছেন, দেশ ও জাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে শেখ মুজিবর রহমানের শীঘ্রই বিচার হবে এবং আগামী অক্টোবর মাসে যখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে তখন মুজিব বেঁচে থাকবেন কিনা তা তিনি বলতে পারেন না। তার এই উক্তির কারণ হিসাবে ইয়াহিয়া খান বলেছেন, মুজিবের ভাগ্য এখন সামরিক ন্যায়বিচারের” উপর নির্ভর করছে। ইয়াহিয়া খান যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতেন, যদি সভ্যশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনও পরিচয় থাকত, তা হলে “সামরিক ন্যায়বিচার” কথাটি ব্যবহারে তিনি দ্বিধাবােধ করতেন। বিচার ন্যায় বা অন্যায় হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারের রকমফের সম্ভব নয়। বিশেষণ ভূষিত ন্যায়বিচার অবিচারের নামান্তর, ন্যায়বিচারের প্রহসনমাত্র। ইয়াহিয়া খান অবশ্য গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন, যদিও পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ ও সবচেয়ে বড় জনগণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় মিতালী এবং প্রয়ােজনমত এই দুই বন্ধু দেশের মধ্যে তিনি দূতিয়ালিও করে থাকবেন। তাই শুধু সামরিক ন্যায় বিচারের উল্লেখ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সঙ্গে সঙ্গে সেই ন্যায়বিচারের ফল কী হবে তার ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। পাকিস্তানে জঙ্গীশাসনের সমস্ত ক্ষমতার। উৎস ইয়াহিয়া খান স্বয়ং। সামরিক আদালত তারই বা তার বশংবদ নিম্নতম কোনও সামরিক অফিসারের নির্দেশে গঠিত হবে এবং সে আদালতের বিচার পদ্ধতিও সামরিক শাসকরাই স্থির করে দেবেন। ইয়াহিয়া খানের আজকের সদর্প উক্তিকে যদি সেই ভাবী সামরিক আদালত নির্দেশ বলে মেনে নেয় তা। হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বস্তুত তার বিপরীত কিছু হওয়াটাই আশ্চর্যকর হবে। কারণ জঙ্গীশাসন এমনই একরােখা যে, সামরিক আদালতের রায় যদি তার মনােমত না হয় তা হলে বিচারকদেরই সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। সামরিক আদালত জঙ্গী শাসন নিরপেক্ষ নয়, তার প্রত্যঙ্গ মাত্র। সুতরাং ইয়াহিয়া খান মুজিবের শাস্তি সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং সে-শাস্তি কার্যে পরিণত করার জন্য।
যে সময় বেঁধে দিয়েছেন তার অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম। যাতে তার হুকুমত বিচার হয়, সেই জন্যই তাে ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতে মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। না হলে পাকিস্তানে বেসামরিক আদালত এখনও আছে; ইয়াহিয়া খানের দাবিমত বাংলাদেশে যদি সত্যই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসে থাকে, তাহলে সেখানেও আইন-আদালতের কাজ শুরু হয়েছে। মুজিবও কিন্তু সামরিকবাহিনীর বেতনভুক নন। স্বাভাবিক নিয়মে তার বিচার অসামরিক আদালতেই হওয়া উচিত ছিল। মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযােগ বিশ্বাসঘাতকতার, পাকিস্তানের যে জঙ্গীশাসকরা এক সময় সগর্বে ঘােষণা করেছিলেন, স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইয়াহিয়া খান জঙ্গীশাসনের ইতিহাসে একটি নজির স্থাপন করলেন। তারাই এখন বলছেন, তাঁদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি এবং সেই নির্বাচনের ফল গ্রাহ্য নয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং জনসাধারণের রায় বরবাদ করার জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়ােগ করে ইয়াহিয়া খান শুধু বাংলাদেশের নয় সমস্ত পাকিস্তানের জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। | ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মুজিবের সঙ্গেও। আওয়ামী লীগ ও অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ছােট-বড় অনেক নেতাই যখন বাংলাদেশে জঙ্গীশাসনের জাল থেকে বেরিয়ে নিরাপদে রয়েছেন তখন মুজিবের পক্ষেও তা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের জনসাধারণ যাকে তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করেছেন তাকে জঙ্গীশাসন গ্রেফতার করবে না।
তিনি মনে করেছিলেন, যে-জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই জনগণের অভিমতকে ইয়াহিয়া খান উচিত মর্যাদা দেবেন। ঢাকায় জঙ্গী বর্বরতা শুরু হওয়ার পরেও মুজিব ইয়াহিয়া খানের উপর একেবারে বিশ্বাস হারাননি; তখনও তাঁর পক্ষে আত্মগােপন সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি ধানমণ্ডির বাড়িতে ইয়াহিয়া খানের বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হয়তাে ভেবেছিলেন ইয়াহিয়া খানের এই উন্মত্ততা সাময়িক। কয়েকদিনের মধ্যেই এই অকারণ গণহত্যায় তাঁর বিতৃষ্ণা আসবে এবং তখন তিনি একটি রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহী হবেন। সেই সমাধান যাতে সম্ভব হয়, যাতে ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে আলােচনায় সক্ষম হন সেজন্যই সম্ভবত মুজিব স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া এ বিশ্বাসের মর্যাদা। রাখেননি। এপরিল মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদস্থ এক অফিসার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, শেখ মুজিবর রহমান। যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন সে সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহ। তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করেছে, বাংলােেশর অবস্থা কিছু শান্ত হলে তখন ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করবেন যে, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে সামরিক আদালতে মুজিবের বিচার হয়েছিল এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, এবং সে-দণ্ড ইতিমধ্যে কার্যকরও হয়েছে। এখন অবশ্য এটি স্পষ্ট যে, মুজিবকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করা হয়নি। হয়ত ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারেননি মুজিবের জনপ্রিয়তা কত গভীর। হয়তাে তিনি ভেবেছিলেন, মুজিবকে যদি কিছুদিন লােকচক্ষুর আড়ালে রাখা যায়, যদি বাংলাদেশের জনসাধারণ মুজিবের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে কিছুদিন বঞ্চিত থাকেন তাহলে তারা ইয়াহিয়া খানের বিধানকে মেনে নেবেন। তখনকার নিঃশেষিত শক্তি মুজিব সম্বন্ধে ধীরে সুস্থে তার কর্তব্য তিনি স্থির করবেন।
গত সাড়ে চার মাসে প্রমাণ হয়েছে ইয়াহিয়া খানের সে ধারণা ভুল। বাংলাদেশের জনসাধারণ মুজিবকে ভােলেনি। যে-অভিযান তিনদিনে শেষ হবে বলে ইয়াহিয়া খান আশা করেছিলেন তা আজও শেষ হয়নি, শেষ হওয়ার কোন লক্ষণই নেই। অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের যুদ্ধ ভিয়েতনামের যুদ্ধের মতােই দীর্ঘস্থায়ী হবে। বাংলাদেশের সাধারণ লােক মুজিবের নির্দেশ অনুসরণ করে আজও সেখানে শাসন ব্যবস্থা অচল করে রেখেছে; হানাদার বাহিনীকে আজও ভাতে মারছে, পানিতে মারছে, আর নির্ভয়, দৃঢ়চিত্ত যুববাহিনীর সশস্ত্র আঘাতে ইয়াহিয়া খানের বেতনভুক সেনাবাহিনী ক্রমশ শঙ্কিত, হতাশ হয়ে পড়ছে। মুজিবের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য আজ যারা এগিয়ে আসছেন তাঁদের অনেকেই ইতােপুর্বে তার দলভুক্ত ছিলেন না; রাজনীতি ক্ষেত্রে হয়ত অনেকে তার বিরােধীও ছিলেন। কিন্তু তাঁর ও তাঁর দলের প্রতি যে পর্বতপ্রমাণ অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিবাদে তার বিরােধীরাও আজ তাঁর সমর্থক। বন্দিত্বে মুজিবের জনপ্রিয়তা হ্রাস হয়নি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আজ সত্যই বাংলাদেশের জনগণমন-অধিনায়ক, তার নির্দেশ পালনের দুর্বার সংকল্পে বংলাদেশের শােষিত জনসাধারণ আজ অটল। | তাই ইয়াহিয়া খান আজ তার শেষ অস্ত্র হানতে উদ্যত । তিনি মনে করছেন, মুজিবকে হত্যা করলে হয়ত বাংলাদেশকে আয়ত্বে আনতে পারবেন। ভবিষ্যতেও যদি মুজিবের নেতৃত্বদানের কোন আশা না থাকে, তা হলে হয়ত বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। তার অন্য অনেক আশার মতােই ইয়াহিয়ার এ আশাও অপূর্ণ থাকবে। লােকচক্ষুর অন্তরালে থেকেও যদি মুজিব বাংলাদেশের জনসাধারণের বীরত্ব ও শৌর্যের উৎস থাকতে পারেন তাহলে তার স্মৃতিও বাংলাদেশের এই জীবন-পণ সংগ্রামকে জয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই পরিস্থিতির উদ্ভব কেন হবে? ইয়াহিয়া খান যে-নারকীয় পন্থা অবলম্বনে উদ্যত হয়েছেন তার। নজির ইতিহাসে নেই। দেশপ্রেমের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া নতুন নয়। প্রত্যেক দেশের ইতিহাসই এই রকমের একাধিক ঘটনায় কলঙ্কিত। যারা পরে দেশপ্রেমিক বলে স্বীকৃত হয়েছেন, তাদের এখন শ্রদ্ধার। সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
কিন্তু তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন বিদেশী শাসকের আদালতে, তাদের বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছিল শােষক সরকার। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তে আর একবার প্রমাণ হল বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ছাড়া আর কিছু নয় । ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের যেভাব যুগ যুগ ধরে। বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, ঠিক সেইভাবেই বাংলাদেশের মুজিবকে পশ্চিম। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার হত্যায় উদ্যত। অথচ মুজিবের ক্ষেত্রে এ-নজিরও প্রযােজ্য নয়। তার দাবির পিছনে কী বিপুল জনসমর্থন আছে তার প্রমাণ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পাওয়া গেছে। তিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, তিনি সমস্ত পাকিস্তানের নেতা। গােটা পাকিস্তানের জনসাধারণ তাকে তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পেতে চান। ইয়াহিয়া খান যাকে হত্যার সংকল্প নিয়েছেন তিনি পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের বিজয়ী বীরকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। কোন সরকার সামরিক বা অসামরিক-জনমতকে এভাবে উপেক্ষা করার সাহস দেখায়নি। | এ কাজ একমাত্র গুপ্তঘাতকের দ্বারাই সম্ভব। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষেই এটি লজ্জার বিষয় যে, ইয়াহিয়া খান এই গুপ্তঘাতকের বৃত্তিকেই সরকারি নীতির মর্যাদা দেওয়ার সংকল্প বলে ঘােষণা করার দুঃসাহস রাখেন। মুজিবের ভবিষ্যৎ যাই হােক না কেন, বাংলাদেশের জনসাধারণ ইয়াহিয়া খানকে তার ধৃষ্টতার শিক্ষা। দেবেন। কিন্তু তাতে অন্য দেশের অপরাধ-স্খলন হবে না। গণতান্ত্রিক দেশগুলির সরকার ও জনসাধারণ যদি বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে যথাসময়ে সােচ্চার হতেন তা হলে আজ ইয়াহিয়া খানের এই দুঃসাহস হত না। মুজিবকে হত্যা করে ইতিহাসের গণতন্ত্রের এক নম্বর ঘাতক বলে চিহ্নিত হওয়ার প্রয়াসী হতেন না।
৭ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা