You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.01 | না চাইলেও যুদ্ধ হতে পারে - পান্নালাল দাশগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

না চাইলেও যুদ্ধ হতে পারে

–পান্নালাল দাশগুপ্ত

ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে “যুদ্ধ” কথাটা ভারতবাসীর মুখ থেকে শুনতে চান না। কোন কথা তুলতে গেলে প্রথমেই তারা একটা সীমানা টেনে দেন- যুদ্ধ চলবে না। কিন্তু পাকিস্তান নিজের গরজেই কোন যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারে না, এমন কথাটি বলা যায়? ওরা প্রতিদিন সীমান্তের এপারে গােরাগুলি নিক্ষেপ করছে, সীমান্ত বরাবর ভারতীয় বাসিন্দারাও সীমান্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে, প্ররােচনার অন্ত নেই তাদের পক্ষ থেকে।  রাত্রিদিন পাকিস্তান তার অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার অফুরন্ত করার জন্য লেগে আছে। প্রতিরক্ষার জন্য কন্‌ক্রিটের ব্যাংকার তৈরি করে নিচ্ছে। ওদের ফায়ার পাওয়ার প্রচণ্ড বাড়িয়ে তুলেছে। চীন বিনামূল্য অকাতরে অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই চলেছে। আরও দুটি ডিভিশন তৈরি করবার জন্য যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র কারাকোরাম গিরিপথ দিয়ে পাঠিয়েছে। আরও পাঠাচ্ছে  চীন যাদেরই অস্ত্রশস্ত্র দেয়- বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। অস্ত্র শস্ত্রের ব্যাবসায় তারা করে না বলে নৈতিক বাহাদুরি তারা নিয়ে থাকে; ব্যাপারটা যদিও অমন নৈতিক ও বৈপ্লবিক নয়, অত্যন্ত ব্যবহারিক স্বার্থেই চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র যােগান দিয়ে চলেছে। কেননা চীনের জিও-পলিটিক্যাল স্বার্থেই ভারত ভূখণ্ডে একটা চিরন্তন যুদ্ধশ্লিহ সৃষ্টি করে রেখে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কে জখম করে রাখা তার উদ্দেশ্য। চীন কি জানে না ইয়াহিয়া শাসনের প্রতিক্রিয়াশীলতা, স্বৈরাচার, ধন্মান্ধতা ইত্যাদি? চীন কি জানে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় ঢের বেশী প্রগতিবাদী? চীন কি জানে না বাংলাদেশের রাজনৈতিক আদর্শ প্রগতিশীল? সব জানে, কিন্তু তাদের বিচারে ঘাের প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান তেমন ভয়ের কারণ নয়, প্রগতিশীল বা প্রগতিবাদী ভারত ও বাংলাদেশ তার চেয়ে ঢের বেশী ভয় ও ভাবনার কারণ। কেননা ইংরাজীতে যাকে বলে Better use the enemy of good, and Best is equally a bitter enemy of better, গণতন্দ্র চীনের পক্ষে একটা চ্যালেঞ্জ; পাছে লােকেরা ভারত ও বাংলাদেশের আদর্শে বিভ্রান্ত হয় সেই হেতু ভারত ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের চেয়ে চীনারা বড় শত্রু বলে মনে করে। কাজেই এই যুদ্ধটাকে তারা নিজেদের যুদ্ধ বলেই মেনে নিয়েছে। যদিও এটা চীনের যুদ্ধ but by proxy, কাজেই বিনামূল্যে অকাতরে অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে দিয়ে যেতে আপত্তি নেই। আর পাকিস্তান তাতে শক্ত হবে? মােটেই না। কেননা চীনারা জানে পাকিস্তানের ভিত এত দুর্বল যে নিজের ভিতরকার গ্লানি ও বিস্ফোরণেই যে কোন দিন শেষ হয়ে যাবে। 

পাকিস্তানকে নিয়ে তাই চীনের কোন ভাবনা নেই, ভাবনা ভারতকে নিয়ে। ভারতকেই চীন তার এশিয়ার সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। কাজেই পাকিস্তানকে চীন সংযত করবে একথা মনে করার কারণ নেই বরং ক্রমবর্ধমান শত্রুতা করতে উসকানি দিয়ে যাবে, এমন কি যুদ্ধও বাধিয়ে দিতে বলতে পারে। | চীন আরব-উপসাগরে ও বঙ্গোপসাগরের উপরে যদি কোন আধিপত্য রক্ষা করতে চায় তবে পশ্চিম ও পূর্ব উভয় পাকিস্তানের উপরেই তার হাত থাকা চাই। এ হিসেবে পূর্ব বাংলাকে চীনা হাতছাড়া করতে পারে কি? তাছাড়া কোন দিন যদি চীন-ভারত যুদ্ধ হয়, তখন পূর্ব ভারতের পিছনটাতেই যদি পূর্ব বাংলা একটি ভারতবিরােধী শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে পূর্ব ভারতে ভারতীয় প্রতিরক্ষার কোন প্রতিরক্ষা-সুরক্ষিত কোন বিস্তৃত পশ্চাৎভূমি থাকবে না। পশ্চিম বাংলা থেকে আসামের সঙ্গে যে ৩০/৩৫ মাইল প্রস্থের সংযােগ ভূমি বর্তমান তার মধ্যে কোনই প্রতিরক্ষার বেস তৈরি করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি আজ বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয় এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পঁাড়ায়, তবে ভারতের পক্ষে তার কোনই অভাব হয় না এবং আসামের সঙ্গে সংযােগও বিপন্ন হয় না। সে ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের উপর কোন কর্তৃত্ব স্থাপন করার স্বপ্ন চীনের পক্ষে সুদূরপরাহত হয়। অতএব চীন সহজে কি বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে দিতে পারে যদি না সে বাংলাদেশ তাদেরই (চীনেরই) সাহায্যে ও সমর্থনে স্বাধীনতা পায়? চীন হিমালয় অতিক্রম করে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায় অথবা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সশরীরে নেমে আসবে না, কেননা তার বিপদ অনেক, তার সাপলাই লাইন অসম্ভব হতে বাধ্য। কিন্তু তিব্বতে অবস্থিত বিমান ঘাঁটি থেকে উত্তর ভারতের যে কোন শহরের উপর বােমা ফেলার মত বিমান বহর তার আছে, অথচ ভারতীয় বিমান বহরের চীনের শহর গুলির উপর পালটা বােমা ফেলার সুবিধা নেই। কেননা সেগুলি সবই প্রায় সুদূর উত্তর চীনে বা মধ্যচীনে।

চীনা বিমানবহর ভারতীয় শহরের উপর বােমা ফেলে দিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যেই তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে পারবে। চীনের দিক থেকে যুদ্ধের আশঙ্কায় এই একটিই মাত্র কারণ হতে পারে, নইলে তার সৈন্যবলটা প্রকৃতপক্ষে ভারতের কোন বিপদের কারণ নয়। এই সৈন্যবলের কাজটা চীন পাকিস্তানী সৈন্যদের দিয়েই করাতে চায় নিজের একটি সৈন্যকেও চীন অযথা বিপদের মুখে ফেলবে না হয়তাে। পাকিস্তান এ জন্যও চীনের এত প্রিয়। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে চীন পাকিস্তানকে ২০০ ট্যাঙ্ক ও ১০০ মিগ বিমান দিয়েছে। মারকিন সাম্রাজ্যবাদও পাকিস্তানকে নিরস্ত্র করছে না, বরং আরও সশস্ত্র করছে। ইতিহাসের এমনি নিষ্ঠুর। পরিহাস, আজ বাংলাদেশের জনগণের উপরে যে গুলিগােলা বর্ষিত হচ্ছে তা চীন ও আমেরিকা উভয়েরই একসঙ্গেই দেওয়া। বিপ্লবী চীন ও সাম্রাজ্যবাদী মারকিন উভয়েরই দান-বাংলাদেশের পক্ষে একই জাতীয় । ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলিও ভারত ভুখণ্ডে শক্তিসাম্য রাখতে বদ্ধপরিকর, ভারত ও বাংলাদেশকে অতিরিক্ত শক্তিমান হতে দিতে নারাজ। রাশিয়ার কার্যকলাপ ও চিন্তাধারাও এর চেয়ে খুব পৃথক-এমন কোন প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। এই দোদুল্যমান পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে পাকিস্তান যে আরও এক পা অগ্রসর হবে না, ভারতকেই আক্রমণ করে বসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিফৌজ যদি খুবই শক্তিমান হয়ে ওঠে এবং মুক্তিফৌজেরা ভারত ও বাইরে থেকে সাহায্য পেতেই থাকে। তবে নিজের প্রজাদের কাছে হেরে যাবার চেয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে হারাটা শ্রেয় মনে করবে। এক্ষেত্রে আক্রমণই আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায়। একটা কোন যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে যুক্ত জাতিসঙ্রে সিকিউরিটি কাউন্সিল এসে উপস্থিত হবে এবং এমন এক জায়গায় যুদ্ধবিরতি সীমারেখা টেনে দেবে সিকিউরিটি কাউন্সিল যা মানতে গিয়ে পাকিস্তানের মুখরক্ষা হয়তাে হয়ে যাবে।

পাকিস্তান কোথায় প্রথম ভারতকে আক্রমণ করতে পারে? হয়তাে ত্রিপুরা রাজ্যটির উপর। ত্রিপুরা রাজ্যটি পাকিস্তানের ভিতরে একটা প্রতিকূল সশস্ত্র গোজ হিসেব দাঁড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামের বন্দর থেকে ঢাকার রেল ও রােডের যাতায়াত পথ ত্রিপুরায় অবস্থিত ভারতীয় কামানের পাল্লার মধ্যে। পূর্ব বাংলার অনেকগুলি শহর ত্রিপুরার ঘাঁটিগুলির অবধি আক্রমণের মধ্যেই অবস্থিত। মুক্তিফৌজেরাও ত্রিপুরার ঘাঁটিগুলির। অবাধ আক্রমণের তাকে ব্যবহার করতে পারছেন। অথচ ত্রিপুরার তিন দিকেই পাকিস্তান। পাকিস্তান সামরিক  বাহিনী ত্রিপুরাকে কাছাড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার জন্য একটা প্রচণ্ড আক্রমণ করতেও পারে। ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের যােগাযােগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। তার বিমানঘাঁটিগুলি যুদ্ধের প্রথম মুহূর্তেই ভারতের পক্ষে অব্যবহার্য হয়ে পড়বে। কাছাড় থেকে রেলপথ ধর্মনগর এসেই শেষ হয়েছে- ত্রিপুরার ভিতরে আর কোন রেলপথ করা হয়নি। যে রােড করা হয়েছে তা বর্ষার সময় অনেক সময়ই ধসের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ত্রিপুরা থেকে মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় ফৌজদের চট করে পিছিয়ে আনাও সহজ নয় । সশস্ত্র ফৌজ ও সাধারণ নাগরিকেরা হঠাৎ মহাবিপদের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। | অথচ আমরা যদি ত্রিপুরাকে হারাই সে ক্ষতি অন্য কোন উপায়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। ত্রিপুরা থেকে ভারতীয় ফৌজ ও মুক্তিফৌজ পূর্ব বাংলার অনেক শহর ও যাতায়াতপথ সহজেই দখল করে নিতে পারে। এ সুবিধাজনক পরিস্থিতিটা আমরা যেমন ছাড়তে পারিনা, পাকিস্তানও তেমিন সহ্য করতে পারে না। আকস্মিক আক্রমণের মুখে ত্রিপুরা কী করবে? যদি সত্যিই যুদ্ধ হয় তবে ত্রিপুরা সাময়িকভাবে কয়েক মাসের জন্য অন্তত ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সেই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যদি সেখানে প্রতিরক্ষা বাহিনী ও মুক্তিফৌজের লড়াই করবার মত যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যবস্ত্র মজুত না থাকে, তবে একটা চরম বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। কেবল ত্রিপুরার একটি দৃষ্টান্ত দিলাম, উত্তর বঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্রই আমাদের আরও একটু সতর্ক ও প্রস্তুত থাকা উচিত নয় কি?

১ জুলাই, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা