রাজধানী রাজনীতি উদ্বাস্তু-দায় কী একা পশ্চিমবঙ্গেরই
–রণজিৎ রায়
‘সম্মিলিতভাবে হত্যা ও সন্ত্রাস দমনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনীতিক দলকে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে শ্রীসিদ্ধার্থশংকর রায় নিজের গৌরব বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু, শুধু প্রস্তাব গ্রহণ করে কিছুই সুবিধা হবে না; ওই প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ হওয়া দরকার। সে পথে বাধাও অনেক। তবু শুরুটা শুভই। হয়েছে। কেন্দ্রও শ্রীরায়ের কাজের তারিফ করছে। এই প্রস্তাবের দ্বারা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ আলােচনার পথ তৈরি হতে পেরেছে। বিভিন্ন দলকে হিংসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানাের জন্য একত্র করার ব্যাপারে শ্রীরায় যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। শুধু এতেই হবে না। পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির শাসন চালু হওয়ার সময় থেকে প্রভূত ক্ষমতা হাতে পেয়ে রাজ্যের পুলিশবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলার রক্ষকগণের বেশ রমরমা অবস্থা যাচ্ছে। স্বল্পকাল স্থায়ী গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকার ওদের আচরণে হেরফের ঘটাতে পারেনি। কিন্তু পুলিশকে সংযত করার দরকার আছে। সব দলের পরবর্তী বৈঠকে অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে এবিষয়টিও আলােচিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা।
রাজ্যের সাধারণ প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল সম্পর্কে কেন্দ্র ঘৃণার মনােভাব পােষণ করে থাকে। ওই মহলে কিছু রদবদল করা হয়েছে, আরাে পরিবর্তন আসন্ন। পূর্ববর্তী কোয়ালিশন সরকারের আমলে প্রশাসনের উপর মহলে বেশ কিছু রদবদল করা হয়েছিল। কেন্দ্র সেই সরকারের গৃহীত কিছু ব্যবস্থা নাকচ করে দিচ্ছে। কোয়ালিশন সরকার শ্রীরায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে কিংবা তার অনুমােদন নিয়ে যে-সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, তিনি আজ তেমন কিছু ব্যবস্থাই উলটে দিতে চলেছেন। | কোয়ালিশন সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন শ্রী বি আর গুপ্ত এবং শ্রীরঞ্জিত গুপ্ত। এ ব্যাপারে কেন্দ্র তার অসন্তোষের কথা মুখ্যমন্ত্রী শ্রীঅজয় মুখারজিকে জানিয়েও দিয়েছিল। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার শ্রীরঞ্জিত গুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযােগ কী তা সরকারীভাবে কখনাে ব্যাখ্যা করা হয়নি। তালীন স্বরাষ্ট্র সচিব শ্রী বি আর গুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল, তিনি দু’জন বিচারাধীন বিরােধী দলের এম এল এ-কে শপথ গ্রহণ করতে দিয়েছেন। শ্রীরায়ও শ্রীগুপ্তের অপসারণকে সমর্থন করেছিলেন। সেই শ্রী বি আর গুপ্তই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অতিরিক্ত সচিব পদে নিযুক্ত হতে চলেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সেলের দায়িত্ব পাবেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির শাসনের আমলে পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারে তিনিই হবেন মুখ্য অফিসার।
পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপদে পাঁচ সপ্তাহ আগে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে শ্রীরায় দু’টি সমস্যার। সুরাহা খোজার ব্যাপারেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন। সমস্যা দু’টি হল-রাজ্য প্রশাসনের পুনর্গঠন এবং হিংসার বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান গড়ে তােলা দুটিই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সকলেই তার সাফল্য কামনা করবেন। কিন্তু যে সি পি এম সম্পর্কে কেন্দ্র বিশেষভাবে চিন্তিত, সেই দলকে প্রতিরােধ করার সমস্যার মােকাবিলা তিনি কী ভাবে করবেন? গত পাঁচ সপ্তাহে রাজ্যের বিধ্বস্ত অর্থব্যবস্থার পুনর্গঠনের ব্যাপারে শ্রীরায় খুব একটা নজর দিতে। পেরেছেন বলে মনে হয় না। কাজটা খুবই জরুরি। কিন্তু সমস্যার গভীরে প্রবেশ করলে শ্রীরায় দেখতে পাবেন—সর্বোত্তম অবস্থায়ও পশ্চিমবঙ্গ একী এর প্রতিকারে সক্ষম হবে না। কেন্দ্রের প্রদত্ত আর্থিক মজুরি, লাইসেন্স কিংবা কাঁচা মালও রাজ্যকে বেশি দূর এগিয়ে দিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা ও উদ্বাস্তু সংক্রান্ত মৌলিক নীতি সম্পর্কে গভীর পর্যালােচনা প্রয়ােজন-কেন্দ্র বােধহয় এ কথা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ওই সব নীতির পারছেন না, তখন শ্রীরায় কী করতে পারেন? কেন্দ্র মে মাসে ঘােষণা করেছিল যে, ছ’ মাসের মধ্যেই উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু তা অবাস্তব বলে প্রমাণিত হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ হবে কিনা সেটাই সন্দেহের বিষয়। প্রত্যাবর্তন কবে শুরু হবে তা কেউই বলতে পারেন না। পাক-সেনারা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আন্দোলনকে গুড়িয়ে দিতে পারবে না তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সুশিক্ষিত পাঁচ ডিভিশন সৈন্যকে পরাস্ত করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য গেরিলাবাহিনীর বহু দিন সময় লাগারই কথা। অর্থাৎ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলি, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা উদ্বাস্তুর বােঝা বয়ে চলতেই বাধ্য হবে। অন্যান্য রাজ্য উদ্বাস্তুর ভার ভাগ করে না নিলে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার অবস্থা যে আরাে অনেক বেশি শােচনীয় হয়ে উঠবে-সে কথাটাই অন্যান্য রাজ্যের মর্মে প্রবেশ করছে না। এ অবস্থার আর্থিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া হবে সাংঘাতিক। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২০০টি বিদ্যালয় উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত হয়েছে; কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যালয় থেকে পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের সরাবার ব্যবস্থা করতে পারেননি। বিদ্যালয়গুলি গত চার মাস ধরে বন্ধ; আরাে দু’-চার বছর বন্ধ হয়ে থাকাও অসম্ভব নয়। যে সব ছাত্ররা এর ফলে লেখাপড়ার সঙ্গে সংস্রব হারিয়ে ফেলল পশ্চিমবঙ্গ তাদের নিয়ে কী করবে? | শ্রীরায় নতুন দায়িত্ব নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল পূর্বাঞ্চলের সকল রাজ্যের উদ্বাস্তু সমস্যা দেখার ভারও। তার হাতে থাকবে; শিবির পরিচালনা এবং উদ্বাস্তুদের অন্যত্র পাঠানাের ব্যাপারে তিনি হবেন সংযােগরক্ষাকারী কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি। কেন্দ্র এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করতে না পারলে উদ্বাস্তু সমস্যাটাই শ্রীরায়ের পক্ষে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি অনেক কিছু করতে চাইলেও ওই একটা সমস্যাই তার সব প্রয়াস বানচাল করে দেবে।
পর্যালােচনা কবে হবে কিংবা কখনাে হবে কিনা-তা কেউই বলতে পারছেন না। যেভাবে নতুন উদ্বাস্তু সমস্যার মােকাবিলা করা হচ্ছে শ্রীরায় কী তাতে খুশী? ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে আগত পশ্চাশ লাখ উদ্বাস্তুর সমস্যাদির কথা ছেড়েই দিলাম। জেনারেল ইয়াহিয়ার নারকীয় অত্যাচার শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে আরাে পঞ্চাশ লাখ উদ্বাস্তু এসেছেন। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে আরাে আসবেন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-বাংলাদেশে চিরকালই কষ্টকর সময়। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় এই তিন মাসেই বাংলায় অনাহারে সবচেয়ে বেশি লােক মারা গিয়েছিল। সে বছর খাদ্যোৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ ছিল শতকরা মাত্র ৬ ভাগ। ব্রিটিশ প্রভুরা সে সময় হতভাগ্য। বাঙালীদের জীবন অপেক্ষা যুদ্ধ নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল। তাই খাদ্যোৎপাদনে ওই সামান্য ঘাটতি সময়মতাে পুরণের কোন চেষ্টা হয়নি। যার ফলে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরও একমাত্র লক্ষ্য বাংলাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ বজায় রাখা। তারা ইতিমধ্যেই প্রায় ১০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে, আরাে ৭০ লাখ মানুষকে দেশছাড়া করেছে। নিরন্ন বাঙালীকে তারা ক্ষুধার কবল থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে-এমন প্রত্যাশা বাতুলতা। তা ছাড়া, এবার খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৯৪৩ সালের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং, এক দিকে ক্ষুধার জ্বালা, আর এক দিকে পাক-সেনাদের অত্যাচারে উত্ত্যক্ত হয়ে আরাে বহু মানুষ যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসবেন তাতে সন্দেহ নেই। আর তাদের অধিকাংশকেই ঠাই দিতে বাধ্য হবে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা।
৫ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা