ইয়াহিয়ার ভাষণের পর নয়াদিল্লী কী করবে
— রণজিৎ রায়
বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তান মাস তিনেকের মধ্যে একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়বে কিছুকাল আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা এ ধরনের এক অতি সহজ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীম্বর্ণ সিং এ মতের মদদার বলে মনে হয় না। বিদেশ ভ্রমণ সেরে এসে সংসদে তিনি একাধিক বার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন; কিন্তু তিনি একবারও ঐ সুরে সুর মিলাতে চাননি। যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতির উপরে যে দারুণ চাপ পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে কোন যুদ্ধলিপ্ত দেশের ক্ষেত্রেই তা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারত কারাে সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়েও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কুট কৌশলে এক অভাবিত বোঝা কাঁধে নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যাদের বলেছেন ‘যুদ্ধজনিত বাস্তুত্যাগী’ সেই অসহায় গৃহহারা দলের জন্য ভারতকে যে কত কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে তার যথার্থ। হিসাব কষা খুবই দুষ্কর। সরকারী হিসাবে প্রথম ছয় মাসে ৩০০ কোটি টাকা লাগার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত যত শরণার্থী এসেছেন তার তুলনায় অনেক কম সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ঐ হিসাব কষা হয়েছিল। আরাে কয়েক লাখ শরণার্থী যে এ দেশে চলে আসবেন তাতে সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এ অবস্থার মােকাবিলার জন্য দরকার হলে নরকে পর্যন্ত যাবাে” । খুবই সাহসের কথা। কিন্তু অর্থটা কী? পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার শরণার্থীর চাপে ইতিমধ্যেই কি নারকীয় অবস্থা সৃষ্টি হয়নি? মেঘালয় এবং আসামেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার আজ আর জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা বলে কিছুই নেই। অথচ ভারতের অন্যত্র এর আদৌ স্পর্শ লাগেনি। এমন কী, খােদ দিল্লিতে পর্যন্ত কৃচ্ছতার কোন চিহ্ন কোথাও নেই। | শ্রী অজয় মুখােপাধ্যায় বলেছেন ? শরণার্থীর সমস্যার বিপুল তার বিরুদ্ধে তাল রাখতে না পারাই তার। মন্ত্রিসভার পদত্যাগের কারণ। একথা যদি সত্য হয় তাহলে বাংলাদেশে পাকিস্তানী আক্রমণের সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে দাঁড়াল পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকার। কেন্দ্রের পূর্ণ আশীর্বাদ পেয়েও মুখারজি মন্ত্রিসভা টিকল না। অর্থাৎ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ব্যাপক গণহত্যা রাজনীতিক সংকট সৃষ্টি করল ভারতের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশে। নয়াদিল্লীর ধারণা ঃ আর এক প্রস্থ রাষ্ট্রপতির শাসন এবং তৎসহ নিবর্তন মূলক আটক আইন ও কেন্দ্রের সশস্ত্র শক্তির দ্বারা এ মুশকিলের আসান হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত সরকারের নীতি যে সত্যিই কী সে সম্পর্কে রাজ্যসভায় আসামের কাছড়। জেলার সদস্য শ্রীমহিতােষ পুরকায়স্থ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন- ভারতের দূতরা এ বিষয়ে। কথা বলার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন অথচ কংগ্রেসী এম-পি-দেরও এ সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হচ্ছে। এ সমালােচনায় প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত।’ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন “আমাদের নীতি অতি পরিষ্কার’ । কিন্তু তার এই মন্তব্যে শ্রীপুরকায়স্থ কিংবা দেশের অন্যান্য মানুষ কেউই অধিকতর জনবান হতে পারেন নি। গত সােমবার লােকসভার বিরােধী দলগুলির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শ্রীমতী গান্ধী তাদের অনুরােধ করেন যে তারা যেন এ বিষয়ে প্রকাশ্যে সংযত ভাবে কথা বলেন। শুনে অটলবিহারী বাজপেয়ী বললেনআমেরিকানরা ওকে যা করতে বলেছেন, উনি আমাদের তাই করতে বলছেন। বৈঠক শেষে ডি এম কে-র শ্রীমনােহরণের তিক্ত মন্তব্য ঃ এ আলােচনা “আমাকে আরাে বিভ্রান্ত করেছে। যারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনার সুযােগ রাখেন তাদেরই যদি এ মনােভাব হয় তাহলে সাধারণ মানুষের মনােভাব কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সারা দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যে এক গভীর হতাশা জন্ম নিচ্ছে সেটা ভারত সরকারের এতদিনে উপলব্ধি করা উচিত।
এতৎ সত্ত্বেও ভারত সরকারের এ সম্পর্কে একটা নীতি বিদ্যমান। নীতিটি হলঃ বাংলদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিকে যুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করা যাবে। ওদের অনিবার্য মহত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের এ এক আত্মঘাতী আস্থা। জেনারেল ইয়াহিয়া যাতে শেখ মুজিবরের দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন তার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিকে আমাদের অনুকূলে পাবার। চেষ্টা করেছি, বুঝিয়েছি সংকট নিরসনের এটাই একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ পথ। আমরা ওদের আরাে বুঝিয়েছি যে। এই প্রাক্শর্ত পূরণ না হলে ‘যুদ্ধজনিত বাস্তু ত্যাগীরা’ স্বগৃহে ফিরে যেতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়‘আমরা বলি হবার জন্য এসব শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারি না।’ অন্যান্যরা ছাড়া আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী স্বর্ণ সিং ইসলামাবদের বিরুদ্ধে আমাদের কূটনীতিক লড়াই চালাবার জন্য মসকো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়রক, ওয়াশিংটন এবং লনডন ঘুরে এসেছেন। দেখা যাচ্ছে আমেরিকানদের রসবােধ বড় ঝুঁজালাে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে যে দিন নয়াদিল্লির মাটিতে পা দিলেন সে দিনই নিউইয়র্ক টাইমস কাগজে খবর বেরােল যে দু জাহাজ মারকিনী অস্ত্র সম্ভার পাকিস্তানের দিকে পাড়ি দিয়েছে। জানা গেল ও অনুরূপ সম্ভার নিয়ে আরাে একটি জাহাজ শীঘ্রই আমেরিকার বন্দর থেকে ছাড়বে। নয়াদিল্লির আশংকা পাকিস্তানকে আমেরিকা আরাে অস্ত্র পাঠাতে পারে। খবর শুনে শ্রীস্বর্ণ সিং বললেন- আমেরিকানরা ওঁকে যা বলেছে, কাজে তার উল্টোটাই করল। এনিয়ে আমাদের খুব বেশি মর্মাহত হয়ে লাভ নেই। পেন্টাগণ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যাপারে দেশবাসীদেরও মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করতে পেছপা হয়নি। কূটনীতিক প্রয়াসের এ হেন আরাে সাফল্যের জন্য আমাদের তৈরি থাকা ভালাে।’ দুনিয়ার যে কোন বৃহৎ শক্তিরই আসল লক্ষ্য হল পৃথিবীতে তার পজিশন বজায় রাখা নিজের স্বার্থ সিদ্ধ। করা। কোথাও গণতন্ত্র টিকল কী টিকল না, তা নিয়ে অন্য কারাে সত্যিকারের মাথাব্যাথা হওয়া কঠিন।
পৃথিবীর সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক কতকগুলি দেশকে নিয়ে আমেরিকার কারবার, তার বিশ্বে পাকিস্তানের একটা বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তান সম্পর্কে ওয়াশিংটন কিংবা ন্যাটোতে তার অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে অন্য রকম আচরণ আশা করাই ভুল। ইসলামাবাদ আমাদের জন্য যে গভীর সংকট তৈরি করে দিয়েছে তার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আমরা সংযম দেখানােয় বিশ্বজন আমাদের পুস্পস্তবক দিচ্ছেন। শরণার্থীদের বিপুল মানবিক দায়িত্ব পালনের জন্যও প্রশংসা পাওয়া যাচ্ছে। এতাবৎ ৭০ লাখ শরণার্থী এসেছেন; তার মধ্যে ৫০ লাখই পশ্চিম বঙ্গে। আন্তর্জাতিক শক্তিবর্গ। ওদের জন্য কিছু খুদ-কুঁড়ােও ছুঁড়ে দিয়েছেন। কূটনীতির লড়াইয়ে আমরা তৎপর; কিন্তু পাকিস্তানও চুপ করে বসে নেই। আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র আদায়ের দ্বারা তার প্রয়াসের সাফল্যও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ হিসাবে পরিগণিত না হলে সমস্যার সমাধান নয় বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী বলে মনে হয়। আমরা মুসলিম দেশগুলির আচরণকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে মুসলমানের হাতে মুসলমান খুন হলেও ধর্মীয় কারণে ওরা ইয়াহিয়ার দিকে। পাশ্চাত্য কিংবা সমাজতান্ত্রিক কোন দেশই পাকিস্তানকে টুকরাে হয়ে যেতে দিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্বজনমত ইয়াহিয়াকে আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠায় বাধ্য করবে এ প্রত্যাশা জেনারেল ইয়াহিয়া গত সােমবার ভাষণে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। ইসলামাবাদের উপর সবরকম চাপ সৃষ্টিই ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে ইয়াহিয়া সামান্যতম কনসেশন করতেও রাজি | জেনারেল ইয়াহিয়া তার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে অগ্নি উর করেছেন। আসলে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলেও তিনি ভীত নন, পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই আশ্বাস দেওয়ার জন্যই তার এই ভাষণ। কুটনীতিক সূত্রে সাহায্য ইত্যাদি সম্পর্কে আশ্বাসের খবর না পেলে ইয়াহিয়ার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে এতটা প্ররােচনাত্মক মন্তব্য করতে সাহসী হতেন না। তিনি হয়তাে ভাবছেন যে, গত তিন মাসে ভারতের সংকট বেড়ে গিয়েছে এবং বাংলাদেশে তার শক্তি এপরিল বা মে মাসের তুলনায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এতে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা দেখার জন্য। অপেক্ষা করতে হবে। খুব সম্ভবত জেনারেল ইয়াহিয়া যেসব কথা বলেছেন সে গুলিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব জনমতকে আমাদের অনুকূলে আনার জন্য আর একবার নয়াদিল্লি কুটনীতিক সংগ্রাম শুরু করে দেবে।
১ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা