বাংলাদেশ মুক্তির সংগ্রাম ও স্বতঃস্ফূর্ত পর্ব শেষ এখন চাই সংগঠন
–পান্নালাল দাশগুপ্ত
বাংলাদেশের জনগণের উপর পাক-সামরিক আক্রমণ শুরু হবার পর তিন মাস পূর্ণ হল। তিনমাস ব্যাপী। প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া কমখানি কথা নয়। তথাপি ভারতীয় ও বাংলাদেশের জনমনে একটা পরাজয়ের ছায়া পড়ছে যেন। আমরা যে ভাবে যত দ্রুত এ সংগ্রামের সাফল্য আশা করেছিলাম, সেভাবে সেটা হয়নি। ভারতের বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ ঘটেনি, তা থেকে-এদেশে-ওদেশে কম আশাভঙ্গের কারণ ঘটেনি। মুক্তিযােদ্ধাদের উত্তরােত্তর সংঘশক্তি ও শক্তিবৃদ্ধির পথে যে জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্য পাওয়া উচিত ছিল এবং যথাসময়ে তা পাওয়া হয়নি, ফলে মুক্তিযােদ্ধারা সামরিক অর্থে যাকে initiative বলে তা কোন ক্ষেত্রেই দেখাতে পারছে আঘাতের পর আঘাত খেয়েই চলেছেন। লক্ষ লক্ষ (দশ লক্ষও হতে পারে প্রাণ যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, শতসহস্র নারীর উপর নির্যাতন যেভাবে ঘটেছে, যেভাবে হাজারে হাজারে শিশু হত্যা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ (হয়তাে কোটি খানেক) লােক গৃহহীন পথের ভিখারী হয়ে প্রাণভয়ে ভারতের দিকে ছুটে আসছে-এসবের পরিষ্কার চিত্র আজ আমাদের মনে একটা হতাশার দীর্ঘায়ত কালাে ছায়া বিস্তার করছে। ষাট-সত্তর লক্ষ শরণার্থীর বােঝাও আমাদের স্বাভাবিক সহানুভূতির উৎসটাকে শুকিয়ে না দিক, আমাদের জীবন-বিন্যাসে। একটা উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। এমতাবস্থায় আশাবাদী কোন প্রত্যয় থাকা সহজ নয়। কিন্তু এই ঘনায়মান নৈরাশ্যময় মনােভাব যেন আমাদের বিচার বুদ্ধিকেও প্রভাবিত না করে। মাত্রাহীন। আশাবাদের বদলে যেন মাত্রাহীন নৈরাশ্যবাদী না হয়ে যাই।
এই প্রবন্ধের লেখক কখন এই সংগ্রামকে সহজসাধ্য করে দেখাননি, সরকারের নীতির সমালােচনা করেছেন, যথাযথ সাহায্য ব্যতিরেকে যে কেবল গেরিলা দিয়েই পাক-বাহিনীকে পরাজিত করা যায় না, গেরিলাবাহিনীর যথেষ্ট সংখ্যা ও তাদের যথাযােগ্য অন্ত্রপাতি শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারটাও যে “আপনিই হয়ে যাবে” ব্যাপার নয়, সংগ্রামের সামগ্রিক নীতি ও কৌশল সম্বন্ধে সুচিন্তিত প্রস্তুতি ছাড়া কেবল এখানে সেখানে আঘাত সংঘটিত করা বা “হিট এন্ড রান’ বলে ছেড়ে দিলেই শত্রুর বিনাশ হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন। বিশাল বিপুল এক জনস্রোত ভারতের দিকে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ছুটে আসবে ও আসছে— যদি না তুরন্ত বাংলাদেশের ভিতরকার প্রতিরােধশক্তি বা মুক্তিফৌজকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে তােলা যায়, তবে যে এই হবে, সে সাবধানবাণী। বা ওয়ারনিং এই জন স্রোতধারা সৃষ্টি হবার পূর্বেই দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম নির্মম নিষ্ঠুর পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যে কেবল একটা “মেলা মেলা” মনােভাব দিয়েই সফল করা যাবে না- একথা । বার বার বলা হয়েছিল। লেখকের যে সব ভয়ভাবনা ছিল তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে বলেই লেখকের মনে কিন্তু আজ এই প্রত্যয় হয়নি যে, বাংলাদেশ হেরে গেছে। বাংলাদেশ হারেনি, সে কথা বলার জন্যই এই নিবন্ধ। মােটামুটিভাবে বলা যায়, স্বতঃস্ফূর্তির পক্ষে যতটুকু সম্ভব ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এখন সংগ্রামটা।
একটা অচল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সচেতন সক্রিয় চেষ্টায় ও সুসংগঠিত উপায়ে সংগ্রামের নতুন পর্যায়। উপস্থিত হবার পূর্বে এজাতীয় অচলাবস্থা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই অচলাবস্থাটা পরাজিত মনােভাব বা শক্রর সঙ্গে সমঝােতা করার প্রলােভন থেকে আসেনি। বলা বাহুল্য, ভারতের অভ্যন্তরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ক্যাম্পগুলির অধিবাসী অথবা ঘূর্ণমান বুদ্ধিজীবীদের নৈরাশ্যবাদী মনােভাবের পরিচয় থেকে আমি এ কথা বলছি না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে সমস্ত হাজার হাজার ছেলে সংগ্রাম করার জন্য নীতি-কৌশল, অস্ত্রশস্ত্র ও শিক্ষা-দীক্ষা পাবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় থেকেই বুঝতে পারছি যে, বর্তমানে যে অচলাবস্থা, তা সংগ্রাম সম্বন্ধে নৈরাশ্য থেকে আসেনি, আসছে যােগান যন্ত্র, আয়ােজন উদ্যোগ ও সংগঠনের অভাব থেকে। যেখানে যতটুকু শক্তি দানা বেঁধে আছে, সেখানেই দেখেছি সংগ্রামের নীতিগতকৌশল সম্বন্ধে তীব্র চেতনা বােধ ও জিজ্ঞাসা। স্ট্রাটাজী-ট্যাকটিস সম্বন্ধে গভীর অনুসন্ধিৎসা। প্রচুর রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক ভীষণ সংকল্পের দৃঢ়তা। | পঞ্চগ্রাহিতার অবসান হয়েছে। আজ মুক্তিফৌজের কেউ আর কোন সুখ স্বপ্ন দেখে না। আজ যা-কিছু হবে, হচ্ছে, হতে চলেছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে থাকছে পরিকল্পনা ও বিচার। বলা যায়, এরই মধ্যে জন্ম নিচ্ছে পরবর্তী সংগ্রামের অপরাজিত অধ্যায়ের সূচনা। স্বতঃস্ফূর্ততার অধ্যায়ের শেষ, পরিকল্পিত সংগঠিত সংগ্রামের অধ্যায়ের সূচনা। পরিকল্পিত সচেতন সংগ্রামের ভবিষ্যৎ ও পর্যায় আলােচনা করার পূর্বে স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের ক্ষয়ক্ষতি যাই ঘটে থাকুক, তার স্থায়ী দানও কী রয়ে গেল যার ভিত্তির উপর নতুন পরিকল্পিত সংগ্রাম শুরু হচ্ছে সে কথাও বলা দরকার।
স্বতঃস্ফূর্ততার সংগ্রামে যা পাওয়া গেছে । | (১) পাকিস্তানে-এর (মানে পশ্চিম পাকিস্তান) সঙ্গে বাংলাদেশের সকল প্রকার আত্মিক যােগের অপূরণীয় বিচ্ছেদ। (২) লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশুর প্রাণ-হত্যা অজস্র রক্তপাত, লক্ষ লক্ষ গৃহস্থের সর্বনাশ, ইত্যাদি ইত্যাদি পাশবিক অত্যাচার যে ক্ষমাহীন তিক্ততার জাতীয় ভিত্তি সুষ্টি করেছে, যে অপ্রতিরােধ্য প্রতিশােধের অনির্বাণ অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করেছে তারই মধ্য থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম ও গেরিলা সংগ্রাম চালু করার মত প্রয়ােজনীয় নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞার ইন্ধন ও উপাদান সৃষ্টি হয়েছে শত্রুপক্ষের এই নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার নিদর্শন ও তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভিন্ন মুক্তিযােদ্ধাদের মােহমুক্তি ঘটতাে না। রূঢ় নিষ্ঠুর বাস্তবতাই সংগ্রামের কাচালােহাকে ইস্পাতে পরিণত করেছে। (৩) বাংলাদেশের কোটি কোটি লােককে এ সংগ্রামে অঙ্গাঙ্গীভাবে লিপ্ত করেছে, মুষ্টিমেয় লােকের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ও শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিটি সংসারের কেউ না কেউ এই পাকনিধনযজ্ঞের আহূতি হয়েছে। (৪) এর ফলে কুইসলিং জাতীয় কোন শ্রেণী আজ আর পূর্ব বাংলায় নেই। সাধারণত জমিদার, মহাজন, রাজা, উজীর ও সুবিধাভােগী পরপদ লেহী শ্রেণী থেকেই সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদীরা তাদের তাঁবেদার খুঁজে থাকে ও তাবেদার সরকার বানায়- কিন্তু পূর্ববঙ্গে এমনিতেই এই জাতীয় কোন শ্রেণী ছিল না।
আর উচ্চ ও নিম্নবিত্ত (ভদ্ৰশ্রেণী বা বুর্জোয়া শ্রেণী) থেকে এই তাঁবেদার সরকারের জন্য লােক মিলছে না, কেন না প্রধানত এঁদেরই বিরুদ্ধ পাক-সামরিক গােষ্ঠীর এই অভিযান। বাঙালী শিল্পপতি, ব্যবসাদার, দোকানদার, কর্মচারি, অফিসার, অধ্যাপক শিক্ষক, ছাত্র, যুবক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি সবই এই পাক-সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যতারা আজ অনেকেই দেশ ছাড়া অথবা আত্মগােপনকারী, নয়তাে বন্দী অথবা নিহত। এর ফলে কোন কুইসলিং সরকার গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না এবং কোন রাজনৈতিক সমাধানের” সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। (৫) সাধারণ ভাবে কোন সরকারি ব্যবস্থা বা বেসরকারি প্রশাসন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে থানা, পুলিশ, মায় পােস্টাফিস, ডাক্তারখানা ইত্যাদি ও সাধারণ আইন-শৃঙ্খলার কাজও চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এর ফলে যে অরাজকতা, চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ হচ্ছে তা ইচ্ছা করলেও (যদিও সে জাতীয় ইচ্ছা এখন ইয়াহিয়া খানদের আসেনি) বন্ধ করতে পারছে না। এতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অপবাদ হয় না, হয় সামরিক শাসনেরই সামরিক শাসকেও একটা “শাসন” বা administration হিসাবে যদি দাঁড় করতে না পারা যায়, নিম্নতম ও ন্যুনতম শাসন ব্যবস্থাদিও চালু না করতে পারা যায়, তবে সেই শাসনও কখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাছাড়া প্রতিটি গ্রামে সৈন্য পাঠিয়ে চৌকিদার, দফাদার ও পুলিশের কাজও যদি সামরিক শাসনকর্তাকে করতে হয় তবে সৈন্যবাহিনী ও দুর্বল এবং আরও দুর্নীতিপরায়ণ ও আরাে আরােও ঘূণ্য হয়ে দাঁড়াবে সকলের কাছে। আর চোর-ডাকাত-খুনী, নারী নির্যাতনকারী ও লুটেরাদের সাহায্য কেউ কখনাে কোন দেশে শাসন ব্যবস্থা চালু করতে পারে? | (৬) অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ও সংকটটাও কম হয়নি। শিল্প-বাণিজ্য বাঙালীরা যা যৎসামান্য গত ২৩ বছরে করতে পেরেছিল, তা তাে বােধহয় সব শেষ হয়ে গেছে গত তিন মাসে। বেছে বেছে পশ্চিমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলিকে তা থেকে রক্ষা করতে পারা যায়নি, সেখানেও ধ্বংসকার্য চলেছে। রেল, বাস ব্যবস্থা, জনসাধারণ, ব্যবসা পত্রের মাল বহনাবহনের পক্ষে ধ্বস্ত বিধ্বস্ত হয়ে আছে। এর ধাক্কা সামলানাে সহজ কথা নয়।
(৭) সামরিক বাহিনীর লােক ক্ষয়টাও সামান্য হয়নি। তিনশ থেকে চারশ অফিসার মারা গিয়েছে এবং প্রায় বিশ হাজার সৈন্যের (রেগুলার ও ইরেগুলারে) প্রাণ গিয়েছে। এত অফিসার ও সাধারণ সৈন্য ক্ষয় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধেও পাকিস্তানকে দিতে হয়নি। | (৮) নিরস্ত্র জনসাধারণের মনে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী সম্বন্ধে যত ত্রাসই সৃষ্টি হয়ে থাকুক, তরুণ বা যুবক সমাজকে ভয় পাইয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি, বরং অনেক ভয় ও মােহ দূর হয়ে গেছে। তারা অস্ত্র চাইছে, তাদের একমাত্র দাবি আজ অস্ত্র দাও। এবং অস্ত্র তারা পাবেও, কেননা সেই প্রতিজ্ঞা তাদের দিন দিন বাড়ছে দেখে এলাম। তারা শত্রুর হাত থেকেই অস্ত্র নেবার চেষ্টা করে চলেছে। আজকাল সংবাদপত্রে অথবা স্বাধীন বাংলা বেতারে যে সমস্ত পাকফৌজ বিরােধী সংগ্রাম ও অন্তর্ঘাতী কাজের খবর বের হয় এর মধ্যে সত্যিই বিশেষ অতিরঞ্জন নেই। এ কথা খোজ খবর নিয়ে জেনেছি এবং এর মধ্যে যে একটা নতুন ধরনের প্রতিজ্ঞা ও কার্যক্রম ফুটে উঠছে, যার চরিত্র আলাদা, সে কথা সবারই বােঝা উচিত। তাছাড়া কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যদি গেরিলা ইউনিটরা গ্রামাঞ্চলে যায়, এমিবাসী সেসাহে তাদের রাখে, খাওয়ায়। বরং সেখান থেকে চলে আসলেই গ্রামবাসীরা ভয় পায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সংগঠন, সংযােগ, পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর হবার জন্য সর্বত্র একটা চেতনা দেখে এলাম সীমান্ত ও বাংলাদেশের মধ্যেও। কোথায় কী হচ্ছে, কী জাতীয় চেষ্টা চরিত্র চলছে, সে কথা সব জানা নেই এবং যতটুকু জানা যায় তা তাে প্রকাশ করা চলে না বা উচিত নয়। তবে যা দেখেছি ও অনুভব করেছি তা থেকে কী হওয়া সম্ভব তারই কিছুটা বিচার উপস্থিত করতে পারি।
(১) ভয়ের চেয়ে অসন্তোষটাই বেশী প্রকট হয়ে উঠছে। এই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষটা অনেকটা নিজেদেরই বিরুদ্ধে। কেন কিছু দ্রুত হচ্ছে না, কেন উপযুক্ত নেতৃত্ব ও সংগ্রামী সংগঠন দ্রুত গড়ে উঠছে না, কতকাল আর অপেক্ষা করবাে শিবিরে শিবিরে, বনে জঙ্গলে, কেন অস্ত্রশস্ত্র মিলছে না, কোন অস্ত্রপাতি সম্বন্ধে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে না এই জাতীয় অসন্তোষ আজ তীব্র। আর এক ধরনের অসন্তোষ হলাে, কেন ভারত বা কোন রাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, কেন “রাজনৈতিক সমাধানের নামে গােপনে কোন “মিউনিক প্যাক্ট” হচ্ছে নাকি, কেন তাদের নেতারা সংগ্রামী জনতার মধ্যে বেশী করে অবস্থান করছেন না ইত্যাদি। দেখা যায় এই অসন্তোষ সুস্থ অসন্তোষ, গঠনমূলক সমালােচনামুখর, তীব্র আত্মান্বেষী ও আত্মসমালােচনামূলক- নেতিবাদী আত্মনিন্দাবাদী নয়। | (২) সংগঠনের দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, এখন সব চেষ্টাই সংগঠিত চেষ্টার অন্তর্গত। প্রথমত বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার হয়েছে, সে সরকার যদিও এখনও খুব দুর্বল। তত তৎপর হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু হচ্ছে, দিন দিন উপযুক্ত হবে এই সংকীর্ণ সীমিত পরিস্থিতির মধ্যেও। দ্বিতীয়ত, বাংলা সরকারের সামরিক কমাণ্ড ও মুক্তিফৌজের রূপরেখাও ক্রমশ ফুটে উঠেছে। এর ফলে যাবতীয় সংগ্রাম ক্রমশ সুনিয়ন্ত্রিত হতে পারবে। তৃতীয়, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য পাক সামরিক শক্তি-বিরােধী দলগুলিও নিজেদের আবার গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন এবং এই দলগুলির মধ্যে একটা সংগ্রামী সমঝােতা সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে।
উপরােক্ত এই তিনটি কেন্দ্রীয় উদ্যম অসংগঠিত স্বতঃস্ফুর্ত মুক্তি সংগ্রামকে সুসংবদ্ধ ও সুসংহত আঘাত দেবার ও আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করে দেবে বলে আশা করা যায়। (৩) দীর্ঘায়ত সংগ্রাম করতে হবে, গেরিলা সংগ্রাম করতে হবে এ জাতীয় কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু তার জন্য কত ছেলে পাওয়া যাবে? হাজার হাজার এমনকি লক্ষাধিক ছেলেও পাওয়া যাবে। কেবল শরণার্থীদের মধ্যে থেকেই নয়, বাংলাদেশের ভিতর থেকে মুক্তিফৌজের ঘাটিগুলিতে (বাংলাদেশের মধ্যে ও সীমান্তে অবস্থিত ঘাঁটিগুলিতে) প্রতিদিন শত শত ছেলে আসে, আশ্রয়ের জন্য নয়, অস্ত্রশস্ত্রের জন্য অস্ত্রশিক্ষার জন্য। যা কিছু সামান্য পায়, তাই নিয়ে তারা তক্ষুণি ফিরে যায়- অ্যাকশনের জন্য। | (৪) ৬০/৭০ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যেই ভারতে এসে গেছে। ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে যুবকের সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৬/৭ লক্ষ। এদের সকলকেই একটা প্রাথমিক আধা-সামরিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব বাধ্যতামূলক এন সি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা দীক্ষা সবাইকেই দেওয়া চলে। ভারত অথবা বাংলাদেশ কারও নিরাপত্তাই তাতে বিপন্ন হয়না। শরণার্থী সকলকেই খাইয়ে দাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অন্তত ছয় মাস ভারত সরকার নিয়েছেন। পরিকল্পিত উপায়ে এ খরচটা যদি যুবকদের পিছনে খরচ করা হয়, তবে স্বাধীন বাংলাদেশের একটা মস্ত উপকার করা তাে হয়ই, উপরন্তু যুবকদের মারফৎ সাধারণ এই বিরাট শরণার্থীদের সুনিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটাও সহজ হয়। (৪৫) “ইয়ুথ ক্যাম্পে” কোন যুবককেই বাদ দেবার কথা ওঠে না। ভাল-মন্দ সব যুবককেই একটা। বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা দরকার- কেউ যাতে বিপথে যেতে না পারে। সাধারণ ভাবে ইতিহাস-রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, স্বাধীনতা, স্বাধীনত্তোর বাংলাদেশে পুণর্গঠনের কাজ কর্ম, জনসেবা, শরণার্থীদের সেবা ইত্যাদি শিক্ষা-শিক্ষা সবাইকে দেওয়া উচিত। নিরক্ষরদের স্বাক্ষর করা দরকার। এই সমস্ত শিক্ষাদীক্ষার কাজ, পি-টি প্যারেড সহ, বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, রাজনৈতিক নেতা, লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যেই করা সম্ভব-এবং বাধ্যতামুলক ভাবে এঁদের এভাবে কাজে লাগাতে পারেন বাংলাদেশের সরকার ভারত সরকারের সহযােগিতায়। সাধারণ শরণার্থী শিবিরগুলির পরিচালনা ও তদারকির দায়িত্ব এঁদেরই হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও জননেতাদের বাংলাদেশের শরণার্থীরা যদি এভাবে পান, তবে তাদের মনােবল ও আত্মীয়তাবােধও অনেক বেড়ে যাবে এবং এভাবে তাদের নেতৃত্ব অটুট থাকবে, অন্য কোনভাবে নয়। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একাজে বা দায়িত্বে বাধ্যতামুলকভাবেই লাগানাে উচিত।
(৬) দ্বিতীয় স্তরে বাছাই করে যােগ্য ছেলেমেয়েদের গেরিলা ট্রেনিং ও উচ্চতর সামরিক শিক্ষা দিতে হবে। এই নির্বাচনে যথেষ্ট সাবধানতা দরকার, যাতে দুষ্ট লােকেরা ও শত্রুপক্ষের চরেরা এসব শিক্ষা ও খবর , নিতে না পারে। আশা করা যায় ৫০/৬০ হাজার ভাল ছেলেমেয়ে এভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য পাওয়া যেতে পারে। বস্তুত হাজার হাজার ছেলে (হিন্দু ও মুসলমান) এধরনের শিক্ষাদীক্ষার জন্য ব্যাকুল, কিন্তু কোন সুযােগ পাচ্ছে না বলে অসন্তুষ্ট। | (৭) ৬০/৭০ লক্ষ শরণার্থী আজ বােঝা মনে হলেও যদি একটা “মাস্টার প্ল্যান করে অগ্রসর হওয়া যায়, তবে এই বােঝাটা একটা শক্তি বা সম্পদ হিসাবে দাঁড় করানাে চলে। এই লােকবলকে সুসংগঠিত করতে যে শিক্ষিত লােকের দরকার, তাও এদেরই মধ্যে থেকে পাওয়া যায়, ভারতীয় শাসনযন্ত্রকে অযথা হয়রানি করার দরকার করে না। সকল শ্রেণীর লােকদের কাছ থেকে কাজ আদায় করা চলে।
(৮) কেবলমাত্র গেরিলা দিয়েই চূড়ান্ত জয় অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য শেষ পর্যন্ত রীতিমত সৈন্যবাহিনী দরকার হবে এবং এখনও হচ্ছে। যেহেতু ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হয়তাে কোন কালেই স্বেচ্ছায় নেমে পড়বে না; সেহেতু মুক্তিফৌজের একটা রীতিমত বাহিনীও সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব গড়ে তােলা। দরকার। এর সুযােগ-সুবিধা ও সূত্র একটা আছে। এছাড়া একটা রীতিমত সৈন্যবাহিনী না থাকলে। গেরিলাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত রাখাও সহজ নয়- বিশৃঙ্খলা, স্বৈরাচারী কার্যকলাপ সম্বন্ধে ও সচেতন থাকতে (৯) ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানের একটি রীতিমত বাহিনী ছিল-এক ডিভিসন যার শক্তি নয়টি ব্যাটিরিয়নের চারটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর পাঁচটি ছিল পূর্ব বাংলায়। পশ্চিমের চারটিকে নিরস্ত্র করে পাক সরকার তাদের ওখানেই অন্তরীণ করে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাঁচটি ব্যাটেলিয়ন যথাসময়ে বিদ্রোহ করে এই জনপ্রতিরােধের মুখ্য শক্তি হিসেবে লড়ছেন। লড়াইয়ে এদের লােকক্ষয় শতকরা ৫০ ভাগ। হয়েছে বলে ধরা যায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা এই ক্ষতি অনেকটাই পূরণ করে নিয়েছেন। নতুন নতুন সংগ্রামী জনতা থেকে এবং ই, পি, আর আনসারদের মধ্যে যারা সাক্ষাৎ সগ্রামে কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন তাঁদের নিয়ে। শত্রুপক্ষ থেকে ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া সাধারণ অস্ত্রশস্ত্রে তাদের সজ্জিত করতেও কতকটা সক্ষম হয়েছেন। আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামটাকে পাঁচটি ক্ষেত্রে বা সেকটরে ভাগ করে যারা বৃহৎ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা হলেন এই পাঁচটি ব্যাটালিয়ান। অবশ্য তাঁদের ভারী কামান নেই, বিমান বিধ্বংসী ও ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামান নেই; অটোমেটিক রাইফেল ও ভারী মেশিনগানও যথেষ্ট নেই।
(১০) অন্তত এক্ষুনি একটি পূর্ণ ডিভিসন সৈন্য বাহিনী তাদের চাই-ই-চাই লাখখানেক গেরিলা যােদ্ধা ছাড়াও। পাক-বাহিনীর হাতে আছে চার ডিভিসন সৈন্য ও প্রায় ৩০/৩৫ হাজার এরেগুলার । কাজেই প্রকৃত প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু করতে হলে প্রথমে অন্তত একটি ডিভিসন সৈন্য দরকার গেরিলাবাহিনী ছাড়াও। পূর্বেই দেখানাে হয়েছে লক্ষ লক্ষ যুবক আছে এসবের জন্য। আর এই ছেলেরা এত আগ্রহী যে সাধারণভাবে ভাড়াটিয়া সৈন্যরা যে জিনিস শিখতে তিনমাস লাগছে, তা তারা পনের দিনেই শিখে নেয়। মুক্তিফৌজের এই ই, বি, আর কে একটি পুর্ণ ডিভিসনে পুনর্গঠিত করতে চাই আরাে চারটি ব্যাটালিয়ান এবং তদনুরূপ অস্ত্রপাতি। ত্রুটি করা কিছুই শক্ত বা বেশী সময় সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। | (১১) কিছু আরটিলারী বা ভারী কামান, বিমান বিধ্বংসী কামান অ্যানটিট্যাঙ্ক গান এঁদের চাই-ই-চাই।। কেননা গেরিলা বাহিনীর সাহায্যে শত্রুপক্ষকে পিছন থেকে দুর্বল করার আজকের মুক্তিফৌজের হাতে যতটুকু ক্ষমতা আছে, তাতে ছােটখাট শহর তারা এখন দখল করতে পারেন। গ্রামাঞ্চল গুলিকে তাে বটেই। কিন্তু শত্রুপক্ষের দূরপাল্লার কামানের মুখে, বিমান বর্ষণের মুখে তা তারা ধরে রাখতে পারেন না, পিছু হটে আসতে হয়। কিন্তু যদি কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্র পান, তবে তাঁরা অগ্রসর হতে পারেন। এবং শত্রুপক্ষের মনােবল আজ এখনই খুব খারাপ, কাজে কাজেই এতটুকু শক্তি নিয়েই মুক্তিফৌজ যুদ্ধের উদ্যম হাতে নিত পারেন। মনে রাখা দরকার, যুদ্ধে উদ্যম যাদের আছে তাদেরই সুবিধা। এক ডিভিসন রীতিমত বাহিনী ও লাখখানেক গেরিলা কাজে লাগাতে পারলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হস্তক্ষেপের দরকার নাও হতে পারে। মুক্তিফেীজের কর্মকর্তারা এ সাহায্যটাই চান, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে জড়াতে চান না। এঁদের এই দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও বিবেচনাসম্মত । ভারতের পক্ষে এজাতীয় প্রস্তুতির সাহায্য দেওয়া তখনই সম্ভব যখন ভারত খােলাখুলি ভাবে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারবেন। গােপনে এ জাতীয় সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়।
২৫ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা