যুদ্ধ না অন্যপথ
৫ জুন তারিখের আনন্দবাজারে শ্রীযুক্ত পান্নালাল দাশগুপ্তর নানা পন্থা’ পড়ে চিন্তিত বােধ করছি। পান্নাবাবু রাজনীতিতে অভিজ্ঞ, সমরনীতি বিষয়েও পড়াশােনা করেন এবং বােঝা যাচ্ছে এখন তিনি যুদ্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন As an extension of politics হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি ত্বরান্বিত করার শুভ উদ্দেশ্যেও ভারতের রণযাত্রা করার বিরুদ্ধে যে যুক্তিগুলি রয়েছে তার উত্তর প্রত্যাশা করেছিলাম এই প্রবন্ধে। প্রথমত পাকিস্তানের পক্ষ থেকে চীন যে, ভারতকে একটি সাবধানবাণী দিয়ে রেখেছে সে বিষয়ে পান্নাবাবু নীরব। তিনি কী মনে করেন ওটা একটা ফাকা ধাপ্পা মাত্র? আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নামলে চীন চুপ করে বসে থাকবে এরকম ভরসা করার সপক্ষে তিনি কী যুক্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন আজ পর্যন্ত চীন একমাত্র কোরিয়া ছাড়া আর কোথাও সরাসরি যুদ্ধে নামেনি, অতএব এবারও নামবার আশঙ্কা নেই। কিন্তু সমস্ত এশিয়াতে একমাত্র ভারতবর্ষকেই চীন তার একাধিপত্যের পথে কাটা বলে মনে করে। তাই ভারতবর্ষকে একবার শাস্তি দেবার জন্য কিংবা ভারতের প্রভাবের ক্ষেত্র বিস্তৃততর না হতে দেবার জন্য আর একবার চীন যে সক্রিয় হবে না একথা কে বলতে পারে? ইতিপূর্বে তারা একবার বমডিলা পর্যন্ত আসেনি কী? যদি সে অবস্থায় রাশিয়া এবং আমেরিকা (যারা আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দিচ্ছে) পাশে এসে না দাঁড়ায় তাহলে আমরা একা হাতে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে লড়তে পারবে তাে?
যুদ্ধে নামলেই সারা পৃথিবীতে রব উঠবে যে, আমাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের আগ্রাসী মতলবটা এবার প্রকট হয়ে পড়েছে। তখন বিশ্বের সহানুভূতির ছিটেফোঁটাটুকুও আর থাকবে না আমাদের দিকে কারণ এই কাজের সপক্ষে একটা নৈতিক যুক্তি দাড়করানাে সহজ হবে না। আর যুদ্ধই যদি করতে হয় তবে তাে বরং তার আগে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং সরাসরি প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রসাহায্য দিয়ে দেখা দরকার বিশ্বে তার কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজ তার সদ্ব্যবহার করতে পারেন কী না। আমরা একবার যুদ্ধে নামলেই পলকে যুদ্ধ জয় হয়ে যাবে এমন তাে নয়। যদি ছ’মাস-এক বছর কী দু’বছর এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। হয় তবে একই সঙ্গে শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আর্থিক দায়িত্ব ভার বহন করতে পারব কী? মনে রাখা দরকার যে, তখন প্রতিকূল প্রচারণার ফলে সারা বিশ্বে যে বিরূপ মনােভাব হবে। আমাদের প্রতি তার ফলে শরণার্থী ত্রাণের জন্য যে সাহায্যটুকু আমরা পাচ্ছি তাও আমরা পাব না। তা ছাড়া এই নৈতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির ধাক্কা আমরা সামলে উঠতে না পারলে স্বদেশে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রবল করে তুলব।
এক দেশের মুক্তিসংগ্রাম আর এক দেশ লড়ে দিতে পারে না। আমরা যথাসাধ্য অর্থ দিয়ে পরামর্শ দিয়ে, সহানুভূতি দিয়ে সাহায্য করতে পারি। একে ‘গােপন ও কৃপণ দান বলে অবহেলা করবার আগে স্বাধীন বাংলা’-র মানুষ কী ভেবে দেখবেন না যে, এর চেয়ে বড় সাহায্য আর কে করেছিল। তা ছাড়া আমাদের দান ‘গোপন-কৃপণ’ হােক অথবা প্রকাশ্য ও অকৃপণ, এর ফলে যতদিন চন্দ্রসূর্য থাকবে ততদিনের বাংলাদেশের। মানুষ আমাদের অনুগত থাকবে এমন প্রত্যাশা শুধু এই যে, পূর্ববাংলায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার ভাল প্রভাব পড়বে আমাদের রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উপর। তাছাড়া দু’দেশেরই সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান পরস্পরের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। এর বেশি কী কিছু প্রত্যাশা করা ঠিক হবে যতই কেন আমরা সাহায্য দিই না আপকালে?
আমরা যদি আজ লড়াইয়ে নামি তবে জলেস্থলে-অন্তরীক্ষে সেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তখন বেছে বেছে পাকিস্তানী হানাদারদেরই ক্ষতি করব আর বাঙালীর ক্ষতি করব না-তা কী সম্ভব হবে? ভারতের বােমারু বিমান পূর্ববাংলার সৈন্যঘাটিতে নগরে, বন্দরে বােমা ফেলছে এবং অল্প হলেও কিছু সাধারণ নাগরিককেও হত্যা করছে এ সম্ভাবনা আমার কাছে প্রীতিপদ নয়। তারপর দু’দিন না যেতেই যখন ইয়াহিয়া খান ধ্বংসের | নিদর্শন দেখাবার জন্য ইউ এন ও এবং নানা দেশের রিপােরটারদের ডেকে আনবে এবং সেই সঙ্গে নিজেদের অপকীর্তিকেও ভারতের তান্ডব বলে চালিয়ে দেবে তখন আমরা কোথায় দাঁড়াবাে? এখনই বিশ্বের মানুষের চোখে লক্ষ লক্ষ শরণার্থরি আগমন এক লক্ষ নরহত্যার পাপকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। তখন কী আমরা পারবাে সত্যমিথ্যার ভেদ ঘােচাতে? | আজ যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ক্রমশ উগ্র থেকে উগ্রতর কোনাে দলের হাতে চলে যায়, এমন কী চীনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কোনাে দলের হাতেও যায় তবু তাকে যথাসাধ্য এই লড়াইয়ে সাহায্য দিয়ে যাওয়া আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। কারণ যে বাংলাদেশ পিন্ডির তাবেদারী করেনি সেই বাংলাদেশ। পিকিং-এর তাবেদারী করবে এ ভয়টার যথেষ্ট মূল বােধ হয় নেই। তা ছাড়া যে দলই বাংলাদেশে রাজত্ব করুক আর্থিক-বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং সাংস্কৃতিক আত্মীয়তাবােধে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের সঙ্গে তারা। সৌহার্দ্য বজায় রাখবে বলেই মনে হয়। আমরা যদি প্রত্যাশা-হীনভাবে সাহায্য দিই এবং কোনােরকম হস্তক্ষেপ না করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখি তবেই বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করতে পারবাে এবং চৈনিক প্ররােচনাতেও তা শিথিল হবে না।
-গৌরী আইয়ুব, কলকাতা-১৭।
১২ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা