You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.01 | সম্পাদক সমীপেষু সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদক সমীপেষু

সাম্প্রদায়িকতা ও বাংলাদেশ

হাসান মুরশিদ সম্প্রদায়িকতা ও বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে বলেছেন- “ঐতিহাসিক কারণেই ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়েছে।” যা ঘটে যায় তাই ইতিহাস হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে ভারত কেন দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? ওটা অনিবার্য ছিল কিনা? মুসলিম লীগ যে অর্থনৈতিক কারণে নয়, আলিগড়ের মুসলমান ছেলেরা যাতে কংগ্রেসে বা স্বাধীনতা  আন্দোলনে যােগ না দেয় সেজন্য ইংরেজরা মুসলিম লীগ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল, সে-কথা কি হাসান মুরশিদ সাহেবের জানা নেই। ১৮৯২ সাল থেকে কিছু মুসলমান নেতা মুসলিম সমাজের নাম করে বিশেষ সুবিধা ভােগ করে আসছিলেন। নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য সংখ্যা বাড়াবার প্রস্তাবে ঐ নেতা শঙ্কিত হয়েছিলেন। তারা মুসলমান সমাজের নাম করে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। তাই তাদের স্বার্থ ও ইংরেজদের স্বার্থ এক হয়ে দেখা দিয়েছিল। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় যখন মুসলিম লীগ তৈরি হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল – 

To promote loyality to the British Government to protect and advance the political rights and interests of Mussalmans of India and respectfully represent their needs and aspirations to Government and to prevent the rise among Mussalmans of any feelings of hostility towards other communities without prejudice to the other objects of the league. | তৃতীয় উদ্দেশ্যের প্রথমাংশ যে অর্থহীন, শেষাংশ পড়লেই তা বােঝা যাবে। আর কিছু না পড়লেও ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠির “দি একসট্রিমিসট চ্যালেনজ” বইটি পড়লেও, মুসলিম লীগের জন্ম সম্পর্কে আর ভিত্তিহীন কথা বলা চলে না। ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগের সমর্থন করার জন্য লর্ড কারজন যে ঢাকার নবাবকে ১০ লক্ষ পাউনড ধার দিয়েছিলেন, এ কথাও হয়তাে মুরশিদ সাহেবের জানা নেই। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গে ব্যাপক হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মূলে ছিলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লা  সাহেব, যিনি মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা।

মুসলমানদের ধর্ম, সংস্কৃতি হিন্দুদের থেকে পৃথক, তারা একটি পৃথক জাতি, “এ নেশন উইদিন নেশন”, অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য মুসলমানত্ব লােপ পাবে, মসজিদের বদলে মন্দিরে যেতে হবে, গােমাংস খাওয়া যাবে না, হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে কিছু নেই- এসব কথা প্রচার করেই মুসলিম লীগ। মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছিল। গরিব মুসলমানদের অর্থনৈতিক দাবি নিয়ে জহরলাল নেহরু, কংগ্রেস সােস্যালিসট পারটি ও কমিউনিসট পারটি কাজ আরম্ভ করেছিলেন। জহরলাল নেহরুর মাস-কনট্যাকট আরম্ভ করার পরেই মুসলিম লীগ অর্থনৈতিক কর্মসূচীর কথা বলতে আরম্ভ করে। কিন্তু পাকিস্তান দাবির পিছনে কোন অর্থনৈতিক যুক্তি ছিল না, যুক্তি ছিল “ইসলাম বিপন্ন” “ইসলামকে বাঁচাবার জন্য মুসলমানদের নিজস্ব রাষ্ট্র চাই।” দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর-ভারত দখলে রাখার অসুবিধা সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের গােপন রিপােরট কংগ্রেস নেতাদের জানা থাকলে তারা হয়তাে লীগের ব্ল্যাক মেলের কাছে নতি স্বীকার করতেন না। সেজন্য “ঐতিহাসিক কারণে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়েছে বলা চলেনা। | পূর্ববঙ্গের বাঙাল মুসলমানেরা আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছে বলেই সকলেই সেকুলার হয়েছে মনে করারও কোন কারণ নেই। ইসলামবাদী দলগুলি যা ভােট পেয়েছে, তার সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। সামরিক বাহিনী না গেলেও হিন্দুদের বাড়ি লুট হয়েছে, হিন্দুদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। মুসলিম যেসব দেশে সংখ্যায় কম, সে সব দেশে তারা একটু বেশী সাম্প্রদায়িক হয়। এজন্য ফিলিপিনের মুসলমানেরা পৃথক হতে চায়, দক্ষিণ তাইল্যান্ডের মুসলমানেরা মুসলিম মালয়েশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে না পেরে এখন স্বাধীন হতে চাইছে। বাঙালী মুসলমানেরা পাকিস্তানে সংখ্যায় বেশী বলে বাঙালী হয়েছে, অবিভক্ত ভারতে থাকলে তারা কেবল মুসলমানই থেকে যেত। শ্রী প্রদীপ জ্যোতি বিশ্বাস কলকাতা-১০

১ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা