রণাঙ্গন থেকে ফিরে
হত্যা আর হত্যা
,– সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
২৬ মারচ সকালেই ওরা খবর পেয়েছিলেন পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মস্থান বগুড়া শহর আক্রমণ হতে যাচ্ছে । এইদিন সকালে বগুড়ার পুলিশ সুপারিনটেনডেন শ্রী ইকবাল হােসেন সদর থানার এসে বাঙালী। অফিসারদের অস্ত্র ছেড়ে দিতে এক হুকুম জারি করেছেন। মুহূর্তের মধ্যে সংবাদটা রটে গেল শহরে। ঝাপিয়ে পড়লেন মুক্তিফৌজ। জমা দিতে দল বেঁধে ওরা ছুটলেন এস পি সাহেবের বাংলােতে। মুজিব বাহিনীর একদল থানা ঘিরে রাখলেন। এস পির বাড়িতে একদল অ-বাঙালী মুক্তিফৌজকে লক্ষ্য করে গুলি করল। মুক্তিফৌজ এইখানে লড়াই শুরু করলেন। তখন ২৬ মারচের দুপুরে ১২টা। এই সময় মুক্তিফৌজের হাতে বন্দী হলেনও এস পি। ঘটনা দ্রুতগতিতে এগােতে লাগল । ইতিমধ্যে শহর থেকে আটমাইল দূরে আড়িয়া বাজার ক্যান্টনমেন্ট থেকে পানজাব রেজিমেনট ট্রাক ভরতি করে শহরের দিকে ঢােকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে। আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম আগুন ধরিয়ে দেয়।
নিরস্ত্র মানুষগুলির হত্যায় মেতে ওঠে দখলদারের দল। ২৬ মারচ সকালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা শেষ। হয়েছে ৩ এপরিল সম্পূর্ণভাবে দখলদার বাহিনী খতম হওয়ার মধ্যে দিয়ে। আমরা ওই শহরে গিয়েছিলাম গত সপ্তাহে। আমাদের বাংলাদেশে হিলি থেকে একটি জীপ গাড়ী করে বগুড়া শহরে নিয়ে আসা হয়। পথে পাঁচবিবি, জয়পুরহাটে কিছু সময় আমরা ঘুরে ঘুরে দেখে গিয়েছি কিভাবে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করেছে ‘খানেদের দল’ (এইখান উল্লেখযােগ্য লােকেরা এখন পাক সামরিক বাহিনী বলেন । ওরা খান বলে উল্লেখ করেন)। বগুড়া শহরে খানদের সঙ্গে যেসব যুদ্ধ হয়েছে সেই সব এলাকায় যাওয়ার আগে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে আটমাইল দূরে আড়িয়াবাজারে। আড়িয়া বাজারে গিয়ে দেখি লম্বা লম্বা কতকগুলি সামরিক শেড ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। ভাঙা ইটগুলির উপর রক্তের দাগ। তখনও শুকায়নি।
বগুড়া শহরে ৩১ মারচ থেকে ১ এপরিল দুবার আকাশ থেকে বােমা ফেলা হয়েছে ফলে শহরের প্রায় ৪০০০ হাজার বেসামরিক ব্যক্তি মারা গিয়েছে। শহরের মধ্যে মুক্তি ফৌজের সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছে খানদের প্রায় হাজার খানেক সেনা। মুক্তি ফৌজ ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক অস্ত্র। এই শহরে রেল বাজার স্টেশন রােড, চাদনি বাজার সাত মাথার মােড়, শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদ, বৃন্দাবনপাড়া প্রভৃতি এলাকা শেলিং-এর ফলে খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃন্দাবনপাড়ায় বড় রাস্তার উপর বহু দখলদার সৈনিককে কবরস্থ করা হয়েছে। তাই শহরে এখনও দুর্গন্ধে চলা যায় না।
১১ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা