মানবতা/সংগ্রাম/শরণার্থীদের স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বরাবরেষু
— সন্তোষকুমার ঘােষ
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী, এই খােলা চিঠি সরাসরি আপনার সমীপে। প্রেরক একজন সাংবাদিক, আপনি তাকে চেনেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনুমান করি, আপনি বাংলা পড়েন না। কিন্তু নিশ্চয় আপনার তথ্য দফতরে বঙ্গভাষাভিজ্ঞ কিছু কিছু কর্মী আছেন। কর্তব্যের স্বার্থে তারা এই চিঠির মর্ম তর্জমায় আপনার কাছে পেশ করবেন। নইলে এই ব্যয়বহুল ঠাট রাখার সার্থকতা কী? শ্রীমতী গান্ধী, একান্ত অনুরােধ আপনি একবার নিজে দুই বাংলার সীমান্ত সফর করে যান। আপনি সব শুনেছেন, কিন্তু নিশ্চয়ই সব জানেন না কর্ণেন পশ্যতি” নিয়ম খাটত সেকালের রাজাদের আমলে। একালের রাজা বা রানীদের চোখ দিয়েও দেখতে হয়। তা হলেই সব বােঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী, এই সামান্য সাংবাদিক নিজে এইমাত্র সীমান্ত থেকে ফিরে এল। বৈশাখ মাস, দীর্ঘ পথে কৃষ্ণচূড়া, শিমূল আর পলাশ বড় বেশী আর বাকী নেই, কিন্তু তাদের রক্তাক্ত সত্তা যাত্রাপথে জ্বলছিল। সেই প্রাচীন পথে এক একটি আয়ুস্মাণ বৃক্ষকে মনে হয় যে জীবাত্মপ্রতিম, শুস্ক কাণ্ড আর নিষ্পত্র শাখাপ্রশাখার তাদের প্রত্যেকটির যেন মুনিঋষিসম । কোনটি বৈশিষ্ঠ, কোন্টি পুলহু, কোন্টি পুলস্ত-জানি না। তারা বারাসত থেকে বেনাপােল, বনগাঁ থেকে বয়রা, সারা পথ পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে। দূরে দূরে রুক্ষশীর্ণ খেজুরের সারি। দু-একটা আবার গুলিবিদ্ধ। বৃক্ষ বলেই ওদের ঈর্ষা করলাম। গােলাগুলি খেয়েও খাড়া আছে। মানুষ হলে? থাকত না, বাঁচত না।
শ্রীমতী গান্ধী, আজকে আপনাকে এই মানুষের কথাই কলব । “হােয়াট ম্যান্ হ্যাজ ডে অব ম্যান”- এতাবৎ খালি পদ্যেই পড়েছি। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। সেই আদ্যিকালের মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল প্রতিকুল অরণ্য প্রকৃতি আর যতেক হিংস্র জন্তু- প্রতিবেশী। তারা মানুষের শত্রু, মানবতারও শত্রু কিনা বলা যায় না। সভ্যতার আশীর্বাদে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ, মানুষ নিজেই আবার মানবতারও ঘাের বিরােধী। স্বচক্ষে তার নমুনা দেখলাম। দেখলাম, দলে দলে মানুষ, কারও হাতে মগ, টিনের কিংবা মাটির পাত্র কারও হাতে। এক ছাউনির তলায় সকলে,- নরনারী, বৃদ্ধযুবা এবং শিশু। সদ্যোজাত শিশুও দেখেছি। আশ্চর্য এই রীতি-মৃত্যুর মুখেও নবাগত প্রাণ; যা সবকিছুকে অস্বীকার করে। শুধু আসে, বাঁচতে চায়, থাকে। কিন্তু তারা থাকবে কি না, থাকতে পারবে কি না, সেইটাই কথা। রাজনীতিবিদেরা ফতােয়া দিয়ে খালাস, রাষ্ট্রশক্তি উন্মত্তের মতাে উৎসাদনে মত্ত, দুইয়ের মাঝখানে আঁতাকলে পিষ্ট প্রাণ-তবু প্রাণ।
সেই প্রাণ থরে-তরে নিরুপায় ছড়ানাে দেখে কষ্ট হল। হাতে ভাঙা সানকি নিয়ে যারা লাইন দিয়েছিল, তাদের মুখ ভুলতে কী লজ্জা তাড়াতাড়ি মহকুমা-শহরে ফিরে এসে ইনসপেকশন বাংলােতে চচোয্যলেহ্যপেয় দিয়ে উদর ভরালাম । সহৃদয় জেলা শাসক স্বয়ং আতিথেয়তা দিলেন। হৃদয়ে তবু বুঝিবা কিছু শূন্যতা ছিল, নতুবা, প্রধানমন্ত্রী, আপনাকেই বা ডাকব কেন? ডাকছি সেই গ্লানির ভার নিতে। দায়িত্ব নিতে। আগে জানতাম না, নতুন শরণাগতদের বৃহত্তর ভাগই কিন্তু হিন্দু, অন্তত এই সেক্টরে। কথাটা অতএব আর নিছক মানবতা নয়, নৈতিক দাবিও বটে। প্রায় সিকি শতক আগে একদিকে এক অস্তগামী বিদেশী প্রভু, অন্যদিকে উদীয়মান দুই রাজনৈতিক দল আপােসে তাদের বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিকিয়ে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইন হয়তাে তাদের বিষয়ে আপনাকে নিঝঞাট করেছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, আপনার নীতিবােধও কি তা-ই। বলে? | যদি সীমান্তে যান- আপনারতে হেলিকপটার আছে- সেখানেই নামবেন। বনগাঁ শহরে থামার দরকার নেই। সেখানে দুপুরে এখনও দোকানে হিন্দী গানের গৎ মাইকে বেজে ওঠে। রণক্ষেত্রের আপনি এত যে কাছে, সহসা সেটা টের পাবেন না। সব এতই নিয়মিত, এতই শীতল, এতই স্বাভাবিক। চাদপাড়ায় কাচাকাছি আসতে রাস্তার দু’ধারে কিছু কিছু মানুষ চোখে পড়তে পারে। নতুন সংসার, নতুন গৃহস্থালি, তারাও মানুষ, না মানুষের ছায়া? হাঁড়িকুঁড়ির পাশে দেখা যাবে, হাঁটু মুড়ে বসে আছে দুই-একটি সুখী গাভী। গাভী কিনা, তাই সুখী। কী ঘটছে, ওরা টের পায়নি। যেমন দি উইন্ড ক্যানট রীড নিরক্ষর হাওয়া কিছুই পড়তে পারে না, শুধু পাতা ঝরিয়ে দিয়ে যায়।
সীমান্তের এই খণ্ডে মুসলিম শরণাগতেরা সংখ্যায় কম; এই উক্তি তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র কটাক্ষ নয় । বরং এতে প্রমাণ হয়, অসম্ভব এক লড়াইয়ে জড়িয়ে গিয়েও ওপারের মুসলিম জনতার মধ্যে এখনও যথেষ্ট প্রতিরােধ অবশিষ্ট আছে। সীমান্তে দাঁড়িয়ে কিছু দূরে রাইফেল হাত নিয়ে একদল মুসলিম তরুণকেও মেঠো পথে নেমে যেতে দেখেছি। তাদের পরণে লুঙ্গি, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। তুলনায় অপ্রস্তুত এই তরুণেরা কি শুধু বাচার অধিকার আদায় করতেই তােপের মুখে মরতে এগিয়ে গেল? আবার একটু আগে বাগদা ছাড়িয়ে আমি একটি শিমুলের তলায় গৌরাঙ্গকেও দেখেছিলাম। ওপার থেকে সদ্য-সদ্য পােষা ছাগ শিশু নিয়ে সে পালিয়ে এসেছে। তারও খালি গা, চোখেমুখে আতঙ্ক আর বিমূঢ়তা, অথচ এই গৌরাঙ্গও ঝিকরগাছা কলেজে প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে বিজ্ঞান পড়ত। | প্রধানমন্ত্রী, আপনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেননি। জানি না, অন্য কোনও সাহায্য দিয়েছেন কিনা। সীমান্তের কয়েকটি অঙ্গনে ঘুরে কোনও প্রকার সাহায্যের বিশেষ কিছু চিহ্ন চোখে পড়েনি। সম্ভবত কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান এখনও আপনার হাত বেঁধে রেখেছে। এই সঙ্কোচের মানে বুঝি । কিন্তু দুনিয়ার বাকী সকলে? তারাও বােঝে তাে? যতদূর টের পাচ্ছি, সবাই ধরে নিয়েছে, আমরা এর মধ্যে আছি। সেটা যদি রটেই থাকে, তবে আর অহেতুক লজ্জার কাজ কী? জানি না, আমরা কখনও কোনও ভরসা ও পারের মুক্তিকামীদের দিয়েছিলাম কিনা। হয়তাে দিইনি। দিয়ে থাকলে কিন্তু পশ্চাদপসরণের কোনও অর্থ নেই, কোনও ক্ষমা নেই। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির একটি দুটির সক্রিয় হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করছেন? যথা, আমেরিকা? আজ স্বতঃই ধারণা হয়, আওয়ামী নেতাদের বুঝি বা প্রতারিত করেছে আমেরিকাও। পিন্ডির স্থায়িত্বেই সম্ভবত ভূমণ্ডলের এই ভাগে। মারকিন মন আর স্বার্থ আবদ্ধ। অন্যান্যদের কথা না বলাই ভাল। আওয়ামী লীগ চরিত্রগত ভাবে বস্তুত এদেশের প্রাক-স্বাধীনতা কালের কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী বুরজোয়া দলের মাধ্যমে এত বড় গণজাগরণ ঘটেছে, এটা কোনও বামপন্থী দেশের বিশ্বাসই হয় না। এদেশেও এই সত্যটা মেনে নিতে প্রগতিবাদীদের খারাপ লাগে। নানা খুঁত তারা বের করেন আওয়ামী নেতৃত্বের। দলীয় অপ্রস্তুতির, শেখ সাহেবের অন্তর্ধানের।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ত্রুটি ছিল না, একথা বলছি না। দূর দৃষ্টির অবশ্যই অভাব দেখা গেছে। অভাব দেখা গেছে সংগঠনেরও। তবুও, সব সত্ত্বেও যা ঘটেছে, আজও ঘটছে, তা অবিশ্বাস্য, অলৌকিক । ভাষাকে ‘মা’ বলা, সেই মায়ের ভিতর দিয়ে দেশকে মাতৃরূপে গ্রহণ করা- এসব সহজ ধারণার অতীত। পৃথিবীতে মানুষ এযাবৎ বহু যুদ্ধ করেছে। করেছে নিজের জিগীষা মেটাতে, করেছে নারীর জন্য। আর্থনীতিক শােষণের বিরুদ্ধেও করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রাম এ তাে শুধু আর্থনীতির জন্য নয়, এ যে সংস্কৃতির জন্য। সাহিত্য আর সংস্কৃতির কি এত শক্তি? আমরা যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ভাঙিয়ে খাই, তারাও এতটা জানিনি। না আমাদের মধ্যে, না অন্যত্র এর পরিচয় পাইনি। | সেই জন্যই শত ক্ৰটি, আপাতপরাভব সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংগ্রামীদের সেলাম করি । জানি, এই সংগ্রামের প্রতি দিল্লির প্রীতি সাংস্কৃতিক কোনও ভাবাবেগ নয়- হতে পারে না। বাঙালীর থাক বা যাক, দিল্লির কী? গণতান্ত্রিক রায়ে সর্বশক্তিমান একটি দলকে দলন করছে স্বৈরতন্ত্রী একটি ঘোট-এতদিন পরে সে-কথাও বুঝি ওঠে না। দেরি হয়ে গেছে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দুর্বলতর হচ্ছে সাদামাটা ভাষায় বলি- হয়তাে শুধু সেই টুকুতেই দিল্লির ঔৎসুক্য। যদি তাই হয়, তা হলেও ফেরার রাস্তা নাস্তি। চাই বা না চাই একটি বৃহৎ সমস্যার দায় আমাদের দু-হাত জুড়ে বসেছে, উপচিয়ে পড়ছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা শরণাগতদের নিয়ে। ইতিমধ্যেই এদেশের যা রীতি খয়রাতি নিয়ে অনাচার ইত্যাদি। তার খবর পেয়েছি। জিপের পর জিপ গাড়ি নাকি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। মানবতার নামে সমর্পিত দান কালােবাজারে ফিরে আসছে। এর প্রতিকারের জন্যেই সরেজমিনে আপনাকে আসতে বলছি। যারা গাছতলায় আছে, তাদের মাথার উপরে চালা চাই। একদিনের বর্ষায় সব আশাভরসা ধুয়ে মুছে যেতে পারেআকাশের দেবতাকে বিশ্বাস নেই। যাদের চালা জুটেছে, তাদের কাজ চাই। না থাকুক, তবু কাজ তৈরী করে দিতে হবে। শুধু লঙ্গরখানার, ‘লপসি’ খানা, শুধু দৈনিক ডােল’ মানুষকে কত মনুষ্যত্ববর্জিত করতে পারে, আমাদের তা অজানা নেই। নিপীড়িত মানবতাকে, দোহাই আপনার, আবার ভিখারী করবেন না। তাদের কিছু দিন, সেই সঙ্গে যে কোন প্রকারের কাজও করতে দিন। শ্রম বিনা গ্রাসাচ্ছাদন ত্রাণ নয়, অপমান, আত্মসম্মান অপহরণ । আর আত্মসম্মান গেলে, অন্তত আমরা তাে জানি, মানুষের সত্যকার মনুষ্যত্ব অথবা আত্মা বলে কিছু থাকে না। শ্ৰীমতী গান্ধী, আপনাকে সীমান্তের হা-হা প্রান্তরে স্বয়ং সরজমিনে আসতে নিমন্ত্রণ করছি সেই কারণে। ‘উন্মুল জীবনকে মুকুলিত করার দায় আমাদের সকলের । কিন্তু তাে আপনি প্রধানমন্ত্রী। তাই প্রধান দায় আপনারই।
৩০ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা