বাঘের থাবা থেকে গাছতলাও ভাল
— কৃষ্ণ দেবনাথ
পেট্রাপোেল, ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশের গ্রামের চাষী গিয়েছিলেন মাঠে চাষ করতে, কিন্তু পাকিস্তানী হানাদারের নিষ্ঠুর গুলি তাকে সেই লাঙলের পাশেই শেষ করে দিয়েছে। গৃহস্থ বধূ গিয়েছিলেন ঘাটে জল। আনতে, দস্যুদের মেশিনগানের লক্ষ্যে তিনি সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। মা যখন শিশুকে খাওয়াচ্ছিলেন দুধতখন দখলদার বাহিনী হানা দিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মেরে ফেলে। পেটরাপােল থেকে বয়রা, বাগদা, থেকে বনগাঁ সীমান্ত অবধি সব জায়গা জুড়ে রােজ কাতারে কাতারে শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে আশ্রয়ের আশায় আসছেন। আসার পথে এখনও অনেকে। দু’একদিনের মধ্যে আরও মানুষ আসবেন। পাক সৈন্যের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে অনেকে ভরতি হয়েছেন হাসপাতালের শয্যায়। আর যারা শিবিরে রয়েছেন তাদের সেখানে থাকাই দায়। যেখানে থাকতে পারেন একটা পরিবার, সেখানে থাকেন। অন্তত দুটি পরিবার। তাদের ঠাসা-ঠাসা করে রাখা হয়েছে। পেটরাপােল শিবির এক সময় তৈরি হয়েছিল পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের জন্য। সেই শিবিরেই এখন বেশীর ভাগ মানুষ ! পাকাঘর আগে থেকেই ছিল। সেখানে রয়েছেন তিন হাজার লােক। আর তৈরি হয়েছে অস্থায়ী শিবির। বাঁশের কাঠামে ত্রিপল দিয়ে শিবির তৈরি। পাঁচ হাজারের উপর মানুষ সেই তাবুর নীচে। কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পড়লেই সকলকেই। জড়ােসড়াে হয়ে বসে থাকতে হয়। জলের ছাঁচে ভিজে হতে হয় একসা। আগে তাঁবুতে মাটির মেঝে ছিল। চলাচলের রাস্তাও ছিল কাঁচা। এখন ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাবার জলের জন্য আছে নলকূপ। শরণার্থীরা শিবিরে আসামাত্র দেওয়া হয় টিকা। তারপর রেজিসট্রেশন কারড। সেই অনুযায়ী সবাই খাবার পান।
দুপুরে ডাল ভাত তরকারী । রাত্রে রুটি। শিশুদের জন্য বরাদ্দ গুঁড়ো দুধ আর বিসকুট। শিবিরের বাসিন্দা বৃদ্ধ মজিদ আহমেদকে জিজ্ঞাসা করলাম- কেমন আছেন? হেসেই বললেন তিনি। বাঘের থাবা থেকে বেরিয়ে এসেছি সেই ভাগ্য। এখন গাছতলাও ভাল। তারচেয়ে ঢের ভাল আছি। একটা আস্তানা পেয়েছি, খাচ্ছি, দাচ্ছি, আর কি চাই? একই প্রশ্ন ছিল সাতক্ষীরার মমতাজ বেগমকে। তিনি বললেনভারতে এসে যা পেলাম তা পাব আমরা কি কখনও ভেবেছি থাকার জায়গা, খাবার ব্যবস্থা, আসার সঙ্গে সঙ্গেই সব তৈয়ারি? কে কবে কাকে দেয় যে পাকিস্তান ভারতের এত নিন্দা করে সে একবার দেখে যাক না । তবুও ক্ষোভ আছে। বললেন মনিরামপুরের নিরঞ্জন দাস। তাঁর বক্তব্য ঃ সকালে কোনও জলখাবার বা রাত্রে কোন ভাল খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সেইটুকু হলে ভাল হত। আর মেয়েদের আবরু বাঁচানাে দায়। এই খােলামেলা জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থেকে না যায় একটু ভাল করে শােওয়া, না যায় কোনও জরুরি কোনও কাজ করা। তবে তারও কথা ঃ যা পেয়েছি তা অনেক বেশি। ভারত ছিল বলে বিপদে আশ্রয় পেয়েছি। পেটরাপােলে ভারত সেবাশ্রম সঙ্রে শিবিরে উদ্বাস্তু এখন ৮০৮৩ জন। বয়বার কছে মামা ভাগ্নে নামে জায়গায় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অন্য শিবিরেও আছেন পাঁচ হাজারের উপর শরণার্থী। আর বাগদায় কাশী বিশ্বনাথ নব যুবক সমিতির শিবিরে চারহাজারের উপর, মামা-ভাগ্নেতে শ্রীগুরু সঙ্ঘের শিবিরেও চার হাজারের উপর, আর হেলেঞ্চা শিবিরেও কয়েক হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু একটা শিবির বাড়ানাে দরকার নতুবা যে চাপ আসছে তা পরে সামলানাে কঠিন ব্যাপার।
২৬ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা