রাজধানী-রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য ভারত যথাসাধ্য করবে
— রণজিৎ রায়
পাছে কারাে মনে দ্বিধা থাকে, তাই স্পষ্ট করেই বলে নেওয়া ভালাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধ শীঘ্র শেষ হচ্ছে না। ইয়াহিয়ার জল্লাদদের জ্বরতা তুলনাহীন; সেই ক্রুরতার শিকার হয়েছে হাজার হাজার অসহায় শান্তিপ্রিয় মানুষ। আগামী কয়েক মাসে আরাে বৃহত্তর ত্যাগের জন্য তাদের তৈরি থাকতে হবে। বাংলাদেশের। মানুষ আশা করেছিলেন সাংবিধানিক পদ্ধতিতে স্বাধীনতা আসবে। কিন্তু ইয়াহিয়ার বিশ্বাস হত্যার ফলে তাদের সামনে যুদ্ধ ছাড়া পথ রইল না। | শেখ মুজিবরের আওয়ামী লীগ গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে এত বিপুল পরিমাণ আসন ও ভােট পেয়েছিল যে, তারপরও ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখার সাহস পাবে বলে শেখ মুজিবর ভাবতেই পারেননি। মারচ মাসে আলােচনার্থ ইয়াহিয়ার ঢাকা অবস্থানকালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বহু পাকিস্তানী সৈন্যকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সৈন্যদের সংঘর্ষও বেধেছিল। তখনি জেনারেলের মনে কী আছে সে সম্পর্কে অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছিল। তবে, সব সাক্ষ্য প্রমাণ সামনে রেখে বলা যায় ? সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগ নিজেকে তৈরি করেনি।
অথচ ইয়াহিয়া এমন ভান করে চলেছিলেন যে, ২৪ মারচও আওয়ামী লীগের নেতারা ভেবেছিলেন শান্তিপূর্ণ মিটমাট সম্ভব হবে; নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে। ২৫ মারচ রাত্রে শুরু হল নির্বিচার আক্রমণ । ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে যে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে লীগের নেতা কর্মী এবং বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা শুরু হলাে তাতে একটা কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠল- ইয়াহিয়া স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার মত কাউকে বেঁচে থাকতে দিতে চান না। ব্রিটিশ রাজের মত পশ্চিম পাকিস্তানীও দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালীদের ঢুকতে দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর বাঙালীরা, বাঙালী রেজিমেন্ট এবং সমগ্র পুলিশবাহিনী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, এবং কয়েকটি স্থানে পাক-বাহিনীকে পর্যদস্ত করে ফেলে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সারা বাংলাদেশেই দা-কুড়াল নিয়ে পাক-সেনার সম্মুখীন হয়; কয়েকটি ক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষা-শূন্য, অস্ত্রশূণ্য সাধারণ মানুষের ঘরােয়া হাতিয়ার দিয়েই বহু সেনাকে খতম করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না; এক জোনের সঙ্গে অন্য জোনের কোন যােগসূত্রও না।
বাংলাদেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখার যে মতলব ইয়াহিয়া ফেঁদেছিলেন তা স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। এখন তিনি ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা বন্ধ করার দিকে নজর দিয়েছেন। কাজটা সােজা নয় । আঁকা-বাঁকা সীমান্তের ১২০০ পােসটে লােক দিতে হলে তাকে অনেক বড় শহর ও ছাউনি থেকে সৈন্য সরিয়ে আনতে হবে; কিংবা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসতে হবে। তাতে সে দিক দুর্বল হয়ে পড়বে। তাছাড়া, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও তিনি সৈন্য মােতায়েনের চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারবেন না। | ওদিকে মুক্তিফৌজ সংহত কমানড গড়ে তুলছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই সরকার গড়েছে। পরে অন্যান্য দল তাতে যােগ দিতে পারে। যুদ্ধের কায়দা পালটে যাচ্ছে। মুক্তিফৌজ ক্রমশ
গেরিলা যুদ্ধের কায়দা অনুসরণ করছে। সাধারণ মানুষও যুদ্ধ করা শিখছে। গত চার সপ্তাহে ইয়হিয়ার অসুবিধাগুলি দূর হয়নি; আগামী দিনে তা আরাে বাড়বে। | আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু দেশ প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন মতামত প্রকাশ করেনি বটে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা ইয়াহিয়ার সমর্থক। বিশ্বের সংবাদপত্র এখনকার মত আর কখনাে ইসলামাবাদের এত সমালােচনা করেনি। এখনকার মত আগে কখনাে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাস্পৃহা এত প্রকট হয়ে ওঠেনি। পাক-সেনাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ও ফটো বিশ্বজনমতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ইসলামাবাদের ক্রিয়া কাণ্ডকে সমর্থন জানিয়েছে এমন একমাত্র বড় দেশ হল চীন। তার জন্য সে দেশ ভুট্টোর প্রশংসাও পেয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মতে, চীন চায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এলাকা সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ বজায় থাকুক। চীনের মতে, বাংলাদেশ ইসলামাবাদের অধীনে থাকলেই তা সম্ভব।
বলা হচ্ছে- যুদ্ধ চলতে থাকলে এবং জয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে চীনের মনােভাব পালটে যেতে পারে। কারণ, চীনের হিসাবমত, এধরনের দীর্ঘায়ত যুদ্ধ আওয়ামী লিগের মত “বুরজোয়া দলের হাতে বরাবর থাকতে পারে না। তার হিসাবে নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত চরমপন্থীদের হাতে চলে যাবে, যারা ভারতকে বন্ধু হিসাবে চাইবে না। আর তখনি চীনের মনােভাব নতুন মােড় নিতে পারে। দুই বৃহৎ শক্তি সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া বিবরণে বিচলিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত শ্রীকেনেথ কিটিং বলেছেন- বাংলাদেশে যা ঘটছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মাত্র নয়। ওদিকে যুদ্ধের বিবরণ ও ফটো প্রকাশ করে আমেরিকার সংবাদপত্র আমেরিকার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তাদের পররাষ্ট্র দফতর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইয়াহিয়াকে ‘রাজনীতিক বােঝাপড়ার পথে আসতে বলেছে। কূটনীতিক বৈঠকে আরাে বহু দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। খােদ বাংলাদেশেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনােভাবে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ন্যাশনাল আওয়ামীদলের নেতা মৌলানা ভাসানি চীনের মনােভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি তুলেছিলেন, সে সময় তাঁর এই দাবিকে শেখ মুজিবরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাল বলে অনেকে মনে করেছিলেন। কিন্তু চোখের সামনে ইয়াহিয়ার জল্লাদদের রক্তলােলুপতা দেখে তার মনােভাব পালটে গিয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ এবং তাজুদ্দিন আহমেদের সরকারের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন জানিয়েছেন। নতুন সরকারের পক্ষে এটা বিরাট জয় । পাকিস্তানী শােষণের ফলে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা কোনদিনই ভালাে ছিল না। যুদ্ধ যত বেশি দিন চলবে তার আর্থিক অবস্থা ততই সঙ্গীন হয়ে উঠবে। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে; কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া জুয়া ছাড়তে নারাজ। বাংলাদেশের জন্য প্রচুর পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী প্রয়ােজন।
শুধু ব্যাপক হত্যা নয়, ব্যাপকভাবে হিন্দু বিতাড়ন এবং পাকিস্তান বিরােধীদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করাও ইয়াহিয়ার পরিকল্পনার অঙ্গ বলে মনে হয়। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মুসলমান সমেত প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এ সংখ্যা আরাে বাড়বে। ফলে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করার জন্য ভারতকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। যুদ্ধে আহত মুক্তিফৌজের লােকজনও চিকিৎসার জন্য ভারতে চলে আসতে পারেন। | বাংলাদেশে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার জন্য ভারত অন্যান্য দেশকে অনুরােধ করে প্রথমে অনুকূল সাড়া পায়নি। কিন্তু এখন অনেকের মনােভাব পালটাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কী পরিমাণ সাহায্য দিতে হবে, কীভাবে। তা দেওয়া যাবে তা নিয়ে মারকিন এবং ভারত সরকারে। মধ্যে আলােচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য দেওয়া প্রয়ােজন বলে অনেক ইউরােপীয় দেশও মনে করতে শুরু করেছে। তবে কবে, কতটা আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া যাবে তা বলা যাচ্ছে না। ভারতের মাটিতে বসে ত্রাণসামগ্রী বণ্টনের দায়িত্ব যাতে ভারতীয় এজেন্টদের হাতেই দেওয়া হয় তার উপর ভারত জোর দেবে। তা ছাড়া, নিজের সম্বলে টান পড়লে ভারত বাংলাদেশের জন্য তার যতদূর সাধ্য করবে।
২২ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা