আমাদের কর্তব্য।
— শিবদাস ভট্টাচার্য
মুক্তি ফৌজের বীর সেনানীদের বিচ্ছিন্নভাবে সাহায্যের জন্য ছােট বড় একাধিক সমিতি গঠিত হয়েছে। এপার বাংলার হাজার হাজার মানুষ যে যা পারেন তাই ওই সব সাহায্য সমিতির কাছে পাঠাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাংলাদেশের জন্য পশ্চিম বঙ্গবাসীর সহানুভূতি ও সমর্থন যে অপরিসীম এসব তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই সঙ্গে আমাদের অতিরিক্ত কিছু কর্তব্যও আছে। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে এ সংগ্রাম তাড়াতাড়ি শেষ হবার নয়। সে ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া এ বাংলায়ও দেখা দেওয়া অবধারিত। এবং এই প্রতিক্রিয়া কী কী ধরনের হতে পারে তার সম্মুখীন হতে আমাদের অর্থাৎ পশ্চিমবাঙলার জনসাধারণ ও সরকারের কী কীই বা করণীয় সে সব আগেভাগে পর্যালােচনা করে ইতিকর্তব্য স্থির করা বিশেষ প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। প্রথমত বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামের তীব্রতা যতই বাড়তে থাকবে সীমান্ত পেরিয়ে তত বেশী পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমাগম বৃদ্ধি পাবে। আর এবার শুধু হিন্দু নরনারীই নয়, অনেক মুসলমান নরনারীও এই উদ্বাস্তু দল ভারি করবেন। ইতিমধ্যেই কোন কোন সীমান্তে বেশ কিছু হিন্দু-মুসলমান উদ্বাস্তু এসে পৌঁছেছেন। এদের এখানে আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করতেই হবে এবং হিন্দু ও মুসলমান উদ্বাস্তু পরিবারগুলির জন্য পৃথক পৃথক শিবির করতে হবে। দেশ ভাগের পর গত ২২ বছর অতীতে বহুবার দলে দলে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় উদ্বাস্তু প্রবেশ ঘটেছে। সে সবই হিন্দু পরিবার। তাদের পুনর্বাসনের জন্য যথাযােগ্য সাহায্য দেননি। এবং যাও দিয়েছেন তা হয় সময়মত আসেনি, না হয় যথাযােগ্যভাবে বন্টিত হয়নি। এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু পুনর্বাসন হয়নি। ফলে উদ্বাস্তুদের অধিকাংশেরই সমস্ত দায়টা প্রায় পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়েই চেপে গিয়েছে। উদ্বাস্তু সমাগমের চাপে পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছে। এই পটভূমিকায় বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙলাদেশ থেকে যে উদ্বাস্তু-সমাগম ঘটবে তার দায় পুরাপুরি কেন্দ্রীয় সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অচিরেই একথাটা সুস্পষ্টভাবে কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য।
দ্বিতীয়ত বাঙলাদেশে পাক জঙ্গীশাহী যে রকম বর্বরভাবে বােমা বর্ষণ, নির্বিচারে নিরীহ নরনারীদের হত্যা, বাড়ি ঘর দুয়ার, হাটবাজার, ধানের গােলা প্রভৃতি ধ্বংস করছে তাতে সেখানকার জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে পর্যদস্ত হচ্ছে। এতে আর কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে নাগরিক সাধারণের মধ্যে নানা অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা। শুধু চাল ডালই নয়, বস্ত্র, ঔষধপত্র, কেরােসিন ও জীবনধারণের অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যেরও অনটন দেখা দিতে বাধ্য। প্রতিবেশী হিসাবে আমাদের কর্তব্য হবে বাঙলাদেশের ওই দুর্গত ভাইবােনেদের সাহায্যের জন্য এখান থেকে যথেস্ট পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্য নিয়মিত যােগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত সীমান্ত বরাবরই এক শ্রেণীর কালােবাজারী চোরাই চালানদারদের স্বর্গরাজ্য। যুদ্ধের অনিশ্চিত অবস্থার সুযােগে এই কালােবাজারী ও চোরাই চালানদের কাজকর্ম যাতে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত হয় সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই তিন সরকারের সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়ােজন হবে।
চতুর্থত এপার বাঙলার জনসাধারণের আশা, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ভারত সরকারের সঙ্গে তার একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং ক্ষেত্রে দুই সরকারই সীমান্ত পথে যাতে ব্যবসায় বাণিজ্য ও লােক চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক হয় তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, অবাঞ্ছিত ও বে-আইনী ব্যবসায় বাণিজ্য রােধ করা দরকার, অবাঞ্ছিত লােকজনের চলাচলও তেমনই নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার যাতে দুই বাংলার সীমান্ত অঞ্চল গুপ্তচরের অবাধ রাজ্যে পরিণত না হয়।
তাছাড়া অনেক আগে থেকেই অনেক পাড়ার ওপার বাংলার সাহায্যের নাম কৌটাহাতে এক শ্রেণীর লােক অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলেন। সম্প্রতি অনেক সংস্থা এই সাহায্য সংগ্রহে নেমেছেন। এসব সাহায্য সংগৃহীত হওয়ার পর যাতে ওপার বাংলার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে গিয়ে পৌছায় তা খেয়াল রাখা দরকার। ছােট ছােট সংস্থা বা সংগঠনগলির বাঙলাদেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করার নানা অসুবিধা আছে। তাই সংগৃহীত সব সাহায্য নির্ভরযােগ্য কেন্দ্রীয় সাহায্য সমিতির হাতে পৌছে দেয়া সমীচীন এবং নিরাপদও।
১৮ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা