“যদি বাংলাদেশের মধ্যেই সীমান্ত বরাবর পাঁচ দশ মাইলও ওঁদের জন্য নিরাপদ রাখা যায়,
তবে তারা সেখানেও দাড়াতে পারেন।
–পান্নালাল দাশগুপ্ত
ইতিমধ্যেই কয়েক লক্ষ আশ্রয়প্রার্থী নরনারী শিশু দীর্ঘ তিন হাজার মাইল ভারত সীমান্ত দিয়ে এদেশে ঢুকেছেন। কী অবস্থায়, কী শােচনীয়ভাবে তাঁরা ঢুকেছেন তা অবর্ণনীয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢুকতে পেরেছেন, এমন ব্যক্তি কম। অনেকেই পথে হারিয়ে গেছেন বা মারা পড়েছেন, নির্মম নিষ্ঠুর পাক বাহিনী পিছু থেকে তাড়া করে আসছে, আমাদের সীমান্তের মধ্যেও ঢুকে পড়বার সাহসও তারা দেখায়। এই নিয়ে ভারত সরকার একটা হুমকি দিয়েছে বটে পাক-সরকারকে, কিন্তু পাকবাহিনী একমাত্র প্রতিশােধের ভয় ছাড়া অন্য কোন ন্যায় নীতির ধার ধারে না। তাসখন্দ চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের দুই ধারে তিন মাইল- বরাবর কারাে সৈন্যসামন্ত মােতায়েন করা হবে না, এমন কথা ছিল। কিন্তু আমরা জানি এই চুক্তি তারা মানে না, মানবে প্রয়ােজনে যে কোনরকম উপদ্রব করতে তারা কুণ্ঠিত নয়।
মুক্তি ফৌজের সবগুলি ঘাঁটি উড়িয়ে দেবার জন্য পাকবাহিনী যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে যদি তারা সফল হয় তবে এর ভয়াবহ পরিণাম কতটা সেকথা আমাদের ভাবতে হবে এবং প্রস্তুত হতে হবে। মুক্তিফৌজের (ই বি আর, ই পি আর, আনসার, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক বহিনী) ভরসাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণ অমন ভয়াবহ পাইকারী হত্যাকাণ্ডের মধ্যেও বাংলাদেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যদি মুক্তিফৌজের হাতে যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র না থাকে, মুক্তিফৌজের সামরিক নেতৃত্ব একটি সুসংগঠিত ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী (স্ট্রাটাজী ও ট্যাকটিকস) এই নিরস্ত্র জনসাধারণকে কোনপ্রকার রক্ষাছত্র না দিতে পারে, তবে নানা সীমান্ত দিয়ে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থী ভারতে ঢুকে পড়বেই। শরণার্থীদের সম্ভাব্য সংখ্যা তখন লক্ষ ছাড়িয়ে কোটিতেও এসে পড়তে পারে। মনে রাখা দরকার বাংলাদেশে আজও এককোটির মত হিন্দু আছেন। তারা সেখানে সত্যিই অত্যন্ত বিপন্ন। তাছাড়া বাঙালী মুসলমান আজ বাংলাদেশে থাকতে পারছেন না। তারাও হাজারে হাজারে এসে পড়েছেন। এত লােকেদের আমরা ঠাই দেবাে কোথায়? খাওয়াবাে-পরাব কী। দিয়ে। বসাবাে কোথায়? তারা যে প্রতিরােধ করবেন তার জন্যই বা রুখে ফিরে দাড়াবেন কোথায়? যদি বাংলাদেশের মধ্যেই সীমান্ত বরাবর পাঁচ-দশ মাইলও তাদের জন্য নিরাপদ রাখা যায়, তবে তারা সেখানেও এসে দাঁড়াতে পারবেন, সেখান থেকেই আত্মরক্ষার ব্যুহ তৈরী করতে পারেন, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়ে বাচার ও লড়বার স্থান করে নিতে পারেন। অতীতে অনেকবার একথা উঠেছে যে, লক্ষ লক্ষ নরনারী ও পরিবারকে যদি ভারতকে পুনর্বসতি দিতে হয়, তবে পাকিস্তানকে বাধ্য করা উচিত তাদের জন্য যথােচিত স্থান ছেড়ে দিতে। কথাটা সেদিন ভাল শােনায়নি। এজন্য যে এতে ভারতের পক্ষে যেন আগ্রাসী অভিপ্রায় আছে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ সেখানে পাকিস্তানকে মানে না এমন লােকই চোদ্দ আনা, তারা নির্বাচনের মারফৎ যে রায় দিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই ভারতে আসতে চাননা।
তারা স্বাধীন সরকার ঘােষণা করেছেন বাংলাদেশের জন্য। এই স্বাধীন সরকার যদি শরণার্থী লক্ষ লক্ষ পরিবারের ভারগুলিও নেন, অর্থাৎ সে দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়, তবে ভারতের তিন হাজার মাইল সীমান্ত বরাবর ৫/১০ মাইল দীর্ঘ একটা অঞ্চল তারা নিজেদের আশু আয়ত্তের মধ্যে আবার কার্যক্রম নিতে পারেন। স্বাধীন বাংলা সরকারকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত সরকার স্বীকার করতে যত সময় নিক, এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অপেক্ষায় সব কাজ বন্ধ থাকতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে সর্বরকমে নিজ পায়ে দাঁড়াবার মত সবরকম সাহায্য ভারতকে দিতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অনুগত কোটি কোটি লােকের মধ্যে যে লক্ষ লক্ষ লােক আজ স্রেফ বাঁচবার জন্য এদেশের সীমান্ত বরাবর ছুটে আসছে, তাদের রক্ষা করার প্রধান দায়িত্ব স্বাধীন বাংলা সরকারের, কিন্তু সে দায়িত্ব বহন করার ক্ষমতা আজও সেই শিশু সরকারের হাতে। আসেনি। কিন্তু সীমান্ত বরাবর উক্ত অঞ্চলগুলিকে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দূর পাল্লার কামানের রক্ষা ছত্র দেওয়া যায়- যার জন্য ভারতীয় গােলন্দাজ ও সীমান্ত রক্ষাবাহিনীকে বাংলাদেশের মধ্যে ঢােকবার প্রয়ােজন নেই, তবেই স্বাধীন জয় বাংলা সরকারের পক্ষে তার শূন্যমূল প্রজাবৃন্দকে আশ্রয় দেওয়া, রক্ষা করা ও মক্তিফৌজে সকল জোয়ানদের পুনর্গঠিত করে তােলার পক্ষে সত্যিকার সহায়তা দেওয়া হবে। নির্যাতিত মানুষেরা মনােবল ফিরে পারেন, তারা একটা জায়গায় এসে রুখে দাঁড়াতে পারবেন সংগ্রামী গেরিলাবাহিনীতে ভরতি হতে পারবেন, নানা ধরনের কমানডাে স্কোয়াডে নিযুক্ত হতে পারবেন। নিজেদের দেশের মাটির ওপরেই তারা আছেন, প্রত্যয় তাদের শক্তি দেবে। সে অঞ্চলটাকে মুক্ত রাখা ও সংগ্রামের প্রয়ােজনে আবশ্যকীয় বেস (Base) হিসেবে ব্যবহার করা, নিজেদের চলাফেরা বা ম্যানুভার করার মত প্রশস্ত স্থান পাওয়া—এসব সেক্ষেত্রেই সম্ভব। কিন্তু যদি এই হাজার হাজার সংগ্রামী যুবক ও মুক্তি ফেীজের লােকদের নিজ দেশ পরিত্যাগ করে ভারতে এসে কেবলই আশ্রয়ই নিতে হয়, তাঁরা নিজেদের যেমন মনােবল হারিয়ে ফেলবেন, তেমনি আমাদের পক্ষেও কালে একটা গলগ্রহ হিসেবে পরিণত হবেন। আমরা অতীতে লক্ষ লক্ষ রিফিউজী বা শরণার্থী দেখেছি, আমরা কি তারই পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই? আরও দশ-বিশ-পঞ্চাশ বা কোটি লােকের শরণার্থীর ভীড় বহন করার আমাদের শক্তি আছে? আমাদের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি তাতে টাল সামলাতে পারবে?
অতএব আমাদের একটা পরিষ্কার পলিসি নিতেই হবে, নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়ােজনেও। নিজেদের ঘাড়ে অসম্ভব একটা দায়িত্ব আমাদের যদি ডুবিয়ে দেয়, তবে উপায়? আজ সম্ভাব্য লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে যারা শিশু নারী ও বৃদ্ধ তাদেরকে আমরা অবশ্যই নিজেদের দেশের মধ্যে আশ্রয় দেবাে। কিন্তু সংগ্রামী যােদ্ধাদের ও নওজোয়ানদের জন্য চাই আশ্রয় নয়, তাদের জন্য চাই সংগ্রাম পরিচালনা করার মত বেস বা মুক্তাঞ্চল। সীমান্ত বরাবর (৫/১০ মাইল) যে অঞ্চলের রক্ষাব্যবস্থার কথা আমি বলেছি, সেটাই হবে সে আত্মরক্ষার যুদ্ধের আশ্রয় । প্রাণে বাঁচবার আশ্রয়টাই বড় কথা নয়, সংগ্রামকে রক্ষা করার মত ক্ষেত্র রক্ষা করা বা সংগ্রামের আশ্রয়টাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে বড় কাজ।
আজ যে আমরা পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে পিছন থেকে আঘাত হানা, ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি গেরিলা সংগ্রামের কৌশলের কথা শুনছি, এসব গেরিলাবাহিনীর জন্যই চাই প্রশস্ত ক্ষেত্র, দ্রুত চলাচল করার নিরাপদ ক্ষেত্র, নিরাপদ স্থানে প্রয়ােজনে আশ্রয় নেওয়া ও শক্তি পুনর্বিন্যাস করে নেবার মত ক্ষেত্র। মুক্তিবাহিনীকে অপারেট করার মত যথেষ্ট স্থান চাই, পিছু হটে আসবার মত স্থান চাই, দ্রুত অগ্রসর হয়ে যাবার মত অঞ্চল চাই, তেমনি চাই সাপলাই পথ, করিডর ইত্যাদি। এরই মধ্য দিয়েই, বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই, সেই ঝটিকাবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী তৈরী হতে পারে। সীমান্ত বরাবর। ঐ অঞ্চলটা সে কাজে আসবে বা সে কাজে ব্যবহৃত করা যায় । মুক্তিফৌজ আজ যে সব জায়গা থেকে হটে যেতে বাধ্য হচ্ছে, হটে গিয়ে তারা যাচ্ছেন কোথায়? পরিকল্পিত উপায়ে যদি পিছু না হটেন, তবে একটা বিভ্রান্তি ও ত্রাস সৃষ্টি হতে পারে, তারা অসম্ভব নির্যাতন ও মৃত্যুর মধ্যে পড়ে যেতে পারেন। মুক্তিফৌজের প্রতিটি অফিসার ও সৈন্যকে ও প্রত্যেকটি মূল্যবান হাতিয়ারকে রক্ষা করতে হবে, নষ্ট হতে দিতে অথবা শত্রুর হাতে পড়তে দেওয়া চলবে না। যদি পিছু হটতে হয়, তারা যেন যথাসম্ভব পূর্ব পরিকল্পিত উপায়ে ওপথেই ফিরতে পারেন, তাদের যেন শত্রুর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে অবস্থিত করানাে যায়, সে সমস্ত স্থান এখনও নিরাপদ অনাক্রান্ত সে সব জেলায় ও স্থানে পার্বত্য অঞ্চলে, নদী নালা বহুল জেলায় শৃঙ্খলার সঙ্গে সরিয়ে দিতে পারা যায়। | মনে রাখা দরকার সুশিক্ষিত সৈনিক ও সমর নায়ক মুক্তিফৌজের হাতে যথেষ্ট নেই। যা কিছু আছে। তাদেরকে লক্ষ্য করা দরকার। অস্ত্র অনেক আসতে পারে- পরে, কিন্তু অস্ত্র ও যুদ্ধ পরিচালনা করবে যারা সেই মানুষগুলিই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের মনােবল, উৎসাহ ও বিশ্বাসের উপরে ও দক্ষতার উপরে সব কিছু নির্ভর করে। ভারত বা বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের তাই আশু কর্তব্য হলাে এই মুক্তি ফৌজের সৈন্য ও অফিসারদের রক্ষা করা, তাদের সুরক্ষিত স্থানে ফিরিয়ে আনা, তাদের অসহায় শরণার্থী করে না ফেলা, তাদের পায়ের তলায় নিজেদের দেশেরই এক চিলতে হলেও স্থান করে দেওয়া, যে স্থানটিকে তারা তাদের যুদ্ধের প্রাথমিক বেস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে সব মুক্ত অঞ্চল, অসংখ্য গ্রাম ও বন্দর আছে সেগুলিকে কি তবে ছেড়ে দিতে হবে? মােটেই না। কিন্তু সেগুলিতে সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখা, সে মুক্তাঞ্চলগুলিকে শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করা নির্ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সুরক্ষিত অঞ্চল থেকে মদত করার যােগসূত্র বা করিডর সৃষ্টি ও রক্ষা করার উপরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মুক্ত অঞ্চলগুলিকে মদত দিতে হবে। কোথায় কীভাবে এই সব মুক্ত অঞ্চলগুলি গড়ে ওঠে তার উপরে যাবতীয় স্ট্রাটাজী নির্ভর করবে। আজই সে কথা বলা যায় না। প্রত্যন্ত মুক্ত অঞ্চল ও ভারত থেকে অভ্যন্তরীণ- মুক্ত অঞ্চলগুলির প্রয়ােজনীয় সমর সম্ভার ও রি-এনফোর্সমেন্ট তখন হাে-চি-মিন ট্রেইলের মত পথ সৃষ্টি করার উপর নির্ভর করবে।
কোন যুদ্ধই একটা কেন্দ্রীয় পলিসি বা স্ট্রাটাজী ও ট্যাকটিকস ছাড়া চলতে পারে না- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও চাই তেমনি সামগ্রিক নীতি ও পরিকল্পনা। কেবলমাত্র বন্দুক ছুঁড়তে পারলেই বা প্রাণ দিতে পারলেই যুদ্ধে জেতা যায় না। স্বাধীন বাংলা সরকার ও তার সামরিক কমাণ্ড ও ভারত সরকারকে তই কতগুলি মৌলিক বিষয়ে বিশেষ করে যুদ্ধ পরিচালনা করার নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে ভাবতে হবে। কেবল সাহায্য করলেই হবে না, সাহায্যটা কীভাবে কোথায় কখন ব্যবহার করতে হবে তাও নির্ধারিত করতে হবে। এর জন্যও চাই staff command। কেবল ঠেলাঠেলি, দৌড়াদৌড়ি, হাকপাক আর গুতােগুতিতে এখন আর চলবে না। এ যদি না করা হয় তবে অতি মূল্যবান মুক্তি সৈনিক ও অফিসারদের তারা হারাবেন এবং সে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হবে না। প্রতিরােধ সংগ্রাম আবার নতুন। করে গঠন করা কঠিন হবে। যে কাজ এখন করা সহজ, পরে তা হাজারগুণ কঠিন হবে, হাজার গুণ ব্যয়সাপেক্ষ হবে।
১৮ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা