You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজ্য- রাজনীতি মুক্তিযােদ্ধারা শেষপর্যন্ত জিতবেনই; কারণ ওরা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন - বরুণ সেনগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

রাজ্য- রাজনীতি মুক্তিযােদ্ধারা শেষপর্যন্ত জিতবেনই; কারণ ওরা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন

— বরুণ সেনগুপ্ত

যারা ধরে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ খুব তাড়াতাড়ি পাক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে গােটাদেশকে নিজে দখলে নিয়ে আসতে পারবেন তাদের মধ্যে এখন কিছুটা নৈরাশ্যের ভাব ফুটে উঠেছে। সীমান্তের বড় বড় শহরগুলিতে পাক সেনাবাহিনী যত এগিয়ে আসছে ততই তারা আশংকিত হয়ে উঠছেন, ততই তারা মনে করছেন-তাহলে বােধহয় মুক্তিফৌজ আর পারলেন না। কিন্তু এভাবে হতাশ হওয়ার মত এখনও কিছু ঘটেনি। এটা মনে করা যেমন আমাদেরই অনেকেরই ভুল হয়েছিল যে মুক্তি সেনাবাহিনী খুব তাড়াতাড়ি পাক সেনাদের পর্যদস্ত করতে পারবেন, তেমনি এটা ধরে নেওয়াও ভুল এবং অযৌক্তিক যে, পাক সেনারা গত কয়েকদিনে যেভাবে এগিয়েছে তাদের সেই অগ্রগতি তারা অব্যাহত রাখতে পারবে অথবা বিভিন্ন ঘাটিতে দখল অটুট রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। লড়াইয়ে জয় পরাজয় সব সময়ই থাকে। লড়াইয়ে কখনও এগােতে হয়, কখনও পিছােতে হয়। লড়াইয়ের কলা কৌশলে শিক্ষিত এবং অঢেল অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় আশিহাজারের একটা বাহিনীকে চট করে পর্যদস্ত করা এত   সহজ নয়। বিশেষ করে একটি অসংলগ্ন আধা সামরিক বহিনীর পক্ষে- যাদের হাতে ভারী অস্ত্র বলতে তেমন কিছু নেই, যাঁদের হাতে গুলি গােলা খুবই কম।

বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাচ্ছেন কারা? চালাচ্ছেন প্রায় ৪০-৫০ হাজারের একটা অসংলগ্ন আধা সামরিক বাহিনী। এতে পুরাে সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত আছেন শুধু ই বি আর অর্থাৎ পাক সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেনটের বাঙালী সৈনিকরা। বিদ্রোহের ভয়ে পাকসামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককেই আগে ভাগে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্ববাংলায় ছিলেন মাত্র হাজার পাঁচেক। আধা সামরিক বাহিনীর প্রধান হলেন ই পি আর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। ই পি আরের মধ্যেও অফিসারেরা এবং অস্ত্রচালকরা অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। তারা অধিকাংশই অস্ত্র শস্ত্র সহ গিয়ে যােগ দিয়েছেন পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে। যারা মুক্তি বাহিনীতে যােগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে খুব অল্প লােকই মেসিনগান বা মরটার চালাতে জানেন। তাদের অধিকাংশের হাতে ছিল সেই পুরানাে ২.২ রাইফেল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ই পি আর পরিচালনার ভার কখনও বাঙালীর হাতে দেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ই পি আরের বাঙ্গালী সিপাইকে কখনও ভারী অস্ত্র চালাতে শেখায়নি। মুক্তি বাহিনীতে আর আছেন মােজাহিদ, আনসার এবং পুলিশ। এদেরই বা অস্ত্র শিক্ষা কতটুকু। মােজাহিদরা আরও একটা বাড়তি অসুবিধায় পড়েন গােড়া থেকেই। তাদের হাতে ছিল সব চীনা রাইফেল- যে রাইফেলের গুলি পাক সেনাবাহিনীর হাতে।

মুক্তিবাহিনীতে এরা ছাড়া আর ছিলেন ছাত্র ও যুবকেরা। তারা লড়াই করতে এসেছিলেন হাজারে হাজারে। যে যা পেয়েছিলেন তাই নিয়েই। আমি যশাের শহরে গিয়ে দেখেছি ছাত্র ও যুবকেরা লােহার রড হাতে নিয়ে পাসৈন্যের সঙ্গে লড়াই করতে এগিয়ে যাচ্ছে।  এই যে মুক্তিবাহিনী তার পক্ষে অস্ত্রে সজ্জিত একটা বিরাট বহিনীকে চট করে পর্যদস্ত করা সম্ভব নয়। তারা প্রথম প্রথম বহু ক্ষেত্রে পরাজিত হবেন, তারা হাজারে হাজারে প্রাণ হারাবেন, তাদের যথেষ্ট ক্ষয় ক্ষতি হবে- কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জিতবেনই কারণ তারা মুক্তি যুদ্ধ লড়ছেন। কারণ, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের সমর্থক। কারণ, পাহিনী স্রেফ একটা দখলদার বাহিনী। কারণ মুক্তি সৈনিকদের বিশেষ করে ছাত্র ও যুবকদের মনােবল বিরাট- তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাই মুক্তি সেনাদের শিক্ষিত সৈনিক করে তুলেছে। প্রতিমুহূর্তের অভিজ্ঞতাই তারা পরবর্তী ধাপে কাজে লাগাচ্ছেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যারা অনেকে ২৭ তারিখ বিকেল পর্যন্তও নির্দেশের অভাবে চুপ করে বসে ছিলেন, ২৫ বা ২৬ তারিখ যারা অনেকে স্রেফ পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের হুকুমে মরটার ও মেশিনগান হাতছাড়া করেছেন আজ তারা কত সতর্ক, আজ তারাই কীভাবে গেরিলা কায়দায়  পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাচ্ছেন। অতর্কিতে আক্রমণ হানার কায়দায় ওরা এখন কতটা অভিজ্ঞ তার একটা দিক শুধু তুলে ধরছি। যেহেতু ব্যাপারটা আর গােপন নয়, তাই সত্যি কথাটা এখন জানা যায়। মুক্তিবাহিনী যখন প্রথম তিন চারদিনের লড়াইয়ের পর দেখলেন যে, পাক বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই করে সাফল্য অর্জন করা কঠিন, তখন তারা শত্রুপক্ষকে বিপথে চালিত করার একটা নতুন কায়দা ধরলেন। তারা পাক সেনাদের কাছে ভুল খবর পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাদের বেতার যন্ত্র বেশি নেই যে তাতে ভুল খবর বলে শত্রুপক্ষকে বেকায়দায় ফেলবেন। কোনও বাঙালীর মাধ্যমে পাক সেনাবাহিনীর কাছে ভুল খবর পৌছবারও পথ নেই, কারণ ওরা বাঙালী দেখলেই গুলি করে হত্যা করে। তখন তারা একটা নতুন পথ ধরলেন। তারা সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্র মারফত মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল খবর প্রচার করতে লাগলেন। পাক সেনাবাহিনী জালে পা দিল। তারা সেইভাবে অগ্রসর হল। কিন্তু কিছুই পেলনা। তারপর তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ হানলেন মুক্তিফৌজ।

এইভাবে তারা বহু পাক সেনাকে ঘায়েল করেছেন। মুক্তিফৌজের পরিচালকরা এখন বেশ হাসতে হাসতেই বলেনঃ আরও কায়দা খাটছে না। ওরা বুঝে গিয়েছে। এখন তাই ওরা আর কোনও খবরের উপর ভরসা করে এগােয় না। এটা অভিজ্ঞতার শিক্ষা। এই রণকৌশল মুক্তিফৌজ ট্রেনিং স্কুল বা কলেজে শেখেনি। শিখেছে রণাঙ্গনে। এমনিভাবে বাংলাদেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ লড়াইয়ের কায়দা শিখছেন। শিখছেন অস্ত্র চালনা। শিখছেন পথঘাট অচল করে দেওয়ার কলাকৌশল। শিখছেন অল্প লােক দিয়ে অতর্কিতে বিরাট সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার কায়দা। খুব দ্রুত তারা শিখছেন। কিন্তু তবু সময় লাগবে। দু-চার সপ্তাহে এ ধরনের লড়াইয়ে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হতে পারে না। এ লড়াই চলবে। এ লড়াইয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর। লড়াইয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত জয় কিছুতেই হতে পারে না। | এই লড়াইয়ে আমাদের অর্থাৎ আমরা যারা বাংলাদেশের পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরে বাস করি, তাদেরও বিরাট ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী অনেক কিছু করছেন। কী কী করছেন, তা নিশ্চয়ই ঢাক পিটিয়ে বলা হবেনা। তবে এটা বিনাদ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বের বহু মানবদরদী নেতার চেয়ে এক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা কম নয়।

সরকার ছাড়া সাধারণ মানুষেরও অনেক কিছু করতে হবে। আজ সবচেয়ে বড় জিনিস সেটা আমাদের দেখতে হবে তা হল, বাংলাদেশের অর্থনীত যেন ওপার ও এপারের কিছু অসাধু লােকের হাতে গিয়ে না পড়ে। ওপারের স্বাভাবিক যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাই বিধ্বস্ত ওপারের ব্যবসা বাণিজ্যও। শহর ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামে। গ্রামীণ অর্থনীতির উপর তাই বিরাট চাপ। গ্রামে গ্রামে খাদ্যাভাব। অভাব কেরােসিন, দেশলাই, টরচের ব্যাটারী, মােমবাতি, ওষুধপত্র প্রভৃতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের। আমাদের সরকার চান আর না চান, এসব জিনিস এপার থেকে ওপারে যাবে। ওপারের লােকেদেরও দেখতে হবে আমাদেরও দেখতে হবে, যাতে না এ নিয়ে বিরাট কালােবাজারী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওপারে। এবং এপারে আঞ্চলিক কমিটি গড়ে তুলে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা যায়। এবং তা করতেই হবে। আবার ওপারের বহু কাচামালও এপারে আসবে। আসবে মাছ, আসবে পাট। আগেও আসত। এখন অনেক বেশি করেই আসবে। ওপারের উৎপাদকরা যাতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন, সেটাও আমাদের। দেখতে হবে। এ ব্যাপারেও ওপার এবং এপারের আঞ্চলিক কমিটিগুলি সক্রিয় হলে ফটকাবাজদের জব্দ করা কঠিন হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, নেপালের সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকে যে ভারত বিরােধী, তার প্রধান কারণ অসাধু ব্যবসায়ীদের ক্রিয়াকলাপ। পূর্ববাংলার বিপন্ন চাষী যেন এদের শিকার না হন। ওপারে যেন এরা নিজস্ব দালাল বাহিনী না সৃষ্টি করতে পারে। দুই দেশের সরকারকে এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দুই দেশের মানুষকেও এই ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। শুধু ভাবাবেগে চলবে না। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ওপার ও এপারের মানুষকে এগােতে হবে। তাহলে বাংলাদেশকে কেউ পদানত করতে পারবে না।

১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা