বাংলাদেশে গণহত্যা বিশ্ব-বিবেক নিদ্রামগ্ন
— ইন্দ্রনীল
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণা গৃহীত হল। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শ্রীমতি রুজভেলট মানবাধিকারের সনদকে সমগ্র মানব জাতির “ম্যাগনা। কারটা” বলে অভিহিত করলেন। ঐদিন সাধারণ পরিষদের সভায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি সবচেয়ে বেশী সােচ্চার হয়ে উঠলেন। মানবাধিকারের ঘােষণাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বললেন, সাধারণ পরিষদ ইতিপূর্বে গণহত্যা নিবারণ ও অপরাধীর শাস্তিদান সম্পর্কে যে কনভেনশন গ্রহণ করেছেন, মানবাধিকার ঘােষণার সনদকে কেবলমাত্র তারই সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। গণহত্যা নিবারণ সংক্রান্ত কনভেনশন এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা-দুই-ই যুগান্তকারী ঘটনা। গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের ধিক্কার জানিয়ে তিনি বললেন, গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাধ। দ্বাৰ্থহীন ভাষায় গণহত্যার প্রতি ঘৃণা ও সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণাকে স্বাগত জানিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি সেদিন সাধারণ পরিষদের সদস্যদের হাততালি কুড়িয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গণহত্যা নিবারণ ও নিষিদ্ধ করা সম্পর্কে এক চুক্তির (কনভেনসন) খসড়া পেশ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে গণহত্য ও নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত চুক্তি গৃহীত হয়। এবং ১৯৫১ সালের ১২ জানুয়ারী তা বলবৎ হয় । | ঐ চুক্তিতে গণহত্যার সংজ্ঞায় দেখা যায়, কোন এক জাতি, রক্ত ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ মানব গােষ্ঠী বা ধর্মীয় গােষ্ঠীকে পুরােপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতলব নিয়ে যে সব কাজ করা হয় তাই গণহত্যা।
গণহত্যার কাজের মধ্যে রয়েছে একটা জাতি বা গােষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, ঐ উদ্দেশ্যে গুরুতর ধরনের শারীরিক ও মানসিক আঘাত, জন্ম প্রতিরােধের জন্য ব্যবস্থা এবং জোর করে শিশুদের অন্যত্র প্রেরণ। গণহত্যা নিবারণ সংক্রান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধ বা শান্তি, যে সময়েই গণহত্যা ঘটুক না কেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তা দণ্ডনীয় অপরাধ। গণহত্যার জন্য যারা দোষী, তারা দায়িত্বশীল শাসক, বেসরকারী ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদ যাই হােন না কেন, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে । গণহত্যার জন্য দোষী প্রধান অপরাধীরাই কেবল শাস্তি পাবেন, তা নয়, এই ঘৃণ্য অপরাধে সাহায্যকারী সকলেরই দণ্ডবিধান করা হবে। সমগ্র সভ্য জগৎ গণহত্যার বিরােধী। চুক্তিতে ঘােষণা করা হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যরা গণহত্যা নিবারণ ও নিষিদ্ধ করার এবং গণহত্যার জন্য দায়ি ব্যক্তিদের শাস্তি বিধানের সংকল্প গ্রহণ করলেন। এই চুক্তির ফলে কেবল রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তিও আন্তর্জাতিক আইনের আওতার মধ্যে এসে পড়ল । অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করে গণহত্যাকে চাপা দওয়ার অধিকার কোন রাষ্ট্রের নেই। ঐ চুক্তিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যরা গণহত্যার ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপের অধিকার মেনে নিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, সেইসব ব্যাপার কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। গণহত্যা ঐগুলির অন্যতম।
চুক্তিতে গণহত্যার অপরাধকে রাজনৈতিক অপরাধ বলে গণ্য করা হয়নি। সুতরাং ঐ অপরাধে কোন দেশকে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে বহিষ্কার করা চলেনা। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ গণহত্যার অপরাধে অপরাধী দেশকে রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্তৃত্বাধীন বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাদ দিতে পারেন। গণহত্যা নিবারণ ও বন্ধের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ আরও কয়েকটি কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ ব্যাপারে সদস্য রাষ্ট্রগুলির দায়িত্ব কম নয়। পৃথিবীর কোন অঞ্চলে গণহত্যা ঘটলে, যে কোন সদস্য-রাষ্ট্র সেই দিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন এবং গণহত্যা বন্ধ করার। জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে দাবি জানাতে পারেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্বের সামনে গণহত্যার বিবরণ দিয়ে বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত করতে পারেন এবং রাষ্ট্রগুলির শুধু গণহত্যা বন্ধ নয়, গণহত্যার অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিদের শাস্তির জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কয়েকটি দেশের সর্বোচ্চ আইন সভায় গণহত্যা নিবারণ করা সংক্রান্ত চুক্তি অনুমােদিত হয়েছে। কয়েকদিন আগে মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ঐ চুক্তি অনুমােদন করেছেন।
এখন প্রশ্নঃ বাংলাদেশে কি গণহত্যা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নরনারী ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করাকে কি গণহত্যা বলা চলে? রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খা ও তাঁর বিবেকবর্জিত অনুচরেরা বাংলাদেশে যে রকম সুপরিকল্পিত ভাবে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর খুঁজে বার করা কঠিন। ইয়াহিয়া খাঁর পদলেহনকারী নরপশুর দল প্রতিদিন গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে স্ত্রী পুরুষ ছেলে বুড়াে নির্বিশেষে বাঙালীদের নির্বিচারে হত্যা করছে। বাঙালীদের একটা জেনারেশনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার। পাশবিক মতলব নিয়েই বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড চালান হচ্ছে। নরপশুদের হাতে হাজার হাজার মা-বােনের লাঞ্ছনার খবর প্রতিদিন সভ্য জগতে এসে পৌছচ্ছে। নরপশুদের হাত থেকে মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধরাও যে রেহাই পায়নি বিদেশী প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকেই তা জানা গিয়েছে।
ইয়াহিয়া খাঁর শয়তান অনুচরদের কামানের গােলায় ঢাকা, রাজশাহী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য। বিশ্ববিদ্যালয় আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনার দল বেছে বেছে বাঙালী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের হত্যা করছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতবিদ্য অধ্যাপকদের প্রায় সকলেই আজ নিহত। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত ছিলেন। নরপশুদের হাত
থেকে ইজ্জৎ রক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশজন ছাত্রী ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় মৃতদেহের স্থূপ সাজিয়ে ব্যারিকেড রচনা করে পাকিস্তানী সেনারা ধ্বংস লীলায় মেতে উঠেছে। একমাত্র ঢাকা ও তার চারপাশে দু-লক্ষ লােক নিহত হয়েছে। সারা বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যা কম করেও পাচ ছ লক্ষ। এ হােল মাত্র দু’সপ্তাহের খতিয়ান। বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানী সেনাদের উৎসাহ বিন্দুমাত্র কমেনি। তারা আকাশ থেকে নাপাম বােমা ফেলছে। বিমানের সঙ্গে যুক্ত মেশিনগান থেকে যথেচ্ছ গুলি চালাচ্ছে। জাহাজ ও গান বােট থেকে নির্বিচারে গােলাবর্ষণ করছে। এছাড়া ট্যাংক ও মরটার থেকে সমানে গুলি গােলা বর্ষণ চলেছে। | এই সুপকিল্পিত নরমেধ যজ্ঞের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ঃ বাঙালী জাতিকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জে গণহত্যা নিবারণ ও বন্ধ সংক্রান্ত চুক্তিতে গণহত্যার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড সেই সংজ্ঞাকে বহু পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। এ গণহত্যা তাে বটেই, তার চেয়েও বেশী, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশে কি গণহত্যা চলছে?
বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটে থাকলে বিশ্ববিবেক এখনও ঘুমিয়ে আছে কেন? পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাইনের সিভিল সারভেনট রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারী জেনারেল উথানট বলেছেন, পাকিস্তান সরকার যদি তাকে অনুরােধ করেন তাহলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত নরনারীর সাহায্যার্থে হাত বাড়াতে পারেন। বৃহৎ শক্তি সমূহের কাছে নতজানু রাষ্ট্রপুঞ্জ যে কতখানি অকেজো ও অন্তঃসারশূন্য সংস্থায় পরিণত হয়েছে উথানটের উক্তিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একমাত্র রাশিয়াই বাংলাদেশের ব্যাপারে কিছুটা জোরালাে ভাষায় পাকিস্তানের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আমেরিকার কণ্ঠ এখনও ক্ষীণ, মিনমিনে। বাংলাদেশের ব্যাপারে ব্রিটেন যে মনােভাব অবলম্বন করেছে তাতে এই সত্যই প্রকট হয়ে উঠেছে যে বৃটেন এখন তৃতীয় শ্রেণীর রাষ্ট্র। কোদালকে কোদাল বলে স্বীকার করা তাে দূরে থাকুক, কোদালকে চামচে বলার আগেও তাকে দশবার এগােতে পিছােতে হয়। | লক্ষ করার বিষয় ঃ রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং কোন বৃহৎ রাষ্ট্র এখনও বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে, এই সত্য স্বীকার করে নিলেই তা বন্ধ করার এবং অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে। কিন্তু সত্যের খাতিরে দায় বহন করতে কেউ রাজি নয়। অথচ দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের পর ইহুদী নিধনের ব্যাপারে হিটলার নাংসীদের বিরুদ্ধে যখন গণহত্যার অভিযােগ ওঠে, তখন পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি সােচ্চার হয়ে উঠেছিল। আজ যখন বাংলাদেশে গণহত্যা চলেছে, তখন বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি কম বেশি পরিমাণে নীরববিশ্ব বিবেকও নিদ্রিত। বাঙালীদের গায়ের রঙ কালাে- এইটাই কি বৃহৎ রাষ্ট্র সমূহের যােগনিদ্রার কারণ?
১১ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা