রাজধানী রাজনীতি পিনডি যদি যুদ্ধ বাধাতে চায়, দেখবে ভারতও ঘুমােচ্ছে না।
– রণজিৎ রায়
পশ্চিম পাকিস্তানের রক্ত-পিপাসু জঙ্গীবাহিনীর লােলুপতা এখনাে মেটেনি। গত চব্বিশ বছর ধরে মুঠোয় গােনা কয়েকটি পানজাবি আর সিনধি পরিবারের স্বার্থে ওরা বাংলাদেশের রক্ত বাদুড়ের মত শুষেছে; নির্যাতন চালিয়েছে উনিশ শতকী কায়দায়। এবারের যুদ্ধে এ পর্যন্ত কত নির্দোষ নরনারী শিশু প্রাণ হারিয়েছে, তা বােধহয় কোন দিনই জানা সম্ভব হবেনা। তবে পানজাবিরা বাংলাদেশের সব কয়টি প্রধান শহরে ও পৌরাঞ্চলে। যে ব্যাপক গণ-হত্যায় মেতে রয়েছে, সে সম্পর্কে পৃথিবীর কোন দেশেরই মনে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশের মানুষ চেঙ্গিস খানের বংশধর পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়ছে, তাতে সারা দুনিয়ার মানুষ বিস্মিত। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমেরিকা, চীন এবং রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত সবরকম আধুনিক অস্ত্র বাংলাদেশে এনে হাজির করেছে। বাংলাদেশের পৌরাঞ্চল দখল করার জন্য তারা। ঐসব অস্ত্র যথেচ্ছ প্রয়ােগ করেছে, করছে। প্রধান জল্লাদ ইয়াহিয়া এবং তার মুখ্য মন্ত্রণাদাতা ভুট্টো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইছেন। ওঁরা জানেন-একবার বর্ষা নেমে গেলে বাংলাদেশকে গুড়িয়ে দেওয়ার বাসনা অতৃপ্ত থেকে যাবে। বাংলাদেশের লােক কিন্তু ইয়াহিয়ার দ্রুকুটিতে ভীত নয়। ওর সৈন্যরা শহর ছেড়ে দূরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশই মুক্তি ফৌজের অধীনে। সাধারণ মানুষ পর্যন্ত লাঠি, বর্শা, দা ইত্যাদি নিয়ে
লড়াইয়ে নেমে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ ক্রমশ বাড়ছে। তবে তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। লড়তে লড়তেই অনেকটা প্রশিক্ষণ হয়ে যাচ্ছে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী। গােয়েন্দা বিভাগের সংবাদ ঃ এ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে তিন ডিভিসন সৈন্য পাঠিয়েছেন। ইচ্ছা করলেই তার পক্ষে এর বেশী সৈন্য, খাদ্য বা অস্ত্র-শস্ত্র পাঠানাে সম্ভব নয়। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতার সীমা আছে। ভারত-পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে নাকি কিছু সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও বিপদ আছে। পাঠানরাও পানজাবি প্রভুত্ব সহ্য করণে নটরাজ। তাছাড়া রয়েছেন পাকতুনিস্তানের দাবিতে অনড় খান আবদুল গফফর। খান। ওঁর শক্তি মােটেই ফেলনা নয়।
ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন- একেবারে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে দু-একদিনের মধ্যে বাংলাদেশকে গুড়িয়ে দেবেন। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তা হয়নি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ওঁর সৈন্যরা তাে মােটেই সুবিধা করতে পারেনি, শহরও বাগ মানছে না। ৫৪,৫০০ বর্গমাইল বিশিষ্ট বাংলাদেশের চারিদিকেই অসংখ্য ছােট বড় নদী আর খাল। অধিকাংশ এলাকাই এত নীচু যে কয়েক পশলা বৃষ্টির পরেই নৌকা চালাতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের সম্পদ শুষে নিয়ে নিজের ভাড়ার বােঝাই করছে; কিন্তু বাংলাদেশে রেলপথ বা রাস্তাঘাটের। উন্নয়নের দিকে কোন দিনই নজর দেয়নি। ফলে বাংলাদেশে নৌকাই এখন পর্যন্ত যাতায়াতের মুখ্য উপায় । এটা কিন্তু সৈন্য চলাচলের পক্ষে মােটেই অনুকূল নয়। এহেন বাংলাদেশকে কাবু করতে হলে ইয়াহিয়াকে অনেক অনেক সৈন্য আনতে হবে; সারা দেশ ছেয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তিনি তা করতে পারবেন না। মুক্তিফৌজের সেটাই সুবিধা। তার অর্থ- বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ দীর্ঘকাল চলতে বাধ্য। মুক্তিফৌজ সহজে শহর এলাকা থেকে শত্রু সৈন্য তাড়াতে পারবে না; তেমনি গ্রামের দিকে শত্রুরা সুবিধা করে উঠতে পারবে না। | ভারত বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং একাত্মতা জানিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এলাকা এখন বস্তুত মুক্ত-এলাকা। সেখানে মােতায়েন করার মত সৈন্যবল ইয়াহিয়ার নেই । যাই হােক, বাংলাদেশ শুধু সহানুভূতিই নয়, সীমান্তের অপর দিক থেকে কাজে লাগার মত সাহায্য চায়। ভারত বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। হাজার হাজার মুসলমান উদ্বাস্তু ইতিমধ্যেই ভারতে চলে এসেছেন। তাঁদের ইয়াহিয়ার বেয়নেটের সামনে ফেরৎ পাঠনাে সম্ভব নয়, বরং তাদের আশ্রয়ই দিতে হবে। সৈন্যদের তাড়া খেয়েও অনেকে ভারতে চলে আসতে পারে; এবং তাড়া করতে করতে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদেরও এপারে ঢুকে পড়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ভারত যে পাকিস্তানী গ্রেফতার ও নিরস্ত্র করবে, সে কথাটা গােপন রাখা হয়নি। তাছাড়া বহু মুক্তি যােদ্ধা ঔষধপত্র এবং অন্যান্য সাহায্যর জন্যেও ভারতে আসতে পারেন। এলে সাহায্য না দিয়ে তাদের বিমুখ করা যাবে না। | মুজিবরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বােধ মুছে গিয়েছে। কিন্তু ইয়াহিয়ার সৈন্যরা হিন্দুদেরও ছেড়ে দিচ্ছে না। বাংলাদেশে এখনাে প্রায় ১০ লাখ হিন্দু রয়েছে। হত্যা এড়াবার জন্য বহু হিন্দু ভারতে চলে আসতে পারে। সেটা ভারতের পক্ষে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এবং ফলে ইসলামাবাদের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কটা আগের চেয়েও তেতাে হয়ে উঠবে।
তাই বাংলাদেশ পানজাবিদের কবল থেকে মুক্ত হলে ভারতেরও মঙ্গল ইসলামাবাদের সঙ্গে ভারতের বিরােধ এত মৌলিক যে, তার অবসান কোথায় হবে কেউ বলতে পারে না। তবে এখনকার ডামাডেলের সুযােগে ইয়াহিয়া যদি পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ বাধাবার মতলব ফাঁদেন, তাহলে দেখতে পাবেন ও ভারত ঘুমুচ্ছে না। নয়াদিল্লি অবশ্য ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি; বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকেও স্বীকৃতি জানায়নি। তার মতে স্বীকৃতি জানাবার সময় এখনাে আসেনি। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অবশ্য বহু দেশের রাজধানীর সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করেছে। সব দেখে মনে হচ্ছে ঃ ইয়াহিয়ার মতলব সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারলেও মুজিবর দূর্দৈবের জন্য প্রস্তুত হতে পারেননি। ফলে বাংলাদেশে সরকার গড়ার মত কোন সংগঠন তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। | বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে মুক্তিবাহিনী স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে নিজেদের সংগঠিত করছে; কিন্তু তাদের মধ্যে কোন সুদৃঢ় সংযােগের ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা মুজিবের বাহিনীর একটা প্রধান কাজ। তারা অবশ্য আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে এ মুহূর্তে সারা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলার মত কাউকেই দেখা যাচ্ছে ।
ইয়াহিয়া বাহিনীর আক্রমণের প্রথমটায় ভারত ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। যাই হােক, সাধারণ মানুষের দাবি মেনে নিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের অনুকূলে কূটনীতিক যােগাযােগ শুরু করেছে। সে রাষ্ট্রপুঞ্জে এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তিকে ত্রাণ কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছে; কিন্তু বৃথাই। ইয়াহিয়ারা আন্তর্জাতিক রেডক্রশের সদস্যদের বাংলাদেশে যেতেই দিল না; অথচ তা নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলির প্রায় কোন উদ্বেগই নেই। ওদের মনােভাব-বাংলাদেশে যা ঘটছে, সে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। দুনিয়ার সকল নির্যাতিত ও শােষিত মানুষের স্ব-ঘােষিত বন্ধু পিকিং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সংবাদপত্রকে নীরবতা ভাঙার অনুমতি দিয়েছে। চীনা সংবাদপত্র শেষ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়ার বিবৃতি উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের ভাঙনধরানাে উপাদান এবং পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতের নাক গলানাের কথা। লিখেছে। [অর্থাৎ পিকিং ইসলামাবাদেরই সমর্থক। পিকিং তাহলে হয়ত ভাবছে যে, ইয়াহিয়া বাংলাদেশকে দমন করতে সক্ষম হবে এবং ভূট্টোর রাজনীতিক নেতৃত্বের অধীনে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে খেল চালিয়ে যাবে।
ভারতের কূটনীতিক প্রয়াস অবশ্য একটা ক্ষেত্রে সুফল দেখিয়েছে। সােভিয়েট প্রেসিডেনট পােদগােরনি কড়া ভাষায় জেনারেল ইয়াহিয়াকে চিঠি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের কাছে এ চিঠি প্রকাশনার্থও দেওয়া হয়েছে। সােভিয়েট প্রেসিডেনট তার চিঠিতে “রক্তপাত বন্ধ করার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর নির্যাতন বন্ধ করা এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে রাজনীতিক বােঝাপড়া পন্থানুসন্ধানের জন্য ইয়াহিয়ার কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। “মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য যে-সব রাজনীতিক নেতা। সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন পেয়েছেন, তাদের গ্রেফতারের ফলে সােভিয়েট ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন বলে শ্রীপােদােেরনি জেনারেল ইয়াহিয়াকে জানিয়েছেন।
৮ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা