You dont have javascript enabled! Please enable it! সামরিক পরিস্থিতি-সমীক্ষা অবরােধে বিব্রত পাক-ফৌজ - সংগ্রামের নোটবুক

সামরিক পরিস্থিতি-সমীক্ষা অবরােধে বিব্রত পাক-ফৌজ

ভবানী পাঠক বলা হয়ে থাকে, যে রােগে নেপলিয়নের মৃত্যু হয়েছিল, সে রােগের নাম স্প্যানিশ ক্যান্সার। মন্তব্যটি সামরিক জিজ্ঞাসারই একটি জবাব। স্পেন আক্রমণ করতে গিয়ে নেপলিয়নের বাহিনীকে যে বিশেষ একটি সমস্যায় অভিভূত হতে হয়েছিল, সেই সমস্যাটিকেই ক্যান্সার বলা হয়েছে। লজিস্টিক্‌সের সমস্যা। সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করবার, এগিয়ে নিয়ে যাবার এবং সুদৃঢ় ঘাঁটিতে আশ্রিত করবার সমস্যা। অঞ্চলের জটিল পার্বত্য প্রকৃতি ছিল নেপলিয়নীয় বাহিনীর আভিযানিক স্বাচ্ছন্দ্যের অন্যতম প্রধান বাধা। বিড়ম্বিত ও বিব্রত বাহিনী। এবং স্বয়ং নেপলিয়নও বুঝতে পেরেছিলেন যে, যাকে পথ বলে মনে হয়েছিল সেটা নিদারুণ বিপদ। কিন্তু বুঝতে দেরী হয়েছিল। অঞ্চলের পার্বত্য প্রহেলিকার মধ্যে বস্তুত এক ধরনের অবরােধ সহ্য করে লড়াই চালাতে গিয়ে দিন-দিন শুধু হীনবল হবার দুর্ভাগ্য বরণ করেছিল লিপলিয়নের সেই বলদৃপ্ত বাহিনী। সে ক্ষতি শেষ পর্যন্ত নেপলিয়নের সামরিক শক্তির কালরােগে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী ফৌজের আক্রমণের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এই সন্দেহ না হয়ে পারে   যে, আসন্ন পরিণামে না হােক, চরম পরিণামে পাকিস্তানী সামরিক শক্তি এখানে নিদারুণ এক শ্বাসরােগে অভিভূত দশায় পড়ে হীনবল হতে বাধ্য হবে। পূর্ব বাংলার ভৌগােলিক গঠনে বালাক্লাভার মত গিরিসংকট অবশ্য নেই, কিন্তু লক্ষণ দেখে এরই মধ্যে ধারণা করিয়ে দেবার মত অনেক তথ্য বেশ স্পষ্টরূপ প্রকট হয়ে উঠেছে যে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোমল সমতলই পাকিস্তানী সৈন্য চালনার একটি কঠোর সঙ্কট হয়ে উঠবে। 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আক্রমণের ফৌজ এবং ফৌজী প্রয়ােজনের সম্ভার উপনীত করতে পথের সুযােগ ও সংযােগ খুবই সীমিত। শুধু বিমানপথ ও সমুদ্রপথ মুক্ত আছে; স্থলপথ নেই; অর্থাৎ স্থলপথে সৈন্য নিয়ে যাবার কোন সুযােগই নেই; এক্ষেত্রে ভারত একটি স্বাভাবিক ভৌগােলিক বাধা, এবং অটল রাজনীতিক বাধাও বটে। বাংলাদেশকে সামরিক আঘাতে নির্জিত করবার পশ্চিম পাকিস্তানী স্পৃহা যতই প্রবল হােক না কেন বিপুল দূরত্ব ও ব্যবধান যে অদৃষ্টগত বাধা, সে কারণে সৈন্য চালনার প্রবণতা খণ্ডিত ও মন্দীভূত হতে বাধ্য। বিমানপথ মুক্ত থাকলেও স্বচ্ছন্দ নয়, সিংহল ও বর্মার আকাশের রাজনীতিক সহযােগীতার প্রশ্ন সে-পথে দাঁড়িয়ে আছে। আজ না হােক কাল, ওই দুই দেশের পক্ষে আক্রান্ত বাংলাদেশের জনজীবনের সম্পর্কে সহানুভূতির নীতি প্রত্যক্ষ আগ্রহে পরিণত হতে পারে। তখন বিমানপথে বাংলাদেশে সেনাবল উপনীত করবার পাকিস্তানী তৎপরতা ওই দুই দেশের ‘নিরপেক্ষতা’র বাধায় কুণ্ঠিত না হয়ে পারবে না। এই অবস্থায় পাকিস্তানের পক্ষে নতুন বিমানপথ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। যদিও বা পাওয়া যায়, তবু সেই বিমান পথে পাকিস্তানের সৈন্য ও সামরিক সম্ভার পরিবহনের দ্রুততা খুবই খর্ব হয়ে যাবে।

মুক্ত থাকবে শুধু একটি পথ, সমুদ্রপথ। সংলগ্ন বিভিন্ন রাষ্ট্র, যথা সিংহল, ভারত ও বর্মা যতদিন নিরপেক্ষ থাকবে, শুধু ততদিন পাকিস্তান তার সামরিক সম্বল জাহাজভর্তি করে করাচী থেকে চট্টগ্রামে ও খুলনার বন্দরে পৌছে দেবার অবাধগতির সুযােগ পাবে। ওই তিনদেশের কোন একটির নিরপেক্ষতা বিচলিত হয়ে যদি বাংলাদেশের আক্রান্ত জনজীবনের জন্য সহানুভূতির প্রত্যক্ষ সক্রিয়তায় পরিণত হয়, তবে সামরিক ঘটনার দৃশ্যপট সমূহরূপে বদলে যাবে। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান দখল করবার জন্য করাচী থেকে সৈন্যবাহী জাহাজের যাতায়াতের সমুদ্রপথ আর মুক্ত, অবাধ ও স্বচ্ছন্দ সংযােগের পথ হয়ে থাকবে না।

সম্ভাবনার কথা ছেড়ে দেওয়া যাক। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাক-ফৌজের সংঘর্ষ এরই মধ্যে যে পর্যায়ে এসে সে বিশেষ প্রকার লাভ করেছে, তারই সামরিক অবস্থার একটি মানচিত্র দেখতে পাওয়া যায় । অজস্র সংবাদের ভিড়ের মধ্যে বেশ স্পষ্ট একটি বাস্তব তথ্যের রূপ দেখতে পাওয়া যায়। সংঘর্ষে দুই পক্ষের  জয় পরাজয়ের তথ্য সাফল্যের মােটামুটি হিসেব করলে যা দাঁড়ায় তা এই যে, পাক সামরিক শক্তির অস্তিত্ব ও তৎপরতা এখন বিশেষভাবে শহরগুলির মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। পাক সামরিক শক্তির এই শহরাশ্রিত কেন্দ্রীভূত অবস্থাটা বস্তুত এক প্রকারের অবরুদ্ধ অবস্থা। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও শহর-ঘাঁটি থেকে পাকবাহিনী কমান্ডাে পদ্ধতিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কমান্ডাে পদ্ধতিরও একটি নিকৃষ্ট প্রকার। হঠাৎ ঘাঁটি থেকে বের হয়ে, এদিক ওদিক ধাবিত হয়ে পাক-বাহিনীর এক একটি দল কিছু নরহত্যা করে আবার ঘাটিতে ফিরে যায়। বুঝতে পারা যায় এটা অবরুদ্ধ অবস্থারই হিংস্র প্রকাশ। কমান্ডাে অনুযায়ী সৈন্য চালনা করবার আশা, উপায় ও সুযােগ কি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে? নইলে এ ধরনের নিকৃষ্ট কমান্ডাে পদ্ধতি কেন গ্রহণ করেছে ক্যান্টনমেন্টে শহর ঘাটিতে আশ্রিত পাক-বাহিনী?

বাংলাদেশের বিপুল-বিস্তারিত গ্রাম্য অঞ্চল মােটামুটিভাবে মুজিবের মুক্তিফৌজের দখল ও প্রভাবের অঞ্চলে পরিণত হয়েছ। এই ঘটনাও প্রমাণিত করছে যে, সৈন্যচালনা করবার পাকিস্তানী ইচ্ছা ও চেষ্টা ক্ষুদ্রতর পরিধির মধ্যে থেকে অবস্থান গ্রহণ করবার নীতি আপাতত গ্রহণ করেছে। মুক্তিফৌজের প্রভাবাধীন বিরাট এলাকার জনসাধারণ এবং পথঘাটও পাকিস্তানী সৈন্যের গতিশীল অভিযানের কঠিন প্রতিবন্ধক। গতিতে বেগবান হয়ে ওঠবার উপায় ও সুযােগ তাদের নেই। সড়ক ধরে কিংবা নদীপথে সামরিক সরবরাহ নিয়ে আসবার উপায়ও অজস্র বাধায় বিড়ম্বিত। মুক্তিযােদ্ধার গেরিলা তৎপরতার আঘাত সহজে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বিমান থেকে বােমাবর্ষণ, এই ঘটনাও পাক-বাহিনীর ব্যাহত গতির এবং অবরুদ্ধ অবস্থার একটি প্রমাণ।  নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করবার ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করবার এই বিমানবাহিত সুযােগ অবশ্য তেমন কিছু বিড়ম্বিত হবে না, মুক্তিফৌজ যদি বিমানধ্বংসী কামানের সম্বল সগ্রহ করতে না পারে।

চট্টগ্রাম ও খুলনাতে জাহাজ যােগে পাক-সামরিক শক্তির সেনাবল ও অস্ত্রবল এসে পৌছতে পারলেও ভিতর অঞ্চলে প্রবেশ করবার দুরূহ প্রশ্নটি থেকে যায়। নদীপথে কিংবা স্থলপথে ভিতরের অঞ্চলের নানাদিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা পদে পদে বিপর্যস্ত হতে পারে। মুক্তি ফৌজের হাতে যথােচিত পরিমাণের অস্ত্র সম্বল থাকলে পাকিস্তানী সৈন্যের বন্দর থেকে ভিতরের অঞ্চলে এগিয়ে যাবার চেষ্টা সহজে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে বাঙালী গেরিলা। এ ক্ষেত্রেও বিমানবাহিত হওয়া ছাড়া পাক-সৈন্যের গতিশীল হবার কোন প্রশস্ত উপায় নেই। মুক্তিফৌজের অস্ত্র সম্বলের অভাবের জন্যই পাক-বাহিনী এখনও তার খর্বিত গতিশক্তি সত্ত্বেও নরহত্যাপ্রবণ ব্যস্ততা প্রকাশ করতে পারছে। সন্দেহ নেই, মুক্তিফৌজের হাতে যথােচিত অস্ত্রসম্বল যদি এসে পড়ে, তবে সামরিক দৃশ্যপট কয়েকদিনের মধ্যেই পালটে যাবে। কচ্ছের রান নয়; জন্ধুর উন্মুক্ত ছাম্ব উপত্যকাও নয়; পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে এ জালা সুদুরবাহিত বাংলাদেশ। কচ্ছ ও জম্বু উভয়ই পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানা সংলগ্ন অঞ্চল। যে প্রসন্নতা নিয়ে ও সহজে কচ্ছে এবং জম্বুতে হঠাৎ সৈন্য চালনা করতে পেরেছিল পাকিস্তান সেটা সেদিন সেখানেই সম্ভব হয়েছিল।

সেটা আজ এখানে এই বাংলাদেশের উপর ফলিয়ে দেখবার উপায় পাকিস্তানের নেই। মনে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে। সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে মুক্তিফৌজের পক্ষে সমুদ্র বন্দরগুলি দখল করে নেবার, অন্তত অচল করে দেবার সুযােগ এবং শক্তি ঘটনার ভিতর দিয়েই স্বাভাবিক সম্ভাবনা হয়ে দেখা দেবে বলে আশা করা যায়। সামান্য কয়েকদিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি যতটা বিব্রত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী বিব্রত হবে, যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী পাকিস্তানের সৈন্য পরিচালনার অদৃষ্টের পক্ষে বস্তুত কালগ্রাস হবে। মুজিবের বাংলাদেশের জীবনের দুঃখ ক্লেশ হয়তাে আরও কঠোর হবে, কিন্তু আক্রমণােৎসাহী পাক-বাহিনীর শক্তিকে নিদারুণ এক পঙ্গুতায় অবসন্ন হয়ে পড়তে হবে। এমনও হতে পারে, বাংলাদেশের আসন্ন বর্ষা পাক সামরিক শক্তিকে সেই শিক্ষা দিয়ে দেবে নেপলিয়নের বাহিনীকে যে শিক্ষা দিয়েছিল রাশিয়ার বরফ।

৬ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা