এই বিশাল কুরবানি ব্যর্থ হবে না
— তরুণ দত্ত
যুদ্ধমাত্রেরই বিরুদ্ধে যাদের বিবেকী আপত্তি, সকল সভ্যদেশের আইনে সাধারণত তাদের যুদ্ধে যােগদানের নাগরিক কর্তব্য থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়ে থাকে। এঁরা মনে করেন যে, এমন কোনাে অন্যায় নেই যার শাস্তি হিসাবে আরেকজনের জীবন ধ্বংস করে দেওয়া যেতে পারে, এমন কোনাে কাম্য নেই, যা পাবার উপায় আরেকজন লােকের মৃত্যু। এই ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গ নীতিবােধ বলে মানুষের প্রাণ নেওয়া পাপ এবং প্রাণহানির প্রত্যুত্তরেও প্রাণহানি করা শুধু পাপের বােঝা বাড়ানাে। যে মানুষ এইমাত্র গুলি খেয়ে মারা গেল, সে আর ফিরবে না, চোখ মেলবে না দেশ স্বাধীন হল কিনা হলাে তাতে তার কিছু মাত্র এসে যাবে না, মানুষের তৈরী স্বাধীনতা পরাধীনতার, ন্যায় অন্যায় যুদ্ধের বেড়াজাল পেরিয়ে সে এখন পােকার খাদ্য। এই ভীষণ বােধ থেকেই জন্মায় সেই ধার্মিক অনীহা যা বলে যুদ্ধমাত্রই অন্যায় এবং যেহেতু প্রচারকল্যাণে সব সরকারই নিজের জনগণকে বােঝাতে সক্ষম হয় যে, এই যুদ্ধ ন্যায় ও অনিবার্য, তাই জনগণের একমাত্র কর্তব্য। নিরপেক্ষভাবে বিচার করে যুদ্ধমাত্রের বিরুদ্ধেই বিবেকী আপত্তি তােলা, যােগ দিতে অস্বীকার করা বিবেকী প্রতিবাদীরা আরও বলেন, দেশ প্রেমের দোহাই দিয়ে খুনের ডাক যখন দেওয়া হয়, যখন বােঝানাে হয়, খুন করলে খুন হয়ে যাবাে, তখনই এই ব্যক্তিগত নীতিবােধে কিছুমাত্র চিড় ধরা উচিত নয়, কেননা জীবনহানির। চেয়ে বড়াে পাপ নেই এবং এক পাপ দিয়ে আরেক পাপের শান্তি হয় না। | মানুষের চরিত্রের কিছু কিছু মহৎ গুণ আছে, যা স্বল্প সংখ্যকতার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে; টিকে থাকতে হলে হয় এই গুণগুলিকে সকল মানুষের দ্বারা স্বীকৃত হবে, যা কখনাে হয় না, নতুবা খুব নগণ্য। সংখ্যক মানুষের দ্বারাই যেন সমর্থিত হয়। ঝড়ের মতাে অগ্রসর নাজি-বাহিনীর সম্মুখীন মিত্র দেশগুলির সকল অধিবাসী যদি বিবেকী আপত্তির বশে নিরস্ত্র দর্শক হয়ে দাঁড়াতাে, তাহলে সন্দেহ নেই, বহু লােক নিশ্চিহ্ন হতাে ও ইউরােপের বুকে এক দীর্ঘ জীবঘ্ন অন্ধকার নেমে আসতাে। বেশীর ভাগ লােকই দেশ প্রেমের অন্ধ। আবেগে যুদ্ধে নামে বলেই কিছু বিবেকী লােক ব্যক্তিগত নীতিবােধ অবিচলিত রাখে এবং নিঃসঙ্গ শুদ্ধ থাকে।
‘ন্যায়-অন্যায় মানিনে শুধু হে দেশমাতৃকা তােমাকেই জানি এই পতাকাচুম্বনকারী আবেগ এবং নির্বিচার পরামুখতা এই দুই প্রবৃত্তিই অস্বীকার করে সেই মৌলিক প্রশ্নকে যা সামাজিক মানুষের উপর এক নিরুপনের ও চূড়ান্ত বর্শার মতাে বিঁধে আছে ঃ দায়িত্ব, বিচারের, সিদ্ধান্তে উপনীত হবার এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজের। যেহেতু আমরা সমাজে বাস করি এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের রক্ষক, তাই আমার প্রতিটি কাজ বা নিস্ক্রিয়তার একটি প্রতিফল আছে। এমন কোনাে কোনাে মুহূর্ত আসে যখন ব্যক্তিগত শুদ্ধি বলে কিছু একেবারেই থাকে , কেননা হয় আমি খুন করে খুন থামাবার অপরাধে কলঙ্কী কিংবা কিছু না করে খুনের পৃষ্ঠপােষকতা করার পাপে পাপী। এইসব মুহুর্তে কী করবাে বা কী করবাে না এই প্রশ্নের কষ্টিপাথর ব্যক্তিগত আত্মিক শুদ্ধি নয়, যা কল্পিত ও অস্তিত্বহীন আমার ব্যক্তিগত বিচারে যাকে প্রাথমিক অপরাধী মনে করি তা কিসে রােধ হতে পারে, এই সমস্যার নির্দয় বিচারে। চেতনাসম্পন্ন মানুষমাত্রেরই দায়িত্ব এই বােঝাপড়া নিজের সাথে করে। নেওয়ার, পথ নির্ধারণ করার এবং চূড়ান্ত ঝুঁকি সত্ত্বেও সেইপথ মেনে চলার। খুন যখন সমাজের বুকে একবার। উৎসারিত হতে শুরু করে, তখন রক্তে সকলেই ভিজে যাই, কেউ শুদ্ধ থাকেনা; এই সার্বিক অশুদ্ধির মধ্যে আকণ্ঠ দাঁড়িয়ে একটিই প্রশ্ন থাকে ? আরও পাক ঘেঁটে এই পাঁক রুদ্ধ করা যায় কিনা।
পূর্ববাংলায় আজ যে বিপ্লব দেখা দিয়েছে, তার দিকে তাকিয়েই প্রথমেই এইসব কথা মনে হয়। রক্তপাত মাত্রই আমরা যারা অসুস্থ, আনন্দে কাপতে পারি না, তাদের একথা মনে হতেই পারে এই অগণিত মৃত্যু, এই ব্যাপক ধ্বংসের শেষে যে স্বাধীনতা আসবে, সে স্বাধীনতা কে, কীভাবে ভােগ করবে? সমস্ত যুব সম্প্রদায়ের প্রাণহানি ও পােড়ামাটির মতাে পড়ে থাকা দেশ কি জাতীয়তাবাদী স্বায়ত্ত্বশাসনের পথে বড় বেশী মূল্য নয়? স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দুই বছর আগের যে গণ-আন্দোলন, যার উচ্ছসিত বিকাশ আমরা দেখলাম স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক নির্বাচনী জয়লাভের মধ্যে, যার আজকের রূপ সশস্ত্র যুদ্ধের, যে যুদ্ধের চেহারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পর, আন্তঃরাষ্ট্রিক। অথচ জাতীয়তাবাদী যুদ্ধমাত্রই ভালাে এ সিদ্ধান্ত করার মতাে মানসিক শৈশবে যুদ্ধ বিক্ষত ইতিহাস আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে। আমরা দেখেছি, উত্তেজিত জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের বিশালতম খুনী; আমরা দেখেছি, সম্পূর্ণ অর্থহীন প্রথম মহাযুদ্ধে রাজনৈতিকদের দ্বারা প্রচারিত বিজাতি ঘৃণায় উন্মত্ত হয়ে ছুটে যেতে ইওরােপের সমস্ত যৌবনকে, ফ্ল্যানডারসের কাদায় রাশি রাশি মরে পড়ে থাকতে; এবং এও দেখেছি যে, জাতির এক শ্রেণী অপর শ্রেণীর উপর কমন ঘাতক অত্যাচার চালাতে পারে। কতকগুলি ভৌগােলিক ও ঐতিহাসিক ঘটনায় একটি রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারিত হয় এবং রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অনেক সময়েই বিশিষ্ট জাতি-চরিত্র নিহিত থাকে, যেমন ওয়েলশীয়, স্কটল্যানডীয় বা আইরিশ মানুষদের সাথে ইংলন্ডীয় লােকেদের তফাৎ আছে; যেমন সােভিয়েট রাশিয়ার এশীয় অঞ্চলে, পূর্ব ইওরােপে জায়গায় জায়গায়, কিছুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে অথবা যেমন নিগরাে সম্প্রদায়, আমাদের দেশের মধ্যে নাগা ও মিজোরা অথবা তামিলরা যারা নিজেদের আর্যাবর্তের সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ভাবেন। তবু শান্তির জন্য ও সমৃদ্ধির জন্য আমরা চাই, মানুষ ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির পরবশ হয়ে তফাৎ এর চাইতে মিলন গুলির উপর জোর দিয়ে একই রাষ্ট্রের মধ্যে থাকুক। এবং অন্তর্ঘাতী জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে এইরূপ রাষ্ট্রের টুকরাে টুকরাে হয়ে যাওয়া কাম্য নয়। সুতরাং বাঙালীরা আজ পাকিস্তানে লড়ছে পানজাবীদের বিরুদ্ধে, স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য, শুধু এই কারণে আমরা এপাশে আচম্বিতে উত্তেজিত হতে পারি না। যে মুহূর্তে আমরা এই যুক্তি উপস্থাপিত করি সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মতাে পূর্ব বাংলার আন্দোলনের আসল রূপ দেখতে পাই।
পাকিস্তানের ক্ষমতা ধরে আছে একটি সামরিক অফিসারগােষ্ঠী, যাদের সঙ্গে জনগণের সম্মতির কোনাে সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের যা বিশিষ্টতম চিহ্ন অর্থাৎ অধিকাংশের ইচ্ছা অনুযায়ী গড়া একটি শাসনযন্ত্র সেই মৌলিক লক্ষণই এখানে অনুপস্থিত। রাষ্ট্র মানুষের তৈরী এমন একটি যন্ত্র যা সেই ভূখণ্ডের মানুষের নিজেদের জীবন চালিত করার ইচ্ছা রূপায়িত করে; রাষ্ট্রের তাৎপর্য ও ভূমিকা শুধু এইটুকু, বাকি সব প্রতারক মােহ, শূন্য শব্দের সারি। যখন দেখা যায়, রাষ্ট্র ঐ ইচ্ছার প্রভু হয়ে দাড়িয়েছে, আরােপিত ও স্বাবলম্বী, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংস করে নতুন, জনগণের ইচ্ছানির্ভর রাষ্ট্র তৈরী করা আবশ্যিক হয়। মুজিবের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই স্বয়ম্ভূ রূপ ধ্বংসের জন্যই উদ্দীপিত হয়েছিল। সারা পাকিস্তানকে যারা বাপের জমিদারীর মতাে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে সম্ভোগ করেছেন সেই গােষ্ঠী, যেহেতু ঐতিহাসিক ঘটনাবশত, বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের, যে সম্প্রদায়েরই আজ পাকিস্তানে রবরবা, যার প্রতীক সারা পাকিস্তানের জাগতিক সম্পদ কুক্ষিগত করে বিশটি পরিবার। তাই মুজিবের আন্দোলন চেয়েছিল, খালি বাংলাদেশের লােকের মুক্তি যা সংবিধানের মধ্য দিয়ে চিরতরে মেনে নেওয়া হবে। এই বাংলাদেশের লােক সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ; এই সংখ্যাগরিষ্ঠ চেয়েছিল খালি নিজেদের জন্য নিজেদের মতাে শাসন কায়েম করার অধিকার, কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় যেহেতু একাধারে জুনটার পােষ্যপুত্র ও ধর্মবাপ, তাই তারা জুনটার গড়া শাসনতান্ত্রিক কাঠামাের পূর্ণ সমর্থক ছিল। সমস্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যদি মুজিবর হতেও পারতেন, তাহলেও দরকার ছিল পূর্ব বাংলার সংবিধানস্বীকৃত মুক্তি, কেননা পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার গত পঁচিশ বছরের শরীর গড়ে উঠেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র একটি গােষ্ঠীর সেচ্ছাচারিতার উপর নির্ভর করে। সংবিধানের মধ্যে দিয়ে যদি মুজিব এদের প্রথমেই এবং চিরতরে খোড়া করে না দিতে পারতেন, তাহলে তাকে ক্রীড়নক হতে হতাে পুরানাে ব্যাভিচারী ব্যবস্থার অথবা জড়াতে হতাে অন্তহীন ফলহীন-পারলামেনটি বাচালতা ও খেয়ােখেয়ির জালে।
কী করলেন মুজিব? তিনি রাজি হলেন আলােচনায় বসতে সকলের সাথে, জাতীয় পরিষদে পূর্ণ সহযােগীতা করতে; তিনি রাজি হলেন না গােড়াতেই তাঁর মৌলিক দাবিগুলিকে বাদ দিতে। সংখ্যালঘু গােষ্ঠী তখন বললেন, জাতীয় পরিষদে আমরা যাব না। হঠৎ পরিষদের বৈঠক স্থগিত করলেন জুনটার অধিকারীযিনি নিজেকে বছর দুই আগে রাষ্ট্রপতি হিসাবে বহাল করেছিলেন- দোষ দিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠকে। অহিংস অসহযােগী আন্দোলন শুরু হলাে সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা, অবিসংবাদিত নির্বাচনী জয় যে সংবিধান আগেই তৈরী করে দিয়েছে, তার প্রাথমিক রূপ দেওয়া হলাে স্বায়ত্তশাসনের শুরু দিয়ে।
তারপরের ঘটনা ঃ একদিকে প্রসন্ন একনায়কের মুখােশ পরে ইয়াহিয়া বসলেন বৈঠকে মুজিবের সাথে, অন্যদিকে সৈন্য আনা হতে লাগলাে; ধারণা জন্মাতে দেওয়া হলাে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ইয়াহিয়া স্বায়ত্তশাসন ঘােষণা করবেন। পরিবর্তে, রাতের অন্ধকারে করাচি প্রত্যাবর্তন, সেখান থেকে আদেশ, গুলি, বােমা ও যুদ্ধের। রাষ্ট্রশাসনের অধিকার আসে কেবলমাত্র জনগণের হাত থেকে; নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যাকে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকারের একমাত্র সনদ দিয়েছে, তাকে আজ আক্রমণ করেছে একদল সাঁজোয়া আমলা, প্লেন, ট্যাঙ্ক, রকেট, হেলিকপ্টার, নৌবাহিনী নিয়ে।
পূর্ব বাংলায় আজ এসেছে সেই ইতিহাসবিশ্রুত মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্ত, যখন সমস্ত মানুষ ভাগ্যঅধিকারের সব শান্তিপূর্ণ পথ পরীক্ষা করে করে বন্ধ দেখে দেখে অবশেষে চরমতম মূল্য, অর্থাৎ প্রাণ দিতে যাওয়ার মতাে নিদারুণ অমানুষী সিদ্ধান্ত নেয়। এই সেই শােচনীয়, কিন্তু রক্তোন্মাদী ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন মানুষ বেঁচে থাকতে গেলে যা বারবার দরকার সেই স্বাধীনতার জন্য, যা হারালে স্বাধীনতাও নিরর্থক সেই অমূল্য সম্পদ বেঁচে-থাকা ফোয়ারার মত দান করে। এই চরম ভীষণ মুহূর্ত যখন সমাজে ব্যক্তিগত অপাপবিদ্ধতা থাকেনা, রক্তে সকলের হাত ভিজে যায়, পরজীবনহানির তীব্র দায়িত্ব যখন আমরা গ্রহণ করতে বাধ্য হই, জীবনহানি পাপ জেনেও জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। পূর্ববাংলার এই লড়াই তাই নিছক জাতীয়তাবাদী অন্তযুদ্ধ নয়; বেঁচে থাকার কাছে যে শপথ আমাদের জন্মসূত্রে করা থাকে, যে শপথ অদ্ভুতভাবে বলে জীবনকে নিজেদের মত করে অধিকার করতে হবে, দরকার হলে জীবনদানের ঝুঁকি নিয়ে, সেই বিচিত্র রহস্যময় শপথের অন্তিম পালন করা হচ্ছে আজ পূর্ব বাংলার সমস্ত সমাজের দ্বারা।
দেশকে আমরা এদেশে যা বলে থাকি সেই মায়ের বুক আজ সীমান্তের ওপাশে বােমায় রকেটে মরটারে ছিড়ে গেছে, রক্তের ফোয়ারা উঠছে। রক্তে ভেজা পূর্ব বাংলার আজ যে যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-বৃদ্ধেরা মরণপণ প্রতিরােধে নেমেছেন, তারা কতটা সশস্ত্র আমরা জানি-না; যুদ্ধের ব্যবহারিক সরঞ্জাম তাদের কী আছে আমরা কিছুই এদেশে জানিনা। লজিসটিকস বলে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদল যদি প্লেন, কামান, সাঁজোয়া জাহাজ ইত্যাদির জোরে শহরাঞ্চল দখল করেও রাখতে পারে, জলময় বিস্তৃত গ্রামাঞ্চল তাদের ক্ষমতার বাইরে থেকে যাবে। জয়ের সঙ্গে মনে হয়, তবে কী আমরা দেখব বাংলাদেশে একটি বিস্তৃত দীর্ঘসূত্রী গেরিলা যুদ্ধ কাঁটাতার বেড়া রক্ষিত শহর, গােপন আক্রমণ, গ্রামকে গ্রাম হসটিজ ধরা ও হত্যা, দখলদার বাহিনীর শাসন ও ব্যাপক রেজিসট্যানস (ও কিছু কোলাবােরেশন, দালালবৃত্তি) যেমন ফ্রানসে দেখা গিয়েছিল? নাকি ইচ্ছাময় আশা হয় স্থলপথে সরবরাহহীন পশ্চিম পাকিস্তানীর কপালে নাচছে আরেক দিয়ে বিয়েন ফু? | কয় মাইল এপাশে পশ্চিম বাংলায় আজ আমরা কী করতে পারি? বক্তৃতা হরতাল- এর শুধু মূল্য এই যে, পূর্ব বাংলা আশা করে, আজ যারা হরতাল করছে, কাল তারা আরও কিছু সক্রিয় সাহায্য করবে। শুধু গান গেয়ে, শ্লোগান তুলে আমাদের যদি উদ্যম ফুরিয়ে যায়, অথবা এদেশীয় রাজনৈতিক ভাগবাটরায় ব্যস্ত থেকে আমাদের উদ্যম যদি এগুতেই না পারে, তাহলে মানতেই হবে, কিছুতেই যা মানতে পারা যায় না, এ বাংলার হৃদয়ে নারকীয় মরচে পড়ে গেছে, আমরা কতকগুলি বাচাল অমানুষ হয়ে গেছি। পূর্ব বাংলার আজ এখুনি দরকার খাবার, ঔষধ এবং হঁ্যা, সেই নিষিদ্ধ অশ্লীল বস্তু- অস্ত্র। গানরানিং বা অস্ত্র পাচার এদেশে সরকারি উদ্যম ছাড়া হতে পারে না; কিন্তু যা আমরাই করতে পারি, তা- ঔষুধ পাঠানাে, খাবার পাঠানাে, দরকার হলে সীমান্তে তাঁবু- হাসপাতাল তৈরি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা। খুব শীঘ্রই পূর্ব বাংলার ব্যাপক খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে, কেননা সেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী। পােড়াতে পােড়াতে পিছু হটছে বা এগুচ্ছে। বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান যাতে কিছুতেই বায়াফ্রা না করতে পারে, তার পূর্ণ দায়িত্ব আজ পশ্চিম বাংলার ।
এর জন্য দরকার একটি রাজনীতি নির্বিশেষে সংস্থা, কংগ্রেস থেকে নকশাল অবধি, যারা এখনি এই কাজে নামবে। এবং দরকার টাকা, যে টাকা তােলার দায়িত্ব এখনি নেওয়া উচিত পশ্চিম বাংলার প্রত্যেকটি শ্রমিক সংস্থার, ছাত্র সংস্থার, সংবাদপত্র, সাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়ক অর্থাৎ যারা সাধারণ লােকের মত ও প্রবৃত্তি গঠনে অংশ নেন, তারা সকলে আজ নেমে এসে ডাক দিন, জাগরূক করে রাখুন, সকলের চোখের সামনে পূর্ব বাংলার ভাই বােনেদের রক্তের অশেষ স্রোত। বিশ্বাস না করে পারি না যে, ক-মাইল দূরের ওই মরণপণ অসম যুদ্ধ, আমাদের এই বাংলাকে অবিকল এমনিই রেখে যাবে না, আমাদের হৃদয়ে পুরােপুরি মরচে পড়ে যায়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মদত দেওয়ার দায়িত্ব শুধু পশ্চিম বাংলার নয়, সব বিবেকী লােকের; কিন্তু যতাে দূর বিবেক তত ক্ষীণ হতে থাকে। আমাদের এই বাংলার লােকেদের দায়িত্ব আরও এই কারণে আমর্মমূল যে, আমরা চিরকাল বলে এসেছি, দুই বাংলা ভালবাসার এক। শয়নে স্বপনে আমরা এতকাল গানে গল্পে কবিতায় যে অঙ্গীকার করেছিলাম, তা আজ বিশাল চেহারা নিয়ে দাবি মেটাতে উপস্থিত, সেই মুহূর্ত আজ, এখন। সময় অতি দ্রুত পলাতক কেননা, ভুললে চলবে না, বিপ্লবী যুদ্ধের শুরুতেই মরচে শুরু করে সমাজের শ্রেষ্ঠ অংশ; পূর্ব বাংলার সবচেয়ে সচেতন, আদর্শবাদী ও সাহসী যুবকদের নিশ্চিহ্ন করার পর যদি এই বিপ্লব জয়ী হয়ও, সেই জয় বহুপরিমাণে পঙ্গু থেকে যাবে। এবং এই ব্যাপক বিশাল কুরবানি যদি ব্যর্থ হয়, তার এক নিদারুণ দায়িত্ব বর্তাবে এই বাংলার উপর, এই ভারতের উপর।
৫ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা