রাজধানী-রাজনীতি ভারত সরকার বড়ই সাবধানী পথিক
— রণজিৎ রায়
বিশ্বাসঘাতকতা করে জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পুরােপুরি যুদ্ধ ঘােষণা করে দিয়েছেন। তাকে মদৎ জুগিয়েছেন জুলফিকার ভুট্টো এবং আর কয়েকজন রক্ত-লােলুপ পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিক। ওঁরা। অবশ্য এর জন্য গােটা কুড়ি পানজাবি ও সিনধি পরিবারের ধন্যবাদ পাবেন। গত তেইশ বছর ধরে বাংলাদেশের রক্ত শুষে ওই সব পরিবার প্রাচুর্যে কেঁপে উঠেছে। পশ্চিম পানজাবের সৈন্যরা বাংলাদেশে যে নারকীয় কাজের নজর রাখছে ইতিহাসে তার দোসর নেই। এই যুদ্ধের ফল সম্পর্কে সংশয় রেখে লাভ নেই। হাজার মাইল দূরে বসে যারা বাংলাদশের উপর কর্তৃত্ব চালাচ্ছে তাদের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজেদের শাসনভার নিজেদের হাতে নেবার জন্য বাংলাদেশ এত রক্ত দিয়েছে, দিচ্ছে। আরও অসংখ্য তাজা প্রাণ পানজাবিদের হাতে বলি হবে সন্দেহ নাই। কিন্তু ওরা বাংলাদেশের মানুষ নিধনে সক্ষম হলেও তার স্বাধীনতা-কামনাকে ধ্বংস করতে অক্ষম । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতিহাসের ধারা বলে দিচ্ছে ঃ স্বাধীনতাকামী কোন জাতিকেই শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলিত করে রাখা যাবেনা। ভিয়েতনামে আমেরিকানরা যথেষ্ট শিক্ষা লাভ করেছে; ক্ষমতা-লােলুপ পানজাবিরা শিখবে বাংলাদেশে। খবরের সব সুত্র বন্ধ; বিদেশী সাংবাদিকরা বিতাড়িত; তবু জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের উপর তার নির্যাতনের চেহারা বিশ্বজনের কাছ থেকে অগােচর করতে সক্ষম হননি। ছােট বড় সব দেশ চকিত বিস্ময়ে। দেখছে ঃ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের দল কী দুর্দম তেজে ইয়াহিয়ার আড়াই ডিভিশন সৈন্য, অধুনিক অস্ত্র, ট্যাংক এবং জোটের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে। পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর অন্তত দুটি স্কোয়াড্রন এখন বাংলাদেশে সক্রিয় ।
ওয়াকিবহাল কূটনীতিক মহলের বিশ্বাস ঃ ইয়াহিয়া অনেক কষ্টে বাংলাদেশের কয়েকটি শহর বড় জোর দখলে রাখতে পারবেন। কিন্তু গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় মুজিব বাহিনীর শাসন কায়েম হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের সুদীর্ঘ এবং আঁকাবাকা আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে দখলদারি কায়েম করা প্রায় অসম্ভব। বাস্তবিক অর্থে ঐসব এলাকা ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়ে পড়েছে। ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ঃ জেনারেল ইয়াহিয়া সংক্ষিপ্ত অথচ অতিদ্রুত আক্রমণে বাংলাদেশকে বিধ্বস্ত করার পরিকল্পনা করেছেন। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে তার পক্ষে সরবরাহ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই জন্যই বােধহয় গত বৃহস্পতিবার রাত্রে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে এমন অন্ধ বর্বরতা সহ আক্রমণ চালিয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া বােধহয় ভেবেছিলেন ঃ বাংলাদেশের হাজার কয়েক মানুষ খুন করতে পারলেই অন্যরা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করতে এগিয়ে আসবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিবর আশা করেছিলেন ভদ্রভাবেই বােঝাপড়া হবে, বাংলাদেশ স্বায়ত্ত শাসন পাবে; পাকিস্তান খণ্ডিত হবে না। তবুও মনে মনে তার আশংকা ছিল ঃ পানজাবি সৈন্যরা বােধ হয় তা হতে দেবেনা; বাংলাদেশ যে তাদের উপনিবেশ। সে সুবিধা তারা ছাড়তে চাইবে না। তাই মুজিবের চরম অবস্থার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছিলেন। তৈরি করে রাখছিলেন নিজের বাহিনীকে।
মাস দুয়েক আগে শেখ মুজিবরের এক ঘনিষ্ঠ সহযােগীর সঙ্গে আলােচনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেখেছিলাম ঃ ওঁর চোখে আগুন জ্বলছে। “আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবীর ভিত্তি ছাড়া পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হতে পারবে না।’- ওঁর কণ্ঠ স্পষ্ট, সুস্থির। “দরকার হলে সশস্ত্র লড়াইয়ে নামবাে, হােক সে লড়াই দীর্ঘ।” এ লড়াইয়ের লক্ষ হবে কয়েকটি পৌরএলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলা; সরবরাহের অভাবে ওদের শুকিয়ে মারা। সময় বাংলাদেশের অনুকূলে; ভৌগােলিক অবস্থানও। “নদী-নালায় এবং জলাভূমিতে পানজাবিদের ডুবিয়ে মারব।” ওর চোখে আবার আগুন জ্বলে উঠল । যে কোন সামরিক বিশারদই স্বীকার করবেন- বাংলাদেশের বনাঞ্চল ও জলাভূমি গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে চমৎকার।
এখন স্পষ্টই বােঝা যাচ্ছে তলে তলে সৈন্য, অস্ত্র, সৈন্যদের জন্য খাদ্যসম্ভার বাংলাদেশে এনে জমা করার সময় পাবার জন্যই ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা মুজিবরের সঙ্গে আলােচনা করতে বসেছিলেন। তবে, লাহােরে ভারতীয় বিমান পুড়িয়ে দেবার সুযােগ দিয়ে এবং বিমান দস্যুদের কোল দিয়ে। ইয়াহিয়া যে মােটেই নিজের সুবিধা করেননি- সেটা এখন তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ভারত তার আকাশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ওরা এখন সিংহল হয়ে অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশী রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে সেনা পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। এরজন্য যে অতিরিক্ত ব্যয় বহন। করতে হচ্ছে ইয়াহিয়ার পক্ষে সেটা মােটেই স্বাদু ব্যাপার নয়। | সিংহল সরকারের আচরণে দিল্লির কুটনৈতিক ও পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই হতবুদ্ধি। সিংহল পাকিস্তানী বিমানকে তেল নিতে দিচ্ছে বাংলাদেশের অনেক মিত্র নাকি সিংহলের সরকারকে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরােধ জানিয়েছেন। নয়াদিল্লির কাছে সংবাদ এসেছে; কলমবাে তার সিদ্ধান্ত পর্যালােচনা করছে; কিন্তু সে পাকিস্তানকে সুবিধা দেওয়া বন্ধ করবে কিনা, করলে কবে করবে, তা বলা যাচ্ছেনা। | পশ্চিম পাকিস্তানের রক্ত-পিপাসুর দল শুধু যে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নানারকম গাঁজাখুরি গল্প ছড়িয়ে সেখানে বাংলাদেশের বিরােধী আবহাওয়া গড়ে তােলার চেষ্টা করছে। ওদের এই অপপ্রচারের প্রধান লক্ষ্য হল বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বালুচ ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করা।
বাংলাদেশের নরমেধ সারা বিশ্বের পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগিয়ে তুলেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে; সেকরেটারি জেনারেল উথানট এ বিষয়ে মনােযােগ দিয়েছেন। দুনিয়ার প্রতিটি দেশেই উদ্বেগের ছায়া। নিধনযজ্ঞের শিকার যারা তাদের আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে সাহায্য দেবার চেষ্টা চলছে। ভারত জানিয়ে দিয়েছে। আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে যে আসুক না কেন, আশ্রয় সে পাবে। ইতিমধ্যে অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে। তাদের অধিকাংশই মুসলমান তরুণ। তারা অবশ্য পানজাবিদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সময় বুঝে আবার বাংলাদেশে চলে যেতে বদ্ধপরিকর। | ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে এক অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করেছে। ঐ সরকার নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাইবে। তার প্রতি কোন দেশই এখনাে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানায়নি; সকলেই অবস্থা। নিরীক্ষণ করছে। পৃথিবীর বহু দেশের রাজধানীতে কূটনীতিক সূত্র মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে সংবাদ লেনদেন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে সহানুভূতি স্পষ্ট আকার নিতে সময় লাগবে।
ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের ঘটনায় বিশেষ চিন্তিত হবার কারণ আছে। ওখানে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ঘাটি হয়ে দাঁড়াবে। সেটা ভারতের পক্ষে প্রাতিপ্রদ নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের ঘটনা ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এক নবীন আবেগ জন্ম নেবে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে তা প্রকট হবার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের সংঘর্ষ সম্পর্কে নয়া দিল্লি অত্যন্ত সতর্কভাবে অগ্রসর হতে চায়। শনিবার লােকসভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে সরদার স্বর্ণ সিং এর নরম বিবৃতিতে বহু এম পি-ই বিস্মিত। আগে থেকে তৈরি করা এক বিবৃতিতে তিনি বলেন- গত নভেম্বর মাসে সাইক্লোনের পর ভারত অন্যান্য দেশের মত যেভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে, এখনাে সে তা করতে প্রস্তুত। পররাষ্ট্র দফতরের সতর্ক উপদেষ্টারা এর বেশী কিছু বলার পক্ষপাতী নন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আলােচনায় যােগ দিয়ে বলেছেন যে, তিনিও উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভাগীদার; যথাসময়ে এ ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংসদের অধিকাংশ সদস্যের আবেগ-মথিত মনােভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য। সরকারের অত্তি সতর্ক মনােভাবের ব্যাপারে তার এই বিবৃতি কোন পরিবর্তনের আভাসবাণী কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা যাক।
৩১ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা