অস্ত্রের বিরুদ্ধে শূন্য হাতে
— নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
আজকের দিনে এই পৃষ্ঠায় আপনাদের কী দেব? আমরা প্রথমে ভেবে উঠত পারিনি। পরে এই দুটি লেখার কথা ভেবেছি। -একটি সারা বিশ্বে সারা ইতিহাসে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ কী করে হিংসাকে পরাস্ত করেছে। আর একটি প্রবন্ধের বিষয় অসহায় এবং আক্রান্ত একটি জাতির জন্য বাইরের বিশ্ব কোথায় কী করেছে বা কী করতে পারে। মুজিবর রহমানের বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা চলছে, তাকে পুরােপুরি ‘যুদ্ধবস্থা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দুই পক্ষের অস্ত্রশক্তি অবশ্য সমান নয়। এক পক্ষ যে ক্ষেত্রে কামান-বন্দুক-রাইফেল চালাচ্ছে, রাস্তার উপরে ট্যাঙ্ক নামিয়েছে, আকাশ থেকে বােমা ফেলছে, অন্যপক্ষ সেক্ষেত্রে প্রায় অস্ত্রহীন। স্থানীয় পুলিশ আর “পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল’ বাহিনীর একাংশের হাতে হয়ত বন্দুক আছে, কিন্তু বাদবাকী জনতার হাতে লাঠি বঁটি-দা সড়কি ইত্যাদি মামুলী হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই বিচারে বলা যায় যে, এই যুদ্ধ বস্তুত নিরস্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্রের যুদ্ধ। কিন্তু পূর্ববাংলার সংগ্রামী জনতা নিরস্ত্র হলেও নির্বল নন। তাঁদের সবচাইতে বড় বল আদর্শ নিষ্ঠতা। ইহাহিয়া-টিক্কা গােষ্ঠীর যা আদপেই নাই। বাংলাদেশের শহর-গঞ্জ গ্রামাঞ্চলে যে ফৌজকে তারা লেলিয়ে। দিয়েছেন, তারা নেহাতই বেতনভােগী সৈনিক মাত্র, মহৎ কোনও আদর্শ রক্ষার জন্য তারা লড়ছে না। প্রশ্ন উঠবে, অস্ত্রবলে বলীয়ান আদর্শহীনতার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র আদর্শ নিষ্ঠা জয়ী হতে পারে কিনা? পারেনা, এমন কথা বলতে হলে ঘাের নৈরাশ্যবাদী হতে হয়। শক্তিমানের রথচক্র কিংবা বুটের তলায় নিরত্নের প্রতিরােধ শােকাবহভাবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, ইতিহাসে অবশ্য এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। বিংশশতকের ইতিহাসে আছে আবিসিনিয়ার দৃষ্টান্ত।
অস্ত্রবলে পরাক্রান্ত মুসােলিনির অভিযানকে সে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে, তুলনায় হীনবল হয়েও যে আক্রমণকারীকে সফলভাবে বাধা দেওয়া যায়, উনিশ এবং বিশ শতকে তার দৃষ্টান্তও অনেক। বিগত শতকের মধ্যভাগ থেকে একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরছি। সম্রাট ফ্রানৎস যােসেফ যখন হাঙ্গারিকে দখল করে অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন, তখন তাকে এক প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হয়। হাঙ্গারীয় জনতা অস্ত্র ধারণ করেনি, ফেরেনস ডীক নামে এক ক্যাথলিক ভূস্বামীর নেতৃত্বে তাদের প্রতিরােধ আন্দোলন সেদিন সম্পূর্ণ অহিংসভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল অসহযােগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তলােয়ারের চাইতে অসহযােগের ধার অনেক বেশী। দিনের পর দিন আক্রমণকারী ম্রাটকে তারা কর দেয়নি কিংবা অন্য কোনও ভাবে তার সঙ্গে সহযােগিতা করেনি। ফল কী হয়েছিল, ইউরােপীয় ইতিহাসের ছাত্রদের তা অজানা নয়। নিরস্ত্র সেই প্রতিরােধের চাপ সহ্য করতে না, পরে ফ্রানৎস যােসেফ শেষ পর্যন্ত হাঙ্গেরীর জনসাধারণের দাবি মেনে নিয়েছিলেন। অসহযােগের শক্তি যে কতখানি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়েও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে তার পরিচয় দিয়েছেন, তারা নেহাতই বেতনভােগী সৈনিক মাত্র, মহৎ কোনও আদর্শ রক্ষার জন্য তারা লড়ছে না।
প্রশ্ন উঠবে, অস্ত্রবলে বলীয়ান আদর্শহীনতার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র আদর্শ নিষ্ঠা জয়ী হতে পারে কিনা? পারেনা, এমন কথা বলতে হলে ঘাের নৈরাশ্যবাদী হতে হয়। শক্তিমানের রথচক্র কিংবা বুটের তলায় নিরত্নের প্রতিরােধ শােকাবহভাবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, ইতিহাসে অবশ্য এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। বিংশশতকের ইতিহাসে আছে আবিসিনিয়ার দৃষ্টান্ত। অস্ত্রবলে পরাক্রান্ত মুসােলিনির অভিযানকে সে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে, তুলনায় হীনবল হয়েও যে আক্রমণকারীকে সফলভাবে বাধা দেওয়া যায়, উনিশ এবং বিশ শতকে তার দৃষ্টান্তও অনেক। বিগত শতকের মধ্যভাগ থেকে একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরছি। সম্রাট ফ্রানৎস যােসেফ যখন হাঙ্গারিকে দখল করে অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন, তখন তাকে এক প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হয়। হাঙ্গারীয় জনতা অস্ত্র ধারণ করেনি, ফেরেনস ডীক নামে এক ক্যাথলিক ভূস্বামীর নেতৃত্বে তাদের প্রতিরােধ আন্দোলন সেদিন সম্পূর্ণ অহিংসভাবে পরিচালিত হয়েছিল।
তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল অসহযােগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তলােয়ারের চাইতে অসহযােগের ধার অনেক বেশী। দিনের পর দিন আক্রমণকারী ম্রাটকে তারা কর দেয়নি কিংবা অন্য কোনও ভাবে তার সঙ্গে সহযােগিতা করেনি। ফল কী হয়েছিল, ইউরােপীয় ইতিহাসের ছাত্রদের তা অজানা নয়। নিরস্ত্র সেই প্রতিরােধের চাপ সহ্য করতে না, পরে ফ্রানৎস যােসেফ শেষ পর্যন্ত হাঙ্গেরীর জনসাধারণের দাবি মেনে নিয়েছিলেন। অসহযােগের শক্তি যে কতখানি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়েও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে তার পরিচয় কিছুকালের মত কাজ চলে যাবে, তবু প্রশ্ন থাকে, অগ্রসরমান সৈন্যদলকে বিভিন্ন ব্যারাক থেকে সেই রসদ ঠিকমত পৌছে যাবে কিনা। সাপ্লাই লাইন সর্বক্ষেত্রেই অটুট থাকবে, এমন কথা ভাবা শক্ত। যে-সব ক্ষেত্র অটুট থাকবে না, বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের অবস্থা সেখানে কী দাঁড়াবে? তারা সেক্ষেত্রে জনতার অস্ত্রাঘাতে না মরুক, অনাহারে মরবে তাতে সন্দেহ নেই। মুজিবর তাদের হাতে মারতে বলেননি। তা সত্ত্বেও তারা মারা পড়বে নিশ্চিত। মুজিবরের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায় যে তারা ভাতে মরবে’, ‘পানিতে মরবে’। বাংলা দেশের মানুষ তাদের প্রতিজ্ঞায় যদি অটল থাকেন, তাহলে নতুন করে আবার প্রমাণিত হবে যে, অহিংস অসহযােগের শক্তি সত্যিই সামান্য নয়। প্রমাণিত হবে, গান্ধীজী এই উপমহাদেশকে যে পথের সন্ধান দিয়েছেন, সেই পথ অবলম্বন করেও সশস্ত্র অত্যাচারীর হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব। অনেকে বলবেন, মুজিবরের প্রতিরােধ সম্পূর্ণ অহিংস নয়। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তে সায় দিতে বাধে। আগে যে কথা বলেছি, সেই কথাই পুনশ্চ বলতে ইচ্ছে করে। কামান-ট্যাঙ্ক-বিমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ যৎসামান্য কিছু অস্ত্র হয়ত ব্যাবহার করছেন, কিন্তু তুলনায় তা অস্ত্রহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত, তাঁদের আসল বল অস্ত্র নয়, আদর্শ। সেই আদর্শ কীভাবে প্রতিপক্ষের অস্ত্ৰবলকে পর্যদস্ত করে, গােটা বিশ্ববাসী তা দেখবার জন্য আজ উন্মুখ হয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।
২৬ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা