পূর্ব বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারী নিয়ন্ত্রণ
— হাসান মুরশিদ
দুর্বল ভিত্তির ওপর দণ্ডায়মান সুউচ্চ মিনারের পতন শুধু সময়সাপেক্ষ। চারিদিক থেকে টানা দিয়ে তার অস্তিত্বকে চিরস্থায়ী করার প্রচেষ্টা করতে পারেন গম্বুজনিম তা; কিন্তু পরিণতি তাতে অপরিবর্তিত থাকে। একথা পূর্ণবার প্রমাণিত হয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে। জাতীয়তার একটি মিথ্যা সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে একদা পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলাে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ অথবা লিয়াকত আলী খান মুখে যেই বলুন, ভালাে করে জানতেন ধর্ম জাতীয়তার একমাত্র শর্ত নয়, সর্ব প্রধান শর্তততা নয়ই অথচ পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তবিক ঐক্যসূত্রততা ধর্ম ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এই মিথ্যা মিলনকে অমর করার জন্যে দুরদর্শী।
নেতারা স্বধর্মপ্রীতি, আরাে স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় স্বধর্মান্ধতা ও পরধর্মের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণাবােধ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন বিশেষ করে পূর্ব বাংলার লােকেদের মধ্যে। সরকারি নীতিকে বাস্তবায়িত করার। উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে গঠিত হয়েছিলাে অনেকগুলি কার্যকর প্রচারযন্ত্র। চতুর ফন্দিবাজরা বুঝেছিলেন, বুড়াে ঘােড়াকে নতুন কিছু শেখানাে শক্ত, সুতরাং বর্তমান জেনারেশনকে ইসলামের ডুগডুগি বাজিয়ে তারা নাচতে চেয়েছিলেন, আর সাম্প্রদায়িক শিক্ষাকে মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে নির্বাচন করেছিলেন ভাবী প্রজন্মকে।
ভাবের অবাধ চলাচল যেখানে নিষিদ্ধ, শিক্ষাকে সেসব দেশে ছেটে-কেটে বিশেষ আকৃতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় বিতরণ করা হয় শিশুদের মধ্যে। এ শিক্ষা লাভ করে যে যুবক বা যুবতী বেরিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী থেকে, সে কথা বলে তােতা পাখির মতাে এবং শেখানাে রীতিতে ন্যায়-অন্যায়, ভালােমন্দ, শক্ৰমিত্র বিচার করে; এককথায় স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতাকে চিরকালের জন্যে পঙ্গু করে তাকে শ্রদ্ধাশীল করে তােলা হয় একটি কৃত্রিম মূল্যবােধের প্রতি। দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অঙ্গীভূত করার উদ্দেশ্য নিয়েই পাকিস্তানের নেতারা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এমন একটি শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, বা পাকিস্তানের উভয়াংশের ঠুনকো যােগসূত্রকে দৃঢ় করতে সমর্থ হবে। এই কারণে, মুক্ত চিন্তার বদলে ছাত্রদের তারা দিতে চাইলেন ধর্মীয় সংকীর্ণ শিক্ষা বা তরুণদের যুগপৎ ইসলামের প্রতি মােহাচ্ছন্ন এবং হিন্দু-ভারতের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলবে। | একদেশদর্শী শিক্ষানীতিকে ব্যাপ্ত করে দেওয়ার জন্যে প্রথমে সরকার সব গুলি পাঠক্রম নির্ধারক সংস্থার ওপর আপন কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। দেশের সাহিত্যের নামে মুসলিম সাহিত্যিকদের পাঠ্য-অপাঠ্য রচনাকে নির্বিচার উপস্থাপিত করা হলাে ছাত্রদের সামনে আর দেশের ইতিহাসের নামে শেখানাে হলাে আরব-ইরান এবং মুসলিম লীগের ইতিহাস। বালকবালিকারা জানলে সুলতান মাহমুদ বীর সৈনিক; মুহম্মদ ঘঘারি মহান মুসলিম সুলতান, পৃথুিরাজ কাপুরুষ হিন্দু রাজ্য; ঔরঙ্গজীব দেশপ্রেমিক, শিবাজী দেশদ্রোহী; সুরেন ব্যানার্জি, গোখলে, বিপিন পাল, গান্ধীজী, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল মুসলিম স্বার্থবিরােধী কুট রাজনীতিক, সৈয়দ আহমদ, আবদুল লতীফ, সলিমুল্লাহ, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী উদার স্বাধীনতা সংগ্রামী।
কিন্তু যেহেতু শুধুমাত্র পাঠক্রম নির্ধারণ করেই শিক্ষাকে উদ্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করা যায় না, তার জন্যে প্রয়ােজন যে শিক্ষার অনুকূল পাঠ্য পুস্তক, সে কারণেই অতঃপর আইয়ুব খাঁর আমলে একটি টেকস্ট-বুক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রচিত হয়েছে এক-এক শ্রেণীর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে একখানি মাত্র পাঠ্যপুস্তক। আর সে পুস্তকে সত্যের চেয়ে বেশি খাতির পেয়েছে সরকারি বক্তব্য। পাকিস্তান যে মিথ্যার ওপর নির্মিত, তাকে সত্যের চেহারা দিতে এই সকল গ্রন্থে শত মিথ্যার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত কতিপয় তথাকথিত শিক্ষিত লােক এই পাঠ্যপুস্তকগুলির নীতিনির্ধারণ করেছেন এবং সেগুলি রচনা করেছেন। স্বার্থান্ধ এই অসাধু বুদ্ধিজীবীরা আদর্শ এবং সত্যকে বিসর্জন দিয়েছেন সরকারি প্রলােভন ও ক্ষুদ্র আর্থিক লাভের মুখে।
কর্তৃপক্ষ যখন দেখলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তারা কিছুতেই বর্জন করতে পারবেন না, তখন সূক্ষ্মতর পথে তাকে খর্ব করতে উদ্যত হলেন। বিভাগপূর্ব বাংলা সাহিত্য থেকে সকল হিন্দু নামকে ধুয়ে ফেলে তাকে একটা ইসলামি রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলল। এই কারণে পূর্ব বাংলার স্কুলপাঠ্য সাহিত্য সংকলনগুলি বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই গ্রন্থগুলিতে নির্বাচিত কবিলেখকদের প্রতিষ্ঠা যেমন প্রশ্নাতীত নয়, তেমনি রচনাগুলিও দাবি করতে পারে না অবিসংবাদিত উৎকর্ষ বা প্রশংসা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের নাম করে পূর্ব বাংলার ছেলেরা পড়ে মীর মশাররফ হােসেন, শেখ ফজলুল করিম, মােজাম্মেল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, গােলাম মােস্তাফা, জসীম উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, ফররুখ আহমদ, হাবীবুর রহমান, আহসান হাবীব প্রমুখের রচনা। রবীন্দ্রনাথ নামক একজন অবাঞ্ছিত লােকের কথাও তারা। শােনে অথবা হয়তাে জীবনানন্দও কখনাে চকিতে তাদের সামনে উপস্থিত হন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্য একপ্রকার অপরিচিত থাকে তাদের কাছে।
বাংলা সাহিত্যের মতাে স্বাধীনতাসংগ্রামের যে ইতিহাস শেখানাে হয় অপরিণত শিশুদের তা একান্তভাবে বিকত ও পক্ষপাতদুষ্ট। সে ইতিহাস পাঠে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে মুসলমানদের স্বাধীনতার সবচেয়ে দুর্লজ্জ প্রতিবন্ধক ছিলেন হিন্দুরা এবং সংগ্রামবিক্ষত মহান নেতা জিন্নাহ সাহেব তাঁদেরই কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছেন দুর্লভ আজাদী। গান্ধী নেতাজী-নেহরুর নাম প্রায় সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত পূর্ব বাংলার। ছাত্রছাত্রীদের নিকট-অন্তত টেক্সট-বুক কমিটির গ্রন্থে এঁরা প্রায় অনুপস্থিত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে এঁদের। দান প্রায় অস্বীকৃত। | এই টেকসট-বুক কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষালাভ করে যে ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তার পক্ষে মুক্তচিন্তার শরিক হওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে এই ছাত্রদের তাই খটকা লাগে। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলি কমিটির রচনা নয়, এমন কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম নির্ধারক সংস্থার ওপরও সরকারি প্রভাব উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ের মতাে অত প্রবল নয়। কিন্তু অনেক তরুণই নতুন মতামতের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপককে তারা এ কারণে বিবেচনা করে জাতীয়তাবিরােধী বলে। পাঠ্যপুস্তকের প্রতিও তাদের অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা গুপ্ত থাকে না। তবে কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী মিথ্যা শিক্ষার শিকল কেটে বেরিয়ে আসে মুক্তবুদ্ধির উন্মুক্ত প্রান্তরে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিকার হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় কী করে এমন ব্যাপক চিত্তজাগরণ সম্ভব হলাে, সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। হয়তাে সত্য মিথ্যা দিয়েও শেষ পর্যন্ত শেষরক্ষা হয় না বলেই সত্য প্রকাশিত হয়েছে তার স্বাভাবিক রীতিতে এবং পূর্ব বাংলাও সেই পথে সরকারি ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করতে সমর্থ। হয়েছে।
অক্টোবর () ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা