স্বদেশী-আন্দোলন বাংলাদেশ
–শিবদাস চক্রবর্তী
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধে অতীত দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মনীষী বিপিনচন্দ্র পাল তার বাংলা আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছিলেন- “এ জগতে আসিয়া ভারতবর্ষে জন্মিয়াছি ইহা সৌভাগ্যের কথা। আবার যদি এ সংসারে জন্মিতে হয়, তাহা হইলে এই ভারতবর্ষেই জন্মিতে চাই, সুখ-সমৃদ্ধিশালী অন্য কোন দেশে জন্মিতে চাহি না। সর্বোপরি এই বাংলাদেশে এ যুগে জন্মিয়াছি, ইহা পরম সৌভাগ্যের কথা। মৃত জাতি কি করিয়া নবজীবন প্রাপ্ত হয়, এ যুগে এই বাংলাদেশে জন্মিয়া তাহা স্বচক্ষে অনেকটা দেখিয়াছি। এপরম। সৌভাগ্য সকলের ঘটে না।”
বিপিনচন্দ্র যে মৃত জাতির নবজীবন প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ দর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন, সে জাতি হলাে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের অখণ্ড বাঙালী জাতি। বিপিনচন্দ্র ছিলেন শ্রীহট্ট জেলার মানুষ, যে শ্রীহট্ট তেইশ বছর যাবৎ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবার পর সম্প্রতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর অন্তর্গত। সুতরাং তিনি যদি আজ পর্যন্ত জীবিত থাকতেন, তাহলে প্রায় শতাব্দীকালের ব্যবধানে খণ্ডিত এক নতুন বাঙালী জাতির নবজীবন প্রাপ্তির আত্মহারা উল্লাস প্রত্যক্ষ করে যেতে পারতেন। নিদ্রা এবং জাগরণ যেমন জীবনের ধর্ম, তেমনি জাতিরও ধর্ম । এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জীবনের মতাে জাতিরও স্বাভাবিক স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অন্যান্য জাতির সঙ্গে বাঙালী জাতির যেন কিছু পার্থক্য আছে। প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালীর জাতীয় সত্তা যে পরিমাণ জাগ্রত হয়ে ওঠে, অনুকূল পরিবেশে যেন তা হয় না। বাঙালী জাতির এই জীবন-রহস্য পরিস্ফুট করতে গিয়ে বিপিনচন্দ্র বলেছেন- ‘বাংলার চরিত্র ও ইতিহাসের অনুসন্ধান করিলে ইহাও দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই নতুন যুগেও সেই পুরাতন বাঙালী চরিত্র ও সাধনাই অভিনব আকার ধারণ করিয়াছে মাত্র। রূপের পরিবর্তন হইয়াছে কেবল মাত্র, মূল বস্তু নষ্ট হয় নাই, তাহা যেমন ছিল, তেমনই আছে।’
বিপিনচন্দ্রের চিন্তাধারা অনুসরণ করে বলা যায় যে, সেই মূল বস্তু হচ্ছে- ‘স্বাধীনতা এবং মানবতা’। মানবতা হচ্ছে সাধ্য আর স্বাধীনতা হচ্ছে তার সাধনােপায়। এই মানবতা সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, এমনকি স্বদেশিকতারও উর্ধ্বচারী মানুষ মাত্রেরই প্রতি মানুষের সহজাত মমতবােধ। এ ধরনের মমতাবােধের প্রেরণাবশেই একদা বাংলার কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বাঙালী জাতির অন্তরলােকে নিগুঢ় বাণী ?
শুনহে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই।
এই মনােভাবের বশবর্তী হয়েই বাংলার সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ দিল্লির সুলতানী শাসনের বিরুদ্ধাচারণ করে বাংলায় পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। প্রবল প্রতাপান্বিত ফিরােজ তুঘলকের দুর্বার আক্রমণ শেষ পর্যন্ত একডালা দুর্গপ্রান্তে প্রতিহত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। বাংলার ঈশা খাঁ প্রতাপাদিত্য প্রমুখ বারাে ভূঁইয়ারা আপেক্ষিকভাবে হীনবল হয়েও দিল্লির মুঘল-শাহীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। ইতিহাস তার সাক্ষী। নবীন রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাঙালী যখন বুঝতে পারলাে যে, ইংরেজরাজের প্রত্যক্ষ প্রতিশ্রুতিগুলি পরােক্ষ প্রতারণারই নামান্তর, তখনই তার কণ্ঠ প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠল। বঙ্গভঙ্গোত্তর স্বদেশী আন্দোলনের যুগে প্রতিকারহীন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘লাল-বাল-পাল’-এই ত্রিনাথের অন্যতম বাঙালী বিপিনচন্দ্র বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার স্তম্ভে এক ঐতিহাসিক ঘােষণায় লিখেছেন, They desire to make the Government of India popular without ceasing in any sense to be essentially Broitish. We desire to make it autonomous abosolutely free of the British Control.
একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করে সারা পাকিস্তানের অবিসংবাদী জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর দেশের কেন্দ্রীয় কর্তত্ত্বকে লক্ষ্য করে যে বজ্রকণ্ঠ শপথবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তারমধ্যে সেই সনাতন বাঙালী কণ্ঠই মুখর হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন- ‘বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নস্যাৎ করে দেবার জন্য শক্তি প্রয়ােগ করা হলে তা বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়ােজনে বাঙালী আরও রক্ত দেবে, কিন্তু স্বাধিকারের দাবির প্রশ্নে কোন আপস করবে না।’ দেশ, কাল, পরিস্থিতি ভিন্ন, কিন্তু অভিন্ন বাঙালী প্রাণ একইভাবে অবিচলিত প্রত্যয়ে উদ্দীপিত, যেন সনাতন বাঙালী কণ্ঠ একই সুরে স্পন্দিত। অথচ এই শপথ যে শূন্যগর্ভ শব্দগুচ্ছ মাত্র নয়, তা প্রমাণ করে দিল ছাব্বিশে মার্চের ঐতিহাসিক ঘােষণা, যে ঘােষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর ‘বাংলাদেশ’ কে ‘সার্বভৌম, স্বাধীন ও লােকতন্ত্রী রাষ্ট্র রূপ’ উল্লেখ করে বললেন- “আমরা বিড়াল কুকুরের মতাে মরব না। যদি মরতে হয়, তাহলে বাংলামায়ের সুযােগ্য সন্তান হিসাবেই প্রাণ বিসর্জন দেব।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের কয়েকটি পর্যায়ের কথা আশ্চর্যভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনের সাদৃশ্য সর্বাধিক, যে আন্দোলনের বিপিনচন্দ্র ছিলেন রাজনৈতিক দার্শনিক, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চারণ কবি এবং অরবিন্দ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি।
মুক্তিফৌজের মুক্তি-মন্ত্র ‘জয়বাংলা’ পরাধীন ভারতবর্ষে নেতাজী সুভাষচন্দ্র পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি-মন্ত্র “জয় হিন্দ’ এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । শেখ মুজিবর রহমান তাঁর আন্দোলনকে ‘অহিংস অসহযােগ আন্দোলন’ বলে ঘােষণা করেছিলেন। এই নাম স্বভাবতই গান্ধীযুগের নন্ ভায়ােল্টে নন্ কোঅপারেশন মুভমেন্টের কথা সর্বাগ্রে স্মরণ করায় । শেখ মুজিবরের একক নেতৃত্বের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন নন্ কো-অপারেশনের যুগে গান্ধীজীর নেতৃত্বের প্রতি তৎকালীন ভারতবাসীর অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনের কথাও সহজে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই নিস্ক্রিয় প্রতিরােধের আদি প্রবক্তা ছিলেন তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মানুষ বিপিনচন্দ্র। অববিন্দ ঘােষ (পরবর্তী কালে শ্রী অরবিন্দ) ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় লিখিত পনেরটি প্রবন্ধে (এপ্রিল ৯-এপ্রিল ২৩, ১৯০৭-সেই নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধকে এক দার্শনিক মতবাদের পর্যায়ে উন্নীত করেন। বিপিনচন্দ্র বলেছিলেন “Passive Resistance is not nonactive but non-aggressive resistence. We stand upon our right. We stand within the limit of the law that we have still in the Country. শেখ মুজিবরও প্রথমে তার দেশে প্রচলিত আইনের সীমার মধ্যে দেশবাসীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের জন্য অহিংস উপায়ে তার অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। স্বদেশী যুগে স্বাধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পর যে শ্ৰেয়ােপথ ছিল না, তার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র বলেছিলেন—- ‘Circumstances as the people of this country are at present such method would be suicidal to the very cause in the service of which they may be employed. The Foreign despatism that held political sway over us now is strong if not absolutely invincible in arms- the people are as absolutely disaserned.’। শেখ মুজিবরের সামনেও একই সমস্যা ছিল। নিরস্ত্র জনবল নিয়ে সুসংগঠিত সশস্ত্র শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়া ছিল আত্মঘাতী- পন্থাগ্রহণের সামিল। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পরিস্থিতি ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। কারণ তিনি ছিলেন দেশের বিপুল সংখ্যাধিক্যের সমর্থনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
বিপিনচন্দ্রের নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধের সংজ্ঞায় নিষ্ক্রিয়তার কোনাে সীমা নির্দেশ করা ছিল না। কিন্তু অরবিন্দ নিষ্ক্রিয়তার সীমা নির্দেশ করে বলেছিলেন- “So long as the action of the executive is peaceful and within the rules of the fight, the passive register scrupulously maintains his passivity, but he is not bound to do so a moment beyond.’ যে মুহূর্তে পাক জঙ্গীশাহীর ক্রিয়াকলাপ সভ্য জগতের রীতিনীতি লঙ্ন করেছে, সেই মুহূর্ত থেকে বঙ্গবন্ধু উদ্ভাবিত অসহযােগ আন্দোলনও আর নিষ্ক্রিয় থাকেনি। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রেরণাতেই সে সক্রিয় এবং সশস্ত্র হয়ে উঠে অরবিন্দ ব্যাখ্যাত পন্থাই অনুসরণ করেছে।
স্বদেশী যুগের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পাক জঙ্গী-তন্ত্রবিরােধী আন্দোলনের আরও দুএকটি ব্যাপারে মিল আছে। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ‘বঙ্গদর্শন’-এর পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের যে বিখ্যাত দেশাত্মবােধক গান প্রকাশিত হয়, যার প্রথম পংক্তি- ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি’। সেই গানখানিকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে কণ্ঠে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু পরিচালিত বাংলাদেশবাসীর মুক্তি সংগামের প্রেরণা বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বাঙালী জাতির হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়েছিল। আর একটি ব্যাপারেও বেশ মিল রয়েছে। সেদিন ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের ছােটলাট ছিলেন ব্যামফাইন্ডে ফুলার, যিনি স্বদেশী আন্দোলন দমনের জন্য পূর্ববঙ্গের শহরে, গঞ্জে, গ্রামে, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেও শেষরক্ষা করতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক গভর্ণর টিক্কা খান যেন ব্যামফাইন্ড ফুলারেরই আধুনিক সংস্করণ। ফুলার প্রদর্শিত পথে পদক্ষেপ করে টিক্কাখান অবশ্য অচিরেই ফুলারকে অতিক্রম করে গেছেন। জানিনা, তিনিও শেষ রক্ষা করতে পারবেন কিনা।
বিপিনচন্দ্র বলেছেন- স্বাধীনতার প্রেরণা ও মুক্তির বাসনা মানুষের অন্তরে একবার জাগিলে তাহার সমগ্র চিত্ত ও চরিত্রকে অধিকার না করিয়া ছাড়ে না। যে একবার জীবনের কোনও বিভাগে সত্যকার মুক্তির আস্বাদ। পাইয়াছে, সে কোনও বিষয়ে কোন প্রকারের বন্ধন সহিতে পারে না। দীর্ঘকাল আগে বাঙালীর চিত্ত ও চরিত্র সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি যে সাধারণীকৃত মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন, তা বর্তমান বাংলাদেশের চিত্তে ও চরিত্রে আশ্চর্যভাবে সত্যরূপে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সদ্যজাত বাঙালী জাতির অন্তর আজ সত্যই বন্ধন-অসহিষ্ণ। পাক জঙ্গীশাহীর সদ্য-উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্রের আতঙ্কতার মরণপণ মুক্তি-সংগ্রামকে তাই আজও স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। যে দাবিকে কেন্দ্র করে উনিশ শ’পাঁচের স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা, বাঙালীর দুর্বার প্রতিরােধের কাছে নতি স্বীকার করে সেদিন প্রবল প্রতাপান্বিত বৃটিশ রাজকে শেষ পর্যন্ত বাঙালীর সেই দাবিকে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল। আজ সীমান্ত পারে বাঙালীর যে দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন, সে দাবির আকৃতি হয়তাে ভিন্ন, কিন্তু তার প্রকৃতি তেমন ভিন্ন নয়। বিপিনচন্দ্রের বক্তব্যের অনুসরণে বলা যায় এই নতুন যুগেও সেই পুরাতন বাঙালী চরিত্র ও সাধনাই অভিনব আকার ধারণ করেছে মাত্র। প্রবাদ আছে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। কে জানে বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীন পরিস্থিতির জন্য ইতিহাস দেবতার একই বিধান অপেক্ষা করে আছে কিনা?
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ ,