কিলো ফ্লাইট
মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি গেরিলারা কিভাবে ধীরে ধীরে সড়ক ও জলপথ ধ্বংস করে পাকিস্তানী সেনাদের চলাচল ও রসদ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যেক্ষেত্রে পথের কোন ভূমিকা নেই অর্থাৎ স্থাপনাগুলো ধ্বংসের জন্য গেরিলাদের নানারকম অপারেশন করতে হয়েছে। তবে তুলনামূলক হাল্কা অস্ত্র নিয়ে আমেরিকা আর চিনের দেয়া পাকসেনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাথে গেরিলাযুদ্ধে সব সময় সফল হওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। ঠিক এই অবস্থায় দরকার ছিল আকাশপথে আক্রমণের।
সেই উদ্যেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি বৈমানিক ও প্রকৌশলীরা মিলে ভারতের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত এক জঙ্গলঘেরা রানওয়ের পাশে গড়ে তোলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। যার সাংকেতিক নাম হল কিলো ফ্লাইট। কিন্তু বিমান কোথায়?
হ্যাঁ, জীর্ণ দুটি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
একটি হল কানাডার তৈরি অটার বিমান যা মূলত বেসামরিক কাজে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের এটা দিয়েই করতে হবে। পেছনের দরজা খুলে বসানো হল মেশিনগান। আর মেঝের পাটাতন খুলে ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা যুক্ত করা হল। আর অটোমেটিক না। অর্থাৎ ফেলতে হবে হাত দিয়ে।
আরেকটি ছিল যোধপুরের মহারাজা গজ সিংএর ব্যক্তিগত ব্যবহারের বিমান। এটি আমেরিকার তৈরি ডাকোটা বা ডিসি-৩ বিমান। এটি শুধু পরিবহন কাজেই ব্যবহার সম্ভব ছিল।
হ্যাঁ, বিমান এই দুইটিই। তবে এটাই শেষ নয়। আমাদের একটা ফ্রান্সের তৈরি ছোট আকৃতির অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার ছিল। এটাও বেসামরিক। এতে যুক্ত করা হল মেশিনগান ও রকেট পড। আর ২৫ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু এটা খুব উঁচুতে উড়তে পারতো না। তাই নিচ থেকে আসা গুলি ঠেকাতে ফ্লোরে এক ইঞ্চি পুরু স্টিল প্লেট লাগানো হল।
এবার ট্রেনিং শুরু। যেহেতু বিমান আর হেলিকপ্টার বেশি উঁচুতে যেতে পারেনা আর গতিও কম তাই অপারেশন রাতে করার ট্রেনিং চলল। জিপিএস বলতে একটি কম্পাস, চাঁদের আলো আর বুদ্ধি ছাড়া কিছুই ছিলোনা। দুই মাস ট্রেনিং চলল।
তারপর অপেক্ষা। দীর্ঘ সময় পরে নির্দেশ আসল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি বাহিনীর বৃহৎ দুটি তেলের ডিপো ধ্বংস করতে হবে। শুধু গেরিলাদের চেষ্টায় এগুলো ধ্বংস করা যাচ্ছিলোনা। ডিপোতে মজুদ আছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল। ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টিকে থাকার সকল পথ শেষ হয়ে যাবে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
অন্যদিকে এলুয়েট হেলিকপ্টারটি গোদনাইল তেল ডিপো ধ্বংস করে আসে
ভারতের মণিপুরের কৈলাশহর থেকে অটার বিমান চট্টগ্রামের পতেঙ্গার উদ্দেশে রওনা করে। লক্ষ্য ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপো। অটারের তিন আরোহী ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম। যেহেতু কোন ন্যাভিগেশন সিস্টেম ছিলোনা তাই কৈলাশহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে উড়ে বঙ্গোপসাগরে এসে সমুদ্রতীর ধরে চট্টগ্রাম পৌঁছে যায় তারা। নৌবাহিনীর গানবোট ও জাহাজের এন্টি-এয়ার গান ফাঁকি দিয়ে যেতে হয়। লক্ষ্যের কাছে গিয়েই শুরু হয় তাদের রকেট আক্রমণ। কিন্তু প্রথম তিনবার বোমা ফেললেও সেগুলো বিস্ফোরিত হয়না। ঘামতে থাকে সবাই। ইতোমধ্যে উড়তে থাকা বিমানের শব্দে শত্রুরা টের পেয়ে যায়। গুলি শুরু করে ওরা। শেষবারের আশায় এগিয়ে যায় তারা। এবার কাজ হল। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ট্যাংকারগুলো আর বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে একের পর এক।
জানা যায়, পুরো তেলের স্টক শেষ না হওয়া একটানা তিন দিন এগুলো জ্বলেছে।
এদিকে কিলো ফ্লাইটের লিডার সুলতান মাহমুদের পরিচালনায় একই সময়ে আগরতলার তেলিয়ামুড়া থেকে উড়ে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পৌঁছায় অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারটি। এ মিশনে তাঁর সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। তারা বড় কোন আক্রমণ ছাড়াই তেলের ট্যাংকারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। মুহূর্তে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়।
পাকিস্তান বাহিনী ঘুর্নাক্ষরেও ভাবতে পারেনি তাদের ওপর আমরা বিমান হামলা করার ক্ষমতা রাখি। তাই তাদের কোন প্রস্তুতি ছিলোনা। হতভম্ভ হয়ে পরিস্থিতি দেখে যাওয়া ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিলোনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম সফল দুঃসাহসী অভিযান এভাবেই শেষ হয়। গুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানীদের বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকার মনোবল।