মিলির সাইকেলঃ
………………..
৭০ বছর আগে মফঃস্বলের শহর রংপুর কতোটা আধুনিক ছিল জানিনা। শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর একটি ছিল কাজী পরিবার। তিন-ভাই-সাত-বোনের সবচেয়ে বড় ছিল মিলি। ঠিক এই মুহুর্তে মিলির মন খুব খারাপ। সারাটা বিকেল বৃষ্টি। সাইকেলের দিকে তাকাতে মিলির মনে হল সাইকেলের মন আরও বেশি খারাপ। তাই সাইকেলটা ঘরের কোণে হেলান দিয়ে আছে। মিলি সেই সময়েই সাইকেল চালাতো। পরিবার থেকে কখনো বাধা আসেনি। বরং উৎসাহই পেয়েছে। খুব ভালো গানও করতো সে। পড়েছে কারমাইকেল কলেজে। রংপুর শহরে মনসনিয়া পুলের কাছে বড় একটা বটগাছ ছিল। সেখানে মাঝে মধ্যে কীর্তনের আসর বসত। ভালোই লাগতো। আস্তে আস্তে মিলি বড় হয়ে ওঠে। লম্বায় ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি। শ্যামলা মিষ্টি মেয়ে। সাহিত্য যোগ করলে আরও কিছুটা লেখা যেত – কিন্তু আমাদের ট্রেন ওদিকের নয়।
.
১৯৫০ সালে ফুপাত ভাই ভিকুর সাথে বিয়ে হয় মিলির। তবে কারমাইকেলে থাকতেই সে রাজনীতিতে জড়ায়। ৫২ র ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। মিটিং মিছিলের মধ্যমণি ছিল একটি নাম – মিলি চৌধুরী। রংপুর শহরে মিছিলে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা ছিলোনা। ৫৮ সালে মিলি ঢাকায় বোনের বাসায় চলে আসে। ৬২ সালে ছায়ানটে ভর্তি হয়। বোনের ভাষ্যমতে – ‘আমরা যদি ঠাট্টা করে বলতাম, এখন গান শিখে কী হবে? ও বলত গানের কি বয়েস আছে? গান হল সব বয়সের, সর্বকালের।’ ‘ওর পছন্দের গান ছিল – আমার সকল দুঃখের প্রদীপ।’ মিলি ফুল খুব পছন্দ করত। সেই সময়ে ১০০ টাকার ফুলের চারা কিনে আসাদ গেটের কলোনিতে বাগান করেছিল। খুব শান্ত গলায় কথা বলত মিলি। যদিও তার স্বামী ভিকু ভাই হৈচৈ পছন্দ করতেন।
.
তবে রাজনীতি মিলি ছাড়তে পারেনি। দেশ তাঁকে ভাবিয়েছে। সে ঘরে বসে থাকেনি। ৭১ সালে মার্চের দিকে ছোটাছুটির কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হলে মিলি তার বোনকে রাত ১১ টার দিকে ফোন করে। বাবা সংবাদিক হওয়ায় মূলত খবর নিতে সে ফোন করত। রাত দুটোর সময় জানা গেল বঙ্গবন্ধু বন্দী হয়েছেন। মিলির সাথে আর কথা হয়নি তার বোনের।
.
মিলি যুদ্ধে যাবেন মনস্থির করেন। ট্রেনিং এর জন্য ভারত যাবার পথে ৩১ মার্চ সপরিবারে টাঙ্গাইলের পাকুল্লা গ্রামে পৌঁছান। কিন্তু ইতোমধ্যে খবর আসে আর্মি গ্রামটি ঘিরে ফেলেছে। মিলি তার দুই মেয়েকে নিয়ে একটি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের দেখে ফেলে সেনারা। মেয়েদের ভাষ্যমতে – ‘ওরা যখন আব্বাকে গুলি করেছে আব্বা তখন কেবল আমাদের নাম ধরে চিৎকার করেছেন। আর মায়ের গায়ে মাত্র একটা গুলি লাগল – তবু মা কেন মরে গেল?’ মিলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মূহুর্তে শুধু বলেছিল – ‘বাংলাকে স্বাধীন দেখতে চেয়েছিলাম, পারলাম না। তোরা দেখিস। তোরাই আমার কর্ম।’ মিলি সহ ঐদিন গ্রামে মোট ১২৮ জনকে হত্যা করা হয়।
.
প্রিয় প্রজন্মঃ
মিলি হয়ত মুক্তিযুদ্ধ করতে পারেনি। কিন্তু শুনে অবাক হবে ঐ সময়ে সকল মেয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা তোমাদেরই পূর্বপুরুষ। তোমাদেরকে শুধু একটা মানচিত্র দেবার জন্য তারা যুদ্ধে গেছিল। আর কোন উদ্যেশ্যে নয়। এখন যখন ইতিহাসকে রাজনীতি মনে করে এড়িয়ে চলো – বা কেউ কেউ ধর্মের কথা বলে পাকিস্তানকে ভাই মনে কর – হিজাব দিয়ে শুধু কান-ঘাড় ঢেকে জিন্স পড়ে হাতে গিটার নিয়ে ইংরেজি গান গেয়েই নিজেকে আধুনিক মনে করো – তাদের বলছি – এর চাইতে আধুনিক ছিলেন সেই বীরসেনানীরা – তোমাদের শরীরে বইছে বীরের রক্ত – সেটাকে আর ঘুম পাড়িয়ে রেখো না – দেশমাতৃকার গর্বের ইতিহাস জানো – সাহসী হও ভেতর থেকে। নারীর সাহসের উপরেই সভ্যতা দাঁড়িয়ে থাকে। পুরুষ শুধু সহায়ক শক্তি-মাত্র। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব যেদিন বিকেলের বৃষ্টিরা তোমাদের বিষণ্ণ করে দিতে পারবেনা – সাইকেল নিয়ে বের হবে এক নিঃশ্বাসে – ঠিক যেন ৭০ বছর আগের মিলি ফিরে আসবে তোমাদের মাঝে।
ছবি – জনৈক মুক্তিযোদ্ধা।