You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযোদ্ধাদের একটি লিফলেট  - সংগ্রামের নোটবুক

একটি লিফলেট
……………….


কুমিল্লার মন্দভাগের প্রত্যন্ত গ্রাম। ভরা বর্ষা। ভরাট নদী। রাতের বেলা প্রচণ্ড নীরব। রাত যত গভীর দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচা আর শেয়ালের ডাক ততোই ভীতিকর। মাঝে মাঝে পাখীদের ডানা ঝাপটানো। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ এখন নদী। এরই মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে গেরিলারা। আধা পেটা – ক্ষুধার্ত। ঘর নেই। চাল-চুলো নেই। বৃষ্টিতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোবার যো নেই। বাংলার মাটি আজ হায়েনার দখলে। সমস্ত পৃথিবী এই অঞ্চলের মানুষের ব্যাপারে নীরব। কারণ তারা কিছু জানেনা। জানতে দেয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকের প্রবেশ নিষেধ। ইয়াহিয়ার মিথ্যাচার চলছে রেডিওতে। সে বলেছে, ‘পরিস্থিতি এখন শান্ত’। হয়ত এই গহিন রাতের গ্রামের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতই শান্ত। শুধু জেগে আছে একদল ‘মুক্তি’। হ্যা, পাকসেনারা তাদের ‘মুক্তি’ নামেই ডাকতো। মন্দভাগের এই গ্রাম থেকে মুক্তিরা নৌকায় চড়বে। সাথে আছে সেক্টর কমান্ডার খালেদ। হৃদয়ে জমানো দুর্বার সাহস অন্ধকারের ভাঁজে লুকিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে তারা। হারিকেনের টিমটিম মৃদু আলোতে শুধু নৌকার বৈঠার সাথে কাঠের গুমোট একটা শব্দ। আকাশে ঘন মেঘ দিয়ে ঢাকা আধেকটা-চাঁদ। ভরা বর্ষায় চাঁদের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। এমন নৈসর্গিক আবেদন ভেদ করে ওরা অপারেশনে যাচ্ছে। একাত্তরের বীর বাঙালির এমন হাজারো অপারেশনের কথা আমরা জানি। আজকের দিনে কে-ফোর্সের খালেদ মোশাররফ খুন হন। না, কোন পাকিস্তানী সেনা তার বুক তাক করে গুলি পাঠাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বাধীন বাংলায় শুরু হওয়া দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের নাটকে মঞ্চায়িত হয় খালেদ চরিত্রের বিদায়গাঁথা। যে যুদ্ধ চলছে এখনো। নতুন প্রজন্মের চিন্তার উঠোনজুড়ে লেপে দিয়ে গেলাম মুক্তির ইতিহাস।
.
মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ সাধারণ জনগণের মাঝে লিফলেট বিলি করেন। সেই লিফলেটটির টেক্সট হুবহু তুলে ধরা হলো।
.
বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে
…………………………………
জনগণই মুক্তিযোদ্ধাদের চালায়, বাঁচার, অগ্রসর হওয়ার, জয়ী হওয়ার একমাত্র অবলম্বন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ যে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত তা সম্পূর্ণভাবেই জনগণেরই যুদ্ধ। জনতার প্রতিটি অংশ, সমস্ত শক্তি এতে একত্রিত। গণবাহিনীর চরিত্র অনুযায়ী প্রত্যেক বাঙালি আজ যুদ্ধরত – কেউ সশস্ত্র, কেউ নিরস্ত্র। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। তবে কেউই অতিরিক্ত নয়, প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকা আছে এই যুদ্ধে এবং সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেউ যেন হুকুমের অপেক্ষায় বসে না থাকে। কেউ যেন না ভাবে যে হাতিয়ার ছাড়া বা সামরিক ট্রেনিং ছাড়া এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়।
.
আমরা জানি, সব বাঙ্গালীই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ইচ্ছুক। এই যুদ্ধকে অনেক ভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এই নির্দেশাবলি বিশেষ করে বাংলাদেশের সেই সংগ্রামরত নিরস্ত্র জনগণের উদ্দেশ্যে লিখিত তারা যাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন স্বাধীনতার এই যুদ্ধে।
.
মুক্তিযোদ্ধা ও আপনিঃ

– যে যেখানে আছেন সেই এলাকায় গেরিলা ইউনিট বা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
– মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া, লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিন।
– বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে দিন।
– মুক্তিযোদ্ধাদের কোন খবর (কোথায় আছে, ওদের সাথে কী অস্ত্র, কয়জন আছে ইত্যাদি) যেন শত্রুদের হাতে না যায়।
– শত্রুদের সমস্ত খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এনে দিন।
– সম্ভব হলে শত্রুদের ভুল নির্দেশ দিন, কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে শত্রুদের এনে দিন।
– দালাল এবং বিশ্বাসঘাতকদের খতম করুন।
– লোকজনদের মনোবল দৃঢ় করতে প্রচার কাজ চালান।
– আজেবাজে কথাবার্তা বলবেন না।
– প্রতি পদক্ষেপে শত্রুদের সাথে অসহযোগিতা করুন।
এই সংগ্রামের বিভিন্ন দিক আছেঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মিলিটারি। এই তিন ফ্রন্টেই আমাদের শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।
.
রাজনৈতিকঃ

শত্রুরা যেন পুতুল সরকার বা নিজেদের ইচ্ছেমত কোন শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দিতে না পারে। এবং দেশের অবস্থা স্বাভাবিক বলে জাঁকিয়ে বসতে না পারে, সেই জন্যে –
– সমস্ত স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিন।
– যারা পাকসেনাদের এব্যাপারে সাহায্য করছে তাদের শেষ করে দিন।
– সরকারী শাসনতন্ত্র বিফল করে দিন।
– পুলিশ স্টেশন, তফসিল অফিস ইত্যাদি অকেজো করে দিন।
– দলাদলি করবেন না। নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করাই পাক শাসকচক্রের উদ্যেশ্য। তাই ব্যক্তিগত শত্রুতা ভুলে গিয়ে মতবিরোধ, নীতি-বিরোধ বাদ দিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজ শুধু স্বাধীনতার সংগ্রাম করুন।
.
অর্থনৈতিকঃ

এতদিন পাক শাসকচক্র দুটো প্রয়োজনে বাংলাদেশকে আঁকড়ে ছিল –
ক) বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ হিসেবে
খ) ওদের উৎপাদিত জিনিসের সংরক্ষিত বাজার হিসেবে।
.
লিফলেটটি দেখতে খুব সাধারণ হলেও এখানে তৎকালীন পরিস্থিতির একটি সমূহ ধারণা পাওয়া যায়।
.
– Source: Muntassir Mamoon, S M nabi
– Photo: Screenshot from the documentary ‘World in action’ by Granada. Camera: Mike Whittaker, Dubbing: Peter Walker, Film editor: Kelvin Hendrie, Producer: Gita Mehta