You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা (১) - হাসান মুরশিদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা (১)

— হাসান মুরশিদ

সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা পাকিস্তানে কোনাে কালে ছিল না। গত তের বছরের সামরিক শাসনের পূর্বে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনের কালেও না। কেননা পাকিস্তান নির্মাতাগণ দেশে ঐক্য আনতে চেয়েছিলেন সত্যকে চাপা রেখে, তবু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতিক্ষেত্রে স্বল্প কালের মধ্যে যে বিপুল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই পত্রপত্রিকা তাতে একটা সুবৃহৎ ভুমিকা নিয়েছে। বস্তুতপক্ষে গণমাধ্যম হিসাবে পত্রপত্রিকা সকল দেশেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে, পূর্ব বাংলাতেও করেছে। বরং বলা যেতে 

পারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই করেছে। কেননা অধুনা লুপ্ত পাকিস্তানের অন্য দুটি গণমাধ্যম বেতার ও টেলিভিশন ছিল পুরােপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান জনগণের আশা আকাঙ্খকে প্রতিফলিত, লালিত অথবা উৎসাহিত করেনি, সারাক্ষণ সরকারি প্রচারেই আত্মনিয়ােগ করেছে। কিন্তু মানুষ প্রচারকে সর্বদা স্বাগত জানায় না। তদুপরি পাকিস্তানের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ের আগে পর্যন্ত বেতার যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছায়নি। টেলিভিসন এখনাে কেবল মুষ্টিমেয় মানুষের নাগালে আসতে পেরেছে। এমতাবস্থায় স্বশাসনের দাবি ও চিত্তজাগরণকে জনপ্রিয় করার দায়িত্ব বহন করেছে পূর্ব বাংলার দৈনিক ও সাময়িক পত্রগুলি। ধূর্ত আইয়ুব সরকারও জানতেন প্রচারকার্যকে সর্বাত্মক ও কার্যকর করতে হলে শক্তিশালী পত্রিকার সাহায্য আবশ্যিক হয়ে পড়ে। এই কারণে আইয়ুব প্রেসট্রোসটের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রেট্রাসটের কাজ ছিল পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার করা এবং অন্য পত্রিকার প্রচারকে খণ্ডন করা।

স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে পূর্ব বাংলার এমন কোনাে পত্র পত্রিকা ছিল না যা আঞ্চলিক স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতি পুরাে সচেতন ছিল। বরং প্রায় সব কটি পত্রিকাই ধর্মের গাজা বিতরণে মুক্তহস্ত ছিল। ইসলামের জিগির তুলে, কায়েমি স্বার্থবাদীদের দালাল এই পত্রিকাগুলি জাতীয় সংহতির নামে পুর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিকে উনূল করতে চেয়েছে এবং পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর লােকেরাই এই পত্রিকাগুলি পরিচালনা করতেন। পাকিস্তানের জন্মের পরেই বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এঁদের স্বরূপ উন্মােচিত হয় । কিন্তু সবগুলি পত্রিকা এই জনবিরােধী ভূমিকা নিলে, বলা বাহুল্য, মুক্তবুদ্ধির বিকাশ সম্ভব হতাে না অথবা কালে কালে স্বাধীন বাংলার দাবিও জনপ্রিয় হতে পারতাে না। কিন্তু সংবাদপত্র যেহেতু জনমত দ্বারা এবং জনমত যেহেতু সংবাদপত্রের দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত, সে কারণে, পূর্ব বাংলায় ধীরে ধীরে জন্ম হয়েছে যথার্থ পূর্ববঙ্গীয় পত্রিকার । এবং এই পত্রিকাগুলিই শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে।

পাকিস্তানের ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য পরস্পর পরিপূরক নয়, একথা পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন। এই জন্যেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি যখন উঠলাে, তখন তাকে নির্মূল করতে উদ্যত হল নেতৃবৃন্দ। টেলিভিশন তখনও দেশে নির্মিত হয়নি, বেতার তখনও গণমাধ্যম হিসবে জনপ্রিয় হতে পারেনি । এমত অবস্থায় দৈনিক মরনিং নিউজ এবং সাপ্তাহিক যুগভেরী, সৈনিক ও আসাম হেরালড় প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাংলা ভাষাবিরােধী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। আলােচ্য পত্রিকাগুলি ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই উরদুর পক্ষে এবং বাংলার  বিরুদ্ধে নানা প্রচার চালাতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মরনিং নিউজ বলে যে, পূর্ব বাংলার সকল মানুষ উরদু বােঝেন এবং উরদু বলতে পারেন। পত্রিকায় আরাে বলা হয়, ইসলামি সংস্কৃতির সম্যক বিকাশের জন্যে উরদু ভাষার প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য। ঢাকার তমদ্দন মজলিশ তখন বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গঠনে তৎপর ছিল। মরনিং নিউজ এ প্রতিষ্ঠানের নিন্দায়ও মুখর হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি ও মারচ মাসে বহু অপপ্রচারের মাধ্যমে মরনিং নিউজ ও উল্লিখিত পত্রিকাগুলি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তান বিরােধী ও সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চেষ্টা করে। পত্রিকাগুলি তারস্বরে ঘােষণা করে এ আন্দোলন ভারতীয় দালালদের দ্বারা সৃষ্ট।

মাওলানা আকরাম খার “আজান” ও আবুল মনসুর আহমেদের ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকাও ছিল ইসলাম ঘেঁষা, তথাপি তারা এ অপপ্রচারের প্রতিবাদ না করে পারেনি। বাস্তবিকপক্ষে, আজাদ ও ইত্তেহাদ বাংলা ভাষার দাবিকে গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য বলে সমর্থন করে। দুটি পত্রিকাই পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের গণপরিষদের ভাষণও অযৌক্তিক বলে নিন্দা করে।

কিন্তু তথাপি এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এমন কোনাে পত্রিকা ছিল না পূর্ব বাঙলার স্বার্থরক্ষায় সর্বাত্মকভাবে যে সচেষ্ট হবে অথবা প্রয়ােজনবােধে সরকারি প্রচারণার বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রামে লিপ্ত হবে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন যে পুরােপুরি সফল হতে পারেনি, অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি কার্যকর গণমাধ্যমের অভাব তার অন্যতম। 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে কমপক্ষে একটি দৈনিক ও একটি সাপ্তাহিক ছিল বা এ আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন ও উৎসাহ দান করেছে। এ পত্রিকা দুটি যথাক্রমে পাকিস্তান অবজারভার ও ইত্তেফাক। জনমনে তার প্রভাব দৃষ্টে তদানীন্তন নুরুল আমিন সরকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করেন ১৩ ফেব্রুয়ারি। একই সঙ্গে এ পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম হর্ন কারারুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের প্রতি এ ছিল একটি দৃঢ় আঘাত। তথাপি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে খর্ব করা যায়নি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলা ভাষার প্রবল বিরােধী পাকিস্তান সরকারকে বাংলার দাবি মেনে নিতে হয়।’

এ আন্দোলন কালে মরনিং নিউজ যথারীতি বাংলার বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভকে এ পত্রিকা ভারতীয় দালালদের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। যা ছিল অগণিত মানুষের প্রাণের দাবি, তাকেই এ পত্রিকা অবজ্ঞা ও উপহাস করে। বাইশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় এ পত্রিকায় ব্যানার হেড লাইনে সংবাদ বেরােয় ঃ

‘Dhoties roaming Dacca street. police forced to resort firing on unrully mab. Government brought the situation under Control.’

এই ঔদ্ধত্য ও দুঃসাহসের মাশুল দিতে হয় মরনিং নিউজকে। বিক্ষুব্ধ জনতা ওই দিনই মরনিং নিউজের সদরঘাটের অফিসটি পুড়িয়ে দেয় । জনপ্রতিরােধের জন্যে এমন কি দমকল বাহিনী গিয়েও অফিসটি রক্ষা করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই অতঃপর পূর্ব বাংলার জনগণ আপনাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন। স্বভাবতই জনগণের মতাদর্শের পরিপােষক হিসেবে পকিস্তান অবজারভার, ইত্তেফাক, সংবাদ প্রভৃতি পত্রিকা ক্রমশ পরিচিত হয়েছে। অপরপক্ষে মরনিং নিউজ, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকা আপনাদের ললাটে অদৃশ্য সরকারি ছাপ এঁকে সরকারি পৃষ্ঠপােষণায় আপনাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের নজীরবিহীন বিপর্যয়, ১৯৬২ সালের আয়ুব বিরােধী আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরােধী মনােভাব ও নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রতি বিপুল জনমত সৃষ্টি, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিজয় এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলার দাবি উত্থাপন প্রভৃতি আংশিক ভাবে সম্ভব হয়েছে কয়েকটি পত্রিকার অব্যাহত প্রচারের ফলেই । সমান্তরালভাবে একই সময়ে অবশ্য এই জনপ্রিয় আন্দোলনগুলির বিরুদ্ধে একটি চক্র সক্রিয় ছিল এবং এদের মুখপত্রগুলি জনবিমুখ কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল।

স্বতন্ত্রভাবে পূর্ব বাংলার সংবাদপত্রগুলির ভূমিকার আলােচনা ও মূল্যায়ন করা যেতে পারে ।

পাকিস্তান অবজারভার ও পূর্ব দেশ  পঞ্চাশ দশকে ও ষাট দশকের প্রথমার্ধে পাকিস্তান অবজারভার একটি প্রগতিশীল পত্রিকারূপে পরিচিত ছিল। বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করার ফলস্বরূপ পত্রিকাটি লীগ সরকারের রােষে পতিত হয়, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু ষাটদশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই পূর্ব বাংলার স্বশাসনের দাবি ও বাঙালি “জাতীয়তাবাদের শ্লোগান যত জনপ্রিয় হতে থাকে, অবজারভার ততই জনতা থেকে দূরে সরে যায়। সংক্ষেপে অবজারভারের নীতি হচ্ছে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও শক্তিশালী পাকিস্তান। গণতন্ত্র ও শক্তিশালী পাকিস্তানের মধ্যে যে কোন আপস চলতে পারে না, এ সত্যের প্রতি অবজারভার সম্ভবত স্বেচ্ছায় চোখ বুজে ছিল। যে দেশে শতকরা ৫৬ জন মানুষ শতকরা ৪৪ জন মানুষের চেয়ে ন্যূনতম অধিকার লাভ করে, গণতন্ত্র যে। সেখানে অর্থহীন ধুলােমাত্র, অবজারভার বােধহয় ইসলামের প্রতি অবচেতন আস্থা ও অনুরাগবশত তা উপলব্ধি করতে পারেনি। এই জন্য ৬৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যখন এন ডি এফ থেকে বেরিয়ে এসে দুর্বল কেন্দ্রের অধীনে পূর্ণ স্বশাসনের দাবি জানায়, তখন থেকে অবজারভার ডান দলগুলির বিশেষত বৃদ্ধ অথর্ব রাজনীতিগণের সমন্বয়ে গঠিত পি ডি পি-র মুখপত্র হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অবজারভারের চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রকাশ পায় যখন, ১৯৭১ সালের নির্বাচন প্রাক্কালে সে 

ইসলাম-পসন্দ’ দলগুলির প্রতিনিধিত্ব করতে আরম্ভ করে। সম্পাদক আবদুস সালাম একাধিক প্রবন্ধে “জয় বাংলা” শ্লোগানটির কদর্য করে তার নিন্দা করেন। এমন কি, জয় শব্দটির মধ্যে তিনি হিন্দুত্ব আবিষ্কার করে শিউরে ওঠেন। শেখ মুজিবর রহমানের বিপুল জয়কেও অবজারভার প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারেনি, অথচ আওয়ামী লীগ এবার প্রায় সকল মানুষের সমর্থন লাভ করেছিল। এ ছাড়া, একদিন যে বাংলা ভাষা। আন্দোলনের বড় সহায়ক ছিল অবজারভার সেই অবজারভারই নির্বাচনের সমকালে হঠাৎ বাংলা হরফের পরিবর্তে রােমান হরফ প্রবর্তনের ওকালতিতে মুখর হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিমুখ ভূমিকার জন্যে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটি অনুষ্ঠানে অবজারভারের একটি সংখ্যা আগুনে পুড়িয়ে তাঁদের প্রতিবাদ জানান।

অবজারভার গােষ্ঠীর বাংলা পত্রিকা “পূর্বদেশ”। বলা বাহুল্য, মতাদর্শের দিক দিয়ে কোনাে প্রদেয় নেই। কেবল পূর্বদেশের প্রতিক্রিয়াশীলতা বােধ হয় অবজারভারের থেকে কিছু বেশি সুক্ষ্ম ছদ্মবেশে ঢাকা। সম্পাদকের ব্যক্তিগত মতের প্রতিফলনও হয়তাে এদের চেহারার খানিকটা পার্থক্য সৃষ্টি করে থাকবে। পূর্বদেশের জন্ম ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে।

ইত্তেফাক ও ঢাকা টাইমস। ইত্তেফাক গােড়া থেকেই আওয়ামী লীগের মুখপত্র। আওয়ামী লীগের নীতির ও কর্মসূচীর বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইত্তেফাকের আদর্শও পরিবর্তিত হয়েছে। জনবিরােধী লীগ ও সামরিক সমরকারের বিরদ্ধে যেহেতু আপসহীন সংগ্রামে সর্বদা লিপ্ত ছিল, সেহেতু পরােক্ষত জনস্বার্থের পক্ষে ইত্তেফাক কাজ করেছে। অবশ্য ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন ইত্তেফাকের ভূমিকা আওয়ামী লীগ সরকারের মতােই সম্পূর্ণরূপে জনস্বার্থের পরিপােষক হয়নি। যে ইত্তেফাক একদা ৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থনে সােচ্চার হয়েছে, সেই ইত্তেফাকই আবার প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দির নীতিকে সমর্থন জানিয়েছে। অথবা ১৯৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মাওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল আখ্যা দিয়েছে। যদিও ভাসানী- সােহরাওয়ার্দি মতান্তর সৃষ্টি হয় স্বায়ত্বশাসন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নিয়েই। তারপর আইয়ুব ও ইয়াহিয়া শাহির আমলে, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের পর থেকে, আওয়ামী লীগ। যেমন পূর্ব বাংলার স্বশাসন ও ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করেছে, ইত্তেফাকও প্রবল উৎসাহ প্রভূত সৎসাহসের সঙ্গে তার সমর্থন করেছে। 

স্বশাসনের দাবি ও আইয়ুববিরােধী ভূমিকার জন্যে সরকার ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেনকে গ্রেফতার করেন ১৯৬৬ সালের জুন মাসে। এই সময়ে ইত্তেফাকের নিউনেশন প্রেস সরকার বাজেয়াপ্ত করেন। ফলে ইত্তেফাক, ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১২ জুলাই ইত্তেফাক পুনরায় অন্য একটি প্রেস থেকে সংক্ষিপ্ত কলেবরে প্রকাশ হয়। কিন্তু সরকার নতুন ঘােষণাপত্র গ্রহণ করায় ইত্তেফাক প্রায় তিন বছরের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় ২৭ জুলাই। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যাওয়ার পর ২৬ মারচ ইত্তেফাক আবার সরকারি রােষে পতিত হয়। এবারে আর সম্পাদককে গ্রেফতার কিংবা প্রেস বাজেয়াপ্ত করা নয়, জঙ্গীশাহী এবার সােজাসুজি ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ করে ইত্তেফাক অফিস। ট্যাঙ্ক দিয়ে একটি পত্রিকা অফিস উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বােধ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। তবে ইত্তেফাকের কতগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল। সমাজতন্ত্র নামক একটি জুজুর ভয়ে ইত্তেফাক সদাশঙ্কিত। বামপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে ইত্তেফাকের বিদ্বেষ ও বিষােদগার এজন্য সহজেই চোখে পড়ে। ইত্তেফাক প্রকৃত অর্থে নবগঠিত বাঙালি পুঁজিপতিদের পত্রিকা। কেননা পশ্চিমী শােষকরা বাঙালি বিত্তবানদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল সে কথায় ইত্তেফাক যত উচ্চকণ্ঠ, বিত্তহীন সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টে সে বােধ হয় তত বিচলিত নয়।

২৮ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা