সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রবিরােধিতা
— হাসান মুরশিদ
বহু শতাব্দী থেকে এদেশের পল্লীতে হিন্দু ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র তাে বটেই, এমন কি, ধর্মীয় চেতনায়ও তারা সমন্বয় সাধন করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, ময়মনসিংহ গীতিকা এবং অসংখ্য পল্লীগীতিতে এ সমন্বয়ী ভাবাদর্শ অকৃত্রিমরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু ধর্মীয় কারণে হিন্দু ও মুসলমান এই দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিরােধ বেধেছে; ইতিহাস সেরূপ সাক্ষ্য দেয়না। সমাজ-অর্থনৈতিক কারণে উদ্ভুত উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অন্তর্দ্বন্দ্বের মতাে, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সকল মানুষের মধ্যে একটা শ্রেণীসংগ্রাম চিরকালই চলে এসেছে। ইংরেজদের আগমনের পর বহু সাধারণ হিন্দু ব্যবসা বাণিজ্য করে অথবা ইংরেজি শিখে রাতারাতি মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু মুসলমানগণ ইংরেজদের ওপর গোসা করে এবং বিত্তহীন মুসলমানরা সুযােগের অভাবে, আপনাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারেননি। এর ফলে, অল্পদিনের মধ্যেই হিন্দু ও মুসলমানদের ভেতর যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়, তার প্রত্যক্ষ ফল উনবিংশ শতাব্দীর সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ। হিন্দু মুসলিম বৈরীর মূল কারণ রবীন্দ্রনাথ কবি হয়েও বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি বলেছিলেন, একমাত্র অর্থনৈতিক সাহায্যের ভিত্তিতেই এই উভয় সম্প্রদায়ের মৈত্রী স্থায়ী হতে পারে। দেশবিভাগের পরে আকস্মিক প্রতিযােগিতার অভাব ঘটাতে এবং সুযােগবৃদ্ধির ফলে পূর্ব বাংলায় স্বল্পকালের মধ্যে এটি বৃহৎ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এঁরাই অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির লালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে যে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, এই শ্রেণীর ব্যাপক পৃষ্ঠপােষকতায় তা-ই ১৯৫২ সালের সার্বজনিক রূপ নেয়।
ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের তীব্রতার মুখে পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকারকেও আতঙ্কিত হয়ে বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে হয়। আন্দোলনের তীব্রতা এ আতঙ্কের কারণ নয়, আতঙ্ক ভাবী বাংলা সংস্কৃতিকে। সেহেতু সরকার নতুন পরিকল্পনা নিলেন বাংলা সংস্কৃতিকে খর্ব করার। ১৯৪৭ সালের পূর্ববর্তী বাংলার সকল ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে, সংস্কৃতিক্ষেত্র এক সবুজবিপ্লব আনয়নের আহ্বান জানালেন তাঁরা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত সকল হিন্দু নামকে তারা মুছে ফেলতে উদূযােগী হলেন। বঙ্কিমের বদলে মীর মশাররফ হােসেন, রবীন্দ্রনাথের বদলে নজরুলকে এঁরা দাঁড় করালেন। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সংস্কৃতি বিরােধিতার প্রতীক হলাে রবীন্দ্র বিরােধিতা। সরকারের সাংস্কৃতিক দালালরা চাইলেন রবীন্দ্রনাথকে নানা উপায়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে মুছে ফেলতে। আর বিপুল সংখ্যক সংস্কৃতিসেবীরা চাইলেন তার আপন। মহিমায় রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই টানাপােড়েন প্রবলভাবে আরম্ভ হয় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে। মােনেম খাঁর মতাে অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তির মুখে সংস্কৃতির কথা অট্টহাস্যের উদ্রেক করতে পারে কিন্তু তবু তিনি এবং তার সাকরেদগণ সােচ্চার হয়ে উঠলেন বাংলা বিরােধী স্লোগানে। ১৯৬১ সাল থেকেই আক্রাম খা বলতে শুরু করেন যে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু এবং তাঁর রচনা মুসলিমবিরােধী; সুতরাং তিনি পরিত্যাজ্য। ধর্মের
গোঁড়ামি এঁদের দৃষ্টিকে এমন আচ্ছন্ন করেছিলাে এবং এঁদের মন আরব মরুভূমির খেজুর তলার দিকে এমন নিবিষ্ট ছিল যে, সাম্রাজ্যলােলুপ বিদেশী মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশীয় কোনাে শিবাজী লড়াই করে থাকলে এবং রবীন্দ্রনাথ তার প্রশংসা করে থাকলে, সেটা এঁদের চোখে গণ্য হলাে অমার্জনীয় অপরাধ বলে। অথচ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন যে মুসলমানরা, তাঁরা এদের কাছে বীর সন্তান বলে প্রশংসিত হলেন। এই একচোখামি তাদের সাধারণ চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত ঘুচিয়ে দিয়েছিলাে।
নজরুলকে তারা চিহ্নিত করলেন, ইসলামের ধ্বজাধারী হিসেবে। অথচ সাংস্কৃতিক দালাল এই আক্রাম খারা এ শতকের তৃতীয় দলকে নজরুলকে কাফের বলে ফতােয়া দিয়েছিলেন। তারা এবার নজরুলকে নিলেন সংস্কার করে। খণ্ডিত মার্জিত নজরুল নররূপে প্রকটিত হলেন পূর্ব বাংলায়। মুসলমানি শব্দ দিয়ে তার কবিতা পুর্ণলিখিত হলাে ছাত্রদের জন্যে। ‘ভগবান’ ‘রহমানে’ পরিণত হলেন, ‘মহাশ্মশান’ হলাে ‘গােরস্তান’, নজরুলের কয়েকটি ইসলামি গানই বারংবার প্রচারিত হতে থাকলাে, সরকারী পাকিস্তান বেতার থেকে। তারপর সংস্কৃত নজরুলকে দাঁড় করানাে হলাে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষরূপে। স্বয়ং সূর্য ঘুরতে শুরু করলেন উপগ্রহের চতুর্দিকে। | এ শিক্ষাকে ভাবী জেনারেশনের রক্তের মধ্যে মিশিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে সরকার একটি টেস্ট বুক কমিটি গঠন করলেন। একটিমাত্র টেস্ট বুক সম্পাদিত ও পাঠ্য হলাে এক এক শ্রেণীর কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রীর জন্যে। সাম্প্রদায়িক শিক্ষাদানই এ গ্রন্থসমূহের লক্ষ্য। প্রায় সবগুলাে বাংলা টেস্ট বইয়ের প্রথম লেখাটি ইসলাম ও রসুলকে নিয়ে।
– যে প্রবন্ধ ইসলামিয়াতের অন্তর্ভুক্ত হলেই ভালাে হতাে এবং যা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের জন্যে অবশ্য পাঠ্যরূপে কিছুতেই নির্ধারিত হতে পারে না। এ রচনাগুলি সাহিত্য হিসেবে অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্যের রচনা হিসেবে গৃহীত হয়নি। কেবলমাত্র সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির সমর্থনেই নির্বাচিত হয়েছে। গ্রন্থের দ্বিতীয় রচনা পাকিস্তান বিষয়ক । সেখানে শিশুছাত্র জানতে পারছে পাকিস্তান মুসলমানদের পবিত্র ‘ওয়াতন” । স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ইতিহাস তাদের শেখানাে হলাে, তা নিতান্ত বিকৃত । তারা জানলাে, তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হয়েছে মুসলমানদের জন্মশত্রু, হিন্দুদের কাছ থেকে, এই হিন্দুদের বাসস্থানের নাম হিন্দুস্থান। (ভারত কথাটি ওখানকার টেস্ট বুক অথবা বেতারে কখনাে উল্লিখিত হয় না।) এই সমস্ত গ্রন্থে নজরুলের জীবনী আছে। তাতে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের চাপে তাঁর প্রতিভার বিকাশ যথার্থরূপে ঘটতে পারেনি (রবীন্দ্রনাথ ধনীর দুলাল ছিলেন) এবং রােগাক্রান্ত না হলে তিনি বংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হতেন (রবীন্দ্রনাথ আশি বছর পর্যন্ত লিখেছিলেন)। এই গ্রন্থ সমূহে রবীন্দ্রনাথ কার্যত থাকলেন অনুপস্থিত। এসব প্রচারণার ফল যে কিছু হয়নি, তা নয়। ওখানকার স্কুলকলেজের ছাত্ররা অনেকেই নজরুলকে তার সুপ্ত প্রতিভার জন্যে বড় করে দেখে এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটা সাম্প্রদায়িক মনােভাবও এদের মধ্যে সহজেই চোখে পড়ে।
এই সাম্প্রদায়িক প্রচারে খান সাহেবরা নিজেরা অংশগ্রহণ করেননি, তাদের বাঙালি দালালরাই এ দুষ্কর্ম সুসম্পন্ন করেছেন। সৈয়দ মামুদ হােসেনের মতাে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তালিম হােসেনের মতাে কবি এবং লায়লা আর্জুমান্দ বানুর মত গায়িকা এন্তার পাওয়া গিয়েছিল। এঁদেরই চক্রান্তে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়। এই গুরুতর সিদ্ধান্তই রবীন্দ্রবিরােধিতার চূড়ান্ত বলে গন্য হতে পারে। এঁদের ধারণা ছিল, একবার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসাহিত্যের পঠনপাঠন বন্ধ করাও শক্ত হবে না। বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু, মাইকেল, বঙ্কিম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ অনিবার্যরূপে অতঃপর বহিষ্কৃত হবেন পূর্বগিন্ত থেকে।
কিন্তু শাসক ও দালালদের এই আঘাতই শেষ আঘাত। এরপর বেরিয়ে এসে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হলেন বুদ্ধিজীবীরা, যারা এতকাল সরাসরি সরকারের বিরােধিতা করতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবদুল হাই, প্রফেসর হাবিবুল্লাহ, প্রফেসর সরওয়ার মুরশেদ, ডক্টর আহমদ শরীফ, ডকটর আনিসুজ্জামান প্রমুখ শিক্ষকগণ এক বিবৃতিপ্রকাশ করে বলেন, পূর্ব বাংলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যােগ। অবিচ্ছেদ্য এবং অনিবার্য।
এরপর একে একে এমন সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে যার মধ্যে রবীন্দ্রপ্রীতি সুস্পষ্ট। ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে জগন্নাথ কলেজে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের যে অভিনয় হয়, তাতে ২০ হাজারের বেশী দর্শক উপস্থিত হন, যদিও আগে থেকে কোনাে প্রচার চালানাে হয়নি। ১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে জনমতের। চাপে, ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারিত হয়। ইনজিনিয়ারস ইনসটিটউটে ‘ছায়ানট’, ‘ঐকতান’ প্রভৃতি গােষ্ঠীর সম্মিলিত রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান তিনদিন ধরে চলে। অনুষ্ঠানের শুরুতে যে। গানটি গাওয়া হয়, তা হলাে, ‘ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে, মােদের বাঁধন টুটবে।’ সত্যি সত্যি বাঁধন টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল। পূর্ব বাংলা বেরিয়ে এলাে মুক্তবুদ্ধির স্বাক্ষর নিয়ে।
অবশ্য এ আন্দোলনের সাফল্য একদিনে আসেনি। স্বাধীনতালাভের পর থেকে যে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা সংস্কৃতিকে অকৃত্রিম এবং উদার করতে প্রযত্নবান ছিলেন, ভেতরে ভেতরে তাঁরা তাঁদের গণ্ডীকে করেছিলেন সম্প্রসারিত। তাঁদের কাছে দীক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পূর্ববাংলার সর্বত্র। পত্র পত্রিকায় এদের রচনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলা, পিকিং শান্তিসম্মেলন এবং পূর্ববাংলার অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সঙ্গীত সম্মেলনে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় সংস্কৃতিসেবীদের যােগাযােগ ঘটেছে, আপনপথ মতামত বিনিময় করতে পেরেছেন। দেশ’ প্রভৃতি পশ্চিমবঙ্গীয় পত্রিকা এবং আকাশবাণীর মাধ্যমেও পূর্ব ও পশ্চিমের সংক্ষিপ্ত কিন্তু কাক্ষেয় মিলন ঘটেছে। রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ব বাংলার। গ্রামে গ্রামে যে সাড়া পড়েছিল তা-ও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সরকারী রক্তচক্ষুর নীচে বসে শহরবন্দরেও এ উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে। (প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে সন্জীদা খাতুন, শান্তি-নিতেনের ছাত্রী, ইডেনের অধ্যাপিকা, ডি.পি আই লিখিতভাবে তাঁকে জানান যে, তিনি যেন কোথাও জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যােগ না দেন অথবা গান না করেন।)
এ সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সাহিত্য ক্রমশ একটা অসাম্প্রদায়িকরূপ নিচ্ছিল। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকাতে যে ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপিত হয় সেখানে সামান্যতম সাম্প্রদায়িকতা লক্ষিত হয়নি। বাংলা সাহিত্য তার আপন স্বরূপে সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল। আর যে বিপুল সংখ্যক দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন তারা অধিকাংশই ছিলেন অসাহিত্যিক। ১৯৬৮ সালে ইনজিনিয়ার্স ইনসটিটিউটে যে ‘মহাকবি স্মরণােৎসব’ হয় তাতেও বাংলা সাহিত্যের এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং আপামর জনসাধারণের বিপুল উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়। | সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি সকল মানুষের অনুরাগ জন্মানাের জন্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন ‘ছায়ানট’ নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। জহীর রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়ার মতাে চলচ্চিত্রও এর জন্যে কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। তবু একথা বললে বােধহয় অত্যুক্তি হবে না। যে ছায়ানটই ঢাকাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত রীতিমত চালু ও জনপ্রিয় করেন। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে এঁরা ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে শিলাইদহতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবস পালন করেন। এতে বহু সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেছিলেন এই পরিবর্তিত পটভূমিতে রবীন্দ্রবিরােধী এবং সাম্প্রদায়িক মনােভাব নিন্দিত হবে প্রায় সকল বুদ্ধিজীবীর দ্বারা, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই ১৯৬৬ সালে অসাম্প্ৰয়িক সাহিত্যের দাবি স্থায়ীভাবে স্বীকৃত হয় এবং রবীন্দ্রনাথ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন পূর্ব বাংলায়। এবছরই বদরুদ্দীন উমর (তার পিতা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন) সাম্প্রদায়িকতার ওপর তার বিখ্যাত গ্রন্থগুলির প্রথম গ্রন্থ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রকাশ করেন। ১৯৬৭ সালে আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বিখ্যাত ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উভয় বঙ্গে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত যাবতীয় প্রবন্ধ সংকলের মধ্যে এ গ্রন্থখানি নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য। এছাড়া, এ সময়েই হায়াৎ মামুদের ‘রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত হয়।
নজরুল সম্বন্ধে আকারণ উচ্ছাস ও সাম্প্রদায়িক মনােভাব দূরীকরণের ব্যাপারে আহমদ শরীফ, বদরুদ্দিন উমর প্রমুখের প্রবন্ধ এবং মুস্তফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত ‘নজরুল ইসলাম’ (১৯৬৯) গ্রন্থখানি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। নজরুল ইসলাম সম্পর্কে পূর্ব বাংলায় এই প্রথম নিরপেক্ষ ও মােহমুক্ত মূল্যায়ন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় গােলাম মুরশিদ সম্পাদিত বিদ্যাসাগর সার্ধশতবর্ষ পূর্তি স্মারকগ্রন্থ। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হলাে মুসলমানদের বাসভূমি পূর্ববাংলা থেকে। সম্ভবত এটা সেখানকার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের একটি বড়াে এবং নিশ্চিত প্রমাণ। | বাংলাদেশ এভাবে এগিয়ে চলে অসাম্প্রদায়িক মুক্তবুদ্ধির পথে । রবীন্দ্রনাথের একটি গান নির্বাচিত হলাে সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে- যেগানে দেশকে সম্বােধন করা হয়েছে ‘মা’ বলে ।।
২৪ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা