You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি (১) - হাসান মুরশিদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি (১)— হাসান মুরশিদ

পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে কোনাে সাংস্কৃতিক নবমূল্য বােধ গড়ে ওঠেনি। কেননা, দ্বিজাতিতত্ত্বের ধূয়াে যদি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে জনপ্রিয় হয়েছিলাে, তথাপি সাংস্কৃতিক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের জনগণের কোনাে ব্যবধান কার্যত ছিলাে অনুপস্থিত। অপরপক্ষে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া সাধারণ কিছুই ছিলাে না । ভৌগােলিক দূরত্ব (একটা দেশের পক্ষে) প্রায় অসীম; ভাষা, শিক্ষাদীক্ষা, পােশাক পরিচ্ছদ, খাদ্য এককথায় সাংস্কৃতির আদৌ কোনাে ঐক্য ছিলােনা। সংস্কৃতি তাে কেবল ধর্মনির্ভর নয়! ধর্মের ধরতাই বুলি দিয়ে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে নির্বাচনে জয়লাভ অথবা রাজনৈতিক  উদ্দেশ্যসিদ্ধি তেমন শক্ত নয়; কিন্তু সমাজ অর্থনৈতিক জীবনে লক্ষণীয় বাস্তব প্রভেদ না থাকলে, সংস্কৃতির ভিন্নরূপ কল্পনা করা দুঃসাধ্য। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায়, অনুসৃত অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহে, শিক্ষাদীক্ষায়, সঙ্গীত ও সাহিত্যে, রুচি ও পছন্দে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্তের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তের, দরিদ্রের সঙ্গে দরিদ্রের, ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসায়ীর, শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষকের, গায়কের সঙ্গে গায়কের, মােল্লার সঙ্গে পুরুতের কি কোনাে মৌল পার্থক্য আছে বা কোনাে কালে ছিলাে? বরং মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের, ব্যবসায়ীর সঙ্গে শিক্ষকের, সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে মােল্লা অথবা পুরুতের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা চিরকালই ছিলাে, আজো আছে। কিন্তু সংস্কৃতির এই বাস্তব প্রভেদের কথা স্বীকার না করে, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণে সাংস্কৃতিক অনৈক্য আবিষ্কার করা প্রচারের বিষয় হতে পারে এবং প্রচারকরা হয়তাে এ অর্থসত্যে বিশ্বাস করেন যে, বহু প্রচারের ফলে অনৃত ভাষণও সত্যের মর্যাদা লাভ করে; কিন্তু তাই বলে এই সাংস্কৃতিক অনৈক্য এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক ঐক্য কল্পনা কখনাে সত্য হতে পারে না। তবু স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরবর্তী নবমূল্যবােধহীন সময়ে পাকিস্তান স্রষ্টারা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে ইসলামভিত্তিক একটি অভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দিতে চাইলেন।

তার জন্যে, প্রথমত, প্রাক স্বাধীনতা কালের সমগ্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার প্রয়ােজন হলাে। দ্বিতীয়ত, আবশ্যক হলাে নতুন ছাঁচে ফেলে একটি সাধারণ সংস্কৃতি গড়ে তােলা। (সংস্কৃতি কি গড়ে তােলা যায়? ভাষার মতাে সেও কোনাে জুলুম সহ্য করে না, আপন স্বভাবে সে বিকশিত হয়, যেমন ফুল ফোটে তার আপন বৃন্তে।) | একথা অনস্বীকার্য যে, সংস্কৃতির প্রধান উপাদান ভাষা ও সাহিত্য। এ বিষয়ে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে অমিল কতখানি, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মিল কতখানি। তা ছাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের ভৌগােলিক ব্যবধান প্রাকৃতিক নয়, একান্তই কৃত্রিম। এমতাবস্থায়, পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে একাত্মতা স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার জন্যে পাকিস্তান নির্মাতাগণ প্রথমেই ভাষার যােগসূত্রকে ছিন্ন করতে চাইলেন। এবং এজন্যে তারা তিনটি উপায় অবলম্বন করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। প্রথমত, দুই-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা বাংলাকে কোনাে প্রকার গুরুত্ব দান না করা; দ্বিতীয়ত আরবি (আসলে উর্দু ধর্মের দোহাই দেবার উদ্দেশে আরবি) অথবা রােমান হরফে বাংলালেখার রীতি প্রচলন করা; এবং তৃতীয়ত, প্রচুর পরিমাণ আরবিফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলাকে উর্দুর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা না দিলে, শাসকবর্গ যথার্থই অনুমান করেছিলেন, বাংলা শিক্ষার প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের আগ্রহ ও উৎসাহ কমে যাবে, এবং উর্দু শিখে সরকারি চাকুরি লাভের চেষ্টাতেই তারা হবেন যত্নবান। এই শাসকচক্র আরাে ভেবেছিলেন বাংলা ভাষার পঠন পাঠনের প্রতি বিমুখ হলে পরিণামে বাংলা ভাষার চর্চা পুরােপুরি বিলুপ্ত হবে। এবং বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হলে পাকিস্তানের বুনিয়াদ হবে পাকা এবং সম্ভাব্য কোনাে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আশঙ্কা দূরীভূত হবে চিরতরে। | আরবি অথবা রােমান হরফের প্রচলনের প্রচেষ্টাও একই উদ্দেশ্য প্রণােদিত। ১৯৪৭ সালেই অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের তত্ত্বালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান প্রস্তাব করেন বাংলা ভাষার হরফের জটিলতাহেতু আরবি। অথবা রােমান হরফ তার পরিবর্তে গৃহীত হােক। তিনি ভেবেছিলেন, আরবি হরফে বাংলা লেখা হলে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের দ্বারা বাংলা ও উর্দুর ভেদ ঘুচিয়ে দেবেন তার দালালরা। অন্যদিকে, রােমান হরফে লেখা হলে, উর্দুও রােমান হরফে লিখে বাংলা ও উর্দুর এই রূপ দান করা হবে। ভবিষ্যৎ এই লাভ ছাড়াও উজিরের মনে এ পরিকল্পনাও ছিলাে যে, আরবি অথবা রােমান হরফে লিখতে শুরু করলে প্রাকস্বাধীনতাকালের বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশই নতুন হরফে পুর্ণমুদ্রিত হবেনা এবং বাংলা উচ্চারণও হবে। বিকৃত। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্যকে হারাবে এবং বাঙালিরা নতুন করে ইসলামি পথে ভাবতে শিখবে। | প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চিমী শাসকগণ বাংলা ভাষাকে আখ্যায়িত করলেন ‘হিন্দু’ ভাষা বলে। যেন ভাষারও সত্যি সত্যি কোন ধর্ম আছে অথবা হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থাদি সব বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে কিংবা অধিকাংশ বাঙালির ধর্ম হিন্দু (এমন কি তা যদি সত্য হতাে, তাহলেও ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এ ভাষার কোনাে বিরােধ কল্পনা করা সম্ভব নয়; কেননা সুস্থ চিন্তার-অধিকারী কেউ মাতৃভাষার সঙ্গে ধর্ম পালনের কোনাে প্রতিবন্ধকতা 

খুঁজে পাবেন না।) এ জন্যে তারা প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করে কাফেরদের ভাষা বাংলাকে ইসলাম চেহারা দিতে উপদেশ দিলেন। তাদের সাংস্কৃতিক দালালরা একটি ভাষা সংস্কার কমিটি গঠন করে রায়। দিলেন, হিন্দু বাংলাকে মুসলমানি বাংলায় রূপান্তরিত করতে হবে। তারা বললেন, “তােমাকে আমি জন্মজন্মান্তরেও ভুলিৰ না’ এর বদলে লেখাে তােমাকে আমি কেয়ামতক ভুলিৰ না।’। ‘মাসের। পরিসমাপ্তিতে ঋণ শােধ করিব’ এর বদলে লিখতে হবে মাস কাবারিতে দেনা বা করজ আদয় করিব।’ বলা। বাহুল্য, শব্দ ব্যবহারের বেলায় এই সবুজী করণের প্রস্তাব ধর্মের কারণে নয়, বরং পাকিস্তানের উভয়াংশের। দুর্বল যােগসূত্রকে শক্ত করাই ছিলাে এর গুঢ় উদ্দেশ্য। এজাতীয় আরবি-ফারসি শব্দের প্রাচুর্যের ফলে এবং উর্দুতে তদ্ভব শব্দের আমদানির ফলে পূর্ব ও পশ্চিম একাকার হয়ে যাবে, এই ছিলাে এ মহান পরিকল্পনার একমাত্র উদ্দেশ্য।

এরপর একে একে রবীন্দ্রবিরােধী প্রচার, ভারতীয় বইপত্রের আমদানি নিষিদ্ধকরণ, টেকসট বুক কমিটি গঠন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র ইসলামি পাঠক্রম নির্ধারণ, বেতার ও প্রেসে ভারত বিরােধী প্রচার ইত্যাদি সবই পূর্ব ও পশ্চিমের সংকর বিবাহের দুর্বলতাকে চাপা দিয়ে তাকে মজবুত করার। প্রয়াসজাত। শুদ্ধমাত্র ধর্মের ঐক্য প্রদর্শন করে অভিন্ন সংস্কৃতির জন্মদানের উদ্দেশ্যেই এই উদ্যম ও কঠোর শ্রম।

আগেই বলেছি স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে নতুন কোনাে মূল্যবােধ গড়ে ওঠেনি, তাই পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও সঠিক ধারণা ছিলাে না তাদের বক্তব্য কী। যারা পাকিস্তানের জন্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করেছেন- কলম নিয়ে অথবা ছােরা নিয়ে, হঠাৎ-পাওয়া স্বাধীনতার আনন্দে সব কিছু হিন্দুত্ব ও বাঙালিত্বের ওপর তারা মারমুখী হয়ে উঠলেন। একদল যারা পাকিস্তান অর্জনের ফলে সমাজ-জীবনে প্রকৃত অর্থে কোনাে পরিবর্তন প্রত্যেক্ষ করতে অপারগ হলেন, তারা আবহমান বাংলার কথাই বলতে থাকলেন। আর বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ভাবলেন, ইসলামের নামেই যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে, সেই ইসলামকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই তাঁদের জীবন ও চরিত্রে ছিলাে অনুপস্থিত। বুদ্ধিজীবীদের এই অব্যবস্থচিত্ততা এবং অস্পষ্ট ধারণা সম্বন্ধে, পূর্ব বাংলার বােধহয় সবচেয়ে সাহসী সংস্কৃতিসেবী বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের ‘তাহজীব তমদ্দন’ ইত্যাদি সম্পর্কে কোনাে নিশ্চিত ধারণার অবর্তমানে কেউ এসবের দ্বারা মনে করলাে কোরমা, পােলাউ, কোফতা ও গরু খাওয়ার স্বাধীনতা। কেউ বা আবার মনে করলাে ভাষার মধ্যে যথেচ্ছভাবে আরবী-ফারসী শব্দের আমদানির স্বাধীনতা। কেউ ভাবলাে 

মরুভূমির উপর কবিতা লেখার স্বাধীনতা। কারাে কাছে বা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে বােঝালাে মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যবাদনের পরিবর্তে মুসলমানদের সেই কাজের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কারাে কাছে এর অর্থ হলাে বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে তার স্থলে আলাওল, গরীবুল্লা এবং কায়কোবাদকে অভিষিক্ত করা।”

কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই এই কৃত্রিম ইসলামি তাহজিব ও তমদ্দনের নির্মীয়মান গজদন্তমিনার ভেঙ্গে পড়লাে। কেননা মিথ্যা ও প্রােপােগাণ্ডার চোরাবালির ওপর ভিত্তি করে তা গড়ে উঠেছিলাে। এর বদলে। বুদ্ধিজীবীরা খুঁজে পেলেন তাদের বাস্তব সমাজ-অর্থনৈতিক জীবনের সত্যকে, তারা একাত্মবােধ করলেন অগণ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে-পাল, সেন, মােগল, পাঠান, ইংরাজ ও খান আমলে যাদের চেহারার। উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। এই বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিসেবিগণ সকল উদ্যত খড়গাঘাত থেকে রক্ষা করেছেন। বাংলা সংস্কৃতিকে এবং ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন আপনাদের আসল সাংস্কৃতিক আদর্শকে- সে আদর্শে বাংলার ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্য আছে, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের অবদান আছে, বাংলার সমগ্র ঐতিহ্যের স্বীকরণ আছে, এমন কি স্ব-স্ব ধর্মীয় ভাবও বােধহয় অবর্তমান নেই। বহিরাঘাত থেকে আত্মরক্ষার সংগ্রাম এবং নব সংস্কৃতি গঠনের ইতিহাস অতঃপর সংক্ষেপে বিবৃত হচ্ছে।

১৯ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা