বিশেষ রচনা দুই বাংলার দুই লেখক। ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে এক — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বছরের পর বছর ধরে দুঃখ হতাশা-বিভ্রান্তিই আচ্ছন্ন করেছিল আমাদের সামগ্রিক জীবন। এতদিন পর একটা সত্যিকারের আনন্দের সংবাদ পেলাম। আমার বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমার বাংলাদেশ? হ্যা, জোর দিয়ে বলছি আমারও। আমার জন্ম দেশ বিভাগের আগে ফরিদপুরে। এখন আমি কলকাতায় বসতি নিয়েছি। বিদেশে যাবার প্রয়ােজনে পাশপােরটে নাগরিকত্ব বােঝাবার জন্য আমি নিশ্চিন্ত ভারতীয় তবু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার জন্মভুমির টান অস্বীকার করতে পারবােনা। বাংলাদেশ এখন আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র, অধিবাসীর সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি, তা ছাড়াও এ পারের কয়েক কোটি মানুষ ঐ বাংলাদেশের আত্মিক নাগরিক হয়ে থাকবে। আমি কবিতা লেখার সময় যে বাংলা কথা লিখবাে, তা কি শুধু পশ্চিম বাংলার পশ্চিমবঙ্গ শব্দটাই কবিতায় ঠিক খাপ খায় না। | যুদ্ধের সঙ্গে কোনদিন নিজেকে এতখানি জড়িয়ে ফেলিনি। বাষট্টি আর পঁয়ষট্টিতে ব্যক্তিগতভাবে বেশ খানিকটা দুঃখিতই বােধ করেছিলাম। কিন্তু এই তেরদিন ধরে সারাক্ষণ রেডিওতে কান, টেলিপ্রিন্টারের কাছে, ঘােরাঘুরি মনের মধ্যে একটা ছটফটানি। এই জয় পরাজয়ের মধ্যে যেন আমার অস্তিত্ব জড়িত। নিছক নিরাপত্তা নয়, অস্তিত্ব ও বিশ্বাস। শুধু বাঙালী প্রীতি নয় ন্যায়, সত্য ও সভ্যতার যে-সব ধারণা নিয়ে বেঁচে আছি তার অপমৃত্যু হতাে। নিছক বর্বর সামরিক শক্তি বারাে শশা মাইল দূর থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খা দমিয়ে রাখবে। চরম অর্থনৈতিক শােষণ হবে, বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে, হঠাৎ খেয়াল খুশীমত সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে পাঁচ লাখ কি দশলাখ মানুষকে মেরে ফেলা হবে, কোটি খানেক মানুষকে সর্বহারা করে তাড়িয়ে দেওয়া হবে দেশের বাইরে, আর সারা পৃথিবী জিভ দিয়ে ছদ্ম সহানুভূতির চুকচুক আওয়াজ করবে কিন্তু প্রতিবাদের জন্য একটি আঙুলও তুলবে না- এটাই যদি শেষ সত্য হতাে তাহলে সর্বক্ষণ মুখে নিমপাতা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকতাম। তা হয়নি, যে ভারতবর্ষের আমি নাগরিক, সেই দেশই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছে- এই জন্য আমার গর্ব। আমরা মানুষের মুক্তি চাই। | এই জয়ের গর্ব আরও অনেক বেড়েছে, তার কারণ আমরা প্রায় গােটা পৃথিবীর অন্যায় ভ্রুকুটি গ্রাহ্য করিনি। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরােপের কয়েকটি দেশ দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা একা দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। ধংসের ঝুঁকি নিয়েও আমাদের একা দাঁড়াতে হতাে।
মহা শক্তিধর আমেরিকার শক্তিবর্গ চূর্ণ হয়ে গেল। সমস্ত নীতিবােধ তুচ্ছ করে নিয়ে এলাে সপ্তম নৌবহর। আমেরিকা হেরে গেছে, আর তার ভয় দেখানাে খেলায় কেউ ভয় পাবে না। এটাও একটা মস্ত বড় জয় । পরাজিত আমেরিকা এখন নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। ভারত ও বাংলাদেশের কাছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হুমকি দিয়েছিল, বিশ্বজনমত অগ্রাহ্য করেও ভারত যদি যুদ্ধ চালিয়ে যায় তাহলে। ভারতকে যাতে অত্যন্ত অপমানের সঙ্গে হার স্বীকার করতে হয়- চীন সে ব্যবস্থা করবে। কাগুজে বাঘ’ কথাটা চীনই প্রথম বলেছিল না? হঠাৎ বিশ্বজনমতের প্রতি চীনের আস্থা, দুচারদিন মাত্র রাষ্ট্র সঘের সদস্য হয়েই। বাংলাদেশের অগনন মানুষের মৃত্যু ও গৃহত্যাগ সম্পর্কে চীন থেকে একটি কথা শােনা যায়নি। এজন্য আমার ক্রোধ নয়, দুঃখ হয়। ভারত বা বাংলাদেশ বিরােধী অনেক রাষ্ট্রের অনেক সাধারণ মানুষ বা জননেতা এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু চীনের সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কথা আমরা জানতে পারি না। কোন্ রহস্যময় কারণে যে সব আদর্শ ত্যাগ করেও চীন ঐ ইয়াহিয়া সরকারকে আঁকড়ে রইলাে শেষ পর্যন্ত, তা জানি না। দূর প্রসারী পরিকল্পনা বা আদর্শের ভাঁওতা অবশ্য দেওয়া যায়ই। চীনের ফাঁকা গর্জনে ভারত। একটুও বিচলিত হয়নি- এও আর একটা জয়। ধর্ম গোঁড়া অবাস্তব রাষ্ট্রের বন্ধন ছিড়ে জন্ম নিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ।
আজ বড় আনন্দের দিন। আমি সচক্ষে দেখেছি আজ অনেক বাড়ীতে কান্নার ধুম পড়ে গেছে। অতিরিক্ত আনন্দে যে-রকম কান্না আসে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে কান্না। ন’মাস যারা দেশ ছাড়া, আজ তাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যাওয়ার আনন্দ। কত প্রিয়জন হারানাের দুঃখ, কত বীভৎস অত্যাচারের স্মৃতি, নতুন দেশ গড়ার কত স্বপ্ন। সব আজ মিলে মিশে একাকার। | এখনও ব্লাক আউট ওঠেনি। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়; আমি কি ফিরে যাবােনা? আমি এখন কলকাতার মানুষ, এই শহর আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে- এর মােহিনী মায়া বােধহয় আমি আর ছাড়তে পারবাে না। তবু ঢাকায় প্রথম দিনের বিজয়ােৎসবে যােগ দিতে আমার সাধ হয়। এতে আমারও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একবার দেখে আসবাে না, জন্মভূমির সেই গ্রাম, শশান খােলার পাশে সেই বিশাল বটগাছ, অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে যাওয়ার মতন পাটক্ষেত, দুর্দান্ত আড়িয়ল খাঁ নদী- আমার কৈশােরের কত নিঃশ্বাস ওখানে ঘুরছে। | কলকাতায় বসে শুনলাম, ঢাকা মুক্ত, আমার সােনার বাঙলা- আমি রিপভ্যান উইঙ্কল নই । হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে এ খবর পাইনি। ছ’মাসের প্রবাস-জীবনে প্রতি মুহূর্তে এই খবরের প্রত্যাশা আমি করেছি কখনও হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছি। কখনাে আশায় উদ্দীপ্ত হয়েছি। হতাশ হয়েছি তখন, যখন দেখেছি, একটি পীড়িত জাতির অস্তিত্ববিনাশী চরম বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেও বিশ্বসভায় মুরুব্বী শক্তিবর্গের কোন কোনটির প্রতারক ভূমিকা। আশায় উদ্দীপ্ত হয়েছি তখন, যখন দেখেছি দলে দলে তরুণ বাঙালী উম্মাদ হয়ে ছুটছে; নিষ্প্রাণ পাথরে নিস্ফল মাথা কুটে মররার জন্য নয়, সামান্য অস্ত্র হাতে শিশুঘাতী ও নারীঘাতী বর্বরতা রােখার জন্য, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। মাঝে মাঝে আত্ম-জিজ্ঞাসা জেগেছে, আত্মবিস্মৃতির ঘােরমুক্ত বাঙলীর আত্মপ্রতিষ্ঠা কী সম্ভব হবে? সম্ভব হবে কি ফ্যাসিবাদের হিরণ্যকশিপু বধ? রোঁমা রলা বলেছিলেন, “আই উইল নট রেসট। আমি বিশ্ববন্দিত মনিষী নই, বিতাড়িত একজন সামান্য লেখক ও সাংবাদিক। কিন্তু বাংলাদেশের অরণ্য-মর্মর ধ্বনি নিয়ত আমার প্রাণে বাজতাে, প্রাণে জেগে থাকতাে স্বপ্নের সেই অনির্বাণ শিখা, আমি দেশে ফিরবাে, মুক্ত স্বদেশে এবং দেশের মুক্তির জন্যই আমার ও আমার মত লক্ষ লক্ষ মানুষের এই দেশত্যাগ। বাঁশরী আসি হােক, এ প্রার্থনা আমার জীবনদর্শন নয়, কিন্তু কলম সঙিন হােক আর আমি হই সহস্র সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধার একজন, এ যেন হয়ে দাড়িয়েছিল আমার জীবেনরও শ্রেষ্ঠ কামনা। একবার যেতেই হবে। নাদের আলিকে বলবাে, এবার আমাকে সে তিন-প্রহরের বিল দেখাও, দত্ত বাড়িতে গিয়ে অমলাদিকে বলবাে, খাওয়াও তােমার নিজের হাতের তৈরী করা নারকেলের তক্তি। ব্রজ পন্ডিত মশাই প্রণাম করে বলবাে, চিনতে পারছেন না, আমি আপনার সেই অকৃতী অধম ছাত্র। ছেলেবেলার বন্ধু ইউসুফকে বলবাে…। অনেককেই দেখতে পাবােনা জানি, অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে, অনেক বদলেছে, তবু একবার যেতে হবে।
দুই ॥ আবদুল গাফফার চৌধুরী।
যা ছিল স্বপ্ন, তা আজ বাস্তব। কাল যা ছিলাম, আমি আজ তা নই। গত এক যুগ ধরে যে স্বপ্ন আমি পালন করেছি সযত্নে, সঙ্গোপনে, আমার মননে, ভাবনায় ও কল্পনায়, আজ তার বাস্তব মূর্তি যেন জ্যোতির্ময় শব্দের রূপ ধরে প্রথম বাংলাদেশ মুক্ত । আমি আর পরাধীন নই, মুক্ত। আমি আর পাকিস্তানী নই, বাঙ্গালি । আমার বাঙালী পুণর্জন্মই যেন আজ আবার সগৌরবে ঘােষিত হচ্ছে চারিদিকে। আমার অহল্যারূপী জন্মভূমিমাতৃভূমি আজ আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আর দীর্ঘ দু’যুগের অপরিচয় হীন জীবনের অভিশাপ ঘুচিয়ে স্বদেশ ও স্বাজাত্যবােধের মুক্ত তীর্থ প্রত্যাবর্তনের আনন্দঘন বেদনায় অন্তরে একটি নিরুদ্ধ কণ্ঠ বার বার চিৎকার করছে, জয় বাংলা, জয় হিন্দু।
আমিও মুক্তিযােদ্ধা বইকি। দীর্ঘ আটমাস আমি মুক্তির জন্যই লড়েছি। কলম হাতে লড়েছি। আর এই সংগ্রামেরই সফলতা ও চরিতার্থতা, ঢাকার মুক্তি, সারা বাংলাদেশের মুক্তি। এই মুক্তি অর্জনের গৌরবে আমিও একজন অংশীদার। কিন্তু এই মুক্তি শুধু বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ডের মুক্তি নয়, বাঙালী নামে একটি জাতির মুক্তি, একটি উজ্জ্বীবিত সংস্কৃতি, বেগবান ভাষা ও রুচিশীল কৃষ্টির মুক্তি। মুক্তি গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তার । এই মুক্তি সংগ্রামের পরাজিত পক্ষের নাম জঙ্গী ফ্যাসিবাদ, বর্বর ধর্মসাম্প্রদায়িতা এবং বল্গাহীন
অর্থনৈতিক শােষণ। এ জঙ্গী ফ্যাসিবাদের মৃত্যুতে সারা এশিয়ায় গণতন্ত্র রাহুমুক্ত হবে, ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতা ও জাতীয়তা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে গণতন্ত্রী ভারতের ভূমিকা তাই গােটা এশিয়ায় নবজাগ্রত জঙ্গী ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করার জন্য আমার কানে এসে বাজলাে, ঢাকা মুক্ত, গণতন্ত্র। ও মানব-স্বাধীনতার বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন করার। ইন্দিরা তাই প্রতিটি বাঙালীর চোখে আজ ইন্দ্রানী শুধু ভারতের ইন্দ্রানী নয়, বাংলাদেশ সহ সারা ভারতের ইন্দ্রানী।
আমি পাকিস্তানী নই, বাঙালী। ম্যান ইন দি আয়রন মাসকের সেই কাহিনীর মত সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর গলায় এতদিন যেন পরানাে ছিল একটা লােহার ফাস, পরিচয়হীন দাসত্বের ফাস। আর এই ফাসটির। নাম ছিল পাকিস্তান। একদা আত্মবিস্মৃতির ঘােরে এই ফাস আমরা স্বেচ্ছায় গলায় ধারণ করেছিলাম। ধারণ করে দেখি, এই লৌহবলয়ের চাবি আমার হাতে নেই। দৈত্য বধের সত্য আর শক্তি অর্জনে লেগেছে চব্বিশ বছর। লৌহ বলয়ে আঘাত যেদিন পড়লাে, যন্ত্রণায় অধীর হয়ে সেদিন বুঝলাম আমরা বাঙালী, সেদিন কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি এই পরিচয় এত শ্ৰীর্ঘ বাস্তব সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, স্বপ্ন এত শীঘ্র সফল হবে।
তাই আজ মুক্তকণ্ঠে জয়ধ্বনি দেই আমাদের মুক্তিবাহিনীর, সেই সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর। অপরের স্বাধীনতার জন্য এমন রক্তদানের নজির ইতিহাসে নেই। এই রক্ত ঋণের রাখী অচ্ছেদ্য। আমাদের কানে-বাঙালী জাতির কানে যিনি প্রথম মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের মহামন্ত্র, সেই বঙ্গবন্ধুর কথা আজ ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে। জানি না, তিন আজ কোথায়, বেঁচে আছেন কি না? বেদনার নয়, সম্ভ্রমের নতচিত্তে আজ শুধু বলি, মুক্তিদাতা, তােমার দায়, তােমার ক্ষমা হবে চিরপাথেয়, চিরযাত্রার ।
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা