দুই বাঙলা দুই মধ্যবিত্ত — আবদুল গাফফার চৌধুরী
শিয়ালদার ট্রাম ডিপাের মােড়ে জব চারণকের সঙ্গে রাজা মানসিংহের আকস্মিক দেখা। জব চারণক কলকাতার আদি পিতামহ। মানসিংহ আদি পিতামহ বলে কথিত ঢাকা শহরের। পরিচয় হতেই মানসিংহ বললেন, ‘কি দেখছাে?’ জব চারণক হ্যারিসন রােডের তেমাথার বিশাল জনস্রোতের দিকে চেয়ে বললেন, “দেখছি এই জনস্রোত। এরা মানুষ, না পঙ্গপাল? আমার কলকাতায় এত মানুষ ছিল না। এ হবে কখনাে ভাবিনি।” মানসিংহ বললেন ‘হুম, আমিও এই মাত্তর আমার ঢাকা শহর ঘুরে এলাম। সেই ঢাকেশ্বরী মন্দির সাক্ষী রেখে ঢাক পিটিয়ে গড়া সেই শহর ঢাকা এখন আর নেই। শহর বেড়েছে। লােকসংখ্যাও নাকি বেড়েছিল। কিন্তু এখানে দেখছি লােক কেবল বাড়ছেই। সেখান থেকে থেকে এলাম, লােক শুধু পালাচ্ছে । সবাই পালাতে চাইছে।’ জব চারণক বললেন, ‘লক্ষণ ভালাে কি মন্দ জানিনা, তবে মিলে যাচ্ছে।’
মানসিংহ বিস্মিত হয়ে শুধােলেন, ‘কী মিলে যাচ্ছে?’ জব চারণক হাসলেন, তুমি সেই মধ্যযুগের রাজা বাদশার দরবারের লােক। এই লোেক পালানাে আর লােকবৃদ্ধি দেখে ইতিহাসের মােড় ফেরা ঠিক বুঝবে না। আমি বুঝি। সুতানুটি, গােবিন্দপুর গ্রাম ভেঙে যখন প্রথম এই কলকাতা শহর গড়ি, তখনও লােক পালিয়ে আসছিল, চলে আসছিল কলকাতা শহরে, মুরসিদাবাদ, মুঙ্গের এমন কি ঢাকা থেকে। মাঝখানে উনিশশে সাতচল্লিশ সালের দিকে শুনেছিলাম একদল লােক কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে, আর আসবে না। এখন ফের কলকাতায় এই প্রাচীন বয়সে তার অলিগলিতে লােক পালিয়ে আসছে, দেখে মনে হচ্ছে, ইতিহাস আবার, মােড় ফিরছে। এটা ইতিহাসের মােড় ফেরার লক্ষণ।’ বলেই জব চারণক মানসিংহের মুখের দিকে তাকালেন, ‘তুমি কি হ্যারিসন রােডের এই বিশাল জনস্রোতে ঢাকা থেকে পলাতক বুড়িগঙ্গা-পারের লােকজন দেখছাে?’ মানসিংহ বললেন, ‘আমি ঠিক ধরতে পারছি না।’ জব চারণক আবার হাসলেন, “ওহহাে, তুমি তাে মধ্যযুগের বাংলাদেশে দেখেছাে চাষাভুষাে আর জমিদার নবাব। বাংলাদেশের বাঙালী মধ্যবিত্তদের তুমি ‘দ্যাখােনি।’ মানসিংহ লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকালেন ‘না, দেখিনি।’ জব চারণক, ধীরে ধীর হাঁটতে শুরু করলেন, ‘কলকাতা শহর তৈরি হওয়ার একশাে বছরের মধ্যে এই শহরে একটা নতুন জাত তৈরি হয়েছিল, যাদের নাম মধ্যবিত্ত । বলতে পারাে, এই কলকাতা শহরের সঙ্গে বয়স মিলিয়ে তাদের বয়স?”
এই কলকাতা শহরের শরীরে বয়সের মত বলিরেখা, কুঞ্চন আর ভাঙন এই জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে দেখাে, সেই সব ভাঙাচোরা খাদ আর গর্ত তুমি পাবে এদের বেশীরভাগ মানুষের চোখে মুখে। যাদের তা নেই, নতুন ঢাকার নতুন রাস্তার মত যারা এখনাে কিছুটা ঝর্মকে, বুঝবে তারাই তােমার ঢাকা শহরের পলাতক। পলাতক নতুন মধ্যবিত্ত।’ বলতে বলতে জব চারণক হ্যারিসন রােডের তেমাথার বিশাল জনস্রোতে নিজেও হারিয়ে গেলেন। মানসিংহ তাঁর পশ্চাদ্ধাবণ করলেন।
গড়ের মাঠে বসে দুই বন্ধুতে বাদামের খােসা ছিলাম। কলকাতা শহরের জনককে নিয়ে বিতর্ক নেই। বিতর্ক ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে। বন্ধুটি একটি কিংবদন্তীতে অবিচল বিশ্বাসী। আকবরের রাজত্বের সময় রাজমানসিংহ বাঙলাদেশের নতুন রাজধানীর খোঁজে বুড়িগঙ্গার পারে একটা ভাঙামন্দিরে বসে ঢাকীদের আদেশ দিয়েছিলেন ঢাক বাজাতে। এই ঢাকের শব্দ যতদূর যাবে, ততদূর পর্যন্ত তৈরি হবে নতুন জনপদ। এই জনপদই ঢাকা শহর। এই গল্প সত্য হােক আর না হােক, আজ যদি কলকাতার জব চারণক আর ঢাকার রাজা মানসিংহ শিয়ালদার মােড়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন, উনিশশাে একাত্তর সালের এই বিশাল জনস্রোত, কলকাতা শহরের চলমান জীবনের এই বিস্ময়কর ভাঙন আর উৎক্ষেপ, তাহলে কি ভাবতেন, কি বলতেন, তাই নিয়ে চলছিল দুবন্ধুতে আলােচনা। বন্ধুটি কলকাতাবাসী। বিশ বছরের উপর কলকাতায় আছেন। থাকেন মিরজাপুরের এক গলিতে। পৈত্রিক জমিজমা ছিল পূর্ববাঙলায় এখন কিছু নেই। বাপ বৃদ্ধ। কেরানিগিরি থেকে রিটায়ার করেছেন। পুত্র উপযুক্ত এবং শিক্ষিত। তবু পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে একটি চাকরি পেতে। তাই বাপ কনিষ্ট পুত্রকে আর লেখাপড়া শেখাননি। সে একটি কারখানার মেশিনচালক। সেই কারখানাতে লক আউট চলছে আজ দেড় মাসের উপর। ছােট ছেলে পাড়ার মাস্তান। বড় মেয়ে
বি-এ পাশ করে একটি ব্যাঙ্কের স্টেনাে-কাম-টেলিফোন অপারেটর। সংসারের বড় ভরসা সে-ই। বড় ছেলের মত বিয়ে করে হঠাৎ পর হয়ে যায়নি। বন্ধুটি বলেছিলেন, “তােকে দেখে কিন্তু এখানকার যে কেউ বলতে পারবে, তুই কলকাতার মধ্যবিত্ত ন’। ঢাকার পলাতক নতুন মধ্যবিত্ত । তাের জামার গন্ধ, ট্রামে বাসে চড়ার অভ্যাস, ভঙ্গি, ভাষা এবং ব্যবহারে। সফিসটিকেশনের অভাব অথবা তা নকল করার প্রবৃত্তি বাঙলা শব্দ এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের দিকে অত্যধিক টান- সবই বলে দেবে, তুই পদ্মার ওপারের লােক, এপারের নস্।’ বললাম, তুইও তাে মাত্র বিশ বছর আগে পূর্ববাঙলা থেকে এসেছিস- সম্ভবত সেই পঞ্চাশের রায়টের পরে । তাের গায়েও কি তখন নতুন। মধ্যবিত্তের গন্ধ ছিল? বন্ধু বললেন। ‘তুই ভুল করছিস। আমি পূর্ব বাঙলায় ছিলাম বটে, কিন্তু জাতে ছিলাম। কলকাতার মধ্যবিত্তের প্রশাখা। সুবিধা ভােগী হিন্দু বাঙালী মধ্যবিত্ত । তােরা নতুন মুসলমান মধ্যবিত্তেরা এই সুবিধায় ভাগ বসাবার দাবি জানিয়ে আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করছিস, দেশ ভাগ করছিস। ঝগড়াটা ছিল চাকরি বাকরির বখরার, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের সমাজ-সম্পর্কের। তােরা তাকে ধর্মরক্ষার শ্লোগানের রাংতায় মুড়ে সহজেই, চাষী আর শ্রমিক মুসলমানকে দলে টেনেছিস। তােদের জন্ম এগরাে-ইকোনমি থেকে, মানিইকোনমি থেকে জন্ম আমাদের। ঝগড়াটার উৎপত্তিও এখানেই।
আমাদের চোখে তােরা ছিলি চাষাভুষাে, আর তােদের চোখে আমরা ছিলাম বেনিয়া। তােরা এখন মধ্যবিত্ত হলে কি হবে? তােদের গায়ে এখনাে মাটির গন্ধ, তােদের ঢাকা-কালচারে গ্রাম্যতার প্রলেপ। তােদের গ্রামবাসী কৃষক পিতার সঙ্গে নতুন শহরে চাকরিজীবী পুত্রের জেনারেশন গ্যাপ এক পুরুষের । আমাদের জেনারেশন গ্যাপ পাঁচ পুরুষের। কলকাতার পূজোয় তাই ইংরেজি গানের সুরে হিন্দী রেকরড় বাজে। শুনেছি, ঢাকায় ঈদের দিনেও বাজে রবীন্দ্রনাথ নজরুল আর ডি এল রায়ের গান। উরদু গান একদম বাতিল। এই জেনারেশন-গ্যাপ কম বলেই তাদের নতুন মধ্যবিত্ত শহুরে মিয়ারা (কলকাতার এককালের বাবুদের পাল্টা শ্রেণী) গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি সমাজের সঙ্গে এখনাে পরিচিত এবং সম্পর্কযুক্ত সংখ্যা গরিষ্ঠ । আমাদের মধ্যবিত্ত জেনারেশন গ্যাপ বাড়তে বাড়তে এখন শেকড় ছেড়া এবং পরগাছা। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধোয়া নয়, মাটির মমতা রসে সিক্ত নিবিড় স্বদেশানুরাগ এখন তােদের প্রাণে । ঢাকার ছেলেরা তাই রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি গড়ে। আমাদের ছেলেরা তাদের মূর্তি ভাঙে। রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, ডিএল রায়, মুকুন্দ দাসের যে গান শুনে একদিন বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত স্বদেশী আন্দোলন করেছে, সেই গান এখন তােদের স্বদেশ-মুক্তির যুদ্ধে প্রেরণা। এটা থেকেও দুই মধ্যবিত্তের বয়সের ব্যবধান আঁচ করতে পারবি।’ বললাম, ‘দুই বাঙলার দুই মধ্যবিত্তের বয়সের ব্যবধান যাই হােক, মনােভঙ্গি ও নগরিক-ধর্মের তারতম্য কিন্তু কমছে। কলকাতায় ট্রাম বাসের ভিড়ে নারী পুরুষের যে গুঁতােগুতি তাতে মনে হয়, তােদের মেয়েদের স্পর্শকাতরতা নেই। আমাদের মেয়েরাও এগিয়েছে, তবে অতটা নয়। এখনাে তারা পুরুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে।
বন্ধু বললেন, তাহলে কতটা এগুলাে তােদের মেয়েরা? ব্যবধান কতটা কমলাে?’ বললাম, ‘ধর বিশ । বছর আগেও যে মেয়ে ঘােড়ার গাড়ির জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে রাস্তায় বেরুতাে, এখন সে দিব্যি ভি-কাট ব্লাউজ গায়ে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে একা সিনেমা রেস্তোরা ঘুরে বেড়ায়। মনােনীত পাত্রকে নয়, ভালবাসার পাত্রকেই বিয়ে করে। ১৯৫৪ সালে ঢাকার মেয়েরা প্রথম অনুমতি পায় কো-একটিং বা পুরুষের সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করার। আর ঢাকার মঞ্চে প্রথম নারী পুরুষের (অপেশাদার) সহ অভিনয়ের নাটক রবীন্দ্রনথের “শেষ রক্ষা।” ঢাকার মেয়েরা এখন কপালে খয়েরি, লাল টিপ পরে, শাড়ি পরার ঢং কলকাতার মত আধা রাজস্থানী নয়, তবে শান্তিনিকেতনী আইয়ুব আমলে গর্ভনর মােনেম খা কঠোর হুকুম জারি করেও মেয়েদের এই টিপ পরা বন্ধ করতে পারেন নি। ঢাকার মেয়েরা এখন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখবেই। বছরে একদিন-একুশে ফেবরুয়ারির শহীদ দিবসে খালি পায়ে হাঁটবেই। আর শহীদ মিনারের গায়ে নিপুণ হাতে রক্ত-আলপনা। আঁকবেই। যা দেখে টিকা খা গর্জে উঠে বলেছিলেন, “আরে এ যে দেখছি হিন্দু কালচার। পাকিস্তানে হিন্দু কালচার। এনা বেতমিজ। পানজাবী জেনারেল বুঝতে পারেনি, ওটা হিন্দু কালচার নয়, বাঙালী কালচার। তাই বলছিলাম, আমাদের দুই মধ্যবিত্তের নাগরিক ধর্মের তারতম্যও হ্রাস পাচ্ছে। তবে মেয়েরা তােদের। মেয়েদের মত স্পর্শকাতরতা এখনাে একেবারে হারায়নি।”
বন্ধু খোঁচাটা নীরবে হজম করলেন না। বললেন, ‘আগেই বলেছি না, তােরা চাষাভুষাের জাত, আমরা বেনিয়া। তােদের মেয়েরা মাত্র ঘােমটা তুলেছে। কটা মেয়ে কলকাতার মেয়েদের মত পরিবার বাঁচাতে চাকরির ধান্ধায় রাস্তায় বেরিয়েছে? যদি বেরুতে, তাদেরও স্পর্শকাতরতা থাকতাে না। তােরা নূতন মধ্যবিত্ত । তােদের মেয়েরা পর্দা ছিড়ে নতুন প্রেম করতে শিখেছে। নতুন শেখা রােমান্সের স্বপ্ন তাহাদের চোখে। আমাদের মেয়েরা ওই বয়সে শিবের মত স্বামী পাওয়ায় নয়, টাইপিস্ট, কিংবা স্টেনাে হওয়ার চাকরির সাধনা করে। অল্প বয়সে অম্বল, অজীর্ণ, টিবি-তে ভােগে। তাছাড়া কলকাতার লােকসংখ্যা কত জানিস? পঁয়ষট্টি লাখের উপর। তােদের ঢাকায় কত? সুবরব মিলিয়ে পনের লাখেরও বেশি নয়। তােদের ঢাকার সমাজকে এখনাে আরবান কম্যুনিটি বলা চলে না। বলা চলে পূর্ব বাঙলার একটা সম্পন্ন বর্ধিষ্ণু বড় গ্রাম হল ঢাকা। আর তােরা সেই বর্ধিষ্ণু গ্রামের নতুন সুবিধাভােগী সমাজ। আর এই কলকাতা? কসমােপলিটান সিটি। বাঙালী পাড়ার গায়েই লেগে আছে মাদ্রাজী, বিহারী, উড়ে, ট্যাশ-ফিরিঙ্গি-এমন কি খাস ইংরেজদের পাড়া। একচেটিয়া সুবিধা কারাে নেই। বরং সুবিধা নিয়ে প্রাণান্ত প্রতিযােগিতা। এই প্রতিযােগিতা আর, বহু মিশ্রণ ও ঘর্ষণের অবক্ষয়টাও তাই চোখে পড়ার মত। কলকাতার সমাজ-শরীর বাড়ন্ত গড়ন নয়, ক্ষয়িষ্ণু। সবাই তার ভাঙছে। রাস্তা ঘাট, বাড়িঘর, কালচার, ইকোনমি সব কিছুতেই তার অবক্ষয়ের ছাপ। কলকাতাকে এইভাবে ভাঙ্গার কাজে তাদের অবদানও কম নয়।
নতুন মধ্যবিত্তের আগ্রাসী নীতিতে পূর্ব বাঙলা থেকে গত বিশ বছরে উৎসাদন ঘটেছে প্রায় দু’কোটির মত পুরনাে মধ্যবিত্তের। বছর বছর তােরা রিফিউজি ঠেলে দিয়েছিস কলকাতার ঘাড়ে। এইভাবে বছর বছর হাজার হাজার লাখ লাখ রিফুজি ঢাকার। ঘাড়ে চাপালে তােদর মিয়া কালচার আর প্রিভিলেজড সােসাইটির অবস্থা কী দাঁড়াতাে ভাবতে পারিস? আমি পূর্ব বাঙলার মানুষ। কিন্তু পশ্চিম বাঙলায় মানুষের কাছে বড় বেশি কৃতজ্ঞ। পূর্ব বাঙলার রিফুজিরা প্রতি বছর এখানে হাজারে হাজারে এসেছে। চাকরি, বাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য সব কিছুতে ভাগ বসিয়েছে। কলকাতার বাবু ভাষা ও কালচারের দফা নিকেশ করেছে। পূর্ব বাঙলায় লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল শরণার্থী মানুষের কেবল বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিপর্যস্ত চেহারা দেখলে বুঝবি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ধৈর্য কত অসীম। ধৈর্য আমরাও দেখিয়াছি। পূর্ব বাঙলায় তােদের সব সুবিধা ছেড়ে দিয়ে এসে কোটির উপরে হিন্দু মধ্যবিত্ত এই কলকাতায় ধ্বংসের অতলে চিরদিনের জন্য তলিয়ে গেছি আমার সারা কলকাতাকে সেই অশেষ
মেয়েদের মত স্পর্শকাতরতা এখনাে একেবারে হারায়নি।”
বন্ধু খোঁচাটা নীরবে হজম করলেন না। বললেন, ‘আগেই বলেছি না, তােরা চাষাভুষাের জাত, আমরা বেনিয়া। তােদের মেয়েরা মাত্র ঘােমটা তুলেছে। কটা মেয়ে কলকাতার মেয়েদের মত পরিবার বাঁচাতে চাকরির ধান্ধায় রাস্তায় বেরিয়েছে? যদি বেরুতে, তাদেরও স্পর্শকাতরতা থাকতাে না। তােরা নূতন মধ্যবিত্ত । তােদের মেয়েরা পর্দা ছিড়ে নতুন প্রেম করতে শিখেছে। নতুন শেখা রােমান্সের স্বপ্ন তাহাদের চোখে। আমাদের মেয়েরা ওই বয়সে শিবের মত স্বামী পাওয়ায় নয়, টাইপিস্ট, কিংবা স্টেনাে হওয়ার চাকরির সাধনা করে। অল্প বয়সে অম্বল, অজীর্ণ, টিবি-তে ভােগে। তাছাড়া কলকাতার লােকসংখ্যা কত জানিস? পঁয়ষট্টি লাখের উপর। তােদের ঢাকায় কত? সুবরব মিলিয়ে পনের লাখেরও বেশি নয়। তােদের ঢাকার সমাজকে এখনাে আরবান কম্যুনিটি বলা চলে না। বলা চলে পূর্ব বাঙলার একটা সম্পন্ন বর্ধিষ্ণু বড় গ্রাম হল ঢাকা। আর তােরা সেই বর্ধিষ্ণু গ্রামের নতুন সুবিধাভােগী সমাজ। আর এই কলকাতা? কসমােপলিটান সিটি। বাঙালী পাড়ার গায়েই লেগে আছে মাদ্রাজী, বিহারী, উড়ে, ট্যাশ-ফিরিঙ্গি-এমন কি খাস ইংরেজদের পাড়া। একচেটিয়া সুবিধা কারাে নেই। বরং সুবিধা নিয়ে প্রাণান্ত প্রতিযােগিতা। এই প্রতিযােগিতা আর, বহু মিশ্রণ ও ঘর্ষণের অবক্ষয়টাও তাই চোখে পড়ার মত। কলকাতার সমাজ-শরীর বাড়ন্ত গড়ন নয়, ক্ষয়িষ্ণু। সবাই তার ভাঙছে। রাস্তা ঘাট, বাড়িঘর, কালচার, ইকোনমি সব কিছুতেই তার অবক্ষয়ের ছাপ। কলকাতাকে এইভাবে ভাঙ্গার কাজে তাদের অবদানও কম নয়। নতুন মধ্যবিত্তের আগ্রাসী নীতিতে পূর্ব বাঙলা থেকে গত বিশ বছরে উৎসাদন ঘটেছে প্রায় দু’কোটির মত পুরনাে মধ্যবিত্তের। বছর বছর তােরা রিফিউজি ঠেলে দিয়েছিস কলকাতার ঘাড়ে। এইভাবে বছর বছর হাজার হাজার লাখ লাখ রিফুজি ঢাকার। ঘাড়ে চাপালে তােদর মিয়া কালচার আর প্রিভিলেজড সােসাইটির অবস্থা কী দাঁড়াতাে ভাবতে পারিস? আমি পূর্ব বাঙলার মানুষ। কিন্তু পশ্চিম বাঙলায় মানুষের কাছে বড় বেশি কৃতজ্ঞ। পূর্ব বাঙলার রিফুজিরা প্রতি বছর এখানে হাজারে হাজারে এসেছে। চাকরি, বাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য সব কিছুতে ভাগ বসিয়েছে। কলকাতার বাবু ভাষা ও কালচারের দফা নিকেশ করেছে। পূর্ব বাঙলায় লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল শরণার্থী মানুষের কেবল বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিপর্যস্ত চেহারা দেখলে বুঝবি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ধৈর্য কত অসীম। ধৈর্য আমরাও দেখিয়াছি। পূর্ব বাঙলায় তােদের সব সুবিধা ছেড়ে দিয়ে এসে কোটির উপরে হিন্দু মধ্যবিত্ত এই কলকাতায় ধ্বংসের অতলে চিরদিনের জন্য তলিয়ে গেছি আমার সারা কলকাতাকে সেই অশেষ অতলের দিকে টানছি। ভাবতে পারিস, এই ভাঙ্গনের গহ্বর কত বড়।’
বললাম, ‘তােদের এখানে ভাঙ্গন। আর আমাদের ওখানে পচন। আমাদের নতুন মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধ উপরতলায় সহসাই পচন ধরেছিল। গ্র্যাজুয়েট হলেই বড় চাকরি। বিলাত ফেরত হলেই সমাজের মাথাসুবিধার পরিসর যত বাড়ছিল, আমরা তত হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সিকি মাইল পথ
হেঁটে ইমপােরটেড কার হাঁকান। বুদ্ধিজীবীর আডডা টি হাউস কিংবা কফি হাউস নয়, হােটেল ইনটারকনটিনেনটাল বার। নাইট ক্লাবের সংখ্যা বাড়ছিল। মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীর ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ার কুলার। কলকাতার একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত যা স্বপ্নেও কল্পনা করেনা। একদিকে মুষ্টিমেয় সুবিধা ভােগী। মধ্যবিত্তের বিলাস, অন্যদিকে বিশাল, বিপুল জনসমষ্টির দারিদ্র; একই মধ্যবিত্তের দুই দুই পরিবারে আয়ের বৈষম্যের দ্রুত বৃদ্ধি। এদিক থেকে কলকাতা বরং আদর্শ। দারিদ্র অসহনীয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের ইনকাম ডিসপ্যারিটি সহনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কেরানী, খ্যাতনামা সাহিত্যিক সবাই একই ট্রামে বাদুড় ঝােলা হয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার মত কেউ পায়ে হেটে, কেউ রিকশায় কেউ দ্রুত মােটর হাকিয়ে ছুটছেন না।’
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। বন্ধু বললেন, চল উঠি জব চারণক আর রাজা মানসিংহ হয়তাে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের আলাপ শুনছেন।
২১ অক্টোবর, ১৯৭১