পুজো-আমার গায়ে এবং কলকাতায়–হাসান মুরশিদ
পূর্ব বাংলায় যখন সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব হতাে, তখনাে আমার শৈশব কেটে বাল্যকাল শুরু হয়নি। স্বভাবতই তাই আমার মনে সেদিনগুলাের কোনাে স্মৃতি নেই। কৈশােরে নিজের গ্রামে ফিরে এসে শুনেছি বয়স্কদের কাছে কোনখানে চাটুজ্জেদের বাড়ি ছিলাে আর কোন খানটাতে বােসেদের। শুনেছি, কোন বাড়িতে কখনাে পূজো হতাে। পূজোর ঘটা, আরতির হুল্লোড়, ঢাকের নাচন, নাড়ুর লুট, এক কথায় আনন্দের ছড়াছড়ির কথা শুনেছি আমি কতােজনের কাছে। শুনে শুনে আমার কল্পনায় ছবি ফুটে উঠেছে নববস্ত্রপরিহিত উচ্ছ্বসিত উল্লাসিত আবাল বৃদ্ধবণিতার উৎসব মুখর আলােকজ্জ্বল দ্রিাবিহীন রাত্রির, ঢাক আর কাঁসার ছন্দে কম্পিত প্রতিধ্বনিত নিসর্গের। কিন্তু কলেজ জীবনে প্রথম যেদিন আমি কামিনী সমাদ্দারের বাড়িতে গেলুম পূজো দেখতে, আমি হতাশ হয়েছিলুম। আমার কল্পনার আনন্দের ছবিতে এক পােচ কালাে অন্ধকার লেগেছিলাে মণ্ডপের টিমটিম আলােয় । আনন্দের চেয়ে সেখানে আমি ভক্তিকেই বেশি প্রত্যক্ষ করেছিলুম। তিন বছর আগে আমরা যখন বাজারে একটি সর্বজনীন পূজোর আয়ােজন করেছিলুম, তখন অবশ্য ভক্তির চেয়ে আনন্দই বেশি অনুভব করেছিলুম চারিদিকে। সে যা হােক, পল্লীর রাত্রির চেপেথাকা নিস্তব্ধতার মধ্যে দূর-বহুদূর থেকে যখন ঢাকের আওয়াজ শুনতুম শরতের ছুটিতে, আমার মন এক অকারণ অজানা ব্যথায় মােচড় দিতাে। আমাদের গ্রামের পশ্চিম অংশ যেখানে এখন শুধু জঙ্গল আর শস্যখেত, তাকে সবাই বলে ‘নগর।’ একদিন গিজগিজ বাড়ি ছিলাে সেখানে, সন্ধ্যের পরে ছেলেমেয়েদের উচ্চকণ্ঠে বই পড়ার শব্দে সারাটা পাড়া জেগে উঠতাে, আখড়ায়, তরুণ সংঘ, গুহদের বৈঠকখানায় ভিড় জমে উঠতাে- এসব না-দেখা ছবি ঢাকের বাদ্যিতনে আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠতাে।
শিহরিত কলকাতার পূজোর ছবিও কখনাে বা আমার মনে উকি দিতাে। রাস আমি দেখিনি- তবু তেমন একটা চিত্র আমার মনে পড়তাে। আমার গায়ের চিৎ-বিদীর্ণ একান্ত নৈঃশব্দ আর প্রাণােচ্ছল চঞ্চল কলকাতার কোলাহল মুখরতার তুলনা করতে আমার ইচ্ছে হতাে। কিন্তু কল্পনার কলকাতার পূজোর সঙ্গে বাস্তবের মিল আমি পুরাে খুঁজে পাইনি। ভুক্তভােগীদের পক্ষে কষ্টকর হলেও, ভালাে লেগেছে আমার, কেনাকাটার হিড়িক দেখে, ঘরছাড়া নারীশিশু-যুবক-বৃদ্ধের হুজুগ দেখে, প্রবহমান জনতার তরঙ্গ দেখে। কিন্তু সবচেয়ে ভালাে লাগলাে, যখন দেখলুম সকলের আনন্দটাই বড়াে কথা, ধর্ম আর ভক্তিটা নিতান্তই আনুষঙ্গিক। মণ্ডপের প্রতিমার সামনে গিয়ে দাড়াচ্ছে অল্পসময়ই, অন্যান্য আকর্ষণগুলিই বেশি টানছে। ভালাে লাগলাে এই দেখে যে, একটি সার্বজনিক উৎসব ছােটো বড়াে ডান বাম সকলের ভেদ ঘুচিয়ে দিচ্ছে। সংসারের অনটন অস্বাস্থ্যের অনারাম আসারের সংকীর্ণতা, চলাচলের ক্লেশ সবকিছুর মধ্যেও একটি জাদু এসে সকলের দেহে উজ্জ্বল আবরণ, মুখে অকৃপণ হাসি আর মনে অপরিমেয়
আনন্দের নীড় রচনা করেছে। এ উৎসব যদি না থাকতাে, জীবনের বােঝা তবে কলকাতার আটাত্তর লাখ লােক কী করে বয়ে বেড়াতাে। | কিন্তু অনেক কারণে আমার মনে তাল কেটেছে। আলােকোজ্জ্বল আনন্দবিহ্বল প্রমত্ত কলকাতাকে দেখেও আমার সারাক্ষণ এক কোটি মানুষের কথা মনে পড়ছে, যাদের কেউবা জঙ্গী বাহিনীর দৌরাত্ম্যে কেউবা বন্যার দাপটে আশ্রয়হীন। সবাই যেন আলাদা আলাদা এক একটি ইউনিট, স্থানাভাবে ঘনিষ্ঠ, কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না, চিনতে চায়না । কামিনী সমাদ্দারের বাড়িতে কিন্তু গভীর তাদের যােগ। সেখানে প্রশস্ত আঙ্গিনায় গুটিকতক মানুষ, কিন্তু গভীর তাদের যােগ। সেখানে আরতি করার কী উৎসাহ; সিদ্ধি খেয়ে সকলে কী বিভাের। এখানে আমি আরতি দেখলুম না মনের মতাে। ঢাকের বাজনা আমার খুব প্রিয়। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ রেকর্ডের ‘এত রঙ্গ শিখেছ কোথা’- গানটির আগের ঢাকের বাদ্যি আমি কতবার বাজিয়ে শুনেছি। না, কলকাতায় আমি কোথাও ঢাক পর্যন্ত শুনিনি মনের মত । দেশত্যাগী বাঙালদের কাছেও কি কলকাতার পূজো মনের মতাে, আমার জানতে ইচ্ছে করে। তাদের মনে পড়ে না, ছুটির বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন বরিশাল মেলে চড়ে? বাড়িতে রব পড়ে গেছে- ‘ওরে মেজো কর্তা এসেছে?’ রােজ বাজার করতে যাচ্ছেন? গাঁয়ের অফুরান প্রশান্তির মধ্যে আন্তরিকতায় উদ্ভাসিত আনন্দোৎসব?
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা