You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রিয়বরেষু- কবিরুল ইসলাম - সংগ্রামের নোটবুক

প্রিয়বরেষু

কবিরুল ইসলাম। ঢাকাতে আমার দুজন বিশেষ বন্ধু আছেন ঃ রাশীদুল হাসান এবং আনােয়ার পাশা । একজন বীরভূমের লােক, আরেকজন মুর্শিদাবাদের। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রাশীদ ইংরাজির, আনােয়ার বাংলার । এ দেশেই রাশীদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়, বন্ধুতা জন্মে। গােটা পরিবারকে আমি নিজের মত জানতাম। আমার অ্যালবামে রাশীদের কয়েকটি ফটোগ্রাফ এই অন্ধকারের দিনগুলিতে আরও জ্বল জ্বল করছে। আনােয়ার আমার পত্রবন্ধু, তাকে দেখিনি, কিন্তু তাদের ফটো দেখেছি। সযত্নে সেঁটে রেখেছি অ্যালবামে। সেই ছবিগুলি কয়েকদিন ধরে দেখছিলাম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম। এবং দেখতে দেখতে ওদের মুখগুলি আমার মনে বসে গিয়েছে যেন। তাই এখন আর অ্যালবাম খুলতে হয়না। ছেলেবেলায় যেরকম মেলা-ফেরত চোখ বুজলেই এক মুহূর্তে সবকিছু অবিকল উদ্ভাসিত হতাে, তেমনি এই—প্রিয় মুখগুলি আমার চারপাশে ভিড় করে আছে, যেন প্রত্যেকে পরম সমাদরে বলছে ‘এসাে’। কেননা, আমি তাদের লিখেছিলাম শরঙ্কালে যাবাে। মুজিবের বাংলাদেশ আমি কখনও চোখে দেখিনি। শুধু রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে, ছেটগল্পে, কবিতায় এবং গানে-পাওয়া সেই অমল প্রতিমার আমি আবাল্য সহচর। আমার অস্তিত্ব জুড়ে সব সময় বেজে যায়, ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।’ এবং এই আত্মবিষ্কারের সূত্র ধরে এসেছে সাম্প্রতিককালে রচিত বাংলাদেশের নবজাগ্রত সাহিত্য, যার পাতায় পাতায় মুদ্রিত আছে নিমন্ত্রণের খােলা চিঠি। উত্তরে বলেছিলাম, এই শরক্কালে আমি যাবাে। বলেছিলাম আমি যাচ্ছি।  রাশীদ আমাদের টানে এদিকে আসতেন। বছরে একবার ও ঘুরে যেতেন রমজানের ছুটিতে। এবং একবার এসে গেলে কতবার ঘুরে ফিরে কেবলই আমাদের দেখা হতাে, যেরকম প্রত্যেকেরই এক একটি প্রিয় পুস্তক থাকে, যেখানে নিশ্বাস নেবার জন্য বারে বারেই আমাদের ফিরতেই হয়। একসঙ্গে পথে বেরােতাম, কখনও হেঁটে, কখনও সাইকেল রিক্সায়। স্কুলবাের্ডের মাঠে বিকেলের ঘাসের উপর বসতাম । অদূরের পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে পাশাপাশি পড়াতাম, সামনেই সাজানাে আকাশ। চাঁদমারির টিলার কাছে হাঁটতাম। দুবরাজপুর রােডের উপর দিয়ে ভারি ভারি ট্রাক চলে যাচ্ছে। সিউড়ি স্টেশন থেকে একটি দুটি ট্রেনও। শান্তিনিকেতনে লাস্ট বাস এইমাত্র ছেড়ে গেলাে।

আমার জন্য যত পারতেন বইপত্র আনতেন, প্লেনে যতটুকু সম্ভব। সেই সব স্বপ্নবৎ বাংলা বই-এর সব ভুলানাে সুবাসে আমি বিহ্বল হয়ে যেতাম। আমার অনেক বিজন প্রহর, অনেক মধুর অবকাশ সেই সব পরমাশ্চর্য বই এর উপর হুমড়ি খেয়ে মুখ গুঁজে কেটেছে। আজ সে কথা ঘুরে ঘুরে গুঞ্জনের মতাে কেবলই। মনে পড়ছে, অমর জ্যোত্সার মনে তােলপাড় করছে। রাশীদের হাতে আনােয়ারও বইপত্র পাঠাতেন। ‘ডাকেও যে কত বইপত্র এসেছে। আনােয়ার নিজে লেখক মানুষ, ইতিমধ্যে ডজন খানেকের বেশি ভারি ভারি বই লিখেছেন। খেপে খেপে আমাকে সেগুলি আমাকে পৌছে দিয়েছেন অন্যান্য বই-এর সহযাত্রী করে। আনােয়ার কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, আলােচক, গ্রন্থসম্পাদক অধ্যাপক মহম্মদ আবদুল হাই এর সহযােগী হিসেবে। সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পের বই ‘নিরুপায় হরিণী’ আমাকে পাঠিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। বইটি আমি রেডিওতে রিভু করেছি। আনােয়ারকে খবর দিয়েছি। জানিনা, সে চিঠি তিনি পেয়েছেন কিনা।

চিঠিপত্র চালাচালি ছিলাে নিরন্তর নিয়মিত। কিন্তু শেষের মাস খানেক আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলামতাই বলে অমনােযােগী কদাচ নয়। এমনও হয়েছে হপ্তায় হপ্তায় চিঠি এসেছে, ঠিক পিছনে পিছনে। একটার জবাব না যেতে আর একটা। বিশেষ করে রাশীদ চিঠিপত্র যােগাযােগে অর্থেই নিরলস। বস্তুত কলকাতার চাইতে ঢাকা আমার আরও ঢের বেশী নিকট ছিলাে। কাছে কাছাকাছি ছিলাে। বিশেষ করে ১৯৬৩ সাল থেকে যেবার রাশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ নিয়ে চলে গেলেন, চলে যেতে হলাে। আমি তাে জানি, তিনি যেতে চাননি। ফিরে তাে এসেই ছিলেন। হেতমপুর কলেজে অনেক বছর পড়ালেনও, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে চলে যেতে হলাে। কেননা আমরা তাকে রাখতে পারিনি। 

উত্তাপ চুইয়ে পড়তে যেন। তাঁর সান্নিধ্যের নিবিড় উষ্ণতা এই দুঃসময়ের মুখােমুখি আরাে বেশি করে আমি অনুভব করছি; যেন আমার পাশটিতে বসে আছেন। আমার কাঁধে হাত রেখে ঈষৎ চাপ দিয়ে তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে যেন বলছেন, ভয় নেই। সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত বাঙালীর এই মুক্তিযুদ্ধ, অতএব মাভৈঃ।’ এই বজ্র উচ্চারণ যেন আমাকেই উৎসাহ দেবার জন্য উদ্‌বােধিত করবার জন্য। আমি চিৎকার করে বলেছি, ‘আমরাও তােমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছি।’

তােমরা কেমন আছাে জানিনা। তােমরা কোথায় আছছা জানি না। বেতারে সংবাদপত্রে তােমাদের খবরের জন্য আমরা সারা দিনমান কান পেতে আছি। তােমরা বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা। শুধু এইটুকু জানি যে, তােমাদের মৃত্যু নেই। তােমরা মৃত্যুত্তীর্ণ। ত্রিভুবনে তােমাদের জড়ি নেই। ত্রিভুবনে তােমদের জুড়ি মেলা ভার। তােমাদের আলাদা কোনাে নাম নেই, তােমাদের পৃথক কোনাে ঠিকানা নেই, আজ তােমাদের নাম ও ঠিকানা, তােমাদের সমগ্র অস্তিত্ব, মায়ের মতাে শুধু একটি মাত্র শব্দে স্বয়ম্প্ৰকাশ। না শব্দে ঠিক নয়, মন্ত্রে । এবং সেই মন্ত্র বাংলা, আমার সােনার বাংলা । আনােয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানকে আলবদর বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি।

২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা