You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.03 | তুমি চৌষট্টিতে, আমি একাত্তরে- নগেন্দ্র দাশ - সংগ্রামের নোটবুক

তুমি চৌষট্টিতে, আমি একাত্তরে– নগেন্দ্র দাশ

সন্তোষ এসেছে। সন্তোষ দেবনাথ। ঝিনাইদহ কলেজের গণিত শাস্ত্রের বিভাগীয় প্রধান। দু’খানা গরুর গাড়ি করে, গাড়ি পিছু ষাট টাকা ঘুষ দিয়ে গেছে সীমান্ত পেরিয়ে সন্তোষ এসেছে গত সােমবার। সঙ্গে স্ত্রী কাচ্চাবাচ্চা এসেছে। এসেছে প্রাণের মায়ায় নয়। প্রাণের সাড়ায়। এসেই ছুটে এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে। পরনে তখনাে লুঙ্গি। নিরুজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগ কাঁপা গলায় কত কথা বলে। গেল সন্তোষ।

রূপকথায় ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সােনার কাঠির কথা। সােনার কাঠি দেখিনি। সেই সােনার কাঠি যার ছোঁওয়ায় ঘুমিয়ে-পড়া রাজকন্যা চোখ মেলে তাকিয়েছিল। অনেক দিনের না-দেখা অথচ ভীষণ সত্য বাস্তবকে দু’চোখ দিয়ে গিলছিল। সে-রাজপুত্র রাজকন্যার নাম জানিনা। কোনদিন জানবও না। কিন্তু সেদিন যে সােনার কাঠির জীবনস্পর্শে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে জেগে উঠতে দেখেছিলাম, তার নায়ককে চিনি। তার নাম জানি। সে রাজপুত্র আজকের বাঙালীর অতি প্রিয় নাম, অতি বেশি ভালবাসার নাম। সে নাম মুজিবুর রহমান। ভাবতে পারবে না কোন আদেশ বা হুকুমের অপেক্ষা নয়। কেবল ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ঘােষণাটুকু শুনবার অপেক্ষায়। তারপর সমস্ত দেশজুড়ে সে কি জীবনের জোয়ার! হরতাল হরতাল! কাজে ফিরে যাও! কাজে ফিরে যাই। ক্ষেত-খামারে, কল-কারখানায় সে প্রাণের জোয়ার তুমি দেখনি।

“তুমি এসেছ চৌষট্টিতে। আমি একাত্তরে সেদিন হিংস্রতার চোখগুলি দপদপিয়ে উঠেছিল। কোথাও কোথাও তার ছোঁওয়ায় আগুন জ্বলছিল। আর আজ মাত্র কয়েকটা দিনে সেই দেশ আগুনে পুড়ে-যাওয়া খাক। হয়ে-যাওয়া শ্মশান। খবলা-খবলা ছুবলে-নেওয়া মৃতদেহের স্থূপ। অথচ কী প্রাণের সাড়া ‘ছাব্বিশে। ভুল বললাম। পঁচিশে রাত্রেই ফোনে খবর এলাে ঢাকার । বিস্ময়ে বিমূঢ় সবাই। কিন্তু ঝিনাইদহের পুলিশের বড়কর্তা, দারােগা কাঞ্চনবাবু আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র। জীপে জীপে বেরিয়ে পড়লেন সবাই পথে। সময়টা বড় বেখাপ্পা। ইসকুল-কলেজ সব বন্ধ। ছাত্রশিক্ষক অনেকেই গ্রামের বাড়িতে । হসটেলে বা কাছাকাছি যারা ছিল, ছুটে এল। হানাদারদের ঠেকাবার জন্য সে কী প্রাণের অঙ্গীকার। কাছাকাছি জায়গাগুলি ছাড়া অন্য কোন জায়গার খবর তাে পাইনা। আকাশবাণীর। খবর একমাত্র সম্বল। যুদ্ধ চলবে। দীর্ঘকাল ধরে চলবে। বাংলাদেশকে শ্মশান করেও ইয়াহিয়া থাকতে চাইবে। বুঝতে পারছােনা এক মাসের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। ওখানকার নাগরিকদের আকাশ বাণীর খবর। শুনতে দেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে শিল্পীদের গান-পয়েন্টে কাজ করানাে হচ্ছে।

বাংলাদেশে আজ যা ঘটেছে, তা ওদের অনেক দিনের পরিকল্পিত। পঞ্চাশে পারেনি। চৌষট্টিতে সফল হতে পারেনি পুরাে । আজ পারছে। “আমি কেন এলাম? এক পঁচিশ থেকে আর এক পঁচিশ। একমাস আমি ঝিনাইদহে ছিলাম। ঝিনাইদ’তাে মুক্ত অঞ্চলই ছিল। আজ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কিছুটা অন্তত সুযােগ করে দিতে চাইছে- চাচ্ছি এখানকার তরুণদের বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারি কিনা। ওখানে থাকলে ছাত্ররা আমার জন্য প্রাণ দিত । কিন্তু একার জন্য অনেক প্রাণ। কেন যাবে। ওরাই তাে আমাকে সীমান্ত পার করে দিয়ে গেল। আমি কথা দিয়েছি আবার ফিরে যাবাে। যুদ্ধ তাে চলবে। মুক্তিসেনার প্রয়ােজন বাড়বে দিনের পর দিন।” সন্তোষের অধ্যাপক সন্তোষ দেবনাথের চোখের অনুজ্জ্বলতা কখন কেটে গিয়ে জেগে উঠেছে দৃঢ় প্রত্যয়। কণ্ঠে প্রদীপ্ত শপথের সুর। সন্তোষ-জগন্নাথ হলের সেই নিরীহ শান্ত বন্ধুটির মধ্যে এ কী বাঁচার উন্মাদনা। এ কী আগুন।

৩ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা