বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১১ই সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ২৫শে ভাদ্র, ১৩৮০
নিপীড়িত বিশ্বের একতা দৃঢ় হোক
বিতর্ক এবং সে থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছিল চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া কোন কোন রাষ্ট্রে নায়েকের বক্তৃতা থেকেই। মূল উদ্দেশ্য তাদের যাই থাক সেটা যে জোট নিরপেক্ষতার বাস্তব দর্শন এবং তার অগ্রযাত্রায় অন্তরায় সৃষ্টির সহায়ক হতো তা বিশ্বের শান্তি এবং স্বাধীনতাকামী শক্তি মাত্রেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শীর্ষ সম্মেলন যখন এমনি বিভ্রান্তিতে দ্বিধাগ্রস্থ তখন বক্তব্য রাখলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বললেন, পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বের কোন অস্তিত্ব নেই। আজ গোটা বিশ্ব যে দু’অংশে বিভক্ত তার একটি নিপীড়ক আরেকটি নিপীড়িত। এই নিপীড়িত বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতার কথা ঘোষণা করে তিনি বলেন, যতদিন না পৃথিবীর বুক থেকে সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী এবং বর্ণবৈষম্যবাদী শক্তি মুছে যায় ততদিন মুক্তিকামী জনতার পাশে বাংলাদেশ থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য যেভাবে অভিনন্দিত হয়েছে তাতে করে একটি কথা প্রতীয়মান হয় যে শত বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদানকারী অধিকাংশ রাষ্ট্র নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু চ্যাটের অপেক্ষায় তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করে তাকে বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তির সাথে সংহতি প্রকাশ করে নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামে অংশগ্রহণ বলে অভিহিত করেন।
বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহকে নিজেদের সম্পদ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা একীভূত করে ক্ষুধা-দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের বিরুদ্ধে সুসংহত এবং সুসমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণের আহ্বান জানান। পৃথকভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে এই দেশ সমূহ যে সকল সমস্যার মোকাবেলা করছে তার সমাধান করার জন্য বঙ্গবন্ধু আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহের মধ্যে কার্যকরী অর্থনৈতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের মূল লক্ষ্য অর্জনের নূতন দিকদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমরা আশা করি। হঠকারিতা এবং বিভ্রান্তির কুয়াশা ভেদ করে উন্নতশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ সামাজিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য অতঃপর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে আসবে বলে বিশ্বের প্রগতিশীল শান্তি ও স্বাধীনতাকামী মানবসম্প্রদায় কামনা করে। নিপীড়িত এবং প্রগতিশীল বিশ্বের একতা দৃঢ় হোক, ত্বরান্বিত হোক তাদের অগ্রযাত্রা।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তি
জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দানের আহ্বান জানিয়ে সুপারিশকৃত খসড়া প্রস্তাবটি রাজনৈতিক কমিটিতে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছে। সম্মেলনে গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষে আর একটি কূটনৈতিক বিজয় বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রাচ্যের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব আরো দৃঢ় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় আরো বিস্তৃতি লাভ করলো। ইতিপূর্বে কমনওয়েলথ সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি বিশিষ্ট স্থানের উত্তীর্ণ করেছে।
বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব -এই হচ্ছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। এবং সে কারণেই সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে বাংলাদেশ সবসময় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলে বঙ্গবন্ধু বারবার ঘোষণা করেছেন। এবং একই কারণে কোনো বিশেষ মহল বা বৃহৎ শক্তির আয়ত্তাধীনে জোটভুক্ত হয়ে থাকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ। একথা আরো দিনের আলোর মতো সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে বিশ্বের কনিষ্ঠ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ সংস্থার সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে।
শুধু তাই নয়। বাংলাদেশে মানবতার পক্ষে সর্বদা সোচ্চার। এবং সে কারণেই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির নিরসনকল্পে কেবলমাত্র মানবিক কারণেই বিগত স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আটক যুদ্ধাপরাধীদের ছাড়া সকল যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। শুধুমাত্র মানবিক কারণেই বাংলাদেশ-ভারতের এই যুক্ত ঘোষণা করেছে। পরিশেষে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ মতানুসারেই উপমহাদেশের মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য অতিসম্প্রতি পাক-ভারত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দিল্লি চুক্তি অনুসারে এখন উপমহাদেশের সমস্যাবলীর সমাধান ঘটবে বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি।
বাংলাদেশ শান্তিকামী দেশ। শান্তিকামী বলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন বাংলাদেশের স্বরূপ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সে কারণেই বাংলাদেশ মাত্র বাইশ মাসের মধ্যে একশ’রও বেশি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ না পেলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভের সমর্থ হয়েছে। সুতরাং এখন আর জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। সর্বশেষ আলজিয়ার্সে সমাপ্ত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সম্মেলনে সেই কথাই আবার নতুন করে বলিষ্ঠভাবে ঘোষিত হ’ল।
অতএব আমরা আশা করছি জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বিশিষ্ট্য ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবে।
চিলির প্রতি সংহতি -বুলগেরিয়ার জাতীয় দিবস পালন
চিলির সংগ্রামের সঙ্গে গত পরশুদিন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে সংহতি ঘোষণা করা হয়েছে। পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে এই সংহতি জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেছেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি ও সরকারের কৃষিমন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ। শান্তি পরিষদের নেতৃবৃন্দ সভায় চিলির সরকার ও জনগণের সংগ্রামের স্বপক্ষে তাদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। গত রোববার বুলগেরিয়ার জাতীয় দিবস পালিত হয়েছে ঢাকায়। বাংলাদেশ-বুলগেরিয়ার মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে আয়োজিত এই মহতী অনুষ্ঠানে সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা হয়েছে। বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা দিবস পালন করতে গিয়ে মৈত্রী সমিতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে বুলগেরিয়ার মানুষ ও সরকারের প্রতি। কেননা বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুলগেরিয়ার সরকার ও জনগণ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন যুগিয়েছিল। একইভাবে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলিও আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বন্ধু দেশ। ডঃ সালভাদর আলেন্দে চিলির মহান নেতা। তার সুমহান নেতৃত্বে চিলি বাসীরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছে আজও করছে। ডঃ আলেন্দে চিলির মুক্তিদূত। তার মহান ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুনে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহ আজ বিপর্যয়ের মুখে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিকার সঙ্গে চিলির মিল রয়েছে অনেক। চিলিতেও যেমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ওঁৎ পেতেছে, বাংলাদেশের মাটিতেও তেমনি মার্কিন সাম্রাজ্যের প্রতিক্রিয়াশীলতার লেবাস পড়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছে। চিলির বুকে আজ মার্কিন সমর্থনপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীলরা যেমনি চরম হুমকি দিচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতেও তেমনি স্বাধীনতার শত্রুরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে। সেকারণেই চিলির মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম। বিশ্বের যেখানেই মুক্তিকামী মানুষ তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে সংগ্রাম করবে বাংলাদেশ সাংবিধানিক দায়িত্ব মনে করে তাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন যোগাবে।
বিশ্বের প্রথম গতিশীল দেশ সমূহ ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়ন আজ অপরিহার্য। সে দেশের মানুষের সঙ্গে সে দেশের সমাজ গঠন ও সমাজতন্ত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের পরিচিত হতে হবে। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সে কারণেই সমাজতান্ত্রিক দেশ ও প্রগতিশীল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময় যেসকল তৎপরতা চালাচ্ছে আমরা তাকে অভিনন্দিত করি। তবে এ তৎপরতা আরও জোরদার ও কার্যকরী হতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক