You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা | আমীর-উল ইসলাম এর ভাষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ - সংগ্রামের নোটবুক

আমীর-উল ইসলাম

৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর আমি যখন ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই, তখন বিভিন্ন আন্দোলন এবং সাংগঠনিক তৎপরতার মাঝে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়। সে সময় ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক রূপ নিচ্ছে এবং সেখানে পেছন থেকে জিনিসটাকে সংগঠিত করবার ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। আমার মনে পড়ে, ‘৫৪ সালে নির্বাচন করবার পর তিনি যখন নির্বাচিত হয়ে এলেন তখন কোন এক সংবর্ধনা সভায় এবং তারপর কারকুন বাড়ি লেনে এক বাড়িতে তার সাথে পরিচয় হয় এবং আমি তার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হই। তখন তিনি খুবই তরুণ, বিয়ে করেননি, সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত এবং সংসদ সদস্য হয়ে এসেছেন। সেই সময় আমি ছাত্র লীগের কর্মী আর তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। কাজেই আমাদের কিছু দূরত্ব হয়ত ছিল। তারপর ‘৫৪-র নির্বাচনের পর ৯২-ক ধারা জারি হলে আমাদের অনেককে বন্দি করা হয়। জেল থেকে বের হবার পর সংবর্ধনা সভা হয় ফজলুল হক হলে। সেখানে কয়েকজন রাজবন্দি যারা সদ্য ছাড়া পেয়েছেন তাদের সংবর্ধনা হয়। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার পুনরায় দেখা । এইভাবে বিক্ষিপ্তভাবে তার সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযােগ ঘটেনি। তারপর আমি ‘৫৬ সালে বিদেশে চলে গেলাম পড়াশােনা করতে, ‘৬৬ সালে ফিরে এলাম। দেশে ফিরে এসে আমি ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কে যে বাসা ভাড়া নেই সেখান থেকে তাজউদ্দীন সাহেবের বাসা খুবই কাছে ছিল ।সেই সময় সকালবেলা হাঁটতে বের হলে কখনাে কখনাে তাঁর সাথে দেখা হত, কথা হত। দু’জনের মধ্যে আলাপ-আলােচনা হত। কিন্তু তখনও সম্পর্ক খুব একটা ঘনিষ্ঠতার রূপ নেয়নি। ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিল তখন, যখন আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর একজন কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করতাম। আইয়ুব খান ‘৬৮-র শেষের দিকে অথবা ‘৬৯-এর প্রথমদিকে একটা গােল টেবিল বৈঠক করবার প্রস্তাব পাঠালেন—মাধ্যম নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব ঢাকাতে এসে এই প্রস্তাব নিয়ে সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ছিল তাঁরা কনফারেন্সে যাবেন না। এই ব্যাপারে একদিন মামলার বিরতির সময় বঙ্গবন্ধুকে সালাম খান সাহেব বললেন যে, তােমরা যদি গােল টেবিল বৈঠকে না যাও, জেলখানায় তােমাকে সারা জীবন পচতে হবে। তাতে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত রেগে যান এবং বললেন, ‘আপনার মামলা করার দরকার নাই। আমি পাশেই ছিলাম, আমাকে ডেকে তিনি বললেন যে, “তােমরা যেটা পার সেটা কর, আমার দরকার নেই এত বড় উকিল দিয়ে মামলা করানাের।’ তখন আমি বললাম, ‘মুজিব ভাই, তাঁরা চাচ্ছেন যে আপনি রেগে যান এবং গােলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত আপনি করে বসেন, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব তারাই করতে পারেন। সেই দিনের মত মামলার কার্যক্রম শেষ হবার পর আমি সেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আবার দেখা করি। সেলের পেছনের দিকে রেডিও ছেড়ে আমরা আলাপআলােচনা করতাম যাতে আইবি-র লােকরা শুনতে না পায়।

বঙ্গবন্ধুকে আমি বললাম, “এই বৈঠকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু হওয়া দরকার পূর্ব বাংলার ছয় দফা, স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং তার সাথে সাথে এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং আপনার মুক্তি। এইগুলাে গােল টেবিলের সামনে আনা কর্তব্য। এখনই যদি বলে দেন যে যাবেন না, তাহলে এই কথাটি উত্থাপন করার সুযােগ পাওয়া যাবে না। অতএব যাবেন না, এই কথাটি বৈঠক যেদিন হবে এর আগের দিনও বলতে পারেন। তাই এই মুহূর্তে না বলবেন না।’ তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কী করা যায় ? তুমি কী করতে পার, কী করতে বল?’ আমি বললাম, আপনার সেইরকম কোন লােক আমি দেখছি না।’এর চাইতে বেশি কিছু বললাম না। কারণ আমি জানি মােশতাক সাহেব তখন কপ (সম্মিলিত বিরােধী দল)-এর সেক্রেটারি হিসেবে নিজেকে সামনে নিয়ে আসার ব্যাপারে চেষ্টা করছেন, এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বা আমাদের ছয় দফার ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমি লক্ষ্য করিনি। অপর সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব তখন ময়মনসিংহে থাকেন। ঠিক জাতীয় ক্ষেত্রে ওই রকম একটা ভূমিকা পালন করবার মত অবস্থা, পরিস্থিতি, সময়, সুযােগ কোনটাই তার সে সময় ছিল না। তখন অনেক ভেবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীনকে মুক্ত করাতে পারলে গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দিতে রাজি হতে পার। একটি দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দু’জনই যেখানে বন্দি আছে, সেখান কী করে আমরা গােল টেবিল বৈঠকে যাব? তাকে ছাড়তে হবেএই শর্তে গােল টেবিল বৈঠকে যাবার কথা তুমি আলােচনা করতে পার।’ বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে আমি সােজা তৎকালীন শাহবাগ হােটেলে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) নসরুল্লাহ সাহেবের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, যে তিনি খুব ভগ্নমনােরথ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর জিনিসপত্র সব প্যাক হয়ে গেছে, তিনি এয়ারপোের্টে যাবেন। যেহেতু আওয়ামী লীগ গােল টেবিল বৈঠকে যেতে রাজি হয়নি সে কারণে এটা খুব ফলপ্রসূ হবে না—এ রকম একটা ধারণা নিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। আমি রুমে ঢােকার সাথে সাথে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কোন খবর আছে কিনা। আমি তাকে বললাম, আমি আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই।’ তখন তার রুম থেকে সবাই আগেই এয়ারপাের্টের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। রুমে তিনি থাকলেন, তার হুক্কা থাকল, আর সাথে আমি।

কিছু কথা আমি হােটেলের রুমে বললাম, আর কিছু কথা একটি ভাড়া করা ট্যাক্সিতে বসে এয়ারপাের্ট যাবার পথে। আমি বললাম, “যদি তাজউদ্দীন সাহেবকে বের করে আনা যায় তাহলে গােল টেবিল বৈঠকে যাবার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি দু’জনই যেখানে জেলে তখন সিদ্ধান্ত হতে পারে না।’ তিনি বললেন, “ঠিক হ্যায়।’ এয়ারপাের্টে গিয়ে আমাকে বললেন, বসাে, আমি আসছি।’ তিনি ফোন করতে গেলেন। টেলিফোন করে এসে আমাকে বললেন, কাল সন্ধ্যার আগেই তাকে (তাজউদ্দীন) বাসায় পাওয়া যাবে।’ পরদিন ঠিকই সন্ধ্যার পরে আমি এসে দেখি যে তাজউদ্দীন সাহেব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছেন।কর্নেল নাসের তাজউদ্দীন সাহেব আর আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেখানে বন্দি ছিলেন সেখানে পৌছে দিলেন। তারপর আমরা তিনজন মিলে আলাপ করি আমাদের কৌশল কী হবে, গােল টেবিল বৈঠকে কীভাবে আমরা আমাদের দাবিগুলাে নিয়ে ধাপে ধাপে এগুতে থাকব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার দাবিটা সামনে আসবে, তারপরে আমরা গােল টেবিল বৈঠকে যাব। এইভাবে তিনি ব্রিফ করলেন, সেই ব্রিফ নিয়ে তাজউদ্দীন ভাই এবং আমি ফিরে এলাম। আমাদের লাহাের হয়ে পিন্ডিতে যাবার কথা, আমি আগেই লাহাের চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে লাহাের বার এসােসিয়েশন এবং আজগর খান এদের সাথে লবি। করলাম। আজগর খান একটা বিবৃতিও দিলেন যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা দরকার। কাসুরি সাহেব ও অন্যান্য নেতারা এতখানি উৎসাহিত ছিলেন না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ব্যাপারে। তারপর তাজউদ্দীন সাহেব পিন্ডিতে এলেন। এর আগেই ড. কামাল হােসেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উকিল নিযুক্ত হয়েছেন। এখন ড. কামাল হােসেন, তাজউদ্দীন সাহেব, আমি—আমরা তিনজন মিলে এই লবির মূল কাজটা করছি। ইতােমধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, মান্নান সাহেব, ময়েজউদ্দিন সাহেব, সামসুল হক সাহেব, মােস্তফা সারােয়ার এঁরা এসে গেছেন। লাহাের এবং পিন্ডিতে আমরা কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আইয়ুব খানের আইন মন্ত্রী এস, এ. জব্বারের সাথে আমরা লিয়াজো রক্ষা করতাম।

জব্বার সাহেব আমাদেরকে বলেছিলেন যে, তিনি চেষ্টা করছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এনে গােল টেবিল বৈঠক করা যায় কিনা। তিনি এক গভীর রাতে এসে বললেন, “আমার হাত ঠাণ্ডা কারণ আমি এটা করাতে পারছি না এবং ঘটনা অন্যদিকে মােড় নিচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘এই পর্যন্ত রাজি করানাে গেছে যে শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। সে সময় গােল টেবিল বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একটা অনমনীয় মনােভাব ছিল। আবার এদিকে পত্রপত্রিকায় এটাই আসছে যে, আওয়ামী লীগের অনমনীয় মনােভাবের জন্য বােধ হয় গােল টেবিল বৈঠক ভেঙে যাচ্ছে, বা সাংবিধানিক যে সঙ্কট, এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ করে ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভােটএর ভিত্তিতে পাকিস্তানের একটা সংবিধান রচনা করা বা গণতন্ত্রায়ন করার যে সম্ভাবনা সেটা আওয়ামী লীগ ভেঙে দিচ্ছে—এই রকমভাবে প্রচার হচ্ছে। তখন বােধ হয় কোরবানির ঈদও আসন্ন। করাচীর কাগজ এবং পথেঘাটে এ রকম কথাহচ্ছে, এবার আওয়ামী লীগ এত কোটি লােককে কোরবানি দেবে—এই রকম মিথ্যা প্রচার চলছে। আবার এদিকে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আইয়ুব খানের সরকার আস্তে আস্তে ক্ষমতাচ্যুতির দিকে এগুচ্ছে ইসলামাবাদে, করাচীতে, লাহােরে আইয়ুবের বিরুদ্ধে স্লোগান, মিছিল চলছে। পূর্ব বাংলাতেও এই রকম আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলন দারুণভাবে দানা বেঁধে উঠেছে। ইতােমধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। ক্যান্টনমেন্টে অত্যন্ত টেনশান হচ্ছে বাঙালিদের ভেতরে। সেই রকম পরিস্থিতিতে দুটো ভাগে বিভক্ত আর্মিকেও একটা মীমাংসার দিকে আনা হচ্ছে এবং তারা আরাে হার্ডলাইন-এর দিকে চলে যেতে পারে। এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযােগীদের জীবননাশ করবার একটা ষড়যন্ত্র বা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র, বা এটা ছাড়াও ক্যান্টনমেন্টে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সৃষ্টি করে হত্যার গুজব অর্থাৎ নানা প্রকারের একটা গুজবে গােলযােগ সৃষ্টি করতে চাওয়া হচ্ছে।

সেই সময় আমাদেরকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এদের কাছ থেকে প্যারােলের প্রস্তাব পেয়ে তাজউদ্দীন সাহেব, ড. কামাল হােসেন, আমি—আমরা তিনজন ঠিক করলাম তাদের প্যারােলের প্রস্তাবে আমরা। যদি হ্যা বা না কোনটাই না বলি, বলি যে, ঠিক আছে, আমরা ঢাকাতে যােগাযােগ করি, তাহলে আমরা একটা রিজনেবুলনেস্ দেখালাম এবং একই সাথে সময় পেলাম। আলােচনা যখন প্রায় ভেঙে যাচ্ছে, তখন তাজউদ্দীন সাহেব সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে বললেন যে, আমরা এই প্যারােলের প্রস্তাব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কাছে যাচ্ছি, তিনি কী বলেন শুনতে হয়। কিন্তু এতে তার সহকর্মী মােশতাক সাহেব, নজরুল ইসলাম সাহেব কিছুটা অসন্তুষ্টই হলেন। কারণ তাঁদের কাছে একটা ব্রিফ-ই ছিল যে, হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে হবে, আর না হলে আমরা এখনই বাড়িতে ফিরে যাব। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব খুব ঝুঁকি নিয়ে বললেন যে, আমরা ঢাকাতে যাব, গিয়ে এই প্রস্তাব শেখ সাহেবকে বলব, তিনি কী সিদ্ধান্ত দেন সেটা আমি এসে আপনাদেরকে জানাব। এই যে একটা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় সেই অবস্থার সম্পূর্ণ ডায়মেনশনটা বুঝে একটা যে ডিপ্লোম্যাটিক মুভ তিনি নিলেন, এতে তাঁকে অনেক অপ্রীতিকর কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তী পর্যায়ে। এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছে যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে নিয়ে আসবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধেও এই কথা প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব, কামাল সাহেব, আমি,—পরিষ্কার ছিলাম আমাদের বিবেকের কাছে। আমাদের যে চিন্তা বঙ্গবন্ধুর সাথে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলের বিষয়ে যে কৌশলের কথা বলেছিলেন, সেইভাবেই আমরা এগিয়েছিলাম । ঢাকায় ফিরে আসার পর আমরা তিনজন মানিক মিয়াকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাই। মানিক মিয়া এবং তাজউদ্দীন সাহেব সেলের ভেতরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বললেন আর আমরা দু’জন বাইরে অপেক্ষা করলাম এবং সেদিন ওই কথাই নিয়ে আসা হল যে, তিনি প্যারােলে যেতে রাজি নন।

অর্থাৎ এই যে সময়টা আমরা পেলাম তার ফলে আমরা যে আলােচনা ভেঙে দিচ্ছি এই রকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হলাম না। আবার এদিকে সরকারও সময় পেল তারা কতটুকু নতি স্বীকার করবে বা না করবে সেই বিষয়ে ভাববার। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, স্বৈরাচারদের একটা মজার ব্যাপার আছে, তারা যখন একবার ছাড় দিতে শুরু করে তখন তাদের সম্পূর্ণটাই মেনে নিতে হয়, বিকল্প থাকে না। এটাও তখন আমরা আলাপ করেছিলাম।

তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমরা একমত হয়েছিলাম যে, পাকিস্তানিরা একবার যখন ছাড় দিতে শুরু করেছে তখন এটা যদি আমরা একটু ধরে রাখতে পারি তবে সম্পূর্ণটাই অর্জন করতে পারব। কিন্তু আমাদেরকে এখন এমনভাবে চলতে। হবে যেন ঘটনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা নিয়ে যেতে পারি। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন দেখি পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে বেইল পিটিশন মুভ করবার চেষ্টা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু অথবা আমরা কেউ জানি না এই সম্বন্ধে, অথচ রেডিওতে প্রচার হয়ে গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান বেইল নিয়ে গােল টেবিল বৈঠকে যাচ্ছেন। ইতােমধ্যে ঢাকা শহরে বিরাট মিছিল শুরু হয়ে গেছে। লােকজন আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ধাওয়া করে। ওদের অপপ্রচার এবং দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাজউদ্দীন ভাই এবং আমাদের সঙ্গে আলােচনা করে বঙ্গবন্ধু তখন খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন যে, না, আমি যাব না। কারণ এই যে প্রচার হচ্ছে, এটা আমাকে শেষ করবার জন্যে হচ্ছে। এরপর বেইল পিটিশনের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেল। তার পরদিন সম্পূর্ণভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর ঠিক হল আমরা বড় আকারের জনসভা করে তারপর লাহােরে, ইসলামাবাদে যাব। সেই জনসভা হল বােধ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ওখানেইতখন কীভাবে বিন্যস্ত হয়ে আছে সে সম্পর্কেও তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন। ড. কামাল হােসেন এবং আমি যদিও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন সদস্য বা কর্মকর্তা নই, কিন্তু তখন তাজউদ্দীন সাহেবই মূলত আমাদেরকে দলের সহযােগী হিসেবে কাজ করানাের ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। এবং আমাদের যত কথা, আলাপ-আলােচনা, চিন্তা-ভাবনা, এটা আমরা তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়েই করতাম । তারপর বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ ব্রিফিংটা তাজউদ্দীন সাহেব দিতেন। কারণ তার রাজনৈতিক অবস্থান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, পার্টির অবস্থান এবং সমস্ত ব্যাপারে তাঁর নিজের যে অভিজ্ঞতা এবং সামগ্রিক অর্থে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। ইসলামাবাদে গিয়ে আমরা একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা এত ব্যাপক রূপ নিয়েছে যে আইয়ুবের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে আর্মি চীফ ইয়াহিয়া খান খবর পাঠালেন যে তিনি ড. কামাল হােসেন, বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারি মওদুদ আহমদ এবং আমার সাথে দেখা করতে চান (বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাবার পর মওদুদ আহমদ তার পিএস হয়েছেন)। পরবর্তীতে তিনি। বঙ্গবন্ধুর সাথেও দেখা করবেন এই রকম একটা ধারণা দিয়ে খবর পাঠালেন। আমরা তিনজন তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘যান, গিয়ে শুনে আসুন কী বলে।’ আমরা যাবার পর অনেক কথার মধ্যে ইয়াহিয়া খান যে কথাটা বললেন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তার সাথে আইয়ুব খানের কথাবার্তা হয়ে গেছে। সে সময় এমন একটা অবস্থা ছিল যে আইয়ুব খানও ইয়াহিয়া খানকে দেখে ভয় পাচ্ছিলেন এবং ইয়াহিয়া খানও আইয়ুব খানকে ওয়াচ করছিলেন—অর্থাৎ কামান দু’দিকেই তাক করা ছিল এবং একটা বােঝাপড়াও হয়ে গেছে।

এখন হয় আইয়ুব খান এই সমস্যার সমাধান করবেন, আর না হলে তাঁকে টেক ওভার করতে হবে। এটা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমি তখন বয়সে তরুণ। আমি বলে ফেললাম, ‘সংবিধান তাে আমি পড়েছি, কিন্তু সংবিধানে চীফ অফ স্টাফের কোন দায়িত্ব আছে বলে আমি জানি না।’ তখন তিনি আমাকে বললেন ‘আই সী। আই অ্যাম লাইক আ ব্রুডিং হেন—যখন বিপদ আসে তখন মুরগির সব ছানাকে আমার পাখার তলে নিতে হবে। আমরা এখন সেইরকম একটা বিপদের সম্মুখীন। সংবিধানে লেখা না থাকলেও এটা আমার একটা দায়িত্ব।’ তিনি যা বলতে চাইলেন তা হচ্ছে, দু’জন লােকই এখানেরাজনীতি করছেন, একজন হচ্ছেন দৌলত আনা আর একজন হচ্ছেন আইয়ুব খান। এখন দৌলত আনা এবং আইয়ুব খানের সাথে যদি বঙ্গবন্ধু বােঝাপড়া করে নিতে পারেন, তাহলে ঠিক আছে; আর না হলে তাকে আবার দায়িত্ব পালন করতে হবে। অতএব মার্শাল ল’ বা মিলিটারি যে আসছে এই রকম একটা ইঙ্গিত তাঁর কাছে ছিল। আমরা ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেবকে সবিস্তারে জানাই যে, এই রকম একটা অবস্থা চলছে। আমরা তখন চেষ্টা করছিলাম চোখ-কান সব চতুর্দিকে ভােলা রাখতে এবং তাজউদ্দীন সাহেব আমাদেরকে ঠিক সেইভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যাতে আমাদের জানা থাকে যে মিলিটারির ভেতরে-বাইরে কী হচ্ছে, এখানে মুসলিম লীগের লবিতে কী হচ্ছে, অন্যান্য দল কীভাবে চিন্তাভাবনা করছে। আর ভুট্টোর পিপলস্ পার্টির কৌশলটা কী। কারণ ভুট্টো খুব হার্ডলাইন প্লে করার চেষ্টাতে ছিলাে—আইয়ুবকে সরিয়ে দিতেই হবে এবং তার সাথে কোন বােঝাপড়া করে কোনরকম সমঝােতা হােক এটা তিনি চাচ্ছিলেন না। আর একদিকে আমরা কোন ফাঁদে না পড়ে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থটা কীভাবে সংরক্ষিত হয় এই বিষয়টিতেই অবস্থান করছিলাম। এই ব্যাপারে নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, কিন্তু বিষয়টি পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন সাহেব।

আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানাতে বসেও তার বিশ্বস্ত এবং যােগ্য লােক হিসেবে যার কথা মনে করেছেন তিনি তাজউদ্দীন। সে জন্য তাজউদ্দীনকে বের করা তাঁর প্রথম দায়িত্ব—তাঁকে দিয়েই এই কাজগুলাে করানাে যাবে। পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হবার পরও তাজউদ্দীনের উপরই সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে নির্ভর করতেন, তাঁর সাথে সমস্ত পরামর্শ করতেন। এই যে পরামর্শ এবং আলাপ-আলােচনার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া, এটা স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এটা বড় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর (জানুয়ারি ‘৭২) তাজউদ্দীনের সাথে আলাপ-আলােচনা করে সমস্ত কাজগুলাে করবার যে পদ্ধতি, এই পদ্ধতিটা, এই প্রক্রিয়াটা আর কার্যকর থাকেনি। এটাও দুঃখজনক, আমাদের যে সহযােগিতা ছিল দুই নেতার সম্মিলিত চেষ্টার ব্যাপারে, তিনি ফিরে আসার পর সেটাও আর অব্যাহত থাকেনি।

এদিকে সেই সময় (১৯৬৯) একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে একটা প্রচণ্ড প্রচারণা শুরু হয়েছে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে নিয়ে যেতে চাইছিলেন এবং এভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নষ্ট করার প্রচেষ্টা তার ছিল। আমরা তখনও লক্ষ্য করেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের যে এত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, এত বিশ্বাসের সম্পর্ক, এটা কোন না কোন কারণে তার কিছু বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন এবং কিছু লােক ভাল চোখে দেখত না। অথচ তাজউদ্দীন সাহেব সেই ঘােলাটে পরিস্থিতির সর্বদিক বিবেচনায় রেখে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিপক্ক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পুরাে পরিস্থিতিকে মােকাবেলা করছিলেন। এমনকি মাথায় এই চিন্তাও ছিল, হয়ত বঙ্গবন্ধুকে খুন করে ফেলবে—পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র চলছে। যাহােক, প্রথম গােল টেবিল বৈঠক যেটা হল তাতে একটা আশার উদ্রেক হল। তারপর ঈদের জন্য আমরা ফিরে এলাম। ঈদের পর আবার গােল টেবিল বৈঠক হল। সেখানে বলা হল, ছয় দফার ভিত্তিতে এমন একটা সাংবিধানিক রূপরেখা পাওয়া যায়, যেখানে রাষ্ট্রকে এক রেখেও পূর্ব পাকিস্তানে যদি আলাদা মিলিশিয়া এবং আলাদা মুদ্রা থাকে, কোন অসুবিধা নেই। এই যুক্তিগুলাে দাঁড় করানাের ব্যাপারে, এইগুলােকে প্রস্তাব আকারে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবের খুব অনন্য ভূমিকা ছিল।

এর প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বলা হল যে, ঠিক আছে, আপনারা ঢাকায় গিয়ে সংশােধনী প্রস্তাব পাঠান যে ১৯৬৩-র সংবিধানের কী কী সংশােধন আনলে এটাকে আপনারা আপনাদের ছয় দফা বলে মনে। করবেন। ঢাকায় এসে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাড়িতে আমরা বৈঠকে বসি এবং কামাল হােসেনের বাড়িতেও অনেকগুলাে বৈঠক হয়। প্রতিটি বৈঠকে তাজউদ্দীন সাহেব সার্বক্ষণিকভাবে থাকতেন। আর বঙ্গবন্ধুও কখনাে কখনাে আসতেন। এক ঘণ্টা। দুই ঘণ্টা তিনি থাকতেন, আবার চলে যেতেন। আমাদের অগ্রগতিটা দেখেশুনে তার মতামত দিয়ে যেতেন। সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে ড. কামাল হােসেন, তাজউদ্দীন সাহেব, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. নূরুল ইসলাম, রেহমান সােবহান, শামসুর রহমান খান জনসন, রুহুল কুদ্স সাহেব উপস্থিত থাকতেন। এভাবে একটা খসড়া তৈরি করা হয়, যে খসড়াটা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দেয়া হয় ইসলামাবাদে নিয়ে যেতে। ইতােমধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। চারিদিকে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে কিছুদিন পর ইয়াহিয়া খান বললেন, এক ব্যক্তি এক ভোেটএর ভিত্তিতে একটা নির্বাচন দেবেন। তার ভিত্তিতে যে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হল তাতে একটা বিরাট বিতর্ক হল যে, এই মার্শাল ল’-এর অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব কি যাব না। তখন তাজউদ্দীন সাহেবের যুক্তিটি ছিল যে, আইয়ুব খানের কাছে যখন আমরা চাচ্ছিলাম এক ব্যক্তি এক ভােট, সেটাও তাে প্রকৃতপক্ষে একটা সামরিক সরকার ছিল। সেটা ছিল প্রচ্ছন্ন মিলিটারি সরকার, একটা সংবিধানের আবরণে। আর এখন যেটা এসেছে এটা প্রত্যক্ষ মিলিটারি সরকার। কিন্তু পার্থক্য এই দুইয়ের মধ্যে খুব কম। তবে নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, এই নিশ্চয়তা যদি থাকে, তাহলে নির্বাচনে আমাদের যেতেই হবে। এই কারণে যে, এতে একটা বৈধতার সৃষ্টি হবে। আর আমরা যে বৈধ জনপ্রতিনিধি সেটা প্রতিষ্ঠা করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচন। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার বৈধতা অর্জন করার যুক্তিটা সবচাইতে প্রবল ছিল সেই সময়ে নির্বাচনে যাবার ব্যাপারে। এলএফও যেভাবে তৈরি হয়েছিল তাতে নির্বাচনের পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠরাই একটা নির্বাচিত সংসদ হিসেবে একটা শাসনতন্ত্র গ্রহণ করতে পারবেন। এই ক্ষমতাটা যেহেতু একটি নির্বাচিত সংসদকে দেয়া হচ্ছে সে জন্য বলা যায়, এটা সত্যি একটা বড় বিজয় ছিল জনগণের এবং এই আন্দোলনের।

নির্বাচন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল এটা বলতে হবে। যদিও তাদের ভিতরে বিভিন্ন রকমের শক্তি ক্রিয়াকর্ম করছিল। ‘৭০-এর নির্বাচনের আগে যে সাংগঠনিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হল, ওই সময় আমি দেখলাম আওয়ামী লীগের কী রকম শক্তিশালী সাংগঠনিক গাঁথুনি এবং এর নেতৃত্বের বিন্যাস। এটা আমাকে খুব অভিভূত করেছিল এইদিক থেকে যে, আওয়ামী লীগের নেতা বলতে বঙ্গবন্ধু যদিও ছিলেন, কিন্তু তার সাথে যে নেতৃতুটা গড়ে উঠেছিল তারা প্রত্যেকেই এক একটা জেলার সংগঠক হিসাবেই প্রাথমিকভাবে পরিচিত। যেমন, তাজউদ্দীন সাহেব যদিও জাতীয়ভাবে দলের সেক্রেটারি, কিন্তু তার মূল ভিত্তি ছিল এই যে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের একজন বড় সংগঠক। তিনি প্রকৃতপক্ষে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট, আবার ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। চট্টগ্রামের আজিজ সাহেব ছিলেন তখন চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট, তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও ছিলেন। তিনি মারা যাবার পর জহুর আহমদ চৌধুরী নেতৃত্বে এলেন। কামরুজ্জামান সাহেব। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, তিনিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন।যশােরের মশিউর রহমান সাহেব যশাের জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও ছিলেন। খুলনার শেখ আবুদল আজিজ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। কাজ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই নেতা হয়ে গেলাম এমন ছিল না। নেতৃত্বের একটা সুশৃঙ্খল বিন্যাস ছিল। প্রত্যেকে জানতেন তাদের অবস্থানটা কোথায় এবং এটা স্বীকার করেই সবাই নিজ কাজটি করতেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ক্যান্টনমেন্টের সেলে যখন আলাপ করতাম তখন তাকে বলতাম যে, সংগঠনের কী হবে?’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, “কিছু চিন্তা করিস না, আমি বের হলে পরেই সংগঠন দেখবি দারুণভাবে চাঙা হয়ে উঠবে। আমার সমস্ত জায়গায় খুঁটি পোঁতা আছে, তারগুলাে টেনে দিলেই সমস্ত কিছু ইলেকট্রিকে পরিণত হবে।’ এই কথাটা আমি ঠিক সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হবার পর তার কথামতােই ঘটনা ঘটল। তিনি শুধু তারগুলাে টেনে দিলেন আর সেটা একটা বিরাট বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত হল, অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার হয়ে গেল। আমার মনে হয় যে, সংগঠন যে ব্যাপকতা লাভ করেছিল সেটাই পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কনটেইন করতে পেরেছিল।

সংগঠনের দুর্বলতাও ছিল, আবার সফলতাও ছিল। সফলতা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসবার পরে যে ধরনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় বিশাল মাপের নেতা হিসেবে ইমার্জ করলেন সেটা ছিল একটা প্রবল বড় শক্তি। সাথে সাথে তাকে যখন আটক করে ফেলল, তিনি যখন দৃশ্যত বর্তমান নন, সেই সময় একটা বিরাট দুর্বলতা যে, এখন পাওয়ার স্ট্রাকচারটা কী হবে, কার্যপদ্ধতি কী।অতএব আওয়ামী লীগের ভেতরে যে প্রবণতাটা সবসময় ছিল—দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই বাকি সম্পর্কগুলাে গড়ে উঠছিল। সবাই চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুর নিকটে কীভাবে যাওয়া যায়, তার ঘনিষ্ঠ কীভাবে হওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু যতটুকু ডেমােক্রেসি প্র্যাকটিস করতেন, যতটুকু সিস্টেম করতেন বা করাতেন, ততখানিই হত। আর যতখানি তিনি। করতে চাইতেন না ততখানি সংগঠনে হত না। সেটা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। আমার কাছে ভাল লাগে যে, অসহযােগ আন্দোলনের সময় এখানে হাইকমান্ড নামে একটা পাওয়ার স্ট্রাকচার গড়ে উঠে। হাইকমান্ড দলের একজন প্রেসিডেন্ট, তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দু’জন জেনারেল সেক্রেটারি (একজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্পাদক, একজন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)-কে নিয়ে গড়ে উঠেছিল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই ছিল মূলধারা।

বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মােশতাক আহমেদ, মনসুর আলি তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট; তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামরুজ্জামান দু’জন সাধারণ সম্পাদক- এই পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের হাইকমান্ড গঠিত ছিল এবং এঁরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। আমার কাছে যেটা সবচেয়ে ভাল লাগে, বঙ্গবন্ধু কিন্তু ওই সময় এক দৃষ্টান্তমূলক পার্টির কর্মপদ্ধতি চালু করেছিলেন। সেটা আওয়ামী লীগের জন্যে চিরকালের একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা উচিত ছিল—দল পরিচালনা করার জন্য কী ধরনের সাংগঠনিক যােগাযােগ থাকা দরকার সেটা তিনি করেছিলেন। ওই হাইকমান্ডের সাথে আলােচনা না করে বঙ্গবন্ধু কোন। সিদ্ধান্ত সেই সময় নেননি। প্রত্যেকটি ঘটনাতে এবং দিনে বােধ হয় একবার তাে বটেই দুই-তিনবারও তাদের বৈঠক হত। কামাল হােসেন ও আমি ছিলাম টাস্কফোর্সে। তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। এবং প্রয়ােজন হলে হাইকমান্ড আমাদের দু’জনকে ডাকতেন, আর প্রয়ােজন না হলে ডাকতেন না। আর যখন নিগােশিয়েশন শুরু হয় তখন কামাল হােসেন সাহেব নিগােশিয়েশন টিমে ছিলেন, তখন তাঁকে হাইকমান্ডে ডাকা হত । এই ছিল তখনকার হাইকমান্ডের গঠন। অর্থাৎ হাইকমান্ড একটা ছায়া ক্যাবিনেট হিসেবেই কাজ করেছিল। আর একটা ছিল ইয়ুথদের সাথে লিয়াজো করার বিষয়, সেটা বঙ্গবন্ধু করতেন। সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ, শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক এঁরা ছিলেন সেই ইয়ুথ কমান্ডে। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা চলতে থাকে। তারপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং অসহযােগের পর্ব। অসহযােগের সময় দুটো ব্যাপার ছিল—এক, আমাদের প্রতিদিনের কর্মসূচি ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া। কারণ তখন দেশ পরিচালনার ভার এসে পড়ল কার্যত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের উপর । দ্বিতীয়ত, আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী তা নির্ধারণ করা। সে সময়ে তাজউদ্দীন সাহেবের উপর মূল যে দায়িত্ব ছিল সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন কী নির্দেশ যাবে জনগণের কাছে, কী করবে, কী করবে না, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কতটুকু খােলা। থাকবে, কতটুক থাকবে না—এইগুলাে পরিকল্পনা করা, নির্দেশ দেয়া ইত্যাদি। এই কাজে আমরা টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা সহযােগীর ভূমিকা পালন করেছি। আমাদেরকে বিভিন্ন সেক্টরের সাথে বৈঠক করতে হত। ব্যাঙ্কার যেমন ছিলেন, টেলিফোন-টেলিগ্রাফের কর্মকর্তা ছিলেন, ওয়াসা, হাসপাতাল কর্মীরা ছিলেন— এমন সমস্ত সেক্টর ।।তারপর বিভিন্ন জায়গার সমস্যা, যেমন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা—সেখানে আবার দায়িত্ব দিতে হত বিভিন্ন লােকজনদেরকে। প্রত্যেক জায়গায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে, তিনজনকে কনভেনার করে। এই সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয়ভাবে যে সমস্ত সমস্যা হচ্ছে তার সমাধান করত। তারপর যেখানে ক্যান্টনমেন্ট ছিল সেখানে আর্মির সাথে যে সমস্ত দ্বন্দ্বগুলাে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রাম, জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন জায়গায়—সেগুলােকে সংগ্রহ করতে হত। এই সমস্ত নিয়ে সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের একটা আলােচনা করতে হত। ওই আলােচনায় বঙ্গবন্ধুকে সমস্ত কিছু ব্রিফ করতে হত যে, কী হল এবং আমরা কী প্রেসে দিচ্ছি ইত্যাদি। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য ৩২ নম্বরে ২৪ ঘণ্টা টাস্ক ফোর্স থাকত।

১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ২৪/২৫টি দিন আসলে ৩২ নম্বর থেকেই এই অঞ্চলের সমস্ত কিছু পরিচালিত হত। ইতােমধ্যে আমরা কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে, একটা সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তাজউদ্দীন সাহেব এই জিনিসটা খুবই সঠিকভাবে নির্ণয়। করেছিলেন এবং যে কারণে তিনি কিছু ছােট অস্ত্র চালানাের ট্রেনিং নিজে নিয়ে নিলেন। পিস্তল চালানাে অভ্যাস করলেন, একটা পিস্তল তিনি সগ্রহ করলেন। এটা নিয়েই বােধ হয় আমরা কলকাতা গিয়েছিলাম। আর একটা রাইফেলও যােগাড় করলেন। তিনি আমাদেরও বললেন যে, আপনারা এই সব আর্মসের ট্রেনিং নেন, এগুলাের দরকার আছে।’ তিনি খুব পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে, ‘আমাদের সকলেরই একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার। আমরা যেভাবে অতীতে রাজনীতি করেছি, একটা যে রাজনৈতিক ধারা, এবার কিন্তু এটা ভিন্ন প্রকৃতির হতে যাচ্ছে এবং আমরা একটা সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত।’ সে সময় প্রতি রাতেই বিপদের আশঙ্কা ছিল, তাই আমরা রাত্রিতে বাড়িতে থাকতাম না। কামাল হােসেন তখন অপেক্ষাকৃত নবাগত, কাজেই তার যাতে প্র্যাকটিস হয় সে জন্য তাঁকে নিয়ে আমি সাত মসজিদ রােডের একটা বাড়িতে রাত্রিবেলা থাকতাম। কারণ যে কোন সময় আঘাত আসতে পারে। বঙ্গবন্ধুকেও এ ব্যাপারে বলা হলে তিনি এতে উৎসাহিত বােধ করেননি। তিনি বললেন যে, ‘আমি খােলাখুলি রাজনীতি বুঝি, আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারব না। আমাকে কোথায় তােমরা নিয়ে যাবে, আমার কি বাংলাদেশের বাইরে যাওয়া সম্ভব?

বঙ্গবন্ধুর বাসার উপরতলার শােবার ঘরে নিয়মিত হাইকমান্ডের মিটিং হত । এটা খুব ইন্টারেস্টিং যে মােড়ার উপর একটা ছায়া সরকার বসত। যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ে যে ক্যাবিনেট হয়েছিল সেই ক্যাবিনেট থেকে এই ক্যাবিনেট অনেক বেশি ইফেকটিভ, রেসপনসিল, কালেকটিভ ছিল। হাইকমান্ডের সভাতে বলা হল যে, আপনাকে ধরা না দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। এটা ২২/২৩ তারিখের কথা। তাে তিনি খুব অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, আমাকে তােমরা কোথায় নিয়ে যাবে? যেখানে যাবে সেখানে সেই গ্রামকে গ্রাম তারা নষ্ট করে দেবে, গুঁড়িয়ে দেবে। আমাকে তােমরা কোথায় লুকাবে?’ তারপর কথা হল বঙ্গবন্ধু তার একটা বক্তৃতা রেকর্ড করবেন। স্বাধীনতা ঘােষণা সংবলিত সেই বক্তৃতাটা বাজানাে হবে কোন একটা জায়গা থেকে। সে জন্য আমরা অয়্যারলেস ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সাথে একটা আলােচনা করি । এই আলােচনাতেই অয়্যারলেস ডিপার্টমেন্টের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কুষ্টিয়ার খােকা ভাই বললেন যে, এই কাজে যদি আমার জীবনও চলে যায় তবু আমি এটা করব।

খুলনাতে একটা ট্রান্সমিটার আছে, আমি ওটা আনতে পাঠিয়েছি। ওটা এসে যাবে। কিন্তু তাঁকে ২৫ তারিখ রাতেই পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলে। ২৫ তারিখ সকালেও তিনি এসে আমাকে বলে গেছেন যে, তুমি তাে চলে যাবে, আমার কী দায়িত্ব থাকল বল। আমি বঙ্গবন্ধুর দু’চারটে কথায় তার মনের অবস্থা যতটা বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি নিজ জীবনকে নিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন। ঝুঁকি নিচ্ছেন এভাবে যে, আমাকে যদি ধরে নিয়ে যায় তাহলে এটা নিয়ে আন্দোলন হবে এবং সারা দেশে এমন আগুন জ্বলে উঠবে যে, তাতে স্বাধীনতা আসবে। বা, আমাকে যদি ওরা হত্যা করে ফেলে তাতেও এমন আগুন জ্বলবে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। সাে আইদার ওয়ে দি অবজেক্ট উইল বি ফুলফিল্ড়। এটা হয়ত তার মনে ছিল যে অনিশ্চিত যেটা সেটা আমি কীভাবে করতে পারব জানি না, সশস্ত্র বিপ্লব করার আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, কাজেই আমি আনসার্টেন অবজেক্টের মধ্যে নিজেকে কেন ফেলছি ? আমি যদি আমার জীবনটাকে নিয়ে বাজি খেলি তাহলে স্বাধীনতা তাে অটোম্যাটিক্যালি হবেই—তাে তিনি হয়ত সেটা বাজি রেখেছিলেন। এর একটা লজিকও আছে। যুক্তিটা হচ্ছে এই, যে কাজটা তাজউদ্দীন সাহেব বা আমরা করলাম, এই কাজটার ফলাফল কিন্তু অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু তিনি যে কাজটা করেছেন এর ফলাফল কিন্তু খুব নিশ্চিত, কারণ হচ্ছে যে তাঁকে জেলে বন্দি রেখে বা হত্যা করে পাকিস্তান এক থাকবে এটা সম্ভব না।

কিন্তু আমরা যে কাজটি করতে গিয়েছিলাম এতে অনিশ্চয়তা ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ২৫ তারিখে রাত ১২টার আগে, কিন্তু এর আগে একবার আমি রাত ৯টার দিকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির কপি সাইক্লোস্টাইল করে প্রেসে পাঠিয়ে তাকে কপিটা দেখালাম। তখন তিনি দেখে হঠাৎ বললেন, “কে বলে আমি ঘােষণা দেইনি, আমি সব কথাই বলে দিয়েছি। ৭ মার্চে বলেছি, আজকেও বলেছি, সব কথাই বলে দিয়েছি, বাকি কিন্তু আমি কিছু রাখিনি।’ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে যাবার সময় আমি অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ সাহেব এবং তােফায়েলকে ঢুকতে দেখলাম। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আমি তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। তিনি উত্তেজিত হয়ে আছেন, বললেন, “দেশের এই অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আর এই সমস্ত মহিলারা এসেছেন তদবির করতে সংরক্ষিত আসনের জন্য।

তার মধ্যে তিনি তার একটা ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি আবার তখন ওখান থেকে বেরিয়ে পাশের এক বাসায় গেলাম। ক্ষুধাও লেগেছিল, সেখানে কিছু খেয়ে আবার তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি মুরশিদ সাহেব এবং বেগম নূরজাহান মুরশিদ সেখানে এসেছেন। তখন মুরশিদ সাহেবকে বললাম, ‘শহরের অবস্থা খুব ভাল মনে হচ্ছে না, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌছে দেই, তারপর দেখি কিছু ভাবা যায় কিনা। তাঁকে পৌছে দিয়ে আমি আমার বাসাতে যাব, তখন দেখি যে পাকিস্তান আর্মি রেডিও স্টেশন টেক ওভার করছে অ্যাট গানপয়েন্ট, আর্মি শহরে নেমে পড়েছে। তখন আমি কামাল হােসেনের বাসায় গেলাম। কামাল হােসেন তার ৩ নম্বর সার্কিট হাউসের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আহমদুল কবির আর লায়লা কবিরকে বিদায় জানাচ্ছেন। আমি বললাম, বিদায় পুনশ্চ বেশি না করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান, অবস্থা খুব ভাল মনে হচ্ছে না। তারা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠলেন। তারপর কামাল হােসেনকে বললাম, আপনার তাে বাসায় থাকা ঠিক হবে না।’ তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আমি তৈরি হয়ে নেই।’ এবার আমি আমার বাসায় গেলাম। আমার স্ত্রীকে বললাম, আজকে অবস্থা খুব ভাল না, বাইরে চলে যাচ্ছি।’ আরাে দু’চারটে কথা বলে আমি কামাল সাহেবকে নিয়ে বের হলাম। কিন্তু রাস্তা দিয়ে আর যেতে পারি না, কর্মীরা গাছ ফেলে শাহবাগের ওখানে ব্যারিকেড দিয়ে ফেলেছে। কর্মীরা আমাদের চিনল। তারা কিছু কিছু জায়গা খালি করে আমার গাড়ি পার করার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর আমরা গেলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায়। তখন সেখানে কেউ নেই। তাঁকে আগে গেঞ্জি পরা অবস্থায় দেখেছি, তখনও গেঞ্জি পরা অবস্থায় দেখলাম। আমি বললাম, ‘আর্মি সমস্ত শহর টেকওভার করে নিচ্ছে। তিনি বললেন, আমি খবর পেয়েছি, ইয়াহিয়া খান যাবার পর পরই এখানে ধরপাকড়-গােলাগুলি শুরু হবে। তােমরা এখনই আমার বাড়ি থেকে চলে যাও।’

আমি বললাম, আমরা তাে আপনাকে এখান থেকে না নিয়ে যাব না।’ তিনি বললেন, ‘আমি যা বলব, আমার নির্দেশ তােমরা মানতে বাধ্য। আমি তােমাদেরকে কোনদিন কোন আদেশ করি নাই। আমি এই মুহূর্তে তােমাদেরকে আদেশ করছি, তােমরা আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।’ আমরা তখন তার বাসা ত্যাগ করে চলে এলাম সাত মসজিদ রােডে। তাজউদ্দীন ভাই তখন গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে বাগানে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। তাঁকে বললাম, ‘পরিস্থিতি তাে বেশি ভাল না, বেরােতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘বেরিয়ে কী হবে!’ জিজ্ঞেস করলেন, বঙ্গবন্ধু কী বললেন ?’ বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু তাে বেরুবেন না, বললেন যে ইয়াহিয়া খান চলে গেলেই গােলাগুলি শুরু হবে। তখন তিনি আমাদেরকে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনারা দাঁড়ান। তারপর তিনি ভেতরে গেলেন। লুঙ্গি পরাই থাকল, উপরে একটা পাঞ্জাবি পরেছিলেন। হাতে একটা পিস্তল, রাইফেল, একটা কাপড়ের ঝােলা ব্যাগ।

আমরা গাড়িতে উঠলাম, কোথায় যাব এই নিয়ে আমরা যখন নানা রকম চিন্তা করছি তখন কামাল হােসেন খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। এর আগে যখন তাজউদ্দীন ভাই আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গিয়েছিলেন তখনই তিনি বলেছিলেন, তার তাে বের হতে দেরি হচ্ছে, আমাকে একটু পৌছে দিয়ে আসুন।’ আমি তখন বলেছিলাম, সেটা হতে পারে না।’ তারপর যখন তাজউদ্দীন সাহেব বেরােলেন তখনও দেখলাম যে উনি আমাদের সাথে একত্রিত থাকতে চাচ্ছেন না। যখন বঙ্গবন্ধু বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননি তখনই কামাল হােসেনের মনে নানা রকমের দোদুল্যমানতা দেখা দিয়েছিল। তিনি নেমে গেলেন ১৩ নম্বরে, তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সে বাড়ির দরজা খােলে না, গেট খােলে না। আমি বললাম, যদি আপনি যেতেই চান, গেট টপকে চলে যান।’ কথাটি আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম। তার মানে আমি পছন্দ করিনি যে তিনি আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে যান।

তারপর আমি আর তাজউদ্দীন ভাই লালমাটিয়াতে ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ি গেলাম। গফুর সাহেব আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। একটা ঘরে শুধু একটা চৌকি ছিল, আমরা সেই চৌকির উপরে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চৌকিটা ভেঙে গেল এবং প্রায় সেই একই সময়ে বিকট একটা বােমা বিস্ফোরণের শব্দ এল, মনে হল ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে। এই শব্দের সাথে সাথে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে আর্মিরা তখন স্থান নিয়েছিল, তারা গােলাগুলি শুরু করল। ওই গােলাগুলি যখন হচ্ছে চারদিকে তখন আমরা ছাদের উপর গিয়ে দেখার এবং বােঝার চেষ্টা করি কোথায় গােলাগুলি হচ্ছে। গােলাগুলিতে সমস্ত আকাশ দিনের আলাের মত আলােকিত হয়ে যাচ্ছে। কখনাে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, কখনাে মনে হয়েছে পুরনাে ঢাকায়, কখনাে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে অজস্র গােলাগুলি চারদিকে। প্রথমদিকে কিছুটা জয় বাংলা শব্দ পাওয়া গেল। আর মােহাম্মদপুরে বিহারিরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। ছাদ থেকে আমরা এই স্লোগানগুলাে শুনছি।

এক সময় আস্তে আস্তে সেই স্লোগানগুলাে থেমে গেল।এটা বােঝা গেল যে, সারা শহরে একটা হত্যাযজ্ঞ চলছে। মনে হল যে একটা দানবীয় হামলা শুরু হয়েছে। একতরফা আক্রমণ চলছে। আমাদের এমন একটা ধারণা ছিল যে, বােধ হয় আমাদেরকে গ্রেফতার করবে এবং একটা পুরাে মিলিটারি ক্রাক-ডাউন করবে, সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিষিদ্ধ করে দেবে এবং আমাদেরকে এর মােকাবেলা করতে হবে। কিন্তু গণহত্যা শুরু করবে তা আমাদের ধারণা ছিল না। সাধারণ নিরীহ জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহৃত হবে তা আমরা বুঝতে পারিনি। ওরকমভাবে সারারাত কাটল।

২৬ তারিখে সকালবেলা আমি বাথরুমে ঢুকে আমার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি শেভ করে ফেললাম। বেরিয়ে আসার পর তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ‘আমি একজন নতুন মানুষ দেখছি।’ সেদিন থেকেই আমাদের পালাবার অন্য জায়গায় আমরা কীভাবে সংগঠিত করব সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কারণ, দেখলাম যে আর্মির জীপ ওই পাড়াতে চলাফেরা করছে এবং ২৫ তারিখ রাত থেকেই ফিজিক্যাল ইন্সটিটিউটে আর্মি এসে স্থান নিয়েছে। ওখানে একটা টাওয়ার করে সমস্ত এলাকার উপর নজর রাখছে। সেদিন সমস্ত ঢাকা শহরটাকেই তারা চিহ্নিত করে ফেলেছিল যে তারা কোথায় কোথায় স্থান নেবে, এবং সে সমস্ত জায়গায় মিলিটারি পজিশন নিয়ে নিয়েছে। এই রকম সারা ঢাকা শহরেই তারা স্থান নিয়েছিল। আমরা তখন দেখলাম যে, আমরা একটা নাজুক পরিস্থিতিতে আছি। আমরা এমন একটা বাড়িতে আছি যেখানে পরিবারের আর কোন সদস্য নেই। কোন মেয়েমানুষ, কোন ছেলেপেলে কেউ নেই। গফুর সাহেব, তার এক ভাতিজা, আমরা দু’জন—এই চারজন লােক আছি। এখন নিজেরা যদি অন্য কোনরকম একটা অবস্থার মুখােমুখি হই তাহলে কী করব সেটাও আমরা ঠিক করে ফেললাম। গফুর সাহেব হচ্ছেন কন্ট্রাক্টর। তাজউদ্দীন সাহেব নাম গ্রহণ করলেন মােহাম্মদ আলি, আর আমি নাম গ্রহণ করলাম রহমত আলি। মােহাম্মদ আলি সাহেব গফুর সাহেবের ঠিকাদারী কাজটা ওখানে দেখাশুনা করেন। আর আমি পাবনায় থাকি, পাবনা থেকে বেড়াতে এসেছি, কিন্তু এখন আমরা এখানে আটকা পড়ে আছি। এরপর পরবর্তী যে সমস্যা সেটা হল রাইফেল নিয়ে—রাইফেলটাকে আমরা কোথায় কীভাবে রাখব। এই পরিস্থিতিতে ২৬ তারিখ সারাদিনই চলে গেল।

আমরা রাতে রেডিও অস্ট্রেলিয়াতে শুনতে পেলাম যে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের এই অবস্থা সম্পর্কে রেডিও অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যমেই প্রথম বাইরের বিশ্ব জানতে পারল। এরপর বিবিসি এবং ভারতীয় রেডিওতেও শােনা গেল। আর ইয়াহিয়া খানও পাকিস্তান রেডিওতে বক্তব্য দিলেন রাত্রিবেলা। সমস্ত দোষ আওয়ামী লীগের উপর এবং শেখ মুজিবের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এবং এই সমস্ত বলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। আমাদের তখন সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যে, আমাদেরকে এখান থেকে বেরােতে হবে এবং একটা বিপ্লব, একটা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং সারা বাংলাদেশব্যাপী আমাদের একটা যােগাযােগের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের যে সমস্ত সাহায্য-সহযােগিতা প্রয়ােজন সেগুলাের ব্যবস্থা করতে হবে। এই কারণে আমরা এখান থেকে সবচেয়ে দ্রুত কীভাবে বেরুতে পারি তখন সেই পরিকল্পনা আমাদের মাথায়।

২৭ তারিখ সকালবেলা দেখলাম যে, কিছুটা জীবনের গতি এসেছে। যদিও কারফিউ, কিন্তু পেছনের গলি দিয়ে পানি আনতে যাচ্ছে কলতলাতে। বস্তির লােকেরা বেরােচ্ছে, আর কেউ কেউ ঝাপিতে করে জিনিস বিক্রি করছে। এদিকে আমাদের খাবারের রসদও কমে আসছে। এই রকম পরিস্থিতিতে এখানে বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয়। আর এখানে থেকে তাে কারাে সঙ্গে আমরা যােগাযােগ করতে পারছি না। আমি ২৭ তারিখ সকালবেলাতেই একজন মুসল্লির মত লােককে পেলাম ওই বাড়ির সামনে। আলাপ করে জানলাম তার বাড়ি। পাবনা জেলায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কিনা এবং কুষ্টিয়ার আতাউল হকের বাড়ি চেনেন কিনা। তিনি বললেন তিনি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা এবং আতাউল হক সাহেবের বাড়ি চেনেন। তিনি আমাকে আতাউল হক সাহেব এবং তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন। তারা আমাকে দেখে সাদরে গ্রহণ করলেন। তখন আমি ওই মুসল্লি দ্রলােককে বললাম, ‘চাচা, আমাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছেন ওই বাড়িতে মােহাম্মদ আলি সাহেব আছেন, তাঁকে এখানে নিয়ে আসেন। ওই ভদ্রলােক গেলেন, তাজউদ্দীন সাহেব ১৫/২০ মিনিটের ভিতরেই এসে পৌছালেন। তাঁর মাথায় একটা টুপি, লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা । এবার আমরা লালমাটিয়া থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা, সাত মসজিদ রােড এবং ফিজিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর আশপাশটা দেখতে গেলাম।

যেইমাত্র সাত মসজিদ রােডের মুখােমুখি হয়েছি, দেখলাম যে একটা জীপ থেকে পাক আর্মিরা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। যেহেতু খুব কাছাকাছি ছিলাম তাই গুলিগুলাে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। আমরা তখন একটা বাড়ির পেছনে প্রাচীরের পাশে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তারপরে জীপটি পার হয়ে গেল। আর্মিরা এই জীপটা থেকে তখন চারদিকে গােলাগুলি করছে আর এই বস্তিগুলি পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং একটা মিলিটারি বাংলায় বলছে, সব সরে যাও, সবসরে যাও। বস্তিগুলাে পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং বস্তির লােকগুলাে সব এসে আতাউল হক সাহেবের বাড়ির আশেপাশে স্থান নিচ্ছে। অনেক লােক জড়াে হল, এলােপাতাড়ি গুলি হচ্ছে। আতাউল হক সাহেবের তখন টিন শেড বাড়ি, সাইডের দেওয়ালটাও টিনের। তখন মনে হচ্ছিল এই টিন ছিদ্র হয়ে গুলি আমাদের গায়ে লেগে যাবে। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম, “চলুন পাশের বাড়িটাতে যাই। ওখানে লােকজন নেই এবং ওই বাড়ির চাবিটাও আতাউল হক সাহেবের বাড়ির লােকের কাছে আছে, দরজা টপকে চলে যাওয়া যাবে। এটা ২৭ তারিখ । তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আমি আর এখান থেকে নড়ছি না, গুলি লাগলে লাগবে।’ তিনি রইলেন, কিন্তু আমি দেয়াল টপকে পাশের বাড়িতে গিয়ে থাকলাম। তারপর গােলাগুলি যখন কমল, তখন আবার ফিরে এলাম। ইতােমধ্যে ওই অঞ্চলের কিছু ছাত্র বুঝে ফেলেছে যে, আমরা এখানে আছি। সেই ছাত্ররা এসে আমাদেরকে রিপাের্ট করতে লাগল কী হয়েছে না হয়েছে। দেখলাম যে আর এখানে অপেক্ষা করা ঠিক নয়। আমরা ভাবছি কী করে সাত মসজিদ রােডটা পার হওয়া যায়। কিছুক্ষণের জন্য যেই পাকিস্তানিরা কারফিউ তুলেছে, সাথে সাথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম একটা বাজারের থলেমত হাতে নিয়ে। আমাদের দুজনের মাথায় টুপি, যেন আমরা বাজার করতে যাচ্ছি। কয়েকটি রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ১৯ নম্বর যেখানে শেষ হল সেখান দিয়ে আমরা ভেতরের দিকে রায়ের বাজারের দিকটায়। চলে যাবার পথে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, একটু বাড়ির খবর নিয়ে গেলে কেমন হয় ?’ আমি এতে খুব আপত্তি জানালাম, বললাম, ‘আপনার বাড়ির উপর নিশ্চয় আঘাত হয়েছে এবং আপনার বাড়ির উপর এখনাে নজর আছে, বাড়িতে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাজউদ্দীন সাহেব আর বাড়িতে গেলেন না। এখান থেকে আমরা রায়ের বাজারে ঢুকলাম। রায়ের বাজারে যেতেই আমাদের আওয়ামী লীগের কর্মীরা আমাদের চিনে ফেলল, তারা আমাদেরকে সংগ্রাম পরিষদের অফিসে নিয়ে তুলল। সংগ্রাম পরিষদ তখন রায়ের বাজারে একটা অফিসও করেছে। সেই অফিসে রীতিমত রাইফেল হাতে করে একজন পাহারা দিচ্ছে এবং সেখানে সমস্ত কর্মীরা তখনাে কার্যরত আছে এবং তাদের সাহস অত্যন্ত বেশি। তাদের এতখানি সাহসের মুখে বাস্তব কথা বলতেও যেন আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করে নিয়ে ভেতরের রুমে গিয়ে আলাপ করলাম। বললাম যে, এই অবস্থাতে রাইফেল নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। আমাদের যে মিলিট্যান্ট ফোর্স আছে সেটাকে এখানে তাজা রাখতে হবে, কিন্তু কোন প্রকাশ্য সভা, অফিস ইত্যাদি না রেখে সারা শহরে আমাদের যােগাযােগ তৈরি করতে হবে। আমাদের কোথায় সংগ্রাম পরিষদের লােকজন আছে না আছে ইত্যাদি রিপাের্ট করতে হবে এবং এই মুহূর্তে যােগাযােগটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন, যেন এক জায়গার খবর অন্য জায়গায় চলতে পারে।

আমাদের যে অস্ত্র এবং ট্রেনিং এইগুলি নিয়ে এই সেনাবাহিনীর সাথে মােকাবেলা করতে হলে সম্মুখযুদ্ধে করা যাবে না, গেরিলা কায়দায় করতে হবে। তাদের সাথে কথা বলে সেখানে বসেই আমরা দুটো চিঠি লিখলাম। একটা তাজউদ্দীন সাহেব তার স্ত্রীকে লিখলেন, আর একটি আমি আমার স্ত্রীকে লিখলাম। পরে আমরা দু’জন যখন আলাপ করলাম তখন দেখলাম যে আমরা দু’জন প্রায় একই কথা লিখেছি, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, জনগণের মধ্যে তােমরা হারিয়ে যাও। যদি আমরা কোনদিন জয়ী হতে পারি। তাহলে দেখা হবে—এই ভাবধারার একটি কথা, তিন-চার লাইনের কথা। পরে জেনেছি, তাজউদ্দীন সাহেবের চিঠিটা পৌছেছিল, কিন্তু আমার চিঠিটা বােধ হয় পৌছাতে পারেনি। কর্মীরা আমাদেরকে দুই জোড়া জুতা সংগ্রহ করে দিল। সেটা পায়ে দিয়ে অনেক পথ হাঁটতে হবে, এটা তারা বুঝতে পেরেছিল। এই কর্মীরাই আমাদেরকে রায়ের বাজারের পাশ দিয়ে যে ছােট্ট নদী আছে সেই নদী পার করে দিল একটা খেয়াতে। নদীর ওপারে যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষের কাফেলা। আক্রমণের মুখে বাড়িঘর ফেলে তারা ঢাকা ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে, খুবই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আমাদের কাছে এটা খুব করুণ মনে হচ্ছিল যে, নিজের শহরকে ছেড়ে আজ হাজার হাজার লােক গ্রামে আশ্রয় নেয়ার জন্য চলে যাচ্ছে এবং বিশেষ করে এই গরিব মানুষরা ছিল আর্মির মূল লক্ষ্য।

এই রকমভাবে আমরা বহু পথ হাঁটলাম। হেঁটে আর একটা নদী পার হলাম। সে নদী পার হয়ে আমরা দোহার থানার ভেতরে গেলাম। যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই আমাদের কর্মীদের সাথে দেখা হচ্ছে। একটা বাজারে গেলাম। সে বাজারে কর্মীরা দ্রুত সভার আয়ােজন করল। সেই সভায় তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বক্তৃতা দিলাম। মিটিংয়ের পর আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বসলাম। দোহার থানার আওয়ামী লীগের ও অন্যান্য দলের নেতারা এলেন। তাদের সাথে বৈঠক হল। যাবার পথে সব জায়গাতেই বাজার পাচ্ছি, হাট পাচ্ছি, থানা পাচ্ছি; সর্বত্রই আমরা বলছি যে, এখানে এই সংগ্রাম পরিষদের অধীনেপ্রশাসনকে নিয়ে আসা হােক। পুলিশ, আর্মি, আনসার বাহিনী তাদেরকে একত্রিত করে আমাদের একটা বিদ্রোহী ফোর্স তৈরি করা এবং আর্মি যদি এদিকে আসে তবে সম্মুখসমরে না গিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করা, অপদস্থ করা, তাদেরকে সবকিছুতে অস্বীকার, অসহযােগিতা করা, গ্রাম ছেড়ে প্রয়ােজন হলে অন্য গ্রামে চলে যাবে—এই রকম এক একটা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছিলাম। অনেক গ্রামে দেখেছি যে লােক মারা গেছে, জানাজা হচ্ছে। ওই রকম দু’একটা জানাজাও আমরা পড়লাম, ঢাকা শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই লােকেরা মারা গেছে। এই যে মানুষের ঢল যাচ্ছে, তাদেরকে কিছু সাহায্য করবার জন্য প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে কৃষকরা মুড়ি, চিড়া, পানি নিয়ে তাদের বাহির বাড়িতে রেখেছে, কেউ কেউ রাস্তার উপরে রেখেছে। যারাই যাচ্ছে, তারা বলছে, আপনারা কিছু খেয়ে যান, কিছু পানি খেয়ে যান।’ এই রকম একটা আতিথেয়তা—এ এক অপূর্ব দৃশ্য, এ আর দেখা যায়নি আগে। আমরা ভাবলাম এটাই হচ্ছে চিহ্ন যে আমরা স্বাধীন হব। এই লােকদেরকে তাে কেউ নির্দেশ দেয়নি, কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু তারা সমস্ত খাদ্যদ্রব্য এনে বলছে, আমাদের বাসায় থাকেন, আপনারা খেয়ে যান, অনেক পথ যেতে হবে। এই যে আতিথেয়তা দেখা যাচ্ছে, এর তুলনা হয় না।

আমরা নদী-খাল পার হচ্ছি, খেয়ার মাঝিরা কোন পয়সা নিচ্ছে না। তারা বিনা পয়সায় লােকদের পার করে দিচ্ছে। এক চরম একাত্মতা, যা আমি বাংলাদেশে আর কখনাে দেখিনি। যেমন আমাদের সাথে যাচ্ছে এক বৃদ্ধা, সে নিজের পােটলাটা বইতে পারছে না, তার পােটলাটা আমিই আমার মাথাতে তুলে নিলাম। আর তাজউদ্দীন সাহেব একটা বাচ্চা ছেলের হাত থেকে তার বােঝাটা তুলে নিলেন। এইভাবে আমরা কিছুদূর এগিয়ে দিলাম। এই রকম সকলেই সকলের জন্য এগিয়ে আসছে। পথে একজন কর্মী একটা মােটরসাইকেল নিয়ে এল। সে মােটরসাইকেল নিয়ে এসেছে আমাদেরকে নিয়ে যাবার জন্য। শহরে যেহেতু এই রকম ঘটনা ঘটেছে, এ পথে আমাদের নেতারা কেউ যাবেন, দেখা হবে, এটা সে প্রত্যাশা করে বসে আছে। সে আমাদেরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে ওই সন্ধ্যাবেলায় আমি তােলা পানিতে গােসল করলাম, তাজউদ্দীন সাহেব পুকুরে নেমে গােসল করলেন। তারপর আমরা ওই বাড়িতে বৈঠকখানায় থাকলাম, খাওয়াদাওয়া করলাম। যেহেতু মােটরসাইকেল ছিল একটা, তাই ছেলেটি সন্ধ্যার পর তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে গেল কিছুদূর, তারপর আবার ফিরে এসে আমাকে নিয়ে গেল।এর পরদিন সকালবেলা দুটো মােটরসাইকেল পাওয়া গেল, আমরা দু’জন দুটোর পিছনে বসলাম । এখান থেকে আমরা গেলাম সুবেদ আলি টিপুর বাড়িতে। সুবেদ আলি টিপুকে পেলাম। তাকে বললাম, এখানে থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে এবং যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে—এই কথাই আমরা সব জায়গায় বললাম। তিনি তখন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা যাচ্ছি কোথায়। আমরা তাকে বলেছি যে, আমরা সব জায়গাতেই যােগাযােগ করতে যাচ্ছি এবং শীঘ্রই এই যুদ্ধের নির্দেশ পাবেন। কীভাবে কী সংগঠিত করতে হবে, কোথায় কী পাওয়া যাবে সব নির্দেশ পাবেন। আমরা তখনও বলছি না আমাদের উদ্দেশ্য কী, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আরাে অনেক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সবার সাথে দেখা হল দোহার থানাতে। ওখান থেকে মােটরসাইকেলে আমরা এলাম আশরাফ আলি চৌধুরীর বাড়িতে। তিনিও প্রায় তখনই বাড়ি এসে পৌঁছেছেন। তাঁর দোতলা কাঠের বাড়ি। সেখানে আমরা হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিলাম। তিনি তখন আমাদের প্রভাবশালী নেতা। খাওয়াদাওয়ার পর আশরাফ আলি চৌধুরী তার কলেজের বা স্কুলের দফতরি দিয়ে মােটর সাইকেলে আমাদের পৌছে দিলেন পদ্মার পারে।

পদ্মার পারে এসেও আমরা পার হতে পারলাম না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আর পদ্মায় তখন খুব উত্তাল ঢেউ। কোন মাঝি আমাদের পার করতে রাজি হল না। তখন আমরা ওইখানে আওরঙ্গবাদ নামক গ্রামে একটি তাঁতি পরিবারে থাকলাম। সেখানে গােসল করে খাওয়া দাওয়া করলাম। সেইদিনই আমরা রেডিওতে জিয়াউর রহমানের ঘােষণা শুনলাম। বুঝলাম যে সামরিক বাহিনীর ভিতরেরও কিছু লােকজন পাওয়া গেছে। পরদিন সকালবেলা আমরা নদী পার হলাম। পার হয়ে ওপারে গেলে একটা বাজার পেলাম। সেই বাজার থেকে আমাদেরকে দুটো ঘােড়া সংগ্রহ করে দেয়া হল। সে দুটো ঘােড়াতে চড়ে আমরা ফরিদপুরে যাব। কারণ সেখানে যে পথ সে পথে ঘােড়া ছাড়া আর কোন যানবাহন চলে না। ঘােড়াওয়ালা পিছনে পিছনে দৌড়ায়, আর আমরা ঘােড়ায়। এই দুই ঘােড়ায় চড়ে আমরা দুপুর নাগাদ ফরিদপুর শহরে এসে পৌছলাম । ফরিদপুর শহরে আমাদের আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এবং এমপি ইমামউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে গেলাম। সমস্ত শহর একেবারে জনশূন্য হয়ে গেছে। কারণ তখন ওখানে বিরাট গুজব যে আমি যে কোন সময় ফরিদপুরে এসে আক্রমণ করবে। তাই ফরিদপুর শহরের লােক সব পালিয়ে গেছে। ইমামউদ্দিন সাহেবও দূরে ছিলেন, শহরের বাইরে। তাঁর স্ত্রী দেখলাম খুব সাহসী মহিলা। তিনি আছেন এবং কর্মীদের সাথে যােগাযােগ করছেন। তিনি আমাদের জন্য রান্নাবান্না করলেন। তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ‘শুধু ডালভাত খাব। তাই তিনি ডালভাত তৈরি করেছেন। আমরা যখন খেতে বসছি তখন কিছু লােকজন এবং কর্মীরা এসে বলল যে, আর্মি এদিকে চলে আসতে পারে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আর্মি আসলে জানিয়েশুনিয়ে আসবে। আগে ডালভাত খেয়ে নেই।’ উনি খুব দৃঢ়চিত্ত এবং সহজ ছিলেন, মানে মাথা খুব ঠাণ্ডা, উত্তেজনার কোন চিহ্ন ছিল না। জুতার কারণে তার হেঁটে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে, ইতােমধ্যে পায়ের ফোসকা ফেটে গেছে; কিন্তু আমরা শক্তভাবেই হেঁটে এসেছি। এরপর ওখান থেকে আমরা রিকশা নিয়ে কিছুদূর আসতেই পথে দেখা হল রাজবাড়ির এসডিও শাহ মােহাম্মদ ফরিদের সাথে। তার কাছে খবর পেলাম যে, সে চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়েছিল এবং ওইদিকে মুক্ত অঞ্চল হয়ে গেছে এবং কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ওই সমস্ত অঞ্চলের খবর খুব ভাল। প্রতিরােধ আন্দোলন খুব ভাল চলছে। এইসব এলাকা আমাদের সংগ্রামী মুক্তিবাহিনীর দখলে এবং কুষ্টিয়া দখলের জন্য প্রস্তুতি চলছে। সেখান থেকে আর্মিকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনাও চলছে। আমরা রাজবাড়ির এসডিও-র কাছে ভাল খবর পেলাম। ফরিদপুরের এসপি মিহির খুব একটা সহযােগিতা করছিল না। তাই তার সাথে দেখা না করে রিকশায় আবার রওনা হলাম। 

কিছুদূর যাবার পর আর রিকশা চলে না। কারণ ইতােমধ্যে আমাদের সংগ্রাম কমিটির লােকজন গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। তখন কিছুদূর আমরা হাঁটলাম। আবার কিছুদূর পর দেখলাম একটা বাস চলছে। সে বাস কিছুদূর গিয়ে আর খাদ অতিক্রম করতে পারে না। বাস ওখানে থামল। তারপর আমরা হেঁটে হেঁটে যখন কামারখালি ঘাটে পৌছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে। সেখানে আবার আমরা রেডিওর ঘােষণাটা শুনলাম। রেডিও থেকে সতর্ক করে দিচ্ছে যে, পাক বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডােরা নানা জায়গায় আছে। অতএব আপনারা সাবধানে থাকুন, ইত্যাদি। আমরা নৌকাতে করে কামারখালি ঘাট পার হলাম। পার হয়ে হাঁটছি। মাগুরা ওখান থেকে ৮ মাইল পথ । আমাদের গন্তব্যস্থল হচ্ছে মাগুরাতে সােহরাব আলি সাহেবের কাছে। তাঁকে ২৫ মার্চের আগে কিছু টাকা দেয়া হয়েছিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। তার কাছে গেলে একটা খবর পাওয়া যাবে যে তিনি কোন যােগাযােগ করতে পেরেছেন কিনা।

আমরা হাঁটছি, আমাদের সঙ্গে বহু লােকজনও হাঁটছে। কারণ যারা নদী পার হয়েছে তারাও মাগুরাতে যাবে, কিন্তু কোন যানবাহন নেই। প্রায় ২০/৫০ জন লােক আমরা একসাথে যাচ্ছি, হাঁটছি। আমাদেরকে যেন কেউ চিনতে না পারে সে রকম বেশভূষা ধরে আমরা যাচ্ছি। মাগুরার কিছু আগে একটা কাঠের সেতু আছে চলাচলের জন্য। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি সেই কাঠের সেতুতে আগুন দেয়া হয়েছে, পাকিস্তানি কমান্ডােরা যাতে না আসতে পারে। সেটা তখনও জুলছে। এদিকে আমরা যখন নৌকায় উঠেছি তখন ওপার থেকে আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে যে, নৌকায় কে আসছে। আমরা এপার থেকে বলছি, ‘বন্ধু।’ তারা বলল, “ঠিক আছে, আসাে।’ ইতােমধ্যে ওখানে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়ে গেছে: বন্দুক নিয়ে তারা পাহারা দিচ্ছে, কারা আসছে-যাচ্ছে এটা চেক করার জন্য। সবাই নৌকায় পার হবার পর শেষ যাত্রী ছিলাম আমরা। যে আনসার সেখানে দায়িত্ব পালন করছিল সে আমাদের সার্চ করল। আমার কাছে তাে কিছু নাই। তাজউদ্দীন সাহেবকে সার্চ করতে গিয়ে পিস্তল পেয়ে মুখের দিকে চেয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তাজউদ্দীন সাহেবকে সে চিনতে পেরেছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘সােহরাব সাহেব কোথায় আছে আমাদেরকে বলাে।’ ছেলেটি বলল যে, ‘সােহরাব সাহেব বাড়িতে নেই, শহরের একটু বাইরে আছেন।’ আমরা বললাম, আমাদেরকে একটু নিয়ে যেতে পারাে?’ উৎসাহে আনন্দে একেবারে ফেটে পড়ছে ছেলেটি। রাত দেড়টা-দুটোর সময় রিকশাওয়ালার বাড়ি গিয়ে রিকশা নিয়ে এল এবং আমরা সােহরাব সাহেবের বাড়ি যখন গেলাম তখন রাত তিনটা। আমরা তখন এত ক্লান্ত যে এই রকম ক্লান্ত আর কখনাে হয়েছিলাম বলে মনে হয় না। ২৭ তারিখ ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি, ২৮ তারিখের পর ২৯ তারিখ আসছে, অর্থাৎ ২৯ তারিখ শুরু হবে।

২৮ তারিখ দিবাগত রাত, তারপর যখন আমরা সােহরাব সাহেবের বাড়িতে রান্নার পর ভাত খেলাম, তখন ভাের চারটা। সকাল সাতটার মধ্যেই আমরা আবার তৈরি হয়ে গেলাম বের হবার জন্য। ওখানে তখন মাগুরার এসডিও কামাল সিদ্দিকী খুব ভাল সংগঠন করেছে। সে বিডিআর, আনসার, পুলিশ সকলকে নিয়ে একটা বাহিনী করে ফেলেছে। সংগ্রাম পরিষদের যে স্থানীয় নেতৃত্ব তারা সুন্দর সংগঠন করেছে। মাগুরার সংগঠন দেখেখুব ভাল লাগল। এখানে আমাদেরকে একটা জীপের ব্যবস্থা করে দেয়া হল। সেই জীপে করে আমরা সদর রাস্তা দিয়ে না গিয়ে মাগুড়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের একটা পুরনাে রাস্তা আছে, সেই রাস্তা দিয়েই ঝিনাইদহ চলে এলাম। ঝিনাইদহ এসে আমাদের যে স্থানীয় নেতা আজিজ, আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি, তার বাড়িতে উঠলাম । এখানকার এসডিপিও এবং পরবর্তীতে ঢাকার এসপি হয়েছিলেন মাহবুব—তাঁকে আমরা ডাকিয়ে আনলাম। মাহবুবের সাথে ইতােমধ্যে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের যােগাযােগ হয়েছে এবং কুষ্টিয়া দখল করবার একটা প্রস্তুতি চলছে। সেই অবস্থায় মাহবুবকে আমরা প্রথম আমাদের কনফিডেন্সে নিলাম এবং আমাদের পরিকল্পনার কথা তাকে জানালাম। তারপর জীপে করে আমি, তাজউদ্দীন সাহেব আর মাহবুব ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা এলাম। মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী চুয়াডাঙ্গা প্রশাসনেরও ভার নিয়েছেন। আমরা তৌফিক এলাহীর সাথে আমাদের পরিকল্পনার ব্যাপারে আলাপ করলাম। আমি তখন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, চুয়াডাঙ্গা তখন কুষ্টিয়ার ভেতরে। ডা, আসহাবুল হক এবং অন্যান্য সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে দেখলাম সেখানে সংগ্রাম পরিষদ করে তারা খুব ভাল সংগঠিত অবস্থায় আছে। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী হচ্ছেন সেখানকার ইপিআর-এর কমান্ডার। তিনি সেখানকার ইপিআর-এর পুরাে প্লাটুন, ব্যাটালিয়ানসহ আমাদের। সাথে যােগ দিয়েছেন। এখানে আমাদের খুব শক্তিশালী ঘাঁটি পাওয়া গেল। এদের সকলেরই একটা দাবি যে, আমাদের অস্ত্রের প্রয়ােজন, অস্ত্র পেলে আমরা যশাের ক্যান্টনমেন্টও দখল করে নিতে পারি। এই রকম একটা মনােভাব, মনােবল তাদের।

আমরা যখন ঝিনাইদহ ছেড়ে যাচ্ছি তখন হাজার হাজার লােক ট্রাক ভর্তি করে স্লোগান দিতে দিতে যশাের ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে। ‘যশাের ক্যান্টনমেন্ট জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’, ‘জয় বাংলা’, এই স্লোগানে সমস্ত অঞ্চল মুখরিত এবং মানুষের মনােবল চূড়ান্ত পর্যায়ে। আমরা খুব ধীরস্থির। বুঝছি যে, এভাবে যশাের ক্যান্টনমেন্ট দখল করা সম্ভব নয়। আর যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি ছুঁড়ছে যাতে মানুষ কাছে ভিড়তে না পারে। কিন্তু মানুষ চারদিক থেকে যশাের ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছে। কুষ্টিয়াতেও একই অবস্থা। কুষ্টিয়াতে পাক বাহিনীর যে প্লাটুনটা ২৬ তারিখে গিয়েছিল তারা প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউজ, টেলিগ্রাফ অফিস এইগুলাে দখল করে বসেআছে। ওখানেও হাজার হাজার মানুষ চারদিক দিয়ে তাদের ঘিরে রেখেছে। তারা যে যা বন্দুক, রাইফেল, গাদা বন্দুক পেয়েছে এইসব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বসে বসে আর্মির দিকে গুলি ছুঁড়ছে। দুই পক্ষের ক্রস ফায়ারে ওখানকার ডিসি মারা গেছেন। দু’একজন আর্মির লােকও আহত হয়েছে। এই যে আমরা পথ চলছি, সরকার গঠন এবং পাকিস্তানিদের মােকাবেলা করার চিন্তাটা কিন্তু ২৬ তারিখের পর থেকেই আমরা মনে মনে চিন্তা করছি। ২৭ তারিখ আমরা যখন ঢাকার বাইরে বেরিয়ে পড়েছি তখন আমরা এই কথাটা উপলব্ধি করেছি যে, স্বতঃস্ফুর্ত জনগােষ্ঠী যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বা যাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাদেরকে একত্রিত করা, প্রয়ােজনীয় সহযােগিতার ব্যবস্থা করা এবং পরিচালনা করা প্রয়ােজন। এই জন্য একটা সরকার দরকার এবং সেই সরকারের একটা শক্তিশালী সেন্ট্রাল কমান্ড দরকার। যদি আমরা একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করি তাহলে কাল যদি চট্টগ্রামে, বরিশালে বা সিলেটে আরাে কয়েকটি বিপ্লবী সরকার হয় তাহলে কোনটা আসল। সরকার, কোনটা বৈধ সরকার এটা নিয়ে একটা বির্তকের সৃষ্টি হতে পারে। অতএব এই সমস্ত বিপর্যয় অ্যাভয়েড করার জন্য একটি দায়িত্বশীল এবং আইনানুগ সরকার গঠন করার ক্ষমতা যখন আমাদের রয়েছে, এখন সেটা। আমাদের সবচাইতে প্রথম করা দরকার। এই আরগুমেন্টটি এত জোরালাে ছিল যে এর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আর কোন কথা উঠতে পারেনি।

আমি ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়াতে খবর পাঠিয়েছিলাম আমার বাড়ির পাশের কারাগঞ্জ ব্রিজটা অকেজো করে দিতে। ছেলেরা এমনভাবে পরীক্ষা করে সেতুটাকে চলাচলের অযােগ্য করেছিল যে মনে হচ্ছিল পথ ঠিকই আছে। যখন পাকিস্তানি আর্মি ওই পথে যাচ্ছিল আর নিচে পড়ছিল, তখন সাধারণ মানুষেরা ওদেরকে পিটিয়ে মারে। এই পথে একজন আর্মিও কুষ্টিয়া থেকে যশােরে ফিরে আসতে পারেনি। কিন্তু তাদের কাছে এত গােলাবারুদ ছিল যে সেটা ব্যবহার করলে তারা দু’এক মাস যুদ্ধ চালাতে পারত। কিন্তু জনপ্রতিরােধের মুখে তারা। মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিল, ফলে পিছিয়ে গেছে। আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই সংবাদ এল কুষ্টিয়ায় বিজয় অর্জন করা গেছে। তখন সবচাইতে বড় দাবি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর অঞ্চলের যে, আমাদের অস্ত্র দরকার। এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে ভারতের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে তাদের কাছ থেকে কী সাহায্য পেতে পারি তার ব্যবস্থা করা। আমরাতখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা ভারতের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করব। আমরা তৌফিক এবং মাহবুবকে নিয়ে সাথে আরাে কয়েকজন সশস্ত্র ছেলেসহ বেতনাপুর নামক সীমান্তের বিওপি-র দিকে যাই। পথে দেখি মানুষ এত সজাগ হয়ে গেছে যে পাকিস্তানি আর্মি যাতে না আসতে পারে তাই সব জায়গাতে তারা চেক করছে। আমাদের জীপটাও তারা কয়েকবার চেক করল। মানুষের মধ্যে আর্মির বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করলাম। বিওপি-র কাছাকাছি এসে আমাদের জীপটা বাংলাদেশের ভেতরেই থামানাে হল। তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমাদের সিদ্ধান্ত, আমরা আত্মগােপন করে সীমান্ত অতিক্রম করব না, আমরা সীমান্ত অতিক্রম করব স্বাধীন দেশের সরকারের মুখপাত্র হিসেবে। তখন তৌফিক এবং মাহবুবকে বলা হল, তােমরা স্বাধীন দেশের অফিসার, তােমাদেরকে আমরা ভারতে পাঠাচ্ছি, তােমরা গিয়ে বলবে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে হাইকমান্ড তার প্রতিনিধি তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমীর-উল ইসলাম সাহেব এসেছেন। একটি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিদেরকে যেভাবে সম্মান দিয়ে গ্রহণ করতে হয়, সেইভাবে তারা আমাদেরকে গ্রহণ করতে রাজি আছে কিনা জানালে আমরা ভেতরে যাব।’ তৌফিক, মাহবুব সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে গেল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি। হয়ত তারা দিল্লীর সাথে, কলকাতার সাথে যােগাযােগ করতে সময় নিচ্ছে। এদিকে এই জায়গায় একটা কালভার্ট ছিল, দু’পাশে বসবার মত জায়গা ছিল সেখানে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, প্রচণ্ড গরম, বসে থেকে থেকে আমরা শুয়ে পড়েছি, এমন সময় পাশের ঝােপের ভেতর থেকে ভারি বুটের শব্দ ভেসে এল। ওরা এসে আমাদেরকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু কাম টু আওয়ার ক্যাম্প।’ ঠিক যেভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের সম্মানিত অতিথিকে গার্ড অফ অনার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদেরকেও সেইভাবে আমন্ত্রণ জানানাে হল। আমরা ভেতরে গিয়ে শুনলাম ইস্টার্ন কমান্ডের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আইজি আমাদের সাথে দেখা করার জন্য ইতােমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই গােলােক মজুমদার এলেন। তাঁর সাথে আমাদের আলােচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল যে, আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের লােকদের বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রতি একটা সহানুভূতি আছে এবং থাকবে, কিন্তু আমরা সর্বভারতীয় অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের রেসপন্স চাই। এবং ভারত সরকার আমাদেরকে সেইরকম আশ্রয়, স্থান দেবে কিনা, যেখানে আমরা ট্রেনিং নিতে পারব, নিয়ােগ করতে পারব, অস্ত্রশস্ত্র পাব এমন নিশ্চয়তা।

এই কথা শুনে গােলােক মজুমদার বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একজনই দিতে পারেন, তিনি।আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তবে আমি তার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারি। এছাড়াও এখানে আসবার আগে আমি দিল্লীতে যােগাযােগ করেছিলাম, সেখান থেকে আজ রাতেই একজন আসছেন আপনাদের সাথে দেখা করতে।’ আমরা গােলােক মজুমদারের কথায় রাজি হলাম। গাড়িতে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, গােলােক মজুমদার ইতিহাসের ছাত্র। তিনি বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি কবিতাটি শুনিয়ে বললেন, বাংলা এমনই একটা জায়গা যেখানে বহিরাগতরা কোনদিনই পেরে ওঠেনি। মান সিং-এর কথা, আরাে কয়েকজনের কথা বলে তিনি বললেন, ‘ওরাও পারেনি, এবং এই যে আজ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আপনাদেরকে ধ্বংস করতে নেমেছে, দেখবেন তারাও পারবে না, জয় আপনাদের সুনিশ্চিত।’ এমন আশ্বাসবাণী শােনাতে শােনাতে তিনি আমাদেরকে সােজা নিয়ে গেলেন দমদম এয়ারপাের্টে, যেখানে প্লেন থামে ঠিক তার কাছাকাছি জায়গায়। প্রায় ৬ ফুটের মত লম্বা একজন লােক প্লেন থেকে নেমে এলেন। আমরা জীপ থেকে নেমে একটা কালাে অ্যাম্বাসেডার গাড়িতে উঠলাম, সাথে সেই ভদ্রলােক এবং গােলেক মজুমদার । এই ভদ্রলােক ছিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান রস্তামজী। আমরা একসাথে ‘অসম ভবনে’ (আসাম হাউস) গেলাম। সেই রাতেই পশ্চিম বঙ্গের পুলিশ চীফ, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেখানে আনা হল এবং তাদের সাথে আমাদের বৈঠক হল। তাজউদ্দীন সাহেব বিস্তারিতভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সমস্ত পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সবই আমাদের মুক্ত এলাকা ঘােষিত হয়েছে এবং আমরা কী পরিস্থিতিতে এখানে এসেছি তাও বললেন। প্রত্যেকটি সীমান্ত জেলার সাথে আমাদের যােগাযােগের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা একটা লিস্ট তৈরি করলাম, তাতে সীমান্ত জেলাগুলাের সমস্ত এমপি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নাম দেয়া হল যাতে এঁদের সাথে যােগাযােগ করা যায় এবং তাদের নিরাপদ এলাকায় নিয়ে আসা যায়। ওইসব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যােগাযােগ করে দেয়ার ব্যবস্থার জন্য বললাম। সেই রাতেই অয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর চলে গেল সীমান্তবর্তী নেতৃবৃন্দকে খোঁজ করতে এবং আমাদের সাথে খবর আদানপ্রদানের জন্য। এছাড়াও অয়্যারলেসের মাধ্যমে পরদিনই চুয়াডাঙ্গায় যােগাযােগ করিয়ে দেবার আশ্বাস দিলেন রুস্তামজী। আলােচনা করতে করতে ভাের রাত হয়ে গেল। আমাদের কাপড়চোপড় কিছু নেই, রুস্তামজী তার পায়জামা-পাঞ্জাবি দিলেন। তিনি মস্ত লম্বা মানুষ, কোন রকমে তার কাপড় পরে আমরা ঘুমাতে গেলাম।পরদিন ওঁরা আমাদের জন্য কিছু কাপড় এবং প্রয়ােজনীয় জিনিস কিনে দিলেন। সকালে চুয়াডাঙ্গায় আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডা, আসহাবুল হকের সাথে ফোনে কথা হল। এদিকে আমরা তখন যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা হচ্ছে যে, সমস্ত বাংলাদেশব্যাপী আমাদের যে প্রস্তুতি আমরা দেখে এলাম পথে পথে, তা যথেষ্ট নয় একটা সৈন্যবাহিনীকে সম্মুখসমরে পরাস্ত বা মােকাবেলার জন্য। অতএব এই সমস্ত ছেলেদের একটা জায়গায় নিয়ে এসে একত্রিত করা, ট্রেনিং দেয়া, তাদের। হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া এবং তারপর যুদ্ধটাকে পরিচালনা করা, এই হল আমাদের চিন্তা। কিন্তু যারা ফিল্ডে আছে, যুদ্ধ করছে, তাদেরকে কথাটি বােঝাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারা সবাই বলছে, না আপনারা অস্ত্র নিয়ে আসেন, আমরা সব দখল। করে ফেলব। যাই হােক, ৩০ তারিখ দিনের বেলা আমাদেরকে কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেখানাে হল যেখানে আমরা অফিস করতে পারি। সে দিনই ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের বাড়িটা আমরা দেখি। এদিকে কলকাতায় পৌছবার পর তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ২৫ মার্চের আগে একদিন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ মণি, তােফায়েল আহমদ এদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন সেই সময় হঠাৎ সেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার কানে আসে বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের বলছিলেন ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে গেলে খবর পাওয়া যাবে।’ আরও একটি নাম শুনেছিলেন চিত্ত সূতার। সেই অলক্ষ্যে শােনা কথার সূত্র ধরে তাজউদ্দীন সাহেব গােলােক মজুমদারকে বললেন ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে নিয়ে যেতে। আমরা সেই বাড়িতে গেলাম, কিন্তু সেখানে কেউ চিত্ত সূতার বলে কাউকে চেনে না। আমরা ফিরে এলাম। পরে জেনেছিলাম, ওই চিত্ত সূতার ছদ্মনামে সেখানে থাকেন এবং ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যম হিসেবে কলকাতায় কাজ করেন। ৩১ তারিখে আমরা সীমান্ত বিওপিতে গিয়ে আবু ওসমানের সাথে দেখা করে তার হাতে অল্প কিছু অস্ত্র তুলে দেই। এই অস্ত্রটুকু দেয়া বিএসএফ-এর এক্তিয়ারে ছিল। সেখানে একটা মেশিনগান চালানাের ট্রেনিং দেয়া হল। এই সময় অয়্যারলেসে খবর এল বিশাখালিতে যুদ্ধ-অবস্থা, আবু ওসমান চৌধুরী যেন তাড়াতাড়ি চলে যান। আবু ওসমান চৌধুরী সেখান থেকে চলে গেলেন। আমরাও পরে ফিরে এলাম। সেই রাতেই আমরা দমদম এয়ারপাের্টে গেলাম, দিৱলী যেতে হবে। যে প্লেনে আমাদেরকে যেতে হল সেটা কোন সাধারণ প্লেন নয়, ভারতীয় আর্মির কার্গো প্লেন। খুব ধীরে চলে, ফলে কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে ৬ ঘণ্টাসময় লাগে, ভেতরে কোন সীটের ব্যবস্থা নেই, খুব প্রচণ্ড রকমের কম্পন এবং শব্দ হয়। মূলত গােপনীয়তা রক্ষা করার জন্যই এভাবে যাবার ব্যবস্থা। আমাদের সাথে গােলােক মজুমদার, শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ও আর একজন আছেন। দিল্লীতে যখন পৌছলাম তখন ভাের হয়ে এসেছে। সেখানে বিএসএফ-এর একটা গেস্ট হাউসে আমাদেরকে নেয়া হল। সেখানে আমাদের সাথে কর্নেল মেনন এবং ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান কাটল দেখা করতে এলেন আলাদা আলাদাভাবে। পরে শুনেছি, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে র’ চেষ্টা। করছিল কিছুটা বাধার সৃষ্টি করতে। আমার মনে হয় এখানে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছিল। যেমন বিএসএফ-এর সাথে আমাদের যােগাযােগ হয়েছে, আমরা। বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছি, বিএসএফ-এর এই যে কৃতিত্ব, এতে যেন অনেকটাই ‘র’-এর পরাজয় হয়ে গেছে—বলতে পারি এটা তাদের দুই ডিপার্টমেন্টের প্রতিযােগিতা। আর দ্বিতীয়ত, যেহেতু চিত্ত সূতারের মাধ্যমে আমরা আসিনি তাই একটা ঝামেলা বাধাবার চেষ্টা করেছে ‘র’। আবার যখন শেখ মণি ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে পৌছে এবং জানতে পারে তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি দিল্লীতে চলে গেছি, তখন তারাও বােধ হয় এই ব্যাপারে খুশি হতে পারেনি। কাজেই সব কিছু মিলে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা কিছুটা বিলম্বিত হয় এবং বড় করে একটা প্রশ্ন ওঠে, এরাই যে তাজউদ্দীন বা আমীর-উল ইসলাম তার প্রমাণ দিল্লীতে কে দিতে পারে ? এদিকে সেই একই সময় আগরতলা থেকে সেখানকার প্রাদেশিক সরকারের সহায়তায় এম, আর, সিদ্দিকী দিল্লীতে পৌছেন। অ্যাডভােকেট সিরাজুল হক, তিনিও দিল্লী পৌছেন এবং উত্তরবঙ্গ থেকে আব্দুর রউফও দিল্লীতে এসেছেন। এঁদের তিনজনকে যখন ‘র’ থেকে জিজ্ঞেস করেছে যে এখানে তাজউদ্দীন সাহেব। এসেছে—তখন তিনজনই বলেছেন তাজউদ্দীন সাহেব মূল ব্যক্তি, যদি তিনিই হন তবে ঠিক আছে। তারপর সিরাজুল হক বাচ্চুকে নিয়ে এসে বােধ হয় একটা দরজার ফাক দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখানাে হয়। তখন সে কনফার্ম করে ইনিই তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ হয়। যতদূর মনে হয় ৪ তারিখের দিকে ইন্দিরা গান্ধী নিজে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে রিসিভ করেন। তাঁকে প্রথম প্রশ্ন করেন, ‘শেখ মুজিব কেমন আছেন?’ তখনতাজউদ্দীন সাহেব বলেন, ‘আমার যখন তার সাথে শেষ দেখা হয় তখন তিনি সমস্ত বিষয় পরিচালনা করছিলেন। তার যে পরিকল্পনা ছিল সে মতই আমাদের কাজ চলছে এবং হাইকমান্ড হিসেবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যার যেটা দায়িত্ব সেভাবে কাজ করছি এবং আমি আমার দায়িত্ব হিসেবে এখানে এসেছি।’ তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর এই আলােচনায় একটা কথা তাজউদ্দীন সাহেব খুব স্পষ্ট করে বললেন, এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের সমস্ত রকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য-সহযােগিতা এবং অস্ত্র সরবরাহ। এসব আমাদের জরুরী প্রয়ােজন হবে। আর আমরা যে রকম পরিস্থিতি দেশে দেখে এসেছি তাতে মনে হয় যে দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী এদেশে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় এবং আহারের ব্যবস্থা ভারত সরকারকে করতে হবে। বহির্বিশ্বে আমাদের স্বাধীনতার কথা প্রচারের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখবেন এটা আমরা আশা করি।’ এই সবগুলাে ব্যাপারেই শ্রীমতি গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের একটা একাত্মতা গড়ে ওঠে। এই উদ্দীপ্ত কথাটিতেই বােধ হয় শ্রীমতী গান্ধী আরাে বেশি আকৃষ্ট হন যে, এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের। এই যুদ্ধটার আন্তর্জাতিকীকরণ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকা দরকার। এই যুদ্ধকে যেন হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের লড়াই হিসেবে কেউ না দেখায়, কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ লড়াই হিসেবে কেউ না দেখায়, যা পাকিস্তানের প্রচেষ্টা হবে, সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এরপর দ্বিতীয় যে বৈঠক হয় সেখানে শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবকে জানান যে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গেছেন। এই কথা শুনে তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয় তা করতে শ্রীমতি গান্ধীকে অনুরােধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস দেন তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন কূটনৈতিক ক্রিয়াকাস্ত্রে মাধ্যমে এবং তঙ্কালীন সভিয়েট ইউনিয়নের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের উপরে চাপ দেয়া হয় যাতে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবের মতের সাথে একাত্মতা পােষণ করবার পর মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের ভেতরে-বাইরে এবং ভারতবর্ষের সাথে সাহায্য-সহযােগিতার সম্পর্ক প্রসারিত করবার প্রয়ােজন এবং সেই সমস্ত দিক বিবেচনায় একটি সরকার গঠন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। সেই সরকার গঠনের ব্যাপারেই আমরা এম, আর, সিদ্দিকী, আব্দুর রউফ এঁদের সাথে আলােচনা করেছি। তারা সবাই একমত হলেন একটা সরকার গঠন এখনই প্রয়ােজন। দিল্লীতে বসেই আমরা কিছু চিঠিপত্র পেলাম। যেমন সৈয়দ সুলতান সাহেবের কাছ থেকে, ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঞার কাছ থেকে। এই চিঠিগুলােতে লেখা ছিল যেন অবিলম্বে সরকার গঠন করা হয় এবং তাজউদ্দীন সাহেব যেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তখন। আমরা সবাই একমত হলাম যে, হাইকমান্ড হিসেবে যেটা কাজ করছিল সেটাই এখন ক্যাবিনেট হিসেবে কাজ করুক এবং তাজউদ্দিন সাহেব তার প্রধানমন্ত্রী হােন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেবের প্রচণ্ড দ্বিধা ছিল নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আত্মপ্রকাশ করানাের বিষয়টিতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি তাে আওয়ামী লীগকে চেনেন না, এটা নিয়ে আওয়ামী লীগে কিন্তু নানা রকম ভুল বােঝাবুঝির চেষ্টা করানাে হবে।’ আমি বললাম, কিন্তু সরকার গঠন করা ছাড়া এই মুহূর্তে তাে আর কোন উপায় নেই। এরপর আমাদের হাইকমান্ডের মতাে করেই আমরা একটি সরকার গঠন করি। আমরা যে সরকার গঠন করেছিলাম তা ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির। যুদ্ধ পরিচালনা করার মত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারের। পরিধি ছােট রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। প্রফেসর রেহমান সােবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান তখন দিল্লীতে উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব, রেহমান সােবহান এবং আমি একসাথে মিলে বক্তৃতার একটা খসড়া তৈরি করি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন, যার কিছু অংশ রেহমান সােবহান এবং কিছুটা আমি লিখি । এই সময় তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলে মিলিয়ে দেখা হচ্ছিল যে বক্তব্যের কথাগুলাে রাজনৈতিকভাবে ঠিক হচ্ছে কিনা। তিনি নিজেও কোন পয়েন্ট যােগ করছিলেন, কোনটা বাদ দিচ্ছিলেন। এভাবেই আমরা একটি খসড়া বক্তৃতা প্রথমে ইংরেজিতে লিখি, তারপর বাংলায় অনুবাদ করা হয়। দিল্লীতে বসেই বক্তৃতাটি টেপে ধারণ করাহয়। এই টেপটির মুখবন্ধে আমার কণ্ঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ধারণ করা হয়। দিল্লীতেই সীলমােহর তৈরি করা হয় যেটা আমারই হাতের আঁকা, চারিদিকে গােলচক্র, মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। তাজউদ্দীন সাহেব এটি অনুমােদন করেন। আমরা সেই মনােগ্রামসহ লেটারহেড ছাপিয়ে ফেলি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লিখে। একটি সরকারের প্রাথমিক যে বিষয়গুলাে থাকে তার প্রায় সব ঠিক করে ফেলি। আমরা যাতে যােগাযােগের জন্য সীমান্ত এলাকাগুলােতে যেতে পারি সেই জন্যে মিসেস গান্ধী একটা ছােট প্লেনের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল নগেন্দ্র সিংকে আমাদেরকে সমর বিষয়ে সহায়তা করার জন্য উপদেষ্টা হিসেবে দিলেন। তারপর আমরা কলকাতায় ফিরে আসি। কলকাতায় ফিরে এসেই আমরা জানতে পারি, সেই ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডের বাড়িতেই চিত্ত সূতার থাকতেন, কিন্তু অন্য নামে—যার ফলে কেউ আমাদেরকে জানাতে পারেনি যে এখানে চিত্ত সূতার থাকেন। এই বাড়িতে তখন শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রব, আব্দুল কুদুস মাখন প্রমুখ যুব-ছাত্র নেতারা উপস্থিত হয়েছেন। আমরা যে একটা সরকার গঠন করেছি এরকম আভাস-ইঙ্গিত তারা পেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়েছে যে আমরা কাউকে না বলে দিল্লীতে চলে গিয়েছি। ইতােমধ্যে মনসুর আলি সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব এবং প্রায় ৪০/৫০ জন আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতৃস্থানীয় লােকজন কলকাতায় এসে গেছেন। তখন আমরা সবাইকে একসাথে নিয়ে আলােচনায় বসলাম। এই সময় যুব নেতাদের কাছ থেকে বিশেষ করে শেখ মণি এবং সিরাজুল আলম খানের কাছ থেকে একটা দাবি উঠল যে, যুদ্ধ অবস্থাতে একটা রেভলুশনারি কাউন্সিল তৈরি করতে হবে, এখানে কোন মন্ত্রিসভা তৈরি বা গঠনের প্রশ্ন ওঠে—শুধু এমপিদেরকেই নয়, কাউন্সিলে যুবক এবং অন্যান্যদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। এই বৈঠকে দেখলাম বেশির ভাগ লােকজনই উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। তাজউদ্দীন সাহেব যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, আমরা সেভাবেই জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণ টেপ করেছি, শ্রীমতি গান্ধী এবং দিল্লীতে এই কথাটি সবাই জানে, কাজেই তিনি খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে ছিলেন।আমি তখন কতকগুলাে যুক্তি উত্থাপন করি যে, আমাদের একটা লিগ্যাল আরগুমেন্ট হচ্ছে, আমাদের একটা জনপ্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র আছে। একটা নির্বাচন হয়ে গেছে, সেই নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি, কিন্তু আমাদেরকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। আমাদেরকে সংবিধান তৈরির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতএব আমাদের একটা সরকার গঠন করবার যেমন নৈতিক দায়িত্ব আছে, তেমনি একটা সরকার গঠনের আইনগত অধিকারও আমরা পেয়েছি। পৃথিবীর খুব কম স্বাধীনতা যুদ্ধে এ ধরনের পরিস্থিতি থাকে। আইনগত কোন স্বীকৃতি যেখানে থাকে না, সেখানে তখন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হয়, অর্থাৎ যার আইনগত ভিত্তি অত্যন্ত নড়বড়ে থাকে। কিন্তু এখানে আমাদের আইনগত ভিত্তি এত শক্তিশালী, কাজেই এই জিনিসটা আমরা হারাতে চাই না। এছাড়াও যদি আমরা একটা বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করি এবং কাল যদি চট্টগ্রাম, বরিশাল বা সিলেটে আরাে কয়েকটি এমন সরকার হয় তাহলে কোটা আসল, কোনটা কী এ নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। অতএব এই সমস্ত বিপর্যয় এড়াতে যেহেতু একটি আইনানুগ সরকার গঠন করবার ক্ষমতা আমাদের আছে সেহেতু এটাই আমাদের প্রথম করা দরকার এবং বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা। হাইকমান্ড অনুযায়ী মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে কারােই আপত্তি থাকার কথা নয়। তাজউদ্দীন সাহেব দলের সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে জাতির এই দুর্দিনে ভারতের সাহায্য-সহযােগিতা পাবার জন্য তিনি দিল্লী গেছেন—কর্তব্যের ডাকে তিনি সেখানে গেছেন এবং দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সে অধিকার তার আছে। এই যুক্তিগুলাে এত জোরালাে ছিল যে এর বিরুদ্ধে আর কোন কথা উঠতে পারল। ধীরে ধীরে সকলেই আমাদের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। তখন এই প্রশ্ন যারা কোন একটা মতলব থেকে তুলেছিলেন তারা যদিও এই যুক্তি অস্বীকার করতে পারছিলেন না, কিন্তু মনে মনে ফুসছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সকলেই এই কথাটা মেনে নিলেন। তার পরদিন আমাদের যাবার কথা বিভিন্ন অঞ্চলে। কামরুজ্জামান সাহেব ও মনসুর আলি সাহেবকে রাজি করাতে হবে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য, যেহেতু দুজনই সরকারের অংশ। ভােরবেলা আমি চলে গেলাম কামরুজ্জামান সাহেবের কাছে। তাকে জানালাম আমরা কোথায় যাচ্ছি, সেখানে তাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে। আমরা সরকার গঠন করেছি, এতে তার সম্পূর্ণ সমর্থন আছে কিনা তাও জানতে চাইলাম।কামরুজ্জামান সাহেব বললেন যে, এতে তার সম্পূর্ণ সহযােগিতা এবং সমর্থন রয়েছে। তিনি বললেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেন, আপনারা যে সরকার গঠন করেছেন তাতে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। যদিও গতরাতে আমরা বলেছিলাম একটা বিপ্লবী সরকারের কথা, বিশেষ করে ছেলেরা বলেছিল সেটা, কিন্তু আপনি। যে যুক্তি দিয়েছেন তারপর আমি আপনার কথা মেনে নিয়েছি।’ এরপর তিনি বললেন যে, তাঁর স্ত্রী এবং পরিবার পথে আছে, তারা না আসা পর্যন্ত তাদের জন্য কলকাতায় অপেক্ষা করতে হবে, তাই তিনি যেতে পারছেন না। মনসুর আলি সাহেবকে অনুরােধ করাতে তিনি রাজি হলেন। মনসুর আলি সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, আমি, শেখ মণি, তােফায়েল আহমদ ও গােলােক মজুমদারসহ আমরা রওনা হলাম। দমদম এয়ারপাের্ট থেকে বিমানটি টেকঅফ করল। প্লেনটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে পারে এবং খুব অল্প জায়গার ভেতর নামতে পারে। আমরা এইরকমভাবে কয়েক জায়গায় নামলাম। আগে থেকেই খবর দেয়া ছিল বিএসএফ-এর মাধ্যমে যে, যেখানে যেখানে আমাদের নেতাদের লােকজনদের পাবে তাদেরকে যেন বর্ডারের কাছে নিয়ে আসে যাতে আমরা তাদের সাথে আলাপ-আলােচনা করতে পারি। আমরা ধুবড়িতে নেমে কোন নেতার সন্ধান পেলাম না। তারপর ওখান থেকে শিলিগুড়িতে এসে নামলাম। এখানে একটা ডাকবাংলােতে উঠলাম। এখানে কর্নেল নূরুজ্জামান এবং আবদুর রউফকে আমরা ডেকে পাঠালাম। তারা রংপুর, নীলফামারী এ সমস্ত এলাকা থেকে আসলেন। তারা আসার পর তাদের সাথে আলাপ-আলােচনা হল। কর্নেল নূরুজ্জামানকে বলা হল, আপনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে কাজ করবেন। ইতােমধ্যে আমরা ৬ জন সেক্টর কমান্ডার নির্বাচন করেছি। ১০ এপ্রিলে তাজউদ্দীন সাহেবের যে বক্তৃতা প্রচার করা হবে সেই বক্তৃতাতেও সেক্টর কমান্ডারদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং কে কোন্ সেক্টরের দায়িত্বে থাকবেন তারও উল্লেখ আছে। এদিকে গােলােক মজুমদারের সাথে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, সেই বক্তৃতার টেপটা তাকে দিয়ে দেব এবং শিলিগুড়ির ওখান থেকে এই ভাষণ রেডিওতে প্রচার করা হবে। সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী আমি তাকে টেপটা দিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে শেখ মণি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললেন, ‘মামা, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। তাজউদ্দীন সাহেব এবং শেখ মণি একটা ঘরে গিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক তারা আলাপ করার পর সেখানে। আমাকে ডাকা হল। আমি যাবার পর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “দেখেন, শেখমণি বলছে টেপ করা বক্তৃতাটা আজকে যাতে প্রচার করা না হয়, এটা দু-তিনদিন পর হলেও কোন অসুবিধা হবে না। আমরা যখন আগরতলা যাচ্ছি, সেখানে যারা আছে তাদের সাথে আলাপ করে একমত হয়ে এটা করা যাবে।’ শেখ মণি বিপ্লবী সরকারের কথা বলেছিলেন এবং গতরাতেই একটা আলাপআলােচনার মাধ্যমে যুক্তির মাধ্যমে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠে একমত হতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আগরতলাতে যাওয়ার পর এটা নিয়ে আবার একটা ঝামেলার যে আশঙ্কা তা আমি খুব অনুভব করলাম। সেইসাথে যারা সত্যিকার অর্থে তখন যুদ্ধে লিপ্ত তাদের কাছ থেকে আমরা চিঠিপত্র-খবরাখবর পাচ্ছি প্রত্যেকেই চাপ দিচ্ছেন যে সরকার গঠন করতে একদিনও যেন দেরি না হয়। দ্বিতীয়ত, এটা যদি প্রচারিত না হয় তাহলে দিল্লীতে এটা বুঝে ফেলবে যে, আমাদের সরকার গঠন করার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোন অসুবিধা রয়েছে এবং সেটা ভবিষ্যতে আমাদের যে কোন কাজে তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। এ সমস্ত ভেবে আমি এর প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু শেখ মণি খুব। উত্তেজিত হয়ে গেল। আমি তখন সমস্ত যুক্তিগুলাে তাদের দিলাম যে কেন এই সরকার গঠনের কথা এখনি প্রচার করার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সেইসাথে আরাে বললাম যে, আগরতলাতে হােক বা যেখানেই হােক, যাদের সাথে আমাদের দেখা হবে তারা এটা মেনে নিতে বাধ্য। কারণ, আমরা তাে এমন কাউকে নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছি না যে লােকগুলাের নাম আগে ছিল না। যারা যেভাবে কাজ করছিলেন তারা সেভাবেই কাজ করতে থাকবেন। এটা হচ্ছে আমাদের ধারাবাহিকতা, এবং তাজউদ্দীন সাহেব যখন ঢাকাতে ছিলেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর মতই কাজ করছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানের মতই কাজ করছিলেন। অতএব আমরা এটা নূতন কিছু করছি না যে এটা কেউ অনুমােদন করবে না। এটা তাে আগেই অনুমােদিত হয়ে আছে। তখন শেখ মণি বললেন, ‘আপনি অত বুঝবেন না আমাদের ভেতরের কথা, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী অথরিটি দিয়ে গেছেন।’ এই কথাটাই মণি বলতে চাইলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে একটা অথরিটি দিয়ে গেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব আমার আর শেখ মণির মধ্যকার বিরােধটা মিটানাের জন্য বললেন, ঠিক আছে, মণি যখন বলছে যে আগরতলাতে গিয়ে এই সরকার অনুমােদন করানাের জন্য যা কিছু করা দরকার সে তা করবে, তখন তার কথাটা মেনে নিন।আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত মনে বললাম ঠিক আছে, দেখি আমি কী করতে পারি। ইতােমধ্যে বক্তৃতার টেপ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে চলে গেছে, কাজেই এটা। ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা আমি ঠিক জানি না।’ আমি বাইরে এসে গােলােক মজুমদারকে ফোন করলাম। আমি বললাম, “যে টেপটা আমি আপনাকে দিয়েছি সেটা কোথায় ?’ তিনি বললেন, যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে সেটা চলে গেছে।’ আমি বললাম যে, ‘টেপটার সম্প্রচার আপাতত কি স্থগিত করা যায়?’ তখন তিনি বললেন, যদি আপনারা বন্ধ করতে চান তাহলে আমি হয়ত চেষ্টা করলে এখনাে করতে পারি। কিন্তু তা করা কি ঠিক হবে? বরং এটা করলে নানা জায়গায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।’ তখন আমি গােলােক মজুমদারকে বললাম যে, তাহলে যেভাবে এটা নির্ধারিত হয়েছে। সেভাবে চলতে থাকুক।’ এই একটিমাত্র কাজে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কথা অমান্য করেছিলাম। এটা ঠিক হয়েছিল, কি সঠিক হয়নি তা বিচার করবে আগামী ইতিহাস। আর পরবর্তীকালে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে সেগুলাে দেখলে। বােঝা যাবে এটা বন্ধ করার চেষ্টার পেছনে কী চিন্তাভাবনা বা ষড়যন্ত্র ছিল। আমি ফিরে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম ‘গােলােক মজুমদারকে আপনার ইচ্ছার কথা বলেছি। তিনি হয়ত বা চেষ্টা করবেন এটা বন্ধ করার ব্যাপারে। কিন্তু টেপটা এখন আর তার হাতে নেই।’ এর পরে রাতে আমরা খেতে বসেছি; খাবার টেবিলে শুধু তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ মণি আর আমি। কারণ সেই সময় তােফায়েল আহমদ অসুস্থ হয়ে কলকাতাতে চলে গেছেন। মনসুর আলি সাহেবের জুর, তিনি শুয়ে পড়েছেন। আমি রেডিওটা অন করে দিয়েছি, এই সময় খবর হয়। রেডিও অন করতেই শুনি একটি ঘােষণা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচার করা হবে। আমরা তিনজনই তিনজনের চোখের দিকে তাকালাম। কারাে মুখে কোন কথা নেই, আমরা চুপচাপ। আমরা চুপচাপ রেডিও-র ঘােষণা শুনলাম আর খেয়ে নিলাম। সকলেই বুঝলাম যে কী হয়ে গেছে। তারপর এই খবরটাকে নিয়ে পৃথিবীর সব রেডিও, ভারতের রেডিও পরদিন সকালবেলা থেকে সব স্টেশনের মাধ্যমে অনরবত প্রচার করতে লাগল। এদিকে কামরুজ্জামান সাহেব যখন সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানান তখন আমি মনসুর আলি সাহেবের সাথেও কথা বলি। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “আপনি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলুন, এই সরকারে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। গতকাল যেটুকু পার্থক্য ছিল তা আর কোনদিন আমার কাজের ভেতরে প্রকাশপাবে না।’ এখন থাকলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব আর মােশতাক সাহেব। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এতে মত দেবেন নিশ্চয়ই, কারণ তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে। অতএব তার মত পেতে কষ্ট হবে না। এই চারজন যখন মত দিলেন তখন মােশতাক সাহেব কিছুতেই এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। সেদিক থেকে এই ক্যাবিনেট যে একটা কার্যকর ক্যাবিনেট হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। পরদিন সকালবেলা প্লেনে করে ময়মনসিংহের উপর যে তুরা পাহাড়, সেই পাহাড়ের কাছে আমরা নামলাম। ওখানে আমরা শুনতে পেলাম যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আবদুল মান্নান সাহেব একটা রেস্ট হাউসে আছেন, পাহাড়ের নিচে বিএসএফ-এর লােক পাঠানাে হল। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল তাদের এসে পৌছাতে। আমরা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং তাজউদ্দীন সাহেব দুজন সেখানেই একান্তে আলাপ করলেন। সমস্ত ঘটনা, যা ঘটেছে, সব বিবৃত করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ফিরে এসে বললেন যে, তার সম্পূর্ণ মত আছে এবং আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে আমরা আগরতলার পথে রওনা দিলাম। আমরা আগরতলাতে পৌছলাম সন্ধ্যায়; তখন ওখানে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য এলাকার সদস্যরা উপস্থিত হয়েছেন। এর ভেতরে মােশতাক সাহেব, ওসমানী সাহেব, এম, আর, সিদ্দিকী সাহেব পৌছেছেন। আমাদের প্রথম বৈঠক হল কর্নেল ওসমানীর সাথে। তাঁর সাথে কথা হল যে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে সংগঠিত করব। কর্নেল ওসমানী তাঁর মতাে করে পরিকল্পনার কথা বললেন যে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা যাবে। তাতে কর্নেল ওসমানীর যে ধারণা সেটা ছিল একটা ট্রাডিশনাল যুদ্ধের ধারণা। তার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী একটা ডিভিশন গঠন করতে হবে। এটা একদিকে যেমন ছিল অবাস্তব, অন্যদিকে তা ঠিক আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত জনযুদ্ধের সম্পূরক চিন্তা ছিল না। তার কথা সকলেই শুনলেন, তিনি সিনিয়র ব্যক্তি সকলের চাইতে এবং এ ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান আছে, তাই কেউ কিছু বলছেন না। ২৬ মার্চের পর থেকে তাজউদ্দীন সাহেব যে আলাপগুলাে করতেন সে আলাপের আঙ্গিকেই আমি তখন কর্নেল ওসমানীকে বললাম, ‘আমরা একটা জনযুদ্ধে আছি, সেটা সংগঠিত করার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।’ ট্রাডিশনালওয়ারফেয়ার-এর কথা বাদ দিয়ে কিভাবে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা যায় সে লক্ষ্যে আমি জেনারেল নগেন্দ্র সিং-এর সাথে কর্নেল ওসমানীর পরিচয় করিয়ে দেই এবং নগেন্দ্র সিং, ওসমানী ও আমি একটা বৈঠক করি। ইতােমধ্যে রাত্রিবেলায় সরকার গঠন নিয়ে আলাপ-আলােচনার জন্য সমস্ত এমপিদের ডাকা হল। সেখানে সবচাইতে বেঁকে বসলেন খন্দকার মােশতাক সাহেব। মােশতাক সাহেব কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না ক্যাবিনেটে থাকতে। তাঁর এ রকম একটা মনােভাব যে, হয়ত তাকেই প্রধানমন্ত্রী করলে ঠিক হত । তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব তিনি মেনে নিতে চাচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত, শেখ মণি ওখানে নেমেই চলে গেছেন তার নিজস্ব ডেরায়। আমাদের এই সরকার গঠন করবার ব্যাপারে তাঁর যে সাহায্য করার কথা ছিল সেটা তিনি করলেন না। তবে, একমাত্র মােশতাক সাহেব ছাড়া সকলেই খুব আনন্দিত যে আমরা ক্যাবিনেটটা গঠন করেছি। ফলে এখন যুদ্ধটা অন্য মােড় নেবে, জাতি একটা নেতৃত্ব খুঁজে পাবে। কিন্তু মােশতাক সাহেব বলছেন, তাঁকে মক্কাশরীফ পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে, তিনি হজ্জ করতে যাবেন এবং তার যদি মৃত্যু হয় তাহলে দেশে যেন একটু কবরের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। মােশতাক সাহেব এ ধরনের খেয়ালী কথাবার্তা শুরু করে দিলেন এবং কিছুতেই মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হচ্ছিলেন না। ডা. টি. হােসেনের সাথে মােশতাক সাহেবের খুব বন্ধুত্ব ছিল। টি. হােসেনই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত টি, হােসেনকে বলা হল, “আপনি রাজি করান।’ তারপর তিনি রাজি হলেন এক শর্তে যে, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করতে হবে। সকলেই তাতে মত দিলেন। ক্যাবিনেট হল। জহুর আহমদ চৌধুরী তখন আধঘণ্টা ধরে মােনাজাত করলেন। এমন মােনাজাত করলেন যে সকলেরই সেদিন চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, আমাদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়পরিজন সকলকে ছেড়ে আমরা এখানে এসেছি, বঙ্গবন্ধু কীভাবে আছেন আমরা জানি না; এই রকম পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে আমরা সেই তওফিক চাই যেন স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে পারি । আমরা কলকাতায় ফিরে এসে সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেবার জন্য চিন্তাভাবনা করছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এই অনুষ্ঠানটি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এবং বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে হবে ।চুয়াডাঙ্গাতেই অনুষ্ঠানটি হবে এমন একটা আভাস সেখানে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই কথাটা ডাক্তার আসহাবুল হক অতি উৎসাহে প্রকাশ করে দেন সাংবাদিকদের কাছে। যার ফলে চুয়াডাঙ্গায় একটা বম্বিং হয়। চুয়াডাঙ্গায় আর আমাদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান কার্যকর হল না। ১৭ এপ্রিলের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভীষণভাবে গােপনীয়তা রক্ষা করা হল। ইতােমধ্যে আমাকে স্বাধীনতার ঘােষণা লেখার দায়িত্ব দেয়া হল। সেটা আমি লিখলাম। এই ঘােষণার ভেতরেই আমাদের সরকার গঠনের কথা থাকল। ঘােষণাটি তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখালাম। তাজউদ্দীন সাহেব দেখে বললেন এটা এখানে কাউকে দেখানাে যায় কিনা, যাদের সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞান আছে। গােলােক মজুমদার সুব্রত রায় চৌধুরীর কথা বললেন, তিনি কনস্টিটিউশনাল লইয়ার হিসেবে খুব প্রসিদ্ধ। তার সাথে যােগাযােগ করলাম। তিনি খসড়াটি দেখে বললেন যে, খুব সুন্দর হয়েছে খসড়া এবং সমস্ত বিষয়গুলাে এতে এসে গেছে। সুব্রত রায় পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে একটা বইও ferec-1-Genesis of Bangladeshi সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ি থেকে এসেই আমরা খসড়াটি চূড়ান্ত করে ফেললাম। এটাকে সাইক্লোস্টাইল করা, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তৃতা সাইক্লোস্টাইল করা, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের বক্তৃতা সাইক্লোস্টাইল করা, এই সমস্ত কাজ শেষ করে সাংবাদিকদের কীভাবে সমবেত করা যায় সে জন্যে আমি আর মান্নান সাহেব ১৬ তারিখ সন্ধ্যাবেলা কলকাতা প্রেস ক্লাবে গেলাম। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন। লােকে লােকারণ্য প্রেস ক্লাব, তিল ধারণের স্থান নেই। আমরা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথমেই বললাম, “আমরা এসেছি আপনাদের নিমন্ত্রণ জানাতে। আপনাদের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেট কথা বলবেন, সে ব্যবস্থা করার জন্যই আমরা এসেছি। আপনারা আগামীকাল সকালে এখানে উপস্থিত থাকবেন। আমরা আপনাদের কোন এক জায়গায় নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাব, বাংলাদেশের ভেতরে না বাইরে এমন অনেক প্রশ্ন করলেন সাংবাদিকরা। আমরা একটা কথাই বললাম, এর চেয়ে বেশি আমরা আপনাদের বলতে পারব না। আমরা কোথায় যাচ্ছি তা সব জায়গায় গােপন রাখলাম। আগে থেকে কেউ এই বিষয়ে জানতে পারেনি। তাদের সাথে কথা হল যে, সকাল ৮টার সময় তারা প্রেস ক্লাবে উপস্থিত থাকবেন।রাত ১২টা থেকে আমাদের কাজ শুরু হল। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হল আমাদের কর্নেল ওসমানী সাহেবের পােশাক নিয়ে। তাকে ইউনিফর্ম পরাতে হবে। কিন্তু ভারতীয় বিএসএফ-এর যে সমস্ত কাপড়চোপড় এগুলাে একটাও তার শরীরে ঠিক হয় না। সে জন্য বড় বাজার থেকে দর্জি নিয়ে এসে তার মাপের একটা ইউনিফর্ম তৈরি করা হল। এভাবে সারা রাত এবং ভাের পর্যন্ত কাজ চলল। ভােরে আমাদের ক্যাবিনেট, কর্নেল ওসমানী এবং আমাদের লােকজন বৈদ্যনাথতলার পথে চলে গেলেন। আমি আর মান্নান সাহেব প্রেস ক্লাবে গেলাম। প্রেস ক্লাব থেকে সাংবাদিকদেরকে নিয়ে রওনা দিলাম। প্রায় এক-দেড়শ ট্যাক্সি ভর্তি সাংবাদিক। সবাইকে নিয়ে আমরা চলেছি বৈদ্যনাথতলাতে। আমরা সকাল ১১টার দিকে পৌছলাম। ৩ ঘণ্টা। লাগল পথে । আমরা আগে থেকেই আম্রকাননে সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলাম। স্টেজ তৈরি করা হয়েছিল। ওখানে আমি দ্রুত ইংরেজিতে লেখা স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি বাংলা করে দিয়েছিলাম। সমস্ত পার্লামেন্ট সদস্যদের পক্ষ থেকে চীফ হুইপ হিসেবে ইউসুফ আলি সাহেবকে প্লেনিপােটেনশিয়ারি নিযুক্ত করে স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হয়, ইউসুফ আলি সাহেব ঘােষণাপত্রের বাংলা অনুবাদটি পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব তাঁদের লিখিত বক্তৃতা দিলেন এবং এই বক্তৃতার কপি সাংবাদিকদের দেয়া হল। সে দিনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাংবাদিকরা কাভার করলেন যে, এটা হল আমাদের সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। তৌফিক এলাহী, মাহবুব মেহেরপুরের আম্রকাননে গার্ড অফ অনার দিলেন। তাজউদ্দীন ভাই এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এই জায়গার নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’ । আর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যুদ্ধের সময় সরকার শুধু এক জায়গায় উপস্থিত থাকবে না, যেখানে সরকার থাকবে সেটাই মুজিবনগর। তারপর আমরা চলে আসি। হােসেন আলি সাহেব তখন কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার। হােসেন আলি সাহেবকে খবর দেয়া হয় এবং কোন একটা হােটেলে হােসেন আলি সাহেবের সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের একটা সাক্ষাক্তারের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কারণ হােসেন আলি সাহেবও চাচ্ছিলেন এবং তাজউদ্দীন সাহেবও চাচ্ছিলেন পরস্পরের সাথে আলাপ করতে। ১৮ তারিখ সকালবেলাহােসেন আলি সাহেব মিশনের প্রায় সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। হােসেন আলি সাহেবের কাছে মিশনের যে পরিমাণ টাকা ছিল সেই টাকাটা সম্পূর্ণ তুলে নিয়ে তিনি অন্য অ্যাকাউন্টে জমা করার ব্যবস্থা করেন যেন মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। বেতনের কোন অসুবিধা না হয়। হােসেন আলি সাহেবের স্ত্রী মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছেন। তিনি সেখানকার অবস্থা দেখে এসেছেন। মিসেস হােসেন আলি বিশেষ করে পতাকা তােলার ব্যাপারে নেতৃত্ব দেন। সেই সময়ে তারা দু’জনই খুব সাহসের পরিচয় দেন। হােসেন আলি সাহেব আনুগত্য ঘােষণা করায় আমাদের ব্যাপারে। একটা প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক সাড়া পড়ল। কলকাতাতে আমাদের একটা লিগ্যাল এনটিটি হল এবং এটাই আমাদের মিশন হিসেবে কাজ করায় সুবিধা হল যে, বাংলাদেশের প্রথম মিশন হচ্ছে কলকাতার সার্কাস এভিনিউতে। ১৮ তারিখ সকালবেলা আমরা মিশনের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আমরা ভেতরে গিয়ে হােসেন আলিকে অভিনন্দন। জানালাম। হাজার হাজার লােক মিছিল করে কলকাতা এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, ফুলের মালা দিয়েছে। প্রায় দু’সপ্তাহ সেই জায়গাটা উৎসবমুখর ছিল। বাংলাদেশ মিশনের সামনে তাঁবু খাটিয়ে দেশাত্মবােধক গান, বক্তৃতা দেয়া এসব চলতে থাকল। এরপর এই মিশনে আমরা একটা স্থায়ী লিয়াজো অফিস স্থাপন করি। ওই লিয়াজোঁ অফিসের দায়িত্বে আমি ছিলাম। বাংলাদেশ থেকে যত লােকজন আসতেন তাদের সকলকে ওখানে অভ্যর্থনা করার পর প্রাথমিক সাক্ষাৎকার নেয়া হত। নূরুল কাদের খান, আসাদুজ্জামান, এঁদের অফিসও এখানেই স্থাপন করা হল। অতএব আমাদের ছােটখাট অফিস ওখানে চলছিল। ইতােমধ্যে আমাদের প্রথম কাজ হল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্যে তৎকালীন ১০৭টি দেশের কাছে চিঠি লেখা। স্বীকৃতির জন্যে চিঠি তৈরি করতে হবে, তারপর ১০৭টি চিঠি টাইপ করানাের কাজ। একটা বই ছিল আমাদের কলকাতা হাই কমিশনের লাইব্রেরিতে—Forms and Precedence of Diplomatic Correspondence; সেটা থেকে একটি চিঠি বাছাই করে সে ধাঁচে একটি চিঠি তৈরি করা হল। পৃথিবীর সমস্ত দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের কাছে চিঠি লেখা হল। চিঠিগুলােতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দস্তখত করলেন।এই চিঠিগুলােতে কাউন্টারসাইন করার জন্য একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাউন্টারসাইন করবেন। কিন্তু মােশতাক সাহেব আর সেই চিঠিতে সাইন করতে চান না। শুরুতেই আমাদের এই সমস্ত চিঠিপত্রের যােগাযােগ মােশতাক সাহেবের কারণে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। তিনি একটি অজুহাত খাড়া করলেন, তার পরিবার এখনাে আসছে না, সেটা নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। এর কিছুদিন পর তাঁর পরিবারপরিজন কলকাতায় পৌছলে তিনি চিঠিতে দস্তখত করেন। তারপর চিঠিগুলাে কোথা থেকে পােস্ট করা হবে ? কলকাতা থেকে পােস্ট করলে সেটা কেমন হবে, এই ভাবনার পর শেষকালে তৎকালীন জিডিআর থেকে চিঠি। পােস্টের ব্যবস্থা হল। জিডিআর-এ একটা সম্মেলন ছিল এবং মস্কোতেও তখন শান্তি সম্মেলন ছিল, সেই সম্মেলনে আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবকে পাঠানাে হয়। ওখানে গিয়ে তিনি চিঠিগুলাে পােস্ট করেন। আর ভারতবর্ষের চিঠি তাজউদ্দীন সাহেব যখন পরবর্তীতে দিল্লী যান তখন তিনি সাথে করে নিয়ে যান। আমাদের এই সময় খুব দ্রুত সাংগঠনিক তৎপরতা নিয়ে এগুতে হচ্ছিল। আমরা তখন বালিগঞ্জে একটা বাড়ি ভাড়া নেই—বালিগঞ্জ সার্কেল হাউস, এটা সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ির খুব কাছেই। এই বাড়িতেই মান্নান সাহেব, আমি এবং আরাে অনেকেই থাকি সেই সময়। আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেবও এখানে থাকেন। এখানেই আমাদের মিটিং সিটিং হয়। আর মিশনটাকে আমরা ব্যবহার করতে থাকি আমাদের ফ্রন্ট অফিস হিসেবে। কিন্তু মােশতাক সাহেবের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কিছুটা অনীহার ভাব রয়ে গেল। তিনি বললেন যে, যদি আমরা আগরতলা থেকে দু’জন লােক, মাহবুবুল আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে এনে দেই তাহলে তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এই দু’জন লােককে আমরা খবর পাঠালাম আসার জন্য। তারা এলেন। মােশতাক সাহেব এরপর শর্ত দিলেন, সার্কাস এভিনিউর বাংলাদেশ মিশনকে তিনি ফরেন অফিস হিসেবে ব্যবহার করবেন। এবং যেহেতু মিশনটা ফরেন অফিসের অধীনে তাই সেখান থেকে অন্যান্য সমস্ত অফিস সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে, আমার অফিসও সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা তখন সব অফিস সরিয়ে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে নিয়ে এলাম। হােসেন আলি সাহেবের অফিসই ফরেন অফিস হিসেবে রইল এবং একই সাথে আমাদের মিশন হিসেবেও কাজ চলত। এর ফলে ফরেন অফিস সম্পূর্ণভাবে চলে গেল মাহবুবুল আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের হাতে। মাহবুবুল আলমচাষীকে ওখানে পররাষ্ট্র সচিব করা হয়। যার ফলে দুটো ধারা কাজ করতে লাগল। কারণ তারা একটা সমঝােতা করে আমেরিকার সাথে যােগাযােগ করে নানারকমের চিন্তাভাবনার ভেতরে এগুতে চাচ্ছিলেন, যেগুলাে আমরা অনেক সময় ইন্টারসেপ্ট করেছি। বিদেশীদের সাথে যে বৈদেশিক তৎপরতা করতে হয়েছে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেই চালাতে হয়েছে এবং সেটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হত। যেমন, বিদেশের সাথে যে সমস্ত লবি করা, অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টের সদস্য, সিনেটর, আইনজীবীদের সাথে যে সমস্ত যােগাযােগ হত সেগুলাে আমাকেই করতে হত। আমরা প্রথম থেকেই আঁচ করতে পারছিলাম যে, খন্দকার মােশতাক মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করছিলেন। কিন্তু আমরা সেই সময়ে ৫ জনের যে হাইকমান্ড সে হাইকমান্ডে তাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম যাতে কোন বিভক্তি না হয় ৫ জনের মধ্যে, কেউ যাতে না বলতে পারে এরা স্বাধীনতার পক্ষে নন বা অন্য কোন সমঝােতা করতে তারা রাজি আছেন। মােশতাক সাহেবকে তখন যদি আমরা বিদেশে চলে যেতে দিতাম তাহলে তিনি হয়ত অন্য কোন লাইন ধরতেন বা পাকিস্তানিদের সাথে মিশে কিছু করতেন। সেটা আমরা চাইনি, সেইজন্য তাকে আমরা কাছে রাখতে চেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন সাহেবকে তিনটি মূল ফ্রন্টে কাজ করতে হয়। তিনটি মূল সমস্যার ভেতর তিনি পড়েন। একটি হচ্ছে যে, যারা যােদ্ধা, যুদ্ধ করছে, তার । ভেতরে দুটো ধারা—একটা হচ্ছে পাকিস্তান আর্মি থেকে চলে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ আধা সামরিক বাহিনী অর্থাৎ ইপিআর, পুলিশ, আনসার; আর। অন্যটি হচ্ছে যুবক, কৃষক যারা গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য লােক। এই দুটোকে একসাথে করার একটা দায়িত্ব তাজউদ্দীন সাহেবের উপরে এসে পড়ে। এটি খুবই দুঃসাধ্য ছিল। আরাে একটা সমস্যা যােগ হল, সেটা হচ্ছে ‘মুজিব বাহিনী’ নামের একটা বাহিনী। শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর। রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আ, স, ম, রব, আব্দুল কুদুস মাখন প্রমুখ এই বাহিনী গঠন করল। অথচ এরা আমাদের সবচেয়ে বেশি যােদ্ধা শক্তি হিসেবে কাজ করবে আশা করা গিয়েছিল। এই যে আলাদা একটা বাহিনী মুজিব বাহিনী নাম দিয়ে গঠন করা হল—এই বাহিনীটা যুদ্ধ করার চাইতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল যে যুদ্ধপরবর্তী ঘটনাগুলাে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনাটা যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়। আমরা লক্ষ্য করি যে, মুজিব বাহিনী যেটা গঠিত হয়েছিল সেই মুজিব বাহিনীর ছেলেরা নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে আরাে দশটি ছেলেকে তৈরি করেছে। সেই কাজটি খুব দ্রুত ঘটছিল।মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ওসমানী সাহেব ভেবেছিলেন আমরা যােদ্ধা হিসেবে বেশি লােক পাব না। সে কারণে জেনারেল ওসমানী বললেন, আমার সােনার ছেলে দরকার। তখন আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ এদেরকে দায়িত্ব দেয়া হল রিক্রুটমেন্টের । তখন তারা ওসমানী সাহেবকে এসে বললেন যে, একটা চিঠি লিখে দেন। তখন ওসমানী সাহেব রাজ্জাক এবং তােফায়েলকে অথরাইজ করলেন এইসব ছেলেদের নিয়ােগ করার জন্য। এই চিঠি নিয়েই নাকি ওঁরা ‘র’-এর মাধ্যমে মূলত দিল্লীতে যােগাযােগ করেছিলেন এবং একটা আলাদা বাহিনী গঠন করবার জন্যে দিল্লীর সম্মতি আদায় করে আসেন। দিল্লীর সম্মতি নিয়ে জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনীর। একটা প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। মুজিব বাহিনীতে যারা যেত তারা ভাল সুবিধা পেত। অতএব তারা এভাবে আমাদের বহু কর্মীদেরকে এবং ভলান্টিয়ার বাহিনীতে যেসব কর্মী ছিল তাদেরকে মুজিব বাহিনীতে যুক্ত করলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে এ ধরনের একটা বিভক্তি থাকায় অনেক ভুল-বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি করে। আর একটি জিনিস ঘটে যে, আমাদের যে সমস্ত সামরিক বাহিনীর কমান্ডাররা আছেন তারা তাদের বাহিনীর লােকজন নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁদের সাথে আবার স্থানীয় যুবকরা যােগ দেয়। স্থানীয় বলতে আমি বলছি, ওই অঞ্চলের বাংলাদেশ থেকে যারা গেছে এবং তারাও একটা অনিয়মিত বাহিনী তৈরি করে গেছে। অতএব, তাদের রেশন, কাপড়চোপড় ইত্যাদি জিনিস যেগুলাে দেয়া হত, সেটাকে আবার অনেকজনের সাথে ভাগ করতে হচ্ছে। এই ধরনের একটা সমস্যা সৃষ্টি হল। অর্থাৎ একটা লিয়াজোর সমস্যা দেখা দেয় যে, প্রয়ােজনীয় সংখ্যক পােশাক তারা পাচ্ছে না, প্রয়ােজনীয় পরিমাণ রেশন তারা পাচ্ছে না। এই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেগুলাে কো-অর্ডিনেট করতে হত। দ্বিতীয় যেটা হয়, আওয়ামী লীগের যে সমস্ত এমএলএ বা এমপি গেছেন তাদেরকে দায়িত্ব এবং কাজ গুছিয়ে দেয়া, এবং তাঁদেরও ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা সবকিছুই আছে, অতএব এই সমস্ত কিছুই তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখতে হত এবং এসব ব্যাপারে বেশি সময় দিতে হত—এই সমস্ত সমস্যার কিভাবে সমাধান দেয়া যায়, কাকে কীভাবে দায়িত্ব দেয়া যায় । প্রত্যেক জেলার এমপিদেরকে এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে কীভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করানে। যায় সেজন্য আমরা দ্রুত কিছু ইয়ুথ ক্যাম্প তৈরি করি। প্রতি ইয়ুথক্যাম্পে একজন এমপিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধে যাবার জন্য যে সমস্ত যুবকরা আসত তাদেরকে সাথে সাথেই আমরা ট্রেনিংয়ে পাঠাতে পারতাম না। তারা এই ক্যাম্পে থাকত। এখান থেকে তাদেরকে পরে ট্রেনিং দেয়া হত। কিছুটা পলিটিক্যাল মােটিভেশন দেয়া হত, তারপর তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে নেয়া হত। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে একজন এমপিকে দায়িত্ব দেয়া হত যে, তিনি এই ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকবেন। এই সমস্ত কিছুকে ঠিক করে একটা গােছালাে অবস্থায় আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক প্রচার এবং বিদেশী কূটনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য। এই কাজটাও মূলত তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখতে হয়। এই যে বিভিন্ন ধরনের কাজ, এই সমস্ত কাজের ব্যাপারে আমি তার সাথে জড়িত ছিলাম প্রধান সহায়তাকারী হিসেবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আমার কাজ কী?’ বললেন যে, ‘আমি যা যা কাজ করি সবই আপনার কাজ ধরে নিতে পারেন, এবং আমার সমস্ত কাজের সাথেই আপনাকে থাকতে হবে।’ তার ফলে যুদ্ধ পরিকল্পনা হােক বা কোন ক্যাম্পের বা কোন শাখায় কোন সমস্যা হােক বা জেনারেল ওসমানীর সাথে কোন সময়ের ব্যাপার হােক বা বিদেশীদের সাথে কোন কোঅর্ডিনেশনের কোন ব্যাপার হােক বা বিদেশ থেকে কোন এমপি প্রতিনিধি দল আসছে বা কোন রিলিফের ব্যাপার—এই সবটা জিনিস নিয়েই আমাকে খুব ব্যতিব্যস্ত এবং দৌড়াদৌড়িতে থাকতে হত। তাজউদ্দীন সাহেব সমস্ত বিদেশীদের সাথে বাংলাদেশের ভেতরে গিয়ে দেখা করতেন। বিভিন্ন সময়ে বিদেশী এমপি বা প্রতিনিধিরা আসতেন বাংলাদেশ সরকারের সাথে কথা বলতে বা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করতে। তখন এমনভাবে ব্যবস্থা করতাম যে, তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে আমরা বাংলাদেশের ভেতরে চলে যেতাম। আমরা প্রবাসে সরকার গঠন করেছি এটা সবাই জানতেন, কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে দেখা করার যে মর্যাদা এবং ফলাফল তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে আমরা একটা বিরাট প্রচার পেতাম। সক্রিয় কোন ক্যাম্প যেখানে আমাদের ছেলেরা যুদ্ধ করছে, পাশে যুদ্ধক্ষেত্রে গােলাগুলি হচ্ছে, এই রকম একটা অবস্থাতেই মাঠের ভেতরে এক ধরনের ক্যানভাসের চেয়ারে বসে আলােচনা এবং দেখাশােনা চলত। হয়ত কখনও পাশের ক্যাম্প থেকে ৩/৪ পেয়ালা চায়ের ব্যবস্থা হত। এভাবে বহু সাক্ষাৎকারঘটেছে। হয়ত সাক্ষাঙ্কার চলছে সে সময়েই সেই এলাকাতে খুব যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কামান গর্জে উঠেছে; বাধ্য হয়ে তখন আমাদের কথা শেষ করতে হয়েছে। সেখানে সঙ্কেত দেবার জন্য ফিল্ড ফোন থাকত। এই ফিল্ড ফোনে খবর। আসত যে, শক্র হয়ত এদিকে আসছে, আপনাদের নিরাপদ জায়গাতে যাওয়া দরকার। এই রকম অবস্থার ভেতরে আমরা বহু সাংবাদিকদের সাক্ষাকার দিয়েছি। যেমন, একেবারে প্রথমদিকে এসেছিলেন বৃটিশ এমপি মি, ডগলাস ম্যান—এটা আমাদের সরকারের আত্মপ্রকাশ করার আগের ঘটনা। মি, ডগলাস ম্যান বৃটিশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনারের বাড়িতে উঠেছিলেন। আমি তার সাথে যােগাযােগ করলাম এবং তাঁকে নিয়ে সীমান্তে চলে গেলাম। তাজউদ্দীন সাহেব তার আগেই বেনাপােলের ভেতরে যশােরের কোন একটা জায়গায় গিয়ে থাকলেন। আমরা তাঁকে সেখানে নিয়ে গেলাম। যেখানে। আমাদের বেনাপােল কাস্টমস চেক পােস্ট সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করলাম। সেখানে স্থানীয় মুক্তিবাহিনী কমান্ডার মেজর ওসমান। চৌধুরীকে ডেকে আনা হল। আমাদের যখন কথাবার্তা চলছে ঠিক সেই সময়েই খবর এল যে, শত্রুপক্ষ কিছুদূরেই আছে এবং তাদেরকে মােকাবেলা করার জন্য ওসমান চৌধুরীর এখনি যাওয়া দরকার। ওসমান চৌধুরী তখনই চলে গেলেন। তাে এই রকম অবস্থায় অনেক মিটিং হয়েছে। জন স্টোনহাউসের সাথে, পিটার শােরের সাথে, ডন সেজুয়াসের সাথে, তারপর টাইমস্-এর সাংবাদিক পিটার হেজেল হান্ট-এর সাথে—এমন অনেকগুলাে সাক্ষাৎকার হয়েছে। এটা আমাদের বৈদেশিক তৎপরতার একটা দিক ছিল। তারপর জার্মান মন্ত্রী এসেছিলেন এক সময়, তার সাথেও তাজউদ্দীন সাহেব দেখা করেছিলেন এই রকম একটা জায়গাতে বসে। তিনটি ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সাহেবকে খুব ব্যস্ত থাকতে হত। একটা হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বদেরকে সংগঠিত করা এবং তাদেরকে কাজের দায়িত্ব দেয়া। আর একদিকে আমাদের যােদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রের ব্যবস্থা করা, তাদেরকে দেশের ভেতরে পাঠানাে ইত্যাদি। তৃতীয়ত, বিদেশের সাথে আমাদের যােগাযােগ করা। দিল্লীর সাথে আমাদের যােগাযােগ রাখাটা ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাজউদ্দীন সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে দিল্লীর একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল তার উপরে যে, তিনি একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। ফলেতাজউদ্দীন সাহেবের উপরে দিল্লী নির্ভর করত এবং সেখানে তার একটা যােগাযােগ ছিল এবং সেই যােগাযােগটা মি. নাথ নামক ভদ্রলােকের মাধ্যমে হত। কয়েক সপ্তাহ পরপর তাজউদ্দীন সাহেব দিল্লীতে গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতেন, কথাবার্তা বলতেন। কখনাে তিনি একা গেছেন, কখনাে সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভা নিয়ে গেছেন, কখনাে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং তাজউদ্দীন সাহেব এই দু’জন গেছেন, এরকমভাবে দিল্লীর সাথে যােগাযােগটা হয়েছে। এছাড়া দিল্লীর সাথে চিঠিপত্রেও যােগাযােগ ঘটেছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতার কাজে যান তার আগে তাজউদ্দীন সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটা ব্রিফিং পাঠান এবং তিনি সেটা নিয়ে বিদেশে যান। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবের যে ভূমিকা তা। পরিষ্কার ছিল প্রথম থেকেই, যে কারণে তিনি শ্রীমতি গান্ধীকে প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলেন যে, এটা মূলত আমাদের যুদ্ধ এবং আমরাই এই যুদ্ধ করতে চাই। এবং আমরা ভারতবর্ষের কাছ থেকে যেটা চাই সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষের সাহায্যসহযােগিতা, যযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, অস্ত্রের ব্যবস্থা, বিদেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং প্রচারের ব্যবস্থা করা। এই যুদ্ধ যেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণতহয় এটা যেমন তিনি প্রথম দিন বলেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতার পর ২২ তারিখে যখন তিনি ফিরে যাচ্ছেন ঢাকায় সেই সময় গােলােক মজুমদার, রুস্তামজী উপস্থিত ছিলেন দমদম এয়ারপাের্টে সেই সময় বিদায় জানাতে গিয়ে রুস্তামজী বলেন যে, আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন থাকবে; তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, অবশ্যই দুটি স্বাধীন দেশের মর্যাদার ভিত্তিতে আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন থাকবে। তিনি তাদেরকে এটা বােঝাতে চেয়েছিলেন যে, বন্ধু, তােমরা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। সেই জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এখন আত্মপ্রকাশ করেছি এবং সেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তােমাদের কাছ থেকে সেই ভালবাসা এবং মর্যাদা আশা করি। প্রথম যেদিন আমরা ভারতবর্ষের বর্ডারে ঢুকি সেদিন এবং যেদিন আমরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে আসি সেদিনও সেই একই কথা তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন। আমরা যখন বর্ডারে ঢুকি তখন তিনি বলেছিলেন, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদেরকে যদি ভারত উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে রাজি থাকে তবেই আমরা ভেতরে যাব।তাজউদ্দীন সাহেব ভারতঘেঁষা, এটা আমাদের শত্রুরা প্রচার করেছে। আবার কেউ কেউ হয়ত ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ থেকেও এই ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব খুবই সজাগ ছিলেন যেন আমাদের স্বাধীনতা মেঘাচ্ছন্ন না হয় ভারতবর্ষের কোন চাপের মুখে বা ভারতের কোন অতিপদক্ষেপের কারণে। সেটার প্রমাণ দুটি জায়গায় পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে, যখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ভারতের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল এবং ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া ছাড়া উপায় নেই, সেই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব শ্রীমতি গান্ধীকে বললেন যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য ঢুকবার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃত দিতে হবে এবং কীভাবে সৈন্য ঢুকবে তার একটা ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তি ছাড়া বাংলাদেশে ঢােকা যাবে না। তাজউদ্দীন সাহেবের কত বড় দূরদর্শিতা, এবং তিনি কত বেশি সজাগ থাকলে এই কথা বলা সম্ভব, এটা ইতিহাস নিশ্চয়ই বিচার করবে। অথচ এটার জন্যই তাকে দোষারােপ করা হয় যে, তিনি নাকি ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি যদি বলা হয়, চুক্তি নিশ্চয় করেছেন, কিন্তু সেই চুক্তি ছিল যে, ভারত আমাদেরকে স্বীকৃতি দেবে, তারপরে ভারতের সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকবে এবং যৌথ কমান্ডের মাধ্যমে ঢুকবে। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে ভারতকে সবসময়। আমাদের সাথে, আমাদের কমান্ডের সাথে একত্রিত থাকতে হবে। এবং যখনই বাংলাদেশ সরকার বলবে তখনই ভারতের সৈন্যদের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।। এই চুক্তি যদি তিনি করে থাকেন তবে এর চেয়ে ভাল এবং মহৎ এবং এত সুন্দর চুক্তি আমি তাে পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখি। যখন অ্যালাইড ফোর্স ফ্রান্সে ঢুকেছিল তখন তাে এই রকম চুক্তি করে তারা ঢােকেনি। এমনকি সাম্প্রতিক অতীতে বন্যা, জলােচ্ছাসের সময় যে আমেরিকান টাস্কফোর্স বাংলাদেশে ঢুকল, তারা তাে কোন চুক্তি ছাড়াই ঢুকেছিল। এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, তাজউদ্দীন সাহেব কত দূরদর্শী, কত সজাগ, কত সতর্ক ছিলেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে যৌথ বাহিনীর অধীনে ভারতীয় সৈন্য ঢােকার আগেই তিনি কিন্তু চুক্তি করেছিলেন—যে চুক্তির জন্য তাকে আবার দোষ দেয়া হয়। এটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে। অথচ এই চুক্তির বলেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়ার অনুরােধ জানান।তাজউদ্দীন সাহেবের দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে এভাবে—যেহেতু মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ অবস্থাতে থাকার ফলে তাদের পারিবারিক জীবন যাপন করতে পারছেন না, সে কারণে তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পণ করেছিলেন, যতদিন যুদ্ধ চলবে, বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি তাঁর পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। তিনি তার এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। সে সময়ে অনেক দুর্যোগ, দুর্বিপাক তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে এসেছে। যেমন তার বুকে একটি ফোড়া হয়, ডায়াবেটিসের কারণে এতে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর খুবই সেবাযত্নের প্রয়ােজন হয়। কিন্তু তিনি সেই সময়েও (তখন তাঁর পরিবার কলকাতাতে) তার পরিবারের কাছে যাননি। আর একটি ঘটনা আমার মনে আছে। তার একমাত্র ছেলে সােহেল খুব অসুস্থ, এই অসুখ খুব মারাত্মক রূপ নিচ্ছিল। আমার নিজের এক ছেলেও সেই সময় এইরকম ইনফেকশান হয়ে মারা যায়, এ ব্যাপারে সবাই খুব উদ্বিগ্ন। তাকে বহুবার অনুরােধ করা হয়েছে, কিন্তু তিনি একটা কথাই বলতেন যে, আমি তাে ডাক্তার নই, আপনারা ডাক্তার দেখান। আমরা যখন একদিন বাংলাদেশের ভেতরে কাজ করে ফিরছি সেই সময় গােলােক মজুমদার প্রায় এক রকম জোর করে তার পরিবার যেখানে থাকতেন সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। তিনি কিছুক্ষণ তাঁর সন্তানের বিছানার শিয়রে দাঁড়ালেন, দুই চোখ বুজে হয়ত তিনি তাঁর প্রার্থনা করলেন দুই-এক মিনিট, তারপর তিনি ফিরে গেলেন। এগুলাে তাঁর দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্ষমতার প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের যে কোন আকর্ষণ ছিল না, সে কথা আমি আগেও বলেছি। যখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা বলা হল, তখন তিনি সবচাইতে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর সহযােগীরা যদি এটা অপছন্দ করেন বা তাকে প্রতিযােগী ভাবেন, তাতে যদি যুদ্ধের কোন ক্ষতি হয়, অসুবিধা হয়—এই ব্যাপারগুলাে তার খুব দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। আমরা একই রুমে পাশাপাশি বেডে থাকতাম কিছুদিন। অনেক কথা হত রাতে। তিনি বলতেন যে, দেখুন, প্রত্যেক দিনই ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে আমরা সম্পৃক্ত। আসুন আমরা এমনভাবে কাজ করি, যেন ঐতিহাসিকদেরও ভবিষ্যতে আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয় যে আমরা এর পেছনে কীভাবে কাজ করেছিলাম । তিনি খুব আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন। নিজেকে খুব আড়াল করে রাখতে চাইতেন। নিজের ভূমিকাকে গােপন করে রাখতেন। যেটা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্য যুদ্ধের সময়ও প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে।ভাইয়ের কাছে আমি খবরটা পৌছাতে পারছি না, এর চাইতে বড় দুঃখ আমার আর কী আছে!” এদিকে প্রথম থেকেই মুজিব বাহিনী করার ব্যাপারটা তাজউদ্দীন ভাইসহ আমরা খুব অপছন্দ করেছি এই কারণে যে, আমরা মনে করেছি এটা একটা বিভক্তি সৃষ্টি করবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। অল দি এগ শুড নট রিমেইন ইন ওয়ান বাস্কেট—এই কথাটা আমি ভারতীয় একজন কর্মকর্তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, এর আসল উদ্দেশ্যটা কী? আর দিল্লী সরকার বা ‘র’ কেন এটা করছে ? এই প্রশ্নের জবাবের জন্য তিনি কিছু সময় নিয়েছিলেন। সময় নিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, এর উত্তর একটিই : ইন্ডিয়া ডাজ নট ওয়ান্ট টু কীপ অল দি এগুস্ ইন ওয়ান বাস্কেট। তাে সেটা একটা কারণ। আর এটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা একে অপরের বিরুদ্ধে, এটাও একটা কারণ ছিল। আমি লক্ষ্য করেছি যে, ‘র’ বা এ জাতীয় কোন গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ হতে গেছে সেই সমস্ত জায়গাতেই খুব। মেসি কাজকর্ম হয়েছে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য হচ্ছে যে, তাজউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে আমরা যে যােগাযােগটা করেছিলাম সেটা সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের যােগাযােগ। যতদিন আমরা যুদ্ধ পরিচালনা করেছি ততদিন সেই রাজনৈতিক পর্যায়েই যােগাযােগটাকে রক্ষা করেছি। আমরা কখনােই কোন গােয়েন্দা সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে যাইনি এবং আমরা এটাকে খুব অপছন্দ করেছি। আমার মনে হয় যে, শ্রীলংকাতে যে মেসি ব্যাপারটা হয়েছে, এর অনেকখানি দায়িত্ব ‘র’-এর। কারণ র এই সমস্ত টাইগার বাহিনী তৈরি করার ব্যাপারে এক সময় সাহায্য করেছিল। আবার শ্রীলংকাকে সাহায্য করতে গিয়ে টাইগারদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে অস্ত্রধারণ করতে হয়। যার ফলে এই মেসি ব্যাপারটার কারণে হয়ত রাজীব গান্ধীর জীবনটা পর্যন্ত গেল। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেবের মত যােগ্য নেতৃত্ব থাকার কারণে তারা এটা সম্পূর্ণভাবে করতে পারেনি। কিন্তু চেষ্টা তারা অনেক করেছিল। আমি তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য বলছি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং বিশ্বের সমস্ত দেশের সাথে আমরা বন্ধুত্ব চাইব এবং সেই বন্ধুত্ব হবে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব, রাজনীতির বন্ধুত্ব বা সরকারের সাথে সরকারের বন্ধুত্ব। কিন্তু কোন এজেন্সির মাধ্যমে যেনকোন জাতি বা রাষ্ট্র বা সে দেশের নাগরিকরা আমাদের দেশের কোন অমঙ্গল করতে না পারে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যান, ফলে এই যুদ্ধে তিনি যে নেতৃত্ব দিলেন সেটা স্পিরিচুয়াল লিডারশিপ, ফিজিক্যাল লিডারশিপ দিতে পারলেন না। এর ফলে কতকগুলাে গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ইতিহাসে, আমাদের মননে, মানসিকতায়। এবং বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে এলেন এটা তার স্বীকার করে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে, তার অবর্তমানে নতুন একটা দেশ হয়ে গেল যেখানে তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এটারই সুযােগ নিয়ে কিছু লোেক, বিশেষ করে যুবকরা যারা একটা আলাদা বাহিনী করতে চেয়েছিল, একটা বিপ্লবী কাউন্সিল তৈরি করতে চেয়েছিল, যারা একটা আইনানুগ সরকারের পরিবর্তে একটা নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবছিল, যেখানে তাদের নিজেদের ভূমিকা সামনে আসবে—এই যে কাঁচা আকাঙক্ষা—তারা পরে বঙ্গবন্ধুকে নানাপ্রকারে নানাভাবে বােঝাবার চেষ্টা করেছে যে, তাজউদ্দীনের বােধ হয় তার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার পােটেনশিয়ালিটি আছে। এটা বঙ্গবন্ধু কনশালি না হলেও অবচেতনভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কিছু কারণ ছিল। যেহেতু তার অবর্তমানে বাংলাদেশ স্বাধীন হল, সেখানে বঙ্গবন্ধু ফিজিক্যালি থাকতে পারলেন না, সশরীরে নেতৃত্ব দিতে পারলেন না, এটা যেমন একটা ব্যাপার, আবার তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াতে পারেন, এইরকম একটা কথা তাকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা বা কোন উপদল করবার বিন্দুমাত্র চিন্তা তাজউদ্দীন সাহেবের ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, সেই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে নিরূপণ করতে পারেননি। তিনি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা পালন করবার জন্য কখনাে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কখনাে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল জাতির পিতা হিসেবে, রাজনৈতিক ভূমিকারও উর্ধ্বে যার স্থান ছিল—তিনি জাতির পিতা, জাতি তাঁকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল ঐতিহাসিকভাবেই—সেই জায়গাটাতে না গিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নেতা এবং রাজনৈতিক নেতা এবং দলীয় নেতার ভূমিকা পালন করলেন। তাজউদ্দীন ভাই আর দু’চারজন ছাড়া আমরাযারা তার চারপাশে ছিলাম তারা তাঁকে এই ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করেছিলাম, যে কোন কারণেই হােক না কেন। তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করবেন সেই সময়ে এ ধরনের কথাবার্তা তিনি অনেক সময় বলতেন। কিন্তু সেটা এভাবে দ্রুত ঘটবে তা বুঝিনি। বঙ্গবন্ধু যখন চতুর্থ সংশােধনীর আধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা করলেন, আমরা আশা করেছিলাম যে ওই সময়েই তিনি এটা প্রকাশ্যে বলবেন যে, তিনি এই ধারাতে বিশ্বাস করেন।। কিন্তু সেটা বঙ্গবন্ধুর জন্য যেমন দুর্বলতা, তেমনি বাংলাদেশের জন্য দুর্বলতা, এ দুটো কারণ মিলেই নব্যস্বাধীন দেশে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে; এ কারণেই বােধ হয় তাজউদ্দীন সাহেব এটা করতে পারেননি। কিন্তু পেছনের দিকে তাকালে আমার কাছে মনে হয় যে, সেটা যদি করা সম্ভব হত তাহলে বােধ হয় অনেককিছু অ্যাভয়েড করা যেত। এমনও হতে পারত, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেব দু’জনই বেঁচে থাকতেন। এই বিরােধটা সামনে আসা উচিত। ছিল। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে আমরা একদলীয় ব্যবস্থাটা বিশ্বাস করিনি, তার ফলে সবকিছুই কেমন যেন ঘােলাটে হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের হুমকির ব্যাপারটা তিনি অনেক সময় নিজেই উল্লেখ করতেন, যে কারণে তিনি আলাদা কোন স্ট্যান্ড নেননি। তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের হুমকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ওই যুবক ছেলেরা দিয়েছিল। ওই যুবক ছেলেরা ঘৃণা ছড়াবার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাত যে, তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি নাকি বঙ্গবন্ধুকে ধরিয়ে দিয়ে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ছেলে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে এসে স্বীকারােক্তিও করেছিল যে, তাজউদ্দীন সাহেবকে হত্যা করার জন্য তাকে পাঠানাে হয়েছে। সে অস্ত্রটা তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে রেখে গিয়েছিল। বাকশাল সম্পর্কে তাজউদ্দীন ভাই বলতেন যে, এটা সঠিক পদক্ষেপ নয়, গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু এতকাল যুদ্ধ করে এসেছেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রই হচ্ছে আমাদের দাবি—সেই ‘৫৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। হঠাৎ করে এই দিক পরিবর্তন করাটা ঠিক হচ্ছে না, এতে কোন প্রয়ােজন মেটানাে যাবে না। একটা কথা আমার মনে আছে, সেটা ১৯৭৪ সাল, বঙ্গবন্ধু তার ইজি চেয়ারে বসে আছেন। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, সেরনিয়াবাত সাহেব, শেখ মণি, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই সময় কথা বলতে বলতে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যে প্রেসিডেনশিয়াল ফর্মের কথা বলছি তােমরা এটাকে কী মনে কর?’ এর আগে কেউ এরকম আলােচনা শােনেনি। হঠাৎ একটা পিনপতন নীরবতার সৃষ্টি হয়। তখন আমি এই কথাটা বলে ফেললাম যে, “দেখেন, প্রেসিডেনশিয়াল এবং পার্লামেন্টারি সিস্টেমের পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক তাত্ত্বিক আলােচনা আছে। আমি সেগুলাের ভেতর যেতে চাই না। আমি একটা সহজ হিসেবের কথা বলি যে, পৃথিবীতে যত কু্য হচ্ছে এবং এটা যত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে হয়েছে তার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।’ আমার কথার পর তাজউদ্দীন সাহেব একটা সামগ্রিক বিশ্লেষণ দিলেন যে, রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির কুফল কী । তারপর তাজউদ্দীন ভাই যখন একটা কনভিন্সিং আরগুমেন্ট করলেন তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না, না, আমি এ রকম কিছু ভাবছি না। তবে তােমাদেরকে বললাম আর কি।’ এই বলে কথাটার পাশ কাটিয়ে গেলেন। এরও প্রায় ৫/৬ মাস পর গণভবনে আলােচনা হচ্ছিল বাকশাল করা নিয়ে। তখন বেশির ভাগ এমপি এর বিপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন। দুই দিন ধরে ১২৮ জন। এমপি এর বিপক্ষে বললেন। বঙ্গবন্ধু তখন আলােচনা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, ‘আমি তােমাদের সব কথা বলতে পারব না, ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে, ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত শুরু হয়েছে; তারা যখন আসবে তখন আমাকে স্যালুট দেবে, কিন্তু তাদের হাতে স্টেনগান থাকবে এবং তােমাদের কারাে মাথা থাকবে। আমি তােমাদের বলছি, তােমরা আমার কথার কোনদিন অবাধ্য হওনি, এবারও হবে না। আমি বলছি যে, তােমরা আগামীকাল এই বিল পাস করবে।’ এই কথা সংক্ষেপে বলে বক্তব্য শেষ করলেন। তারপর বের হয়ে এসে ‘তাজউদ্দীন সাহেবের হাত ধরে তাকে তিনি বাগানে নিয়ে গেলেন। আমি কিছু এমপি-র সাথে লেকের ধারে চলে গিয়েছিলাম, সেখানে কিছু নারকেলের চারা রােপণ হয়েছে। এমন সময় তিনি সেখানে এসে দলবলসহ আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী দেখছ?’ আমি বললাম, আমি নারকেলের চারা দেখছি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার এই নারকেলের চারাগুলাে কত সুন্দর হয়েছে!” আমি বললাম, “হ্যা, তা তাে ঠিক। কিন্তু আপনি আজকে যে চারাগাছ পুঁতলেন, এই চারা যে কী বিষফল জন্ম দেবে তা বুঝতে পারছি না।’ তিনি বললেন যে, তােমার মাথায় এটা ভূত ?’ এভাবে তিনি পরের দিন বিল পাস করালেন। মঈনুল হােসেন সাহেব এবং জেনারেলওসমানী এঁরা দু’জন ভােট দিলেন না। তাঁরা পার্লামেন্টেও গেলেন না, আমরা সবাই গেলাম। হাত তুলে বিল পাস করিয়ে এলাম ৪/৫ মিনিটের ভেতরে। এটা পড়ে দেখারও সুযােগ আমাদের হয়নি। আমার যেটা মনে হয়, আমি কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ চাচ্ছিল সেই সময় থেকে, এবং এটা বােধ হয় বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন না কোনভাবে প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ত ভেবেছিলেন যে, আর্মিকে রিপ্লেস করবার এটা একটা পদ্ধতি হবে যে তাদেরকেও আমি সাথে নিয়ে নেব বাকশালের ভেতরে। এতে আর্মি, আমলাতন্ত্র এবং অন্যান্য দলের লােকজন সবাই থাকবে। যে কোন পলিসি হােক সবাই মিলে করা হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যাপারে আমাদের প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি, কামাল হােসেন, আসাদুজ্জামান খান এই তিনজন যুক্তি করি যে, বঙ্গবন্ধুকে আমরা তিনজন গিয়ে বলব তিনি যাতে ওইদিকে পা না বাড়ান। যেদিন বিল পাস হবে সেদিন পর্যন্ত আমরা লবি করলাম। শেষ পর্যন্ত তার ঘরে গেলাম, পার্লামেন্ট ভবনের অফিসে। সেখানে আমরা বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে, এমন কোন্ ক্ষমতা তার প্রয়ােজন, কারণ সব ক্ষমতাই তাঁর আছে। Criminal Procedure Code এবং Bangladesh Penal Code-এর সব পাওয়ারই তার আছে। এমন কোন কাজ যেখানে তিনি ঠেকে গেছেন, সেটা যদি আমাদেরকে বলেন তাহলে আমরা এর সমাধান খুঁজতে পারি। এজন্য সংবিধান বদলানাে ঠিক হবে না। কারণ তিনি সবচেয়ে বেশি নিবর্তনমূলক আইনের শিকার হয়েছেন। তাই নিবর্তনমূলক আইন পাস করানাের কোন ব্যবস্থা যেন তিনি না নেন। অনেক কথা এবং আলােচনার পর তিনি বললেন যে, “দেখ, তােমার বিলেত থেকে পাস করে এসেছ, তােমরা পশ্চিমের গণতন্ত্র দেখেছ—এইগুলাে আমাদের দেশে চলবে না। আমি আমার দেশের লােককে জানি ভাল।’ তখন আসাদুজ্জামান খান সাহেব নরম হয়ে গেলেন। তিনি ধরে ফেললেন যে, আমরা বিলেতি চিন্তার লােক আর তিনি দেশি চিন্তার লােক। তখন আসাদুজ্জামান খান সাহেব বললেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের নেতা, প্রধানমন্ত্রী, তিনি যখন বলছেন, তখন আমাদের আর কি বলার আছে।’ তখন আমি আর কামাল হােসেন সাহেব চলে এলাম। আমি তাকে না বলে পার্লামেন্ট ছেড়ে চলে আসি, আর কামাল হােসেন সাহেব তার অনুমতি নিয়ে চলে যান। তাজউদ্দীন সাহেব তখন পার্লামেন্টে। তিনি এই ব্যাপারে আর না বলতে পারেননি। আমি ভােট দেইনি, কামাল হােসেন সাহেবও ভােট দেননি।তাজউদ্দীন সাহেব যে কষ্টটা মনে নিয়ে মারা গেলেন সেটা হল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাসে কী হল, কীভাবে দেশটা স্বাধীন হল, কীভাবে এই মুক্তিযুদ্ধটা হল, কার কী ভূমিকা—এই ব্যাপারটা বঙ্গবন্ধু কোন দিন তাকে জিজ্ঞাসাও করেননি। এবং তাজউদ্দীন সাহেব এই নয় মাসের ভূমিকা রিপাের্ট। করারও কোন সুযােগ পাননি। এটা তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট ছিল যে, এই নয়টি মাস যেন ইতিহাসের পাতায় নেই। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতিটুকুও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তিনি পাননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের বড় দুর্বলতা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে তিন্থি এমনভাবে ভালবাসতেন যে তিনি তার উপর অভিমান করতেন—হয়ত দেখাই করতেন না, বাড়িতে থেকে হয়ত টেলিফোনের জবাব দিতেন না—কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে এলে আবার সবকিছু ভুলে যেতেন। তিনি একথা বলতেন যে, ‘দেশকে আমি ভালবাসি, দেশকে ভালবাসতে গিয়েই বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেছি এবং দেখেছি যে, দেশের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতা দরকার।’ এই কথাগুলাে তাজউদ্দীন সাহেব ‘৭২-‘৭৪-এর দিকে বলতেন। আবার সেই সময়ের অনেক কিছুই তাজউদ্দীন সাহেব মেনে নিতে পারছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব খুব অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে সংগঠন বঙ্গবন্ধু। করেছেন সেই সংগঠনেই নিজেকে নিবেদিত করবেন। নিজের প্রচেষ্টাতে আর একটা সংগঠন করবেন—এমন মানসিকতা তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে কাজটি করতে হয়েছে সেই কাজটি তিনি করেছেন সুচারুরূপে। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে তিনি খুব ব্যথিত বােধ করতেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু নেই, ঝামেলাটা তাকে পােহাতে হচ্ছে। কারণ রাজনীতিতে। যে কতকগুলাে খুচরাে ঝামেলা থাকে, এই খুচরাে ঝামেলা করতে তিনি মানসিকভাবে কোনদিনই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান মানুষ; সে কারণেই হােক বা যে কোন কারণেই হােক, রাজনীতির যে বাড়তি কাজগুলাে থাকে, সে বাড়তি কাজগুলাে করতে তিনি খুব রাজি ছিলেন না। যেমন, পিঠে চাপড় দিয়ে কথা বলা, মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করে দেয়া, পকেট থেকে পাঁচশ’টি টাকা বের করে দেয়া যে, তুমি এই টাকাটা রাখখা—এ ধরনের কাজে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। সে কারণে রাজনীতির এই বাড়তি কাজগুলাে তার ঠিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার শেষ কথা হয় ১৫ অগাস্ট। ১৫ অগাস্ট আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং অন্য এক বাসায় গিয়েতাজউদ্দীন সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি বলেছিলেন যে, আমি তাে ক্যাবিনেটে ছিলাম না—’ বা এরকম একটা কথা, কিন্তু হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল। তারপর ফোন করে আর পেলাম না। ততক্ষণে বােধ হয় তাঁর টেলিফোন কেটে দিয়েছে। তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগের পর পরিষ্কার করে কিছু বলতেন না, পাশ কাটিয়ে যেতেন অনেক কিছু। তিনি বােধ হয় তখন ভাবতেন যে, দেশটি যেভাবে চলছে এতে পতন অনিবার্য। একে ঠেকাবার উপায় নাই। যখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট হল তখন থেকেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি খুব শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তার ধারণা ছিল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটা শক্তিশালী বিরােধী দল থাকলে আমরা একটা ভারসাম্যের ভেতর দিয়ে চলতে পারব। বিরােধী দল আমাদের কাজের সমালােচনা করবে; তার ফলে আমরা সৎভাবে, ভালভাবে এগিয়ে। চলব—এবং শক্তিশালী বিরােধী দল গড়ে উঠুক এটা তিনি চাচ্ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করলেন তখন দেখলেন যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। ওই সময় মণি সিংকে আমার সামনেই বলেছেন যে, ‘দাদা, আপনারা ত্রিশূল হয়ে আসলেন। এর এক শূল দিয়ে আপনারা মারবেন বঙ্গবন্ধুকে, আর এক শূল দিয়ে আমাদেরকে, আর এক শুল দিয়ে বাংলাদেশকে।’ একথা তিনি বলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে একটা পরিকল্পনা সেল গঠন করা হয়েছিল। শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, কৃষি, শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট, যােগাযােগ এ সমস্ত ব্যাপারে আমাদের প্ল্যান তৈরি হয়েছিল। খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. আনিসুজ্জামান, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড, স্বদেশ বােস, ড. মুশাররফ হােসেন এই সেলে ছিলেন। স্বাধীনতার পর পরই বঙ্গবন্ধু অস্ত্র উদ্ধারের ডাক দিলেন, এটা তাজউদ্দীন সাহেবের মনঃপূত হয়নি। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব এটা বঙ্গবন্ধুকে বলতেও পারেননি। কারণ বলতে গেলে আবার সন্দেহ করে বসতে পারেন যে, এদের অস্ত্র তােলার ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবের আপত্তি কেন—নিশ্চয় কোন কারণ আছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে তার চারপাশের লােক নানারকম কান ভাঙানি দিচ্ছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের পরিকল্পনা ছিল, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ না করে এর পেছনে যে মানুষগুলাে আছে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি অস্ত্রের পেছনের লােকগুলাে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে অস্ত্র স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে। সেজন্য তিনি দেশ মুক্ত হবার সাথে সাথে প্রতিটি জেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রখুলেছিলেন। সেখানে তাদের অস্ত্রসহ তারা থাকবে, তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তােলা হবে। এরপর তারা নিজ নিজ পেশায় চলে যাবে। তারা রাজাকারদের অস্ত্র উদ্ধারে সাহায্য করবে। তারা এই ক্যাম্পে থাকবে, এতে যত অর্থই লাগুক না কেন। তার প্রথম বিবেচনা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প করা। তাতে প্রত্যেকটি মুক্তিযােদ্ধা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে প্রয়ােজনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজে তাদের লাগানাে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে এটি আর করা হল না। তাদেরকে সােজা বলা হল, তােমরা অস্ত্র জমা দিতে আসাে। তাতে যেগুলাে ভারি অস্ত্র, যেগুলাে নিয়ে ঘুরে বেড়ানাে যায় , সেগুলাে জমা হল, কিন্তু ছােট ছােট অস্ত্র রয়েই গেল। সেগুলাে কোনদিনই উদ্ধার করা গেল না এবং এই ছেলেগুলােকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। অথচ এরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ফসল। মুক্তিযােদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেয়ার পদ্ধতিটা ছিল ভুল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল বলে মুক্তিযােদ্ধাদের কাজও শেষ হয়ে গেল, এটা কিন্তু ঠিক হয়নি। তাজউদ্দীন ভাইসহ আমাদের ইচ্ছে ছিল, আমরা নিজেরাও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে এই ক্যাম্পে এসে থাকব। দরকার হলে আমরা আমাদের নিজেদের কাজে যাব না। আমরা এই ক্যাম্পের সাথে থাকব যতদিন দেশের পুনর্গঠন না হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পূর্ণভাবে স্থিতিলাভ করতে যতদিন সময় লাগবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের ক্যাম্প চলতেই থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রক্রিয়া ছিল, চলমান প্রক্রিয়া, যা ১৬ ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে যায়নি। পরে ক্রমশ সেই প্রক্রিয়াটার সাথে বিরােধ ঘটল। এবং যা হল তাতে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমরা বাংলাদেশে সত্যিকার ন্যায়বিচার, সমাজে সুষম বণ্টন ইত্যাদি বাস্তবায়ন করবার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের মাধ্যমে যে সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, সে সুযােগ আর পাওয়া যায়নি।(২১.৬.১৯৯১/২৮.৬.১৯৯১/১২.৭.১৯৯১/২৭.৭.১৯৯১)