ওদের সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে আমরা (১)– রমাপদ চৌধুরী
বয়স তখন পনেরাে। মধ্যপ্রদেশের বনপাহাড়ের মধ্যে ক্ষুদে একটি চটিতে আমরা কয়েক ঘণ্টা ছিলাম । আমার মনে হয়েছিল সেই প্রাগৌতিহাসিক জায়গাটা কোনদিন বাঙালীর মুখ দেখেনি। চটির সেই ছােট্ট অন্ধকার জানালাবিহীন ঘরে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে চাপা ছাদ আর নােংরা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেওয়ালের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কেউ পেরেক টেরেক (নাকি চুলের কাটা) দিয়ে গােটা গােটা বাংলা হরফে একটি নাম লিখে রেখেছে ও কমল। সে যে কি রােমাঞ্চ, কি উত্তেজনা বলে বােঝাতে পারবাে না। সেই দিন থেকে জান, আমার রক্তে আর কিছু না থাক বা না থাক্ একটি জিনিস আছে তার নাম বাংলা ভাষা।
তের বছর বয়সে শুধু এক ঝলক পদ্মাকে দেখেছিলাম, পূর্ব বাংলা আমি দেখিনি। তবু পদ্মা নদীর মাঝিকে আমার একটুও অপরিচিত মনে হয়নি। অথচ কোথেকে কি হয়ে গেল, দু’বাগানের মাঝখানে কাঁটা তারের বেড়া, ও বাড়ীর লােকদের সঙ্গে কথা বন্ধ, দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ । দেওয়ালে যে নামই লেখা থাক- কমল কিংবা কামাল উন্মাদনা একটুও কমবে না তা সত্ত্বেও। মুজিবরের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে উল্লাস সেজন্যেই। এত অসহযােগ কিংবা বিপ্লব নয়। এ যে সহস্র সূর্যের চেয়েও উজ্জল বিস্ফোরণ। একবার ওই রক্তে রাঙা সােনা-সবুজ সদ্য স্বাধীন দেশটার দিকে তাকাচ্ছি, একবার সারা পৃথিবীর দিকে। দু দিকই আমাকে অবাক করছে। কি অকল্পনীয় অসহযােগ। না শুধু শতকরা বাহাত্তরটি ভােটের জোরে নয়, নিচ্ছিদ্র সদস্য সংখ্যার ছায়াছত্র নয়। বন্দুক আর বেয়নেটের ভয় দেখিয়েও কোন নব্য হিটলার তার বেতারে একটা বাঙালী কণ্ঠস্বর উপস্থিত করতে পারলাে না, শপথবাক্য পাঠ করালেন না একজন বিচারকও। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে চলেছে আজও মদমত্ত সামরিক অহঙ্কারকে চূর্ণ করার জন্য ঃ এ যেমন এক অবাক হবার মত ঘটনা, তেমনি অবাক করছে সারা পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলি। কোথায় সেই সব স্বাধীনতার পুরােহিতরা। গণতন্ত্র কিংবা জনগণতন্ত্রের বুলি যাদের কথায় কথায়, তাদের পােশাকে আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তের ছিটে লেগে যেতে পারে এই ভয়েই কি তারা স্তব্ধ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিঙ্কার করে বলছে, ‘আমরা মানুষের মত বাঁচতে চাই’, তাই একখানা রাইফেলও কেউ সেদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেনা। কারণ স্বাধীন মানুষকে যে সকলেই ভয় পায়। মানুষ হিসেবে পরিচয় না দিয়ে, অর্ধেক স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে বুকে যদি সে একটা রাজনীতির নােবেল আঁটতাে তা হলেই, অর্ধেক না হােক, সিকি পৃথিবী তার দিকে ছুটে যেত। মুজিবরের বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর মুখােশ খুলে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর । ফ্যাসিজমের দোস্ত শক্তিশালী। রাষ্ট্রগুলি যদি এরপর মানবতা কিংবা স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করে তাহলে সেদিনের জন্য আমরা যেন আমাদের ধিক্কারের সবটুকু অট্টহাস জমিয়ে রাখি । সকল বর্বরতার প্রতি এখন দিতে পারি শুধু তীব্র ঘৃণা।
৪ এপ্রিল ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭